রাহুলের মামাতো বোনের বিয়ে ঠিক হলো।ছেলে হাই-স্কুলের শিক্ষক।দেখতে শুনতেও ভালো।লম্বা-চওড়া ফরসা।নরমাল মেয়েদের যেমন ডিমান্ড থাকে সবটাই আছে ছেলের মাঝে।তবে সমস্যা একটাই,ছেলে খানিকটা তোতলায়।রাহুলের মামাতো বোন সাকিয়ার এতেই যতো আপত্তি।তার তোতলানো ছেলে পছন্দ না।কলেজে থাকতে মৃন্ময় নামের একটা ছেলে প্রপোজ করেছিলো।
ঐ ছেলেটিও তোতলাতো।বসন্ত বরন উৎসব ছিলো সেদিন তাদের কলেজে।মেয়েরা সবাই পড়লো বাসন্তি রঙা শাড়ি আর ছেলেরা একই রঙের পাঞ্জাবী।ফাংশনের শেষে ছেলে মেয়েরা একে অপরের সাথে ছবি তুলতে ব্যাস্ত।কেউ সেলফি তুলছে তো কেউ তুলছে গ্রুপ ছবি। সাকিয়া তার বন্ধুদের সাথে সেলফি তুলছিলো।সেলফি ক্যামেরায় স্পষ্ট দেখা যাচ্ছিলো একটা ছেলে গোলাপ হাতে হাটু গেড়ে বসে আছে সাকিয়ার পেছনে।সাকিয়া ছেলেটির দিকে ফিরে খুশিতে হা করে ফেললো।এর পর অবাক হওয়ার ভং ধরে দুই হাতের তালু দিয়ে হা করা মুখটি বন্ধ করলো।ছেলে প্রপোজ করা শুরু করলো,”আই লা লা লা লা লা লা লা লা তেই আটকে গেলো।ভালোবাসার গাড়ি আর এগোলো না। সাকিয়ার সাথে রাহুলের সম্পর্ক অনেক ভালো।আর এটা রাহুলের মামা ভালো ভাবেই জানতো।তাই সাকিয়াকে বিয়ের জন্য মানানোর জন্য রাহুলকে ফোন দিলো তার মামা।রাহুল না করতে পারলো না।বিকেলের ট্রেন ধরলো আর মাঝরাতে মামাবাড়ি গিয়ে পৌছুলো।
মামা বাড়িতে অনেক দিন পর আসলো রাহুল।প্রায় ছয় বছর পর।সব কিছু একই আছে।রাহুলের দাদুর কেনা জমিদার বাড়িটির একটা ইট-কাঠও পরিবর্তন হয় নি।ইয়া বড় বড় রুম।ছাদের দিকটার কয়েক জায়গার চুন সুড়কি যদিও খসে গেছে যদিও,তবুও যেন সব একইরকম।তবে সবচেয়ে ভালো ব্যাপার হলো কারেন্ট এসেছে।বছর কয়েক আগেও কারেন্ট ছিলো না।অন্তত এবার শান্তিতে মোবাইল চার্জ দেয়া যাবে। ভোর হতেই রাহুলের ঘুম ভেঙে গেলো।নতুন কোন জায়গায় গেলে রাতে তার ভালো ঘুম হিয় না।এটা সত্যিই বিরক্তিকর।মাঝরাত পেরিয়ে গিয়েছিলো বিছানায় মাথা লাগাতে লাগাতে। বিছানায় এপাশ ওপাশ করতে করতে কখন যে সাতটা বেজে গেলো টের পেলো না রাহুল।আর থাকতে পারলো না বিছানায়।বিছানা থেকে উঠে পুরোবাড়িটা একটু ঘুরে দেখা দরকার। বাড়ির সামনে মোটামুটি মতন একটা দূর্বা ঘাসে ঢাকা ঊঠোন আছে।শীতের শুরু, তাই কিঞ্চিৎ শিশির জমে আছে উঠোনের দূর্বা ঘাস গুলোতে।সূর্যের আলো পড়ায় খানিকটা চিকচিক করছিলো দূর্বাঘাসের মাথা গুলো।
বাড়ির উত্তর আর দক্ষিন পাশে দুটো পুকুর আছে।একটা একটু বড় আর অপরটা তেমন বড় না।ছোট পুকুরটাতে আশেপাশের মানুষ ময়লা ফেলে পচা ডোবা বানিয়ে ফেলেছে।এর পানি পুরো ঘোর অমাবস্যার রাতের কালো।যদিও পুকুরের পাড়ের দিকে কিছু কলমি লতা আর কচু গাছ জন্মানো আছে।অন্যদিকে বড় পুকুরটা ভালই আছে জমিদারদের বানানো একটা ভাঙা ঘাটও আছে সেই পুকুরে।ঘাটের উপরের দিকে বসবার মতো করে কতগুলো সিড়ি বানানো ছিলো।তো সেখানেই গিয়ে বসলো রাহুল। চারপাশে পাখির ডাকে মন ভালো হয়ে যাচ্ছিলো রাহুলের।পুকুরের চারপাশে তেমন লোকের বসতী নেই।পুকুরের বাকি তিনপাড়ের মধ্যে দুইপাড়ে বাশবন আর এক পাড়ের বাশবন বছর কয়েক আগে রাহুলের মামারা পরিষ্কার করে সেখানে পুরোদস্তুর কাঠাল গাছ লাগিয়ে দিয়েছেন।পুকুরে মাছ তেমন নেই।তবে তিতলি পুটি মাছের লাফালাফি ভালই ছিলো পুকুরের পানিতে।
ঘাটে বসে বসে এসবই দেখছিলো রাহুল।হটাৎ করেই এক বুড়ি ঘাটের নিচ থেকে উপরের দিকে মাথা মুছতে মুছতে উঠে এলো।বর্ষার শেষ হওয়ায় পুকুরের পানি খানিকটা নিচে নেমে গিয়েছে।তাই ঘাটের উপর থেকে নিচে কেউ আছে কিনা সবসময় বোঝা যায় না।তো বুড়ি উপরে উঠে রাহুলকে বসে থাকতে দেখেই খানিকটা মুচকি বললো,”নাতি,আমি বুড়া মানুষ।দেখার কিছুই না।বইসা থাইকা লাভ নাই” রাহুল খানিকটা মুচকি হাসি দিয়ে বললো,”দাদী,তোমার যা আছে তা দেইখা সুচিত্রা সেনও ফেইল মারবো।” বুড়ি ফিক করে হেসে দিলো।মাথা নাড়তে নাড়তে বুড়ি চলে গেলো। খানিক বাদে মুখে ব্রাশ ঘষতে ঘষতে সাকিয়া ঘাটের দিকে এসে রাহুলের পাশে বসলো।সাকিয়া এখনো চোখ মেলতে পারতেছে না।ঘুম হয়নি রাতে বোঝাই যাচ্ছে।সাকিয়ার দিকে তাকিয়ে রাহুল বললো,
“ঘুমাস নি রাতে?”
“ঘুমাইছি তো।কিন্তু ঘুমাই নাই।”
“মানে।”
“ঘুমাইছি কিন্তু ঘুমাই নাই।” রাহুল খানিকটা রেগে বললো, “আবেতাবে না বইকা চোখে পানি দিয়া আয় যাহ।” রাহুলের কথা মতো সে নিচে নেমে চোখ হাত ধুয়ে এসে পুনরায় রাহুলের পাশে বসলো।এবার তাকে আগের থেকে খানিকটা স্বাভাবিক লাগছে।ঘুমে ঢুলুমুলু চোখগুলোকে এখন একটু সতেজ লাগছে। সাকিয়া রাহুলের দিকে তাকিয়ে বললো,
‘তুই কখন এলি?”
“কাল রাতে।তুই ঘুমে ছিলি।”
“হটাৎ,আচমকা এই সফর।ছেকাটেকা খাইছিস?”
“মামার বাড়িতে কি মানুষ ছেকা খাইলেই আসে নাকি?আজব কথাবার্তা। “
“শেষ বার যখন আসছিস,তখন ছেকা খাইয়াই আসছিলা।তোমার সাবেক,রিমা।মনে নাই।”
“সকাল সকাল ভালো কিছু বলতে পারিস না।তোর খবর বল!”
“আমার খবর ভালো না।চরম হতাশায় আছি।জানিস তো বাবা বিয়ে করানোর জন্য কুত্তা হয়ে গিয়েছে।পাগলের মতো ছেলে খুজতেছে।একটাকে তো পছন্দও করে আসলো।ছেলেটা ভালো কিন্ত তোতলায়।এটা বিরক্তিকর।”
“এত্ত হতাশায় যাওয়ার কিছু নেই।কেউই ত্রুটি মুক্ত না।ফুল প্যাকেজ তুই কোনদিনও পাবি না।বিয়েটা করে ফেল।ছেলে যেহেতু ভালো তাই বিয়েটা করে ফেল।” “আমি কেন বঞ্চিত হবো বল।ঐ ছেলে তো ঠিকই আমার মতো একটা ফুল প্যাকেজ পাবে।সব দিকেই আমি ঠিক আছি বল।আমার মতো একটা জোস আইটেম বিয়ে করবে ঐ তোতলাটাকে?” “ওয়েট ওয়েট,তুই কি?,তুই ফুল প্যাকেজ!?তোদের ঘরে মশা আসে না কেন জানিস!তোর পাদের গন্ধে।তুই কোন ঘরে গিয়ে একটা পাদ দিলেই হলো,সেই ঘরে আর এক শতাব্দি পর্যন্ত মশা আসবে না।আসলেই তুই একটা ফুল প্যাকেজ।হিহি।”
রাহুলের কথা শুনে সাকিয়া খানিকটা রেগে গেলো।সে বললো, “কি ভাইয়া তুই।ছোট বেলার কাহিনী নিয়ে পড়ে আছিস।এদিকে আমি কোন স্থির সিদ্ধান্ত নিতে পারছিনা।বয়েস ২৫পেরিয়েছে।দুদিন পর তো বুড়ি হয়ে যাবো তখন এরকম তোতলাও জুটবে না।কিছু একটা বল ভাইয়া।” রাহুল সাকিয়ার মাথায় হাত বুলোতে বুলোতে বললো, “ছেলেটি ভালো।আর তুই বিয়ে করলে মামা অনেক খুশি হবেন।করে ফেল বিয়েটা এত ভাবার কিছু নেই।আর কোন পছন্দ থাকলে বল।আমি মামাকে বলছি।” পছন্দের কথা শুনে সাকিয়া লাফিয়ে উঠলো,বললো, “আছে একজন।” রাহুল খানিকটা চোখ বড় করে জিজ্ঞেস করে বললো, “কে?নাম বল?” সাকিয়া লজ্জায় লাল হয়ে গিয়েছে। রাহুল আবার বললো, “কি রে,বল।” সাকিয়া মুখ নিচের দিকে দিয়ে চুপ করে রইলো। রাহুল এবার ধমক দিয়ে বললো, “বাল,ঢং করিস না বল।”
সাকিয়া টপ করে বললো, “সালমান খান।আমি সালমান খানকে পছন্দ করি।কিন্ত উনি তো বিয়ে করবেন না।” কথাটা বলা শেষ করতেই সাকিয়ার মুখটা কালো হয়ে গেলো।আর তা দেখে রাহুল হেসে ফেললো,বললো, “তোর লুচ্চামি আর কমলো না।ছোট বেলায় না শাহরুখ খানকে পছন্দ করতি?আর এখন সালমান!এসব লুচ্চামিগিরি বাদ দিয়া ঐ তোতলার ঘাড়ে ঝুইলা যা। এখন চল নাস্তা করুম।খিদা লাগছে অনেক।” সাকিয়ার স্থির একটি সিদ্ধান্তে আসলো।সে বিয়ের জন্য রাজী।সাকিয়া নিজের মুখে তার বাবাকে বললো উনি যাতে চিন্তা না করেন।সাকিয়ার এমন কথায় রাহুলের মামা তথা সাকিয়ার বাবা খানিকটা চিন্তা মুক্ত হলেন।আর ধীরে সুস্থে সাকিয়ার বিয়ের প্রস্তুতি নিতে থাকলেন।
সেদিন দুপুরের খাবার খেয়েই রাহুল তার বাসার উদ্দেশ্যে বেরিয়ে পড়লো।রাত নয়টা নাগাত বাসায় ফিরলো সে।
খানিকটা ক্লান্ত ছিলো রাহুল।বাসায় এসেই মুখ-হাত ধুয়ে ঘুমুতে চলে আসলো।খেতে ইচ্ছা করছিলো না তার।বিছানায় মাথা লাগাতেই ঘুমিয়ে পড়লো সে।তাদের বাসায় মশার উৎপাত খানিকটা বেশিই।রাহুল মশারি না দিয়েই ঘুমিয়ে পড়লো।কিছুক্ষন পর রাহুলের মা ভেতরে আসলেন।রাতে রাহুল ঘুমিয়ে যাওয়ার পর একবার করে রাহুলের ঘরে এসে রাহুলকে দেখে যান উনি প্রতিদিন।ঠিক মতো ঘুমিয়েছে কিনা,মশারি টাঙিয়েছে কিনা লাইট অফ করলো কিনা,এসবই দেখতে আসেন।আস্তে করে রাহুলের ভাজ করা মশারিটা টেনে দরজার কোনায় থাকা পেরেকে মশারীর কোনা আটকে দিয়ে চারপাশটা খুচে দিলেন যাতে করে ফাক ফোকর দিয়ে মশা না ঢুকতে পারে।লাইটটা বন্ধ করে রাহুলের মা তার ঘর থেকে চলে গেলো।
রাহুলের ফ্যামিলিরর সবার সাথে রাহুলের খুব ভালো একটা সম্পর্ক ছিলো একসময়।এখনো যে খুব একটা খারাপ তা নয়।খুব ভালো নয় ঠিকই তবে চলনসই।বন্ধুত্ব আর পরিবার,দুটোকেই সর্বদা আলাদা রেখেছিলো রাহুল।কোনটাকেই কখনো একে অপরের ভেতরে ঢোকায় নি।একবার রাহুলের মা মাথা গরম অবস্থায় তার খুব কাছের বন্ধু নিকিতাকে নিয়ে খুব বাজে একটি শব্দ ব্যাবহার করেছিলো।নিকিতা হলো রাহুলের বাবার এক বন্ধুর মেয়ে।নিকিতার বাবার সাথে একদা রাহুলদের ফ্যামিলির খুব ভালো সম্পর্ক ছিলো।
মাল্টিপারপাস সমবায় সমিতি স্ক্যামের সাথে যুক্ত হয়ে নিকিতার বাবা প্রায় সাড়ে তিন কোটি টাকা হাতিয়ে নিয়েছিলো।এর মধ্যে রাহুলদের প্রায় সাড়ে পঞ্চান্ন লাখ টাকা ছিলো যার অধিকাংশই ছিলো রাহুলের দাদুর দেয়া গয়না বিক্রির টাকা।তাই নিকিতার সাথে চলাফেরা রাহুলের মা কখনই পছন্দ করতো না।কিন্তু,তার মায়ের এই অপছন্দের ব্যাপারটিকে কখনো রাহুল গুরুত্বও দিতো না।সেই ঘটনার পর থেকেই রাহুল তার পরিবারের সাথে থাকে ঠিকই,কিন্তু আগের মতোন আর মিশতে পারে না। রাহুল,নিকিতা আর নিলেষ,খুব কাছের তিন বন্ধু তারা।এক সাথে চলাফেরা,আড্ডা দিয়েই পার করে তাদের সময়।স্থানীয় একটা কলেজ থেকে বছর খানেক আগে তিনজনই মাস্টার্স পাশ করে বের হলো একসাথে।
নিলেষ, ছেলেমেয়েদেরকে ফ্রিতে পড়ায়।একটু আউলা টাইপ মানুষ সে।কাধে সবসময় একটা ব্যাগ ঝোলানো থাকে।চুল বড় বড়,দাড়ি বড় বড়।কাধের ব্যাগটি ম্যাক্সিমাম টাইম ফাকাই থাকে।একটা নোট প্যাড থাকে যদিও মাঝে মাঝে,তাও ফাকা।আর হ্যা,পকেট ভর্তি এক প্যাকেট আকিজ বিড়ি আর ডলফিন দিয়াশলাই সর্বদাই থাকে।গোল্ডলিফ দিয়ে শুরু,বেকারত্ব আর পরিবার বিচ্ছেদের চাপ তার স্টাটাস আকিজ বিড়িতে এনে নামিয়েছে।
নিকিতাও খানিকটা অদ্ভুত।ওপরওয়ালা ভুল করে মেয়ে বানিয়ে পাঠিয়েছে একে।না না,পোশাকআশাকে দেখলে লক্ষ্মীমন্ত মেয়েটি মনে হলেও তার আসল রূপ রাহুল আর নিলেষের সামনেই প্রকাশ পায় সবসময়।হাত-পা দুটোই সমান তালে চলে।দুই দুই বার প্রাইমারি স্কুলের চাকরির ইন্টারভিউতে টিকেও জয়েন করেনি।এদিকে ডিভোর্সি মা-কে নিয়ে ফিনানশিয়াল ক্রাইসিস তাকে নিজ হাতেই সামলাতে হয়।স্বপ্ন আর্মি জয়েন করবে।যদিও হাইট ২ইঞ্চি কম।তবে সে হাল ছাড়ে নি।
ডেইলি দুই গ্লাস হরলিক্স খাটি গরুর খাটি দুধের সাথে মিশিয়ে খায়।আর একবার ইন্টারভিউ দিতে পারবে।বয়েস পেরিয়ে যাচ্ছে তার।আর একবছর বাকি।বিগত চার বছর ধরেই এমন করে যাচ্ছে সে।অনেক বোঝাইছে রাহুল আর নিলেষ,এখন তারা শুধু একটা কথাই বলে,”অল দ্যা বেস্ট” তিনজনের লাইফই তিনদিকে চলমান।নিলেষের সাথে তার পরিবারের সম্পর্ক খুবই খারাপ।এর নেপথ্যে অবশ্য রয়েছে নিলেষের বড় বৌদির হাত। সেদিন,বাংলাদেশ আর ভারতের এশিয়া কাপ ফাইনাল চলছিলো।সোফায় বসে খেলা দেখছিলো নিলেষ।এগারো রান লাগে এক ওভারে।অনস্ট্রাইকে আছে মুশফিক। মুশফিক টপাটপ দুটো চার মেরে ম্যাচটাকে প্রায় আমাদের করে ফেললো।এমন সময়ই,নিলেষের বাবা সোফায় বসে থাকা নিলেষের সেন্টু গেঞ্জি ধরে টেনে তাকে বাসার গেইটের সামনে আনলো।পরপর দুটো চড় দিয়ে ধাক্কা দিয়ে গেট দিয়ে বের করে দিলো।বেচারা নিলেষের হা করে চেয়ে থাকা ছাড়া কোন উপায় ছিলো না।এদিকে গেট থেকে বেরুতেই ঝাকে ঝাকে কলেজ পড়ুয়া মেয়েরা রাস্তা দিয়ে যে যার বাসায় ফিরছিলো।
সবেই নিলেষদের বাসার পাশের গার্লস কলেজটা ছুটি হলো।মেয়েগুলোর কম বেশি প্রত্যেকেই শর্টস পরা-সেন্টু গেঞ্জি গায়ে দেয়া নিলেষের দিকে তাকিয়ে খানিকটা মুচকি হেসে চলে গেলো।নিলেষ বুঝে গিয়েছিলো,বাংলাদেশ আর এশিয়া কাপে জিততে পারবে না।পারেও নি। এর পর থেকেই বেচারা নিলেষ ঘরছাড়া।রাহুল একটা ভাড়া বাসার ব্যাবস্থা করে দিয়েছে।আপাতত সে সেখানেই আছে।পোলাপান পড়িয়ে যে দুচার আনা আসে তা দিয়েই দিব্যি চলে যায়।তবে নিলেষ খোজ নিয়েছিলো।তার বাবার তার সাথে করা এমন আচমকা আচরনের নেপথ্য ঘটনার নেপথ্য কাহিনি। পুরো ঘটনার পেছনে ছিলো মূলত তার বৌদির হাত।উনি নিলেষের বাবার কাছে বলেছিলেন যে নিলেষ নাকি উনাকে বাজে ইশারা দিয়েছিলো।
কিন্ত আসল ঘটনা ছিলো,এমন।নিলেষ তখন মাস্টার্সে পড়ে।কলেজ থেকে ফেরার সময় কলেজ ক্যান্টিনথেকে সস্তায় এক হালি কলা বাসায় নিয়ে আসে।বাসায় ফিরেই সে দেখলো তার বৌদি একটা পচা কলার কিছুটা খেয়ে বাকিটা ফেলে দিচ্ছে ডাস্টবিনে। এটা দেখেই সে বললো,”পচা কলা না খেয়ে আমার কলাও তো খেতে পারো।আমার রুমে রাখা আছে।” এক বিকেল বেলায় হটাৎ নিকিতা রাহুলকে কে ফোন দিয়ে হসপিটালে আসতে বললো।রাহুল ফোন পেয়ে যত তাড়াতাড়ি সম্ভব সেখানে গেলো।নিকিতার মা স্ট্রোক করেছিলেন।ডাক্তারের ভাষ্য মতে উনার ডান সাইডের পুরোটাই প্যারালাইজড হয়ে যাওয়ার সম্ভাবনা আছে।দুই দিন পর উনাকে ডিসচার্জ করা হলো।
নিকিতা খানিকটা ভয় পেলো এবার।মা ছাড়া তেমন কিছুই নেই তার।সিঙ্গাপুরে এক মামা আছে।বাবার সাথে তার সম্পর্ক ছিন্ন হয়েছে বহুদিন আগে।মূলত তার মায়ের ডিভোর্স পেপারে জোর করেই তার বাবাকে সই করিয়েছিলো নিকিতা নিজে।মায়ের ভ্যালু কতটা যেন নতুন ভানে বুঝতে পারলো সে।একা হয়ে যাওয়ার একটা অদ্ভুত ভয় তার মধ্যে চেপে বসলো। কদিন পরের ঘটনা, নিলেষের বৌদির অবস্থাও ভালো না।বাথরুমে স্লিপ করে পা পিছলে পড়ে গিয়ে পেটে আঘাত পান।আট মাসের গর্ভবতী ছিলেন উনি।হসপিটালে নিয়ে যাওয়া হলো উনাকে।সিজার করে বাচ্চাকে কোন মতে বাচানো গেলেও নিলেষের বৌদির অবস্থা বাজে ছিলো।নিলেষের ভাই তখন কোন একটা কাজে চট্টগ্রাম গিয়েছিলো।তার বৌদির জন্য প্রায় চার ব্যাগ রক্তের ইমিডিয়েট প্রয়োজন ছিলো।
এক ঘন্টার মধ্যে রক্ত না দেয়া গেলে প্যাশেন্টকে বাচানো সম্ভব হবে না।ডাক্তারের মুখে এমন কথা শুনে নিলেষের বাবা খানিকিটা ভয় পেয়ে গেলেন।উনি নিলেষকে ফোন দিয়ে পুরো সব কিছু খুলে বললেন।ঘটনাশুনে নিলেষ আর স্থির থাকতে পারলো না।নিকিতাকে সাথে নিয়ে তড়িঘড়ি করে হাসপাতালে গেলো।নিকিতা,নিলেষ আর তার বৌদির রক্তের গ্রুপ একই ছিলো বিধায় সাথে সাথেই দুই ব্যাগ রক্তের ব্যাবস্থা হয়ে গিয়েছিলো।বাকি দুই ব্যাগ রক্তের ব্যাবস্থা রাহুল করে দিয়েছিলো। রাত দুইটা।নিলেষ নিকিতাকে একটা রিকশায় তুলে দিয়ে হসপিটালের বারান্দায় পাতা চেয়ারে বসে আছে হসপিটালের মেঝেতে কতগুলো পিপড়া একে অপরের সাথে খাবার নিয়ে টানাটানি করছিলো।নিলেষ সেগুলোই দেখছিলো।
কিছুক্ষন পর নিলেষের বাবা তার সাথে এসে বসলো।আলতো করে তার কাধে হাত রাখলো,তারপর বললো,
“বড় হয়ে গেলি তো।বিয়ে করবি না?” নিলেষ কি বলবে বুঝতে পারলো না।চুপ করে নিচের দিকে তাকিয়ে রইলো সে। তার বাবা আবার বললো, “বিয়ে করে ফেল।মরে যাবো হয়তো।এক ছেলের ঘরের আলো ফুটেছে তা তো দেখলাম।এখন তোকে বিয়ে দিয়ে সুন্দর একটা সংসার গড়ে দিতে পারলেও দায়িত্ব শেষ আমার।” বাবার মুখে মৃত্যুর কথা শুনে নিলেষের চোখ কেমন যেন ভিজে উঠলো। তার বাবা আরও বললো, “সন্তান জন্মদেয়া অনেক সহজ জানিস তো।কিন্ত সেই আদরের সন্তানদের দিকে কেউ আঙুল তুললে নিজেকে বেধে রাখাটাও কঠিন।মাঝে মধ্যে শাস্তির মধ্যে ভালোবাসা লুকিয়ে থাকে।তুই কেমন তা আমি জানি,কিন্ত সেদিন আমার কিচ্ছু করার ছিলো না। ক্ষমা করিস তোর বাবাকে।” এই বলে উনি উঠে চলে গেলন।নিলেষ স্থির হয়ে তখনো কিছু বলতে পারলো না।
মাস খানেক পরের কথা, নিকিতার মামা নিকিতা আর তার মায়ের জন্য ভিসা আর বিমানের টিকেট পাঠিয়েছেন।নিকিতার মায়ের চিকিৎসা সিঙ্গাপুরের হবে।সপ্তাহখানেক বাদে ফ্লাইট। এরই মধ্যে নিলেষের জন্য মেয়ে দেখাও হয়ে গিয়েছে।বাবার ইচ্ছা পূরন করতে মাঝে মধ্যে বৈরাগীরাও সংসারাগুনে ঝাপ দেয়।নিলেষের ক্ষেত্রেও এমন কিছুই হয়েছে। সর্বমোট তিনটা মেয়ে দেখা হয়েছে।এর মধ্যে দ্বিতীয় মেয়েটা বেস্ট ছিলো।কিন্ত সেই মেয়েকে নিলেষের পছন্দ হয় নি।তৃতীয় মেয়েকে নিলেষের পরিবারের অন্য কারোরই তেমনইন পছন্দ হয় নি।কিন্ত এই মেয়েটিকেই পছন্দ করে বসে আছে নিলেষ।পছন্দ মানে ঘোর তোর পছন্দ,মানে বিয়ে করলে এই মেয়েকেই,আর নয়তো না।পরিবারের সবাই, রাহুল নিকিতা সবাই কম বেশি বোঝানোর চেস্টা করা হলো,কিন্ত কাজ হয় নি।নিলেষ তার সিদ্ধান্তে অটল।রাহুল আর নিকিতাও হাল ছেড়ে দিলো,খানিকটা দীর্ঘশ্বাস ফেলে একে অপরের দিকে তাকিয়ে তারা বললো,”ভীমরুল যার,ভীমরুলের হুলও তারই!”
শনিবার ফ্লাইট নিকিতার।শুক্রবার রাতে নিলেষের বিয়ের আয়োজন করা হলো।যদিও এর জন্য নিলেষকে যথেষ্ঠ কাঠ খড় পোড়াতে হয়েছিলো।এক মাস পিছিয়ে আনা বিয়ের তারিখ তাও আবার হটাৎ করে কোন কারনে ছাড়াই।সত্যিই অনেক ঝামেলার ছিলো।কিন্ত নিকিতার চলে যাওয়া সকল ঝামেলার উর্ধে ছিলো।বিগত সাত আট বছর ধরে তারা তিন জন একসাথে।নিলেষের বিয়ে হবে রাহুল কিংবা নিকিতা এমনকি নিলেষ নিজেও ভাবে নি।এমন অনাকাঙ্ক্ষিত বিয়ে নিকিতা মিস করে যাবে সেটা কখনই নিলেষ,নিকিতা কিংবা রাহুল,এদের কেউই চায় নি।
হলুদ,বিয়ে সব কিছু ধুম ধামে কাটলো।বিয়ের সারারাত প্রচুর আড্ডা হলো।সে রাতে তিন জনের একজনও ঘুমায় নি।বিয়ের রাত স্বামী স্ত্রীর জন্য স্পেশাল,সেটা জানা সবারই।কিন্ত,নিলেষের জন্য যেন সে রাত ফিকে।তিন জনের এই আড্ডা আবার কমে জমে ঠিক নেই। নিলেষের নতুন বউ হয়তো রাগ করেছে।রাগ করাটা স্বাভাবিক।কিন্ত সে রাগ ভেঙে যাবে।পরদিন বিকেল চারটায় ফ্লাইট নিকিতাদের।ওখান থেকে ঢাকা যেতে পাচ ঘন্টা লাগে।তাই পরদিন সকাল সাড়ে আটটা-নয়টর ভেতর না বের হলে ফ্লাইট নির্ঘাত মিস করবে নিকিতা।
সারারাত তিন বন্ধু মিলে আড্ডা দিলো।পুরো বিয়ের আসর ফাকা।মাঝখানে পাতা একটা টেবিলের তিনকোনে তিনজন বসে বসে ক্রমাগত কথা বলেই যাচ্ছে।এদিকে সূর্যের আলো আস্তে আস্তে ফুটলো।প্রত্যেকটি ভোর আসে একরাশ আশা নিয়ে,সেদিনের ভোর এসেছিলো একরাশ হতাশা নিয়ে। রাহুল নিকিতাকে নিয়ে রিকশায় উঠে নিকিতাদের বাসার দিকে চললো।নিলেষের চোখ খানিকটা ভারী হয়ে আসলো।অনেকবার যেতে চাইলো নিলেষ।কিন্ত,রাহুল আর নিকিতা বাধা দিলো।নববিবাহিতো মানুষ,এভাবে গেলে বাজে দেখা যায়। সব কিছু আগে থেকেই প্যাক করা ছিলো নিকিতাদের।নিকিতা আর তার মা শেষ বারের মতো তাদের আশেপাশের প্রতিবেশীদের সাথে দেখা করে আসলো।আগে থেকে দাড়িয়ে থাকা টমটমে তাদের ব্যাগ প্যাকগুলোকে তোলা হলো।কিছুক্ষন পর এই টমটম সোজা চলে গেলো বাস স্টান্ডে।রাহুল দুটো টিকিট কাটলো।বাসের হেপলারের সহায়তায় উনাদের ব্যাগপ্যাকগুলোকে বাসের ডিক্কিতে তুললো।
বাসটা চলে গেলো।আর চলে গেলো সাত-আট বছর ধরে জমে থাকা কতগুলো স্মৃতি কে। বাসায় ফিরে এলো রাহুল।খুব খারাপ লাগছে শরীরটা।কাল রাতে ঘুম হয়নি তার। একটু ঘুমুতে হবে। ঘুম থেকে উঠে দেখে বিকাল সাড়ে তিনটা।মোবাইল হাতে নিয়ে দেখলো সর্বমোট উনিশটা মিস কল আর একটা মেসেজ।মেসেজ আর মিসড কল সবকিছুই নিলেষের ছিলো।সন্ধ্যায় তাদের বাসায় যেতে বললো রাহুলকে। রাহুল তাদের বাসায় গেলো সন্ধ্যার পর।সেখানে যেতেই নিলেষের বঊ মুড়িমাখা খেতে দিলো রাহুলকে।এক মুঠ মুড়ি মুখে দিলো রাহুল।চিবুতে চিবুতে নিলেষের দিকে তাকিয়ে বললো,”বাউন্ডুলে পনা অনেক হইছে,কি করবি এখন সেটা বল।বউ খাওয়ানো লাগবে তো তাই না?”
নিলেষের মুখেও মুড়ি ছিলো।সে মুড়ি গুলো চিবিয়ে গেলা শেষ করে রাহুলকে বললো,”ভাইয়া একটা নতুন দোকান কিনেছে চট্টগ্রামে।কালকে দুপুরের আগেই আমায় সেখানে যেতে বললো।দোকানটার দায়িত্ব আমার ওপর দিবে শুনলাম।আমি না করতে পারলাম না।বউ খাওয়াতে হবে তো নাকি।” রাহুলের মন ভেতরে ভেতরে খানিকটা খারাপ হলো।সে নিলেষকে বুঝতে না দিয়ে বললো,”তো যাবি কখন কাল।?” সে বললো,”বাবা তো ভোরের ট্রেনের টিকেট কাটতে গেলো কিছুক্ষন আগে,যদি পায় তবে ভোরেই যাবো।” রাহুল বললো,”আরেহ পাবি টিকেট।পাবি।” সেখানে আর থাকতে ইচ্ছে করলো না রাহুলের।কেমন যেন বিরক্তি লাগতে লাগলো।এ বিরক্তির কোন কারন নেই। নিলেষের সাথে শেষ বারের আলিঙ্গন করে বাসায় ফিরলো রাহুল।খুব বাজে লাগছে তার কাছে।ভাষায় অপ্রকাশযোগ্য যন্ত্রনা বোধ করছে সে।কি করবে বুঝতে পারছে না।
ছয় মাস পর, নিকিতার মায়ের শরীরটা ভালো নেই।নিকিতা অবশ্য ভালোই আছে।তার মামার এক ফ্রেন্ডের ছেলের সাথেই কিছুদিন আগে বিয়ে হয়েছে তার।নিলেষও খারাপ নেই।ব্যাবসাটা যদিও এখনো গুছিয়ে উঠতে পারে নি সে।তবে ক্রমান্বয়ে উন্নতির দিকে যাচ্ছে। আর রাহুল? সেও ভালো আছে।প্রতি দিন গল্প লিখছে।সেগুলো লিখে লিখে জমিয়ে রাখছে। গল্প ভালো না হলে ছিড়ে ফেলে দিচ্ছে।সেই ছিড়ে ফেলা পৃষ্ঠাগুলোরই একটা অংশ এই নিলেষ আর নিকিতা। বলা বাহুল্য,নিকিতা আর নিলেষ রাহুলেরই সৃষ্টি নয় তো? রাহুলের লিখা গল্প, নিকিতা আর রাহুল, প্রান পায় অল্প অল্প জীবন বহমান।জীবন ফড়িংয়ের নয়,বহতা নদীরও নয়।
গল্পের বিষয়:
গল্প