শেষ বিকেল এমনই

শেষ বিকেল এমনই
৪৪ বছর সংসার জীবনের পর বৃদ্ধ বয়সে এসে ডিভোর্স পেপার হাতে নিয়ে বসে আছি।প্রথম পৃষ্ঠার নিচের দিকে সিগনেচার করা।গুটিগুটি অক্ষরে লেখা “অভিনব আহমেদ”।ঝাপসা নয়নে কলমের কালির উপর হাত দিলাম।কালি এখনো শুকায়নি মনে হচ্ছে!
এর আগে কখনো চাক্ষুষ ডিভোর্স পেপার দেখা হয়ে উঠেনি।হাজার হাজার নরনারীর মন ভেঙে দেয়া,যত্নে গড়া স্বপ্নগুলোকে বিচ্ছেদে রূপ দেয়া সেই ছোট্ট কাগজগুলো দেখার ইচ্ছে হতো প্রায়ই।সামান্য একটা কাগজ দুটো মানুষকে কতটা দূরে সরিয়ে দিতে পারে তাকে দেখার ইচ্ছে হওয়াটাই কি স্বাভাবিক নয়? প্রকৃতি সত্যিই কোনো ইচ্ছে অপূরণ রাখে না।কোনো না কোনোদিন যেকোনো উপায়ে পূরণ করে দেয়।হোক না মাধ্যম ভিন্ন!কিন্তু আজ কেন কষ্ট হচ্ছে? অবশেষে বিচ্ছেদের কষ্ট আমাকেও ছাড়লো না।তার অনলপুরীর একজন বাসিন্দা করেই অবকাশ নিলো।কিন্তু এখন অবকাশ নিয়ে কি লাভ?হয়তো নিশ্চিন্ত এখন! খামের ভেতর একটা কলমও দেখতে পেলাম।হয়তো অভিনব ভেবেছে কলম খুঁজতে আমার কষ্ট হবে।এখনো কতটা খেয়াল রাখে মানুষটা আমার!
দূরে একটা ঘুঘু পাখি অনবরত ডেকে যাচ্ছে।তারও কি কোনো দুঃখ?আচ্ছা,আমার দুঃখের চেয়ে তার দুঃখের পাল্লা কি ভারী?পেপারটা সিগনেচারবিহীন পুনরায় খামে ভরলাম। কিছুক্ষণ চুপচাপ বসে থাকার পর চেয়ার ছেড়ে উঠে দাঁড়ালাম।ঘুঘুর ডাকটা কেন জানি কষ্টটাকে আরো বাড়িয়ে দিচ্ছে। বেলকনি ছেড়ে রুমে আসলাম। বয়সের ভারে নুয়ে পড়া শরীরটা বিছানায় মেলে দিলাম।চোখের সামনে অতীতের সোনালি দিনগুলো ভাসছে।কতই না সুন্দর ছিল দিনগুলো! অভিনব আর আমার প্রেমের বিয়ে।স্কুলে আসা যাওয়ার পথে প্রায়ই দেখতাম।ভার্সিটিতে উঠার পর আমাদের মাঝে বন্ধুত্বের সম্পর্ক সৃষ্টি হয়।সে আমার দু বছরের সিনিয়র ছিল। একই ভার্সিটিতে পড়ার দরুন আমাদের অনেক কথা হতো।এভাবেই কেটে যায় দুটি বসন্ত।একদিন শেষ বিকেলের দিকে ভার্সিটি থেকে আসার পথে আমার পথ আগলে দাঁড়ায়।আমি অবাক হয়ে তার মুখপানে তাকিয়ে থাকি।
সে বলে,
__’সিথী,তোমায় কিছু কথা বলবো।মন দিয়ে শুনবে।এতদিন তোমার সাথে বন্ধুত্ব করে,কথা বলে তোমাকে মনের
বিশেষ জায়গাতে বসিয়েছি।তোমাকে ছাড়া আমার এখন দম বন্ধ হয়ে আসে।তোমার সাথে কথা না বললে সব কেমন উলোটপালোট হয়ে যায়।তোমার কন্ঠ না শুনলে কেমন মাতাল মাতাল হয়ে যাই।
তোমার প্রতিটা কথার মায়ায় ভীষণভাবে ফেঁসে গেছি আমি।এ মায়া এ জনমে আর কাটবে না।আমি তোমায় কখনো জোর করবো না যে, আমার সাথে বৃষ্টিবিলাস করো,লংড্রাইভে যাও আমার সাথে। বলবো না রাত বিরাতে ডিনারে যেতে,মাঝরাতে জোসনাবিলাস করতে!কিন্তুু আমি তোমাকে চাই,ভীষণ ভাবে চাই আমার বৃদ্ধ বয়সে। যখন আমার চামড়া ভেদ করে হাড়ের অনুপ্রভা দেখা যাবে,চামড়া ঢিলে হয়ে যাবে,সব দাঁত পড়ে যাবে,তখন জীর্ণ শরীর নিয়ে প্রতিটা দিন তোমার সাথে কাটাতে চাই।বৃদ্ধ বয়সে গিয়ে নতুন করে তোমার ফোকলা মুখের সেই হাসিতে প্রেমে পড়বো বারবার। নতুন করে প্রেমে পড়বো তোমার প্রতিটা কথার,প্রতিটি শব্দের, প্রতিটি অক্ষরের।তোমার পেকে যাওয়া সাদা চুলের মায়ায় কাটিয়ে দিবো বৃদ্ধ বয়স।আমায় সেই সুযোগ দিবে?হবে আমার বৃদ্ধকালের সঙ্গী?বৃদ্ধ বয়সে ধরবে আমার এই জীর্ণ হাত?বিয়ে করবে আমায়?’
সেদিন মুখে কোনো বুলি ছিল না আমার।অবাক হয়ে তাকিয়ে ছিলাম তার মুখপানে।তারপর মাথা নেড়ে হ্যাঁ বলেছিলাম।আমিও যে ততদিনে সাদাসিধে মানুষটার সাধারণত্বের মায়ায় নিজেকে জড়িয়ে ফেলেছিলাম!
একত্রে ৪৪ টা বসন্ত আমরা পার করেছি।হাসি খেলার ছলেই কেটে গেল এতগুলো দিন।কি অদ্ভুত মানবজীবন!
আমাদের এত বছরের সংসারে কোনো সন্তান হয়নি।প্রকৃতি কোনো ইচ্ছে অপূর্ণ রাখে না ঠিকই, কিন্তু নিজে হাজারো অপূর্ণতা দিয়ে ভরিয়ে রাখে মানবজীবন।তার কাছে যে নালিশ করার মানুষ নেই!কেউ যে তাকে দোষ দেয় না,দায়ী করে না!মানুষের অন্তরালে থেকে হেসে যায় শুধু।
একটা মেয়েকে দত্তক নিয়েছিলাম আমরা।বড় করে বিয়ে দিয়েছি।সে এখন স্বামীর সাথে বিদেশের মাটিতে সুখের সংসার করছে।রোজ ফোন দিয়ে খোঁজ নেয়।মেয়েটাকে ভীষণ ভালোবাসি! সন্তান না হওয়ার দায়ভার কখনো আমাকে দেয়নি অনিভব।তার জন্য কতই না খুশি আমি।তবে মাঝে মাঝে সাময়িক মনোমালিন্য হতো আমাদের।আমি রাগ করে মুখ গোমড়া করে বসে থাকতাম জানালা ঘেঁষে।অভিনব কত বাহানায় আমার রাগ ভাঙাতো! সেসব মনে হতেই আনমনে হেসে দিলাম!দুজনের সংসারে কতই না সুখে ছিলাম দুজন! সত্যিই কি সে সুখে ছিল?সুখে থাকলে বৃদ্ধ বয়সে হাত ধরার প্রতিশ্রুতি দিয়ে এসে সেই বয়সেই হাত ছাড়লো কেন?কৌতূহলী মন জানতে চায়!
আজ আটদিন হলো অভিনব বাড়িতে আসে না।তার সেই শূন্য বাড়িতে আমি একাকী দিনাতিপাত করছি।হয়তো কোনো হোটেলে উঠেছে সে।কিন্তু সে চাইলেই আমাকে এ বাড়ি থেকে বের করে দিতে পারে।এটা তো তার নিজের বাড়ি।সে অধিকার তার আছে!কিন্তু কেন করছে না? তবে কি অভিনব বিয়ে নামক বন্ধন থেকে শুধু মুক্তি চায়?দিনশেষে কাউকে কৈফিয়ত দেয়ার ভয়ে সে ডিভোর্স পেপার পাঠিয়েছিল?দায়িত্ববোধ থেকে মুক্তি লাভের আশায়? প্রত্যেকটা মানুষের রক্তেই আছে জন্মভবঘুরে হওয়ার বাসনা।কারন আদিম যুগ থেকেই মানুষ নানা জায়গা ঘুরে ঘুরে, বনে জঙ্গলে ছন্নছাড়া জীবন যাপন করে আজ এতদূর এসেছে।সেজন্য বৈরাগী জীবন মানুষের রক্তে মিশে গেছে সেই প্রাচীন কাল থেকেই। তাই কোনো একদিন হুট করে সব সম্পর্ক ছিঁড়ে বের হতে চাওয়া অস্বাভাবিক কিছু নয়।
একটা মানুষের জীবদ্দশায় একবার হলেও তার মনে হবে সন্ন্যাসী হওয়ার।সব ছেড়ে ছুঁড়ে, সব বাঁধন থেকে নিজেকে চিরমুক্তি দিয়ে বেরিয়ে পড়তে ইচ্ছে হবে অজানার উদ্দেশ্যে।কিন্তু শেষমেশ নিজের পিছুটানেরই জয় হোক।পিছুটানের কাছে হেরে যায় সব জাগতিক, আধ্যাত্মিক চিন্তা ভাবনা! বিকেলবেলা একদম শূন্য হাতে বাড়ি থেকে বের হলাম।ধীরপায়ে হেঁটে চলেছি সম্মুখে।এখন শীতের শুরু।বিকেল হতে না হতেই চারপাশে কুয়াশা তার আধিপত্য বিস্তার শুরু করেছে।সূর্য পশ্চিম আকাশে ঢলে পড়লো বলে! পার্কের সেই ক্ষয়ে যাওয়া পুরনো বেঞ্চটাতে বসলাম।এই বেঞ্চের সাথে কতশত স্মৃতি জমে আছে।পুরনো স্মৃতি গুলোকে আরো একবার তরতাজা করার চেষ্টায় মত্ত হলাম। হঠাৎ নিজের পাশে কারো অস্তিত্ব অনুভব করলাম।অনুভূতিটা নতুন নয়।এর সাথে আমি পরিচিত।নিজের অজান্তে ঠোঁটের কোনে ফুটে উঠলো এক চিলতে প্রশান্তির হাসি!
__’যার থেকে পালিয়ে বেড়ানোর জন্য এতকিছু করলাম,দিনশেষে তার কাছেই ফিরে এলাম।’
অভিনবের কন্ঠ কানে আসলো।আমি ঘাড় ঘুড়িয়ে তার দিকে তাকালাম।তার দৃষ্টি আকাশপানে।পরণে তার অ্যাশ কালারের হাফ হাতা শার্ট,ঢিলেঢালা কালো প্যান্ট।গলায় সাদা চাদর পেঁচানো।কপালে সাদা সিল্কি চুলগুলো এলোমেলো ভাবে পড়ে আছে।তাকে একুশ বছরের তরুণ অবস্থায় প্রথম যেদিন দেখেছিলাম,সেদিন যতটা সুদর্শন লাগছিল,আজও তেমনটাই সুদর্শন লাগছে।আমি লজ্জায় চোখ সরিয়ে নিলাম। একটুপর আবার তাকালাম।হঠাৎ করেই চোখের চশমাটার দিকে নজর গেল। নতুন ফ্রেমের মনে হচ্ছে।তৎক্ষনাৎ রাগ উঠে গেল।রাগী গলায় বললাম,
__’তুমি আবারো চশমা ভেঙেছো?তুমি আর কত হাজার চশমা ভাঙে বলো তো?আর কবে নিজের যত্ন নিতে পারবে?এত অগোছালো মানুষ কিভাবে হয়?তুমি কি মানুষ হবে না কোনোদিন?’ অভিনব আমার দিকে তাকিয়ে হাসি দিল।কি মুগ্ধকর সে হাসি!বার বার হারিয়ে যেতে মন চায় তার গহ্বরে।
সে বলল,
__’আমি মানুষ হবো না কোনোদিন। সারাজীবন সিথীর প্রেমিক হয়েই কাটিয়ে দিবো।আমি অগোছালো না হলে কি আমার সম্মুখে থাকা এই মেয়েটা আমার এত খেয়াল রাখতো?এত যত্ন করে আগলে রাখতো?এই মেয়েটার কেয়ার পাওয়ার জন্য আমি আরো বেশি অগোছালো হবো।আরো বেশি নিজের অযত্ন,অবহেলা করবো!’
আমি মুখ ঘুরিয়ে নিলাম।চোখ দুটো জলে ভরে উঠতে চাইছে বার বার।অভিনব তার হাতটা আমার হাতের ভাঁজে দিয়ে বলল,
__’আমি বাকি জীবনটা সিথী নামের মেয়েটার প্রেমিক হয়ে কাটিয়ে দিতে চাই।তার হাতজোড়া ধরে একসাথে পায়ে পা ফেলে ভবিষ্যতটা দেখতে চাই।সে রাজি তো?আমায় দিবে সে সুযোগ?’
__’সিথী ডিভোর্স পেপারে সিগেচার করে দিয়েছে।সে বলেছে তার উপর আর কারো অধিকার নেই।’
__’আমি জানি, সে এটা করেনি।
এটা ছিল তার আর আমার ভালোবাসার ছোট্ট একটি পরীক্ষা। সে পরীক্ষায় সফলতার সাথে পাশ করেছে।সাথে তার অভিমানও জমেছে।আর তার অভিমান ভাঙানোর জন্য তার প্রেমিক পুরুষ সদা প্রস্তুত।’ আমি বাচ্চাদের মতো খিলখিল করে হেসে উঠলাম।সে একটু এগিয়ে এসে চাদর দিয়ে তার সাথে আমাকে পেঁচিয়ে নিলো।আমি হাতটা ধরে তার কাঁধে মাথা রাখলাম। সূর্যের তেজ কমে এসেছে। সারাদিন আলো দিয়ে সে হয়তো বড্ড ক্লান্ত।তার নিভু নিভু লাল আভায় কি ভয়ংকর সুন্দরই না লাগছে শেষ বিকেলটা!চায়ের কাপের চুমুকে মাখা স্নিগ্ধ সকাল,অলস দুপুরে মোড়ানো সময়টুকু পেরিয়ে এখন ক্লান্তির আবেশে ছোঁয়া শেষ বিকেল।
উঠে দাঁড়ালাম দুজন।জীর্ণ হাতজোড়া একে অপরকে শক্ত করে ধরে সামনে এগিয়ে চললাম।এখন আমাদের পুরনো ভালোবাসার নীড়ে নতুন করে ফেরার পালা। দূর থেকে লক্ষীপেঁচার সুমধুর কন্ঠ কানে আসছে।সে যেনো বার বার বলে যাচ্ছে,তোমাদের প্রতিটি বিকেল আজকের মতো সুন্দর হোক!ভীষণ সুন্দর! সত্যি আজকের শেষ বিকেলটা সুন্দর।পরমুহূর্তে মনে হলো শুধু আজকের না,আগামী দিনগুলোর শেষ বিকেলও এমন সুন্দর হবে।কারণ প্রতিটি শেষ বিকেল অসাধারণ।শেষ বিকেলের ধর্মই হচ্ছে সুন্দর থেকে সুন্দরতম হওয়া।শেষ বিকেল এমনই!!
গল্পের বিষয়:
গল্প
DMCA.com Protection Status
loading...

Share This Post

সর্বাধিক পঠিত