প্রতিদিনের মত আজও ঘুম ভেঙে দেখি নয়টা বেজে গেছে।তার মানে ঈশান আজও শুকনো পাউরুটি খেয়ে অফিসে গেছে।প্রতিদিন এই জ্বালা আর ভালো লাগেনা।রোজ রাতে এ্যালার্ম দিয়ে ঘুমাই,অথচ সকালে উঠে দেখি নয়টা ওভার।এ্যালার্ম ঘড়িতে সমস্যা নাকি আমার কানে সেটা আজও বুঝলাম না।।
ঈশানের সাথে আমার বিয়ে হয়েছে দু’বছর হলো।পারিবারিক ভাবে বিয়ে হলেও ও আমাকে নাকি আগে থেকেই পছন্দ করত।সেটা বিয়ের পরে জানতে পেরেছি।ঈশান নিজেই বলেছে।কিন্তু ও আমাকে পছন্দ করতো এই বিষয়টা কেন জানি আমার বোধগম্য হচ্ছে না।ঈশানের মতো প্রানচঞ্চল একটা ছেলে যে সারা ভার্সিটি মাতিয়ে রাখতো,সে কিনা আমার মতো একটা মুখচোরা স্বভাবের মেয়েকে পছন্দ করে।বিষয়টা সত্যিই অদ্ভুত।ঈশান যখন গিটার হাতে ভার্সিটিতে ঘুরে বেড়াতো অনেক মেয়েই ওর পাশে নিজেকে কল্পনা করত।কিন্তু আমি সবসময় সবার থেকে আলাদা থেকেছি।মানুষের সাথে মিশতে আমার জড়তা কাজ করতো।সেখানে ঈশান ছিল ভার্সিটির সিনিয়র।ওকে কিছুটা ভয়ই পেতাম আমি।তাই কখনও ওর সাথে কথা বলা হয়ে ওঠেনি।। কলিং বেল বাজতেই দরজা খুলে দেখি ঈশান এসেছে।ভীষন ক্লান্ত লাগছে ওকে।কোটটা খুলে হাতে নিয়েছে।ভেতরে ঢুকতেই আমি ওকে টেনে চেয়ারে বসিয়ে দিলাম।তারপর একটা প্লেট সামনে রেখে বললাম,,,
—” আগে এটা খেয়ে নাও।
—” এটা কি বস্ত??
—” বস্ত না,এটা পুডিং।।
—” এটা পুডিং।সিরিয়াসলি তনু,এটা তোমার দ্বারাই সম্ভব।পুডিংয়ের ভেতর পানি আটকে আছে।এগুলো নাকি আবার খাওয়া যাবে।
—” এভাবে বলছো কেন ঈশান..??
—” তো আর কিভাবে বলবো।এসব সরাও সামনে থেকে।ভাত দাও আমাকে,ভীষন ক্লান্ত লাগছে।
—” ভাত নেই।
—” নেই মানে…??
—” আসলে পুডিং বানাতে সময় চলে গেছে।তাই রান্না করতে পারিনি।তুমি দু’মিনিট বসো আমি তোমাকে নুডুলস করে দিচ্ছি।
—” তুমি আমাকে আর কতো নুডুলস,পাস্তা,টোস্ট খাওয়াতে চাও একটু বলবে।
এক কাজ করো।এখানে বসে কিছুক্ষণ চোখের পানি ফেলো,আমি ততক্ষণে খিচুড়ি বসিয়ে আসি। ঈশান রুমে চলে গেল।ভীষণ কান্না পাচ্ছে।ঈশানের ব্যবহার এর জন্য নয়,নিজের অক্ষমতার জন্য।বিয়ের দু’বছর পার হয়ে গেল,এখনও ঠিকমতো রান্নাটা করতে পারিনা।প্রতিদিন ঘুম থেকে দেরী করে উঠি।ঈশানকে নাস্তা বানিয়ে টিফিন বক্স সাজিয়ে দিতে পারি না।ও সকালে একস্লাইস রুটি ডিম খেয়ে চলে যায়।দুপুরে অফিস ক্যান্টিনে খেয়ে নেয়।রাতে এসেও নিজেকেই রান্না করতে হয়।আমি মাঝে মাঝে ইউটিউব দেখে কিছু কিছু বানানোর চেষ্টা করি।কিন্তু কোনটাই পার্ফেক্ট হয় না।পুডিং-এর ভেতর পানি জমে থাকে।কাস্টার্ডে দুনিয়ার চিনি হয়।কেক বানাতে গেলে পুড়ে যায়।ভাত রান্নাটাও একদিন হয় রোগীদের খাবারের মতো আঠালো,আর একদিন হয় লোহার মতো শক্ত।।
—” এই নাও,গরম গরম ভুনা খিচুরি।
ঈশান প্লেট নিয়ে খেতে বসলো।কিন্তু আমার গলা দিয়ে নামছে না।বারবার চোখ ভারে উঠছে।টেবিলে বসে থাকতে না পেরে একটু আসছি বলে রুমে চলে এলাম।কান্নাটা গলায় আটকে আছে।পেছন থেকে ঈশান কাঁধে হাত রাখলো।ফিরে দেখি ঈশান খাবারের প্লেট নিয়ে দাঁড়িয়ে আছে।তারপর আমাকে খাটে বসিয়ে খাওয়াতে লাগলো।আমিও বাধ্য মেয়ের মতো খেয়ে নিলাম। রাতে বিছানায় যাওয়া মাত্রই আমি ঘুমিয়ে পড়ি।কিন্তু আজ ঘুম আসছে না।ঈশান ল্যাপটপে কাজ করছে।আমি চোখ বন্ধ করে শুয়ে আছি।আগে ঈশানকে খুব জ্বালাতাম।কিন্তু এখন আর সেরকম করিনা।ঈশান সবসময় সহ্য করে।কিন্তু কোনদিন যদি সহ্য করতে না পারে।আমাকে বকা দিয়ে ফেলে।তাই ভয় লাগে। ঈশান ল্যাপটপ বন্ধ করে আমাকে ডাকলো,,,
—” তনু ঘুমিয়ে পড়েছো,,,??
—” তনু,আমি জানি তুমি জেগে আছো।একটু বারান্দায় চলোতো কথা আছে। এবারের ডাকে উঠে বসলাম।ঈশান আমার হাত ধরে বারান্দায় নিয়ে এসে দোলনায় বসালো।ও নিজেও বসলো।ওর হাতে আমার এ্যালার্ম ঘড়িটা।বুঝলাম না এটা এখানে কেন নিয়ে এসেছে।হঠাৎই ঈশান এ্যালার্মের টাইমারটা অফ করে দিল।আমাকে অবাক দৃষ্টিতে তাকিয়ে থাকতে দেখে বললো,,,
—” এ্যালার্ম বন্ধ করে দিলাম।কারন আমি চাইনা তুমি আমার আগে উঠে যাও।আর আমি অফিসে যাওয়ার আগে তোমার ঘুমন্ত মুখটা দেখা মিস করি।
—” মানে,,,,,,,,,,,,
—” মানে,আমি জানি এ্যালার্ম ছাড়া তোমার নয়টার আগে ঘুম ভাঙেনা।তাই প্রতিদিন তুমি ঘুমিয়ে পড়লে আমি এটা বন্ধ করে রাখি। আমার কোন কাজ থাকেনা তবুও ল্যাপটপ নিয়ে ঘাটাঘাটি করি,তোমার ঘুমিয়ে পড়ার অপেক্ষা করি।
—” কিন্তু এসব করে কি লাভ।সেই তো তোমাকে না খেয়ে অফিসে যেতে হয়।
—” তোমাকে দেখে আমি হাজার বেলা না খেয়ে থাকতে রাজি আছি।
—” বাচ্চাদের মতো আবেগী কথা হয়ে গেলো না।।
—” হোক,আমার বউ তো বাচ্চাই।তাই কোন সমস্যা হবে না।তনু,আমি তোমার জন্য এটা করতাম।কিন্তু বুঝিনি তুমি নিজেকে এতো নিচু ভাববে।আমি সরি,,,,
—” আচ্ছা ঠিকআছে।কিন্তু আজ থেকে আর করবে না কেমন…??
—” কেন কেন…???
—” কারন কাল থেকে আমি নিজের হাতে তোমার জন্য সকালের নাস্তা আর দুপুরের টিফিন বানাবো।
—” আচ্ছা তাই হবে।
এক নিমিষেই মনটা হালকা লাগছে।এতোক্ষণ নিজেকে খুব অপরাধী লাগছিল।কিন্তু যখন জানলাম ঈশান এমন করেছে তখন মনে হচ্ছে,সত্যিই অনেক ভাগ্য করে আমি ঈশানকে পেয়েছি।হারাতে চাই না ওকে,কখনও না।একসমুদ্র ভালোবাসা নিয়ে সারাজীবন পাশে থাকতে চাই।।
গল্পের বিষয়:
গল্প