প্রবাসী জামসেদের স্ত্রী

প্রবাসী জামসেদের স্ত্রী
আমি ঘোষনা দিলাম, এই ছেলেকে ছাড়া আমি আর কাউকে বিয়ে করবো না। আমার কথা শুনে আব্বা খুব ভীষণ বেজার হলেন। তিনি মন খারাপ করে এশার নামাজ পড়তে গেলেন। যাওয়ার আগে আমাকে বলে গেলেন, তোমার যা ইচ্ছা করো। আমি এই বিষয়ে আর কিছু বলবো না।
দাদাভাই মানে বড় ভাই আমার উপর খুব ক্ষেপে আছেন। তার এক কথা, এই ছেলের সাথে আমার বিয়ে হলে তিনি কখনো মেনে নিবেন না। একটু পর পর দাদাভাই আমার রুমে এসে ঠিক এই একটা কথায় বলছেন, মিলি তুই কিন্তু ভীষণ ভুল করছিস। এই ভুলের মাসুল কিন্তু খুব খারাপ হবে। খুব খারাপ। তুই কিন্তু ভীষণ ভুল করছিস বললাম।
আমি দাদা ভাইয়ের কথা শুনে ফিক করে হেসে দিয়ে বললাম, দাদা ভাই তুমি চিন্তা করো না। ভুল হলে আমি আরেকটা বিয়ে করে নিব। আমার কথা শুনে দাদাভাই ভীষণ রেগে যান। রাগে চিৎকার চেঁচামেচি করতে করতে পুরো বাড়ি মাতিয়ে ফেললেন। তারপরও আমি আমার সিদ্ধান্তে অনড়। আমি এই জামসেদকে বিয়ে করবো। জামসেদ বসে আছে আমাদের বসার রুমে। প্রায় ঘন্টা দুয়েক হয়েছে। তাকে সল্টেজ বিস্কুট আর চা দেওয়া হয়েছে। জামসেদের সাথে আমার মেঝো মামাও আছেন। তারা দু’জন খুব আরাম করে সল্টেজ বিস্কুট চায়ে ভিজিয়ে ভিজিয়ে খাচ্ছেন। বিস্কুট ভেঙ্গে চায়ের ভেতর পড়েছে। মামা হাত দিয়ে সেই বিস্কুট তুলে তুলে খাচ্ছেন। মামার খাওয়া দেখে মনে হলো তিনি খুব মজা করে পাচ্ছেন এমন করে খেতে।
মেঝো মামা এই বিয়ের ঘটক। জামসেদের সাথে বিয়ের সম্বন্ধটা মেঝো মামা নিয়ে এসেছেন। মামার পরিচিত এই জামসেদ। দুইদিন আগেও এই বাড়ির সবার প্রিয় মানুষ মেঝো মামা হুট করে সবার অপ্রিয় হয়ে গেলেন।
জামসেদ ছেলেটার সাথে আমার প্রায় বিশ মিনিট কথা হয়েছে। বিশ্রী একটা পারফিউম গায়ে মেখেছেন তিনি। পারফিউমের গন্ধটা আমাদের পুরো বাড়িতে পাওয়া যাচ্ছে। এসেছে ফ্যাকাশে একটা জিন্স প্যান্ট আর কেডস পরে । তবে তাঁর গায়ের শার্টটা বেশ সুন্দর। কেডস আর জিন্স প্যান্টে যতটা খারাপ লাগছে, সেটা এই শার্ট দিয়ে মানিয়ে নিয়েছে। ছেলেটাকে দেখে আমার খুব হাসি পেল। বেশ জড়োসড়ো হয়ে বসে আছে। মনে হলো ভয় পাচ্ছে।
আমি আবার বেশিক্ষণ কথা না বলে থাকতে পারি না। কিছু একটা আমাকে বলতে হবেই। আমার এই মুখ নিয়ে আম্মার অভিযোগের শেষ নেই। আম্মা বলেন, তোর মুখে আল্লাহ কি কোন ব্যথা-ট্যথা দেয় নাই। সারাদিন কেমনে পারিস এত কথা বলতে?
জামসেদ চুপ করে আছে দেখে আমি জিজ্ঞেস করলাম, আমাকে কি কিছু জিজ্ঞেস করবেন? জামসেদ আমতা আমতা করত করতে বলল, না না, কিছু জিজ্ঞেস করবো না। আমি বুঝলাম জামসেদ ভয় বা লজ্জা পাচ্ছে। তখনও আমি নিশ্চিত ছিলাম এই ছেলের সাথে অবশ্যই আমার বিয়ে হচ্ছে না। ছেলেটাকে আমার পছন্দের কোন কারণ খুঁজে পাইনি। তাছাড়া বাড়ির সবাই জামসেদকে দেখে এক প্রকার সিদ্ধান্ত নিয়ে রেখেছে এই বিয়ে হচ্ছে না। শুধুমাত্র ভদ্রতার খাতিরে মেয়ে দেখানো হচ্ছে। আমাকেও সেভাবে বলা হয়েছে। এই কারণেই আমি খুব স্বাভাবিকভাবে তার সাথে কথা বলছি। ছেলেটার ভয় আর লজ্জা দেখে আমার খুব মজা লাগছে। আমি ইচ্ছে করেই জামসেদের সাথে খুব মজা করে নানা গল্প জুড়ে দিলাম। দেখলাম ছেলেটা আস্তে আস্তে স্বাভাবিক হচ্ছে।
খুব সহজভাবে জামসেদ বলা শুরু করল, আমি থাকি ওমান। সেখানে আমার ফলের ব্যবসা। দুই দুইটা ফলের দোকান। ওমান গিয়েছি দশ বছর আগে । ঠিক ইন্টারমিডিয়েট পাশের পর পর। ইন্টারমিডিয়েট পরীক্ষা শেষ হতেই হুট করে বাবা মারা গেলেন। রেজাল্ট তিনি দেখলেন না। ষ্টার পাওয়া রেজাল্ট। নানা স্বপ্ন নিয়ে দিনের পর দিন পরিশ্রমের ফসল এই ষ্টার মার্কস। হুট করে বাবা মারা যাওয়া, পরিবারের বড় ছেলে, অল্প সময়ের মাঝেই অভাবের সাথে পরিচয় হয়ে গেল।
সব মিলিয়ে নিজের ভেতর বিশাল একটা ভয়ের জগৎ তৈরী হয়ে গেল। সেই সময় ছোট চাচা ওমান নিয়ে গেলেন। যুদ্ধ তখন থেকেই শুরু। যুদ্ধ করতে করতে এখন এখানে এসে দাঁড়িয়েছি। যদিও অনেকটা গুছিয়ে ফেলেছি এখন। কিন্তু তা অনেক স্বপ্ন হারিয়ে। এক নাগাড়ে কথাগুলো বলে জামসেদ থামল। ছেলেটাকে আমি ভীষণ বোকা ভেবেছি। হয়তো আমার চঞ্চলতা বা স্বাভাবিকতা দেখে খুব আপন মনে তার কথাগুলো বলেছে। খুব অল্প বলেছে। হয়তো দশমিনিট। আমি মুগ্ধ হয়ে তাঁর দিকে তাকিয়ে আছি। জামসেদের কথা বলার সময় আমার একটুও কথা বলতে ইচ্ছে করেনি। এমনটা খুব কম হয়। আজ হয়েছে। আমি জামসেদের দিকে তাকিয়ে আছি। অল্প অল্প করে বলেছে। বলার সময় তাঁর মধ্যে তিল পরিমাণ লজ্জা, ভয় বা অস্বস্তি আমি দেখিনি। খুব স্বাভাবিক।
জামসেদের কথা শেষ হবার সাথে সাথে আমি সিদ্ধান্ত নিয়ে ফেলেছি আমি এই ছেলেকে বিয়ে করবো। কেন জানিনা। তবে, কী এক মায়া আমাকে মোহগ্রস্ত করে ফেলেছে। এটা সত্য যে এই মায়া অবশ্যই কোনো সহানুভূতি বা দয়া নয়। এটা অন্যকিছু। কী আশ্চর্য, যখনই আমি ভেবেছি জামসেদের সাথে আমার বিয়ে হবে অমনি আমার বেশ লজ্জা লাগতে শুরু করলো। আমি আর জামসেদের সাথে সহজ করে কথা বলতে পারছি না। বেশ লজ্জা লাগছে। আগের মত আমার মুখ দিয়ে ফটফট কথাও কেনজানি বেরুচ্ছে না। ভেতরের রুমে গিয়ে আমি জানিয়ে দিলাম এই ছেলে আমার পছন্দ হয়েছে। বিয়ে করলে আমি এই জামসেদকে করবো।
আমার পড়ালেখাও বেশ ভালো। ইংরেজীতে অনার্স শেষ হলো। মার্ষ্টাসে এখনো ভর্তি হয়নি। আমার দাদা ভাইয়ের ইচ্ছা খুব ভালো একজন চাকরিজীবির সাথে আমার বিয়ে দিবেন। বিসিএস-টিসিএস বোধহয় পছন্দ। দাদা ভাইয়ের সাথে বাড়ির সবারই একই মত। আমার কোন পছন্দ-টছন্দ ছিলো না। বাড়ির লোকজন দেখেশুনে ভালোমন্দ বিবেচনা করে দিলেই হয়। কিন্তু এখন আমার মত পাল্টেছে। আমি তো জামসেদকে বিয়ে করবো। জামসেদ আর মেঝো মামা বসার রুমে এখনো অপেক্ষা করছেন। বাইরে তুমুল বৃষ্টিপাত শুরু হয়েছে। এই বৃষ্টির জন্য তারা বেরুতেও পারছে না। বাড়ির মধ্যে কেমনজানি একটা অস্থিরতা শুরু হয়ে গেল। সবার এককথা, এই বিয়ে কিছুতেই হবে না। পড়ালেখা কম, প্রবাসী ছেলের কাছে বিয়ে দিতে কেউ রাজি হচ্ছে না। আম্মা ফুপিয়ে ফুপিয়ে কাঁদছেন।
তিনি মেঝো মামাকে ডেকে বেশ বকাঝকাও করলেন। আম্মা বললেন, হারামজাদা তোরে কি বলেছিলাম, এমন একটা পাত্র আমার মেয়ের জন্য নিয়ে আসতে? তুই আমার ভাই হয়ে এমন একটা কাজ করতে পারলি?
আম্মার কথা শুনে মেঝো মামা খুব লজ্জা পেয়েছেন। তিনি মন খারাপ করে বললেন, তোমরা মেয়ে বিয়ে, দিলে দিবে না দিলে দিবে না। ছেলে তো আর জোর করে মেয়ে নিতে আসেনি। তোমাদের এমন পেরেশান হওয়ার দরকার নাই। বৃষ্টি কমলে আমরা চলে যাচ্ছি। বৃষ্টির বেগ শুধু বাড়ছে। আব্বা নামাজ পড়ে এসে মন খারাপ করে নিজের রুমে বসে আছেন। দাদাভাই একটু পর পর এসে আমাকে বকাঝকা করে যাচ্ছেন। আমি বললাম, তুমি আমাকে এতকিছু না বলে কিছুক্ষণ ঐ রুমে গিয়ে ছেলেটার সাথে কথা বলো। দেখবে তোমার ভালো লাগবে। আমার কথা শুনে দাদাভাই আরো ক্ষেপে গেলেন। চিৎকার করে বলতে লাগলেন, মেয়েটার লজ্জা শরম সব শেষ হয়ে গেল। এই মেয়ের সাথে আমি আর কোনো কথা বলবো না।
রাত প্রায় দশটা। বৃষ্টি থামার কোন নাম গন্ধ নেই। এত বৃষ্টি কোথ্থেকে নামলো আল্লাহ মালুম। রাস্তা ঘাটের অবস্থা ভালো না দেখে মামারা বের হতেও পারছেন না। আব্বা ভদ্রতার খাতিরে বসার রুমে গিয়ে জামসেদ আর মেঝো মামার সাথে কথা বলছেন। কিছুক্ষণ পর দাদাভাইও গেলেন। আস্তে আস্তে তাদের মধ্যে কথা জমে উঠেছে। দাদাভাই জামসেদকে অনেককিছু জিজ্ঞেস করছেন। দুজনের মধ্যে বেশ কথাবার্তা হচ্ছে। দাদাভাই এখন বেশ স্বাভাবিক। ভেতরের রুম থেকে সেই কথাবার্তার টুকটাক আমরা শুনছি। কথার ফাঁকে আব্বা ভেতরের রুমে এসে মেঝো মামাদের জন্য রাতের খাবার রেডি করতে বলে গেলেন। আব্বার গলার সুর বেশ নরম। আব্বার বলে যাওয়ার কিছুক্ষণ পর দাদা ভাইও ভেতরের রুমে এসে ভালো করে খাবার দাবার তৈরী করতে বললেন। দাদাভাই আমার কাছে এসে বললেন, ছেলেটা আসলেই ভালো রে। পরিবারের হাল ধরতে গিয়ে পড়ালেখা করতে পারেনি। তবে তার মেধা বেশ। তোর মত গাধা না। পড়ালেখা তোর চেয়ে কম করলেও ছেলেটার মেধার জোর প্রচুর। তুই জানিস জামসেদ আমাকে কী বলেছে? আমি খুব আগ্রহ নিয়ে বললাম, কী?
দাদাভাই হাসতে হাসতে বললো, ছেলেটা কিছুক্ষণ চুপ করে থেকে বললো, আমি জানি এই বিয়েতে আপনাদের খুব অমত। এটাও জানি মিলি এই বিয়েতে রাজি এবং এই বিয়ের জন্য জোর করছে। আপনাদের কাছে আমার অনুরোধ, এই নিয়ে মিলির উপর বকাঝকা করার কোন দরকার নাই। মিলির বয়স কম। না বুঝে অনেককিছু বলছে। সত্যি তার জন্য আমার চেয়ে ভালো পাত্র প্রয়োজন। মিলি বেশ ভালো মেয়ে। আমি বললাম,তুমি কী বললে দাদাভাই? দাদাভাই বললো, তার কথা শুনে আমার খুব আগ্রহ জন্মালো। আমার খুব জানতে ইচ্ছে করলো আসলে ছেলেটার ভেতরের মানুষটা কেমন। তাই আমি বললাম, তবে তুমি কি নিজেকে ভাল পাত্র মনে করছো না? ছেলেটা চুপ করে আছে। আমিও চুপ। বেশ কিছুক্ষণ চুপ করে থাকার পর ছেলেটা বলল, নিজেকে ভালো বলার সাহস খুব কম মানুষের আছে। আমরা সব সময় দ্বিধায় থাকি। তাদের মধ্যে আমিও একজন। বিশ্বাস করেন আমি কখনো অবহেলা করে কোন কাজ করি না।
সবকিছু ভালোবেসে করি। মায়া দিয়ে করি। তারপরও মাঝে মাঝে আমি হেরে যাই। যখন হেরে যাই তখন নিজেকে খুব অসহায় লাগে। দিনের পর দিন পরিশ্রম করার পর হেরে যাওয়াটা নিজের ব্যর্থতা মনে হয়। তখন সাহস হারিয়ে ফেলি। এই সাহস হারানোর পর নিজেকে ভালো বলার ক্ষমতাটা কমে যায়। আজও হয়তো আমার হেরে যাওয়ার দিন। দাদাভাই বললো, জানিস মিলি, আমি খুব কম মানুষকে এতটা সুন্দর আর গুছিয়ে কথা বলতে শুনেছি। নিজের ভেতরের কথাগুলো কত সহজ আর সাবলিলভাবে বলে গেল ছেলেটা। তুই জানিস কথাগুলো বলতে গিয়ে ছেলেটার চোখ দুটি পানিতে টলমল করছিলো। বোধহয় তার কান্না পাচ্ছিলো। আমি জানিনা কেন, তার কথা শুনে আমার নিজরে ভেতরটা এক ধরণের অপরাধবোধ জেগে উঠলো। পড়ালেখা থামিয়ে দিনের পর দিন, বছরের পর বছর পরিশ্রম করে যে মানুষ নিজেকে সফল করেছে।
সমাজে নিজের একটা জায়গা তৈরী করেছে তাদের আমরা কতটা অসহায়ভাবে দেখি। প্রবাসী বলে কটুক্তি করি। এটা অন্যায়। জামসেদ ভীষণ মেধাবী আর ভালো ছাত্র ছিলো। ভালো ছিলো বলেই আজ তার জায়গা এত মজবুত। হয়তো সে পড়ালেখায় তোর চেয়ে কম কিন্তু মেধাবী বলে সেই কমতিটা নিজে নিজে পুষিয়ে নিয়েছে। জামসেদের কথা শুনে আমার এই উপলব্ধিটা বেশ ভালো করে হয়েছে যে, একাডেমিক শিক্ষা ছাড়াও একটা মানুষের শিক্ষা অর্জনের অনেককিছু আছে। যে অর্জনটা জামসেদ করেছে। দাদাভাইয়ের কথা শুনে আমার ভীষণ কান্না পাচ্ছে। কেন কান্না পাচ্ছে জানিনা। রাত আটটা থেকে জামসেদ আমাদের বাসায় বসে আছে। এতক্ষণ আমরা সবাই জানি এই বিয়ে হচ্ছে না।
জামসেদও জানে তাকে অযোগ্য করা হয়েছে পাত্র হিসেবে। জামসেদের সাথে কথা বলে এসে আমি বুঝতে পারি কতটা অসহায়ত্ব নিয়ে সে এতক্ষণ বসে আছে। অযোগ্য বিবেচিত হওয়ার পরও একটা মানুষের ভেতর কেমন হতে পারে তা খুব ভালো করে অনুমান করা যায়। হয়তো খারাপ আবহাওয়ার জন্য বেরুতে পারছে না। কিন্তু একটা মানুষের ভেতরের অবস্থা আমি বেশ ভালো করে বুঝতে পারছিলাম। বুঝতে পারছিলাম বলেই নিজের ভেতর আস্তে আস্তে একটা ভালোবাসা আর মায়া তৈরী হয়ে গেল। দাদাভাইয়ের কথা শুনে আমার সেই ভালোবাসা আর মায়াটা কান্না হয়ে গেল। আমি লুকিয়ে কাঁদছি। আমি নিজেও খুব অবাক হচ্ছি দুই ঘন্টা আগে দেখা এবং কথা বলা একটা মানুষের জন্য আমি লুকিয়ে কাঁদছি। নিজের কাছে ভীষণ লজ্জা লাগছে তারপরও কেনজানি আমি কান্না থামাতে পারছি না।
পরের শুক্রবার জামসেদের সাথে আমার বিয়ে হয়ে গেল। সেদিনও কেনজানি সন্ধ্যা অবধি বেশ বৃষ্টি হলো। আমি বউ সেজে বসে আছি। এদিকে বৃষ্টির জন্য বরযাত্রী আসতে অনেক দেরি হলো। জামসেদ জামাই সেজে ভিজে জুবুথুবু হয়ে এসেছে। তাকে দেখে আমার খুব হাসি পেল। সেই বিয়ের আয়োজন শেষ হতে হতে সন্ধ্যা হয়ে গেল।
আমি আর জামসেদ দাঁড়িয়ে আছি আমাদের দোতলা বাড়ি ছাদে। এই ছাদে যাওয়ার সিঁড়িটা আলাদা করে লাগানো। লোহার সিঁড়ি। আমি জোর করে জামসেদকে ছাদে নিয়ে আসলাম। এই ছাদে আমার প্রিয় একটা গাছ আছে। হাসনাহেনা। টবে লাগানো। বিশাল বড় টব। এই টবে একটা ডালিম গাছ ছিলো। সেটা মরে যাওয়ার পর আমি এই হাসনাহেনার গাছটা লাগিয়েছি। গাছটায় এত ফুল হয়েছে যে, ফুলের ভারে ডালগুলো নুইয়ে পড়েছে।
বৃষ্টি থামার পর আকাশটা একেবারে পরিস্কার। কোন মেঘ নেই। আজ জোছনাও বেশ। মনে হচ্ছে আজ পূর্ণিমা। ছাদ থেকে চারিদিক সবকিছু পরিস্কার দেখা যাচ্ছে। আমি আর জামসেদ দাঁড়িয়ে আছি হাসনাহেনা গাছটার সামনে। আমি কিছুই বলিনি তারপরও জামসেদ বললো, এই গাছ বুঝি তুমি লাগিয়েছো? আমি মাথা নাড়লাম। জামসেদ বললো, আমার ভীষণ প্রিয় ফুল। আমি যখন স্কুলে পড়ি তখন আমাদের বাসার সামনে লাগিয়েছিলাম। বেশ বড়োসড়ো হয়েছিলো। বিদেশ থেকে আসার পর দেখি গাছটা নেই। সেদিন খুব কষ্ট পেয়েছিলাম। আমি অনেককিছু হারিয়েছি। কত স্বপ্ন, কত চাওয়া পাওয়া। অনেককিছু।
জোছনার আলোয় জামসেদের মুখ ঠিক ষ্পষ্ট দেখা যাচ্ছিলো। সে আমার কাছ থেকে মুখটা ঘুরিয়ে উল্টো দিকে তাকিয়ে আবার বলা শুরু করলো, যেদিন আমি দেশ ছেড়ে ওমান যাচ্ছিলাম তখন অনেক কেঁদেছি। খুব পড়ালেখা করতে ইচ্ছে করছিলো। জানো, আমার কেমিস্ট্রি পরীক্ষার দিন একশ তিন ডিগ্রী জ্বর ছিলো। আম্মা বললেন পরীক্ষা দেওয়ার দরকার নেই। এই শরীরে পরীক্ষা দিতে পারবি না। তারপরও আমি জোর করে পরীক্ষা দিয়েছি। আমার মনে হয়েছে পরীক্ষা দিতে না পারলে আমি বোধহয় বাঁচব না। আমার যে ইঞ্জিনিয়ারিং পড়ার খুব শখ। যখনই মনে হচ্ছিলো আমার সেই শখ শেষ হতে চলেছে তখন আমি ঐ জ্বর নিয়ে পরীক্ষার দিতে গেলাম।
সময় অনেক পেরিয়েছে। যেদিন পড়ালেখা ছেড়ে ওমান যাচ্ছিলাম সেদিন মনে হচ্ছিলো কোথাও পালিয়ে যায়। কিন্তু আমিতো পালাতে পারি না। সেই জায়গা আমার নেই। ওমান গিয়ে দিনের পর দিন পরিশ্রম করেছি। এখনো করি। আমার পড়ালেখা হয়নি তারপরও আমি স্বপ্ন দেখতাম এমন একটা মানুষকে আমি কাছে পাবো যে পড়ালেখায় বেশ ভালো। কেন জানিনা, অনেকে আমাকে অবহেলা করেছে। প্রত্যাখান করেছে। প্রবাসী বলে কটুক্তি করেছে। বিশ্বাস করো মিলি, আমি নিজেকে কখনো অবহেলা করিনি। নিজেকে অবহেলা করার সাহস আমার কখনো হয়নি। নিজের পরিবারকে আগলে রাখতে হলে নিজেকে কখনো অবহেলা করা যায় না। এতে নিজের পরিবারই অবহেলিত হয়।
জামসেদের শেষের কথাগুলোতে কেমনজানি তার গলাটা ভারী শোনালো। আমি উল্টো ঘুরে থাকা জামসেদের সামনে গিয়ে দাঁড়ালাম। হ্যাঁ, জামসেদ কাঁদছে। পুরুষ মানুষ কাঁদলে আমার সব সময় বিশ্রী আর অসহ্য লাগে। আজ লাগছে না। আজ মনে হচ্ছে জামসেদের কান্নাটা ভীষণ জরুরী। এই কান্নাটার জন্য জামসেদ দিনের পর দিন অপেক্ষা করেছে। সবার নিজের একটা জায়গা লাগে। একান্ত নিজের অনুভূতিগুলো জমিয়ে রাখার জায়গা। আজ হয়তো জামসেদ সেই জায়গাটা পেয়েছে বলে বিশ্বাস করছে। আমি জামসেদের একটা হাত মুঠো করে ধরলাম। আমার কিছু বলতে ইচ্ছে করছে না। আমারো কান্না পাচ্ছে। আমি জামসেদের মত কাঁদতে চাই না। আমি সত্যি সত্যি জামসেদের মত করে কাঁদছি। তারপরও আমার ভীষণ ভালো লাগছে। কারণ, এখন আমি প্রবাসী জামসেদের স্ত্রী।
—প্রবাসী জামসেদের স্ত্রী
——রুহুল আমিন
[পেন্সিল পাবলিকেশনস থেকে বইমেলা ২০২০ এ প্রকাশিত আমার গল্পগ্রন্থ ‘মধ্যবিত্ত’ পাওয়া যাচ্ছে রকমারি তে। ঘরে বসে ‘মধ্যবিত্ত’ সংগ্রহ করতে চাইলে রকমারি তে অর্ডার করতে পারেন খুব সহজে। এছাড়া আরো পাওয়া যাচ্ছে জনপ্রিয় দেশীয় ব্রান্ড কে-ক্রাফট এর শো-রুমে]আমি ঘোষনা দিলাম, এই ছেলেকে ছাড়া আমি আর কাউকে বিয়ে করবো না। আমার কথা শুনে আব্বা খুব ভীষণ বেজার হলেন। তিনি মন খারাপ করে এশার নামাজ পড়তে গেলেন। যাওয়ার আগে আমাকে বলে গেলেন, তোমার যা ইচ্ছা করো। আমি এই বিষয়ে আর কিছু বলবো না। দাদাভাই মানে বড় ভাই আমার উপর খুব ক্ষেপে আছেন। তার এক কথা, এই ছেলের সাথে আমার বিয়ে হলে তিনি কখনো মেনে নিবেন না। একটু পর পর দাদাভাই আমার রুমে এসে ঠিক এই একটা কথায় বলছেন, মিলি তুই কিন্তু ভীষণ ভুল করছিস। এই ভুলের মাসুল কিন্তু খুব খারাপ হবে। খুব খারাপ।
তুই কিন্তু ভীষণ ভুল করছিস বললাম। আমি দাদা ভাইয়ের কথা শুনে ফিক করে হেসে দিয়ে বললাম, দাদা ভাই তুমি চিন্তা করো না। ভুল হলে আমি আরেকটা বিয়ে করে নিব। আমার কথা শুনে দাদাভাই ভীষণ রেগে যান। রাগে চিৎকার চেঁচামেচি করতে করতে পুরো বাড়ি মাতিয়ে ফেললেন। তারপরও আমি আমার সিদ্ধান্তে অনড়। আমি এই জামসেদকে বিয়ে করবো। জামসেদ বসে আছে আমাদের বসার রুমে। প্রায় ঘন্টা দুয়েক হয়েছে। তাকে সল্টেজ বিস্কুট আর চা দেওয়া হয়েছে। জামসেদের সাথে আমার মেঝো মামাও আছেন। তারা দু’জন খুব আরাম করে সল্টেজ বিস্কুট চায়ে ভিজিয়ে ভিজিয়ে খাচ্ছেন। বিস্কুট ভেঙ্গে চায়ের ভেতর পড়েছে। মামা হাত দিয়ে সেই বিস্কুট তুলে তুলে খাচ্ছেন। মামার খাওয়া দেখে মনে হলো তিনি খুব মজা করে পাচ্ছেন এমন করে খেতে।
মেঝো মামা এই বিয়ের ঘটক। জামসেদের সাথে বিয়ের সম্বন্ধটা মেঝো মামা নিয়ে এসেছেন। মামার পরিচিত এই জামসেদ। দুইদিন আগেও এই বাড়ির সবার প্রিয় মানুষ মেঝো মামা হুট করে সবার অপ্রিয় হয়ে গেলেন।
জামসেদ ছেলেটার সাথে আমার প্রায় বিশ মিনিট কথা হয়েছে। বিশ্রী একটা পারফিউম গায়ে মেখেছেন তিনি। পারফিউমের গন্ধটা আমাদের পুরো বাড়িতে পাওয়া যাচ্ছে। এসেছে ফ্যাকাশে একটা জিন্স প্যান্ট আর কেডস পরে । তবে তাঁর গায়ের শার্টটা বেশ সুন্দর। কেডস আর জিন্স প্যান্টে যতটা খারাপ লাগছে, সেটা এই শার্ট দিয়ে মানিয়ে নিয়েছে। ছেলেটাকে দেখে আমার খুব হাসি পেল। বেশ জড়োসড়ো হয়ে বসে আছে। মনে হলো ভয় পাচ্ছে।
আমি আবার বেশিক্ষণ কথা না বলে থাকতে পারি না। কিছু একটা আমাকে বলতে হবেই। আমার এই মুখ নিয়ে আম্মার অভিযোগের শেষ নেই। আম্মা বলেন, তোর মুখে আল্লাহ কি কোন ব্যথা-ট্যথা দেয় নাই। সারাদিন কেমনে পারিস এত কথা বলতে?
জামসেদ চুপ করে আছে দেখে আমি জিজ্ঞেস করলাম, আমাকে কি কিছু জিজ্ঞেস করবেন? জামসেদ আমতা আমতা করত করতে বলল, না না, কিছু জিজ্ঞেস করবো না। আমি বুঝলাম জামসেদ ভয় বা লজ্জা পাচ্ছে। তখনও আমি নিশ্চিত ছিলাম এই ছেলের সাথে অবশ্যই আমার বিয়ে হচ্ছে না। ছেলেটাকে আমার পছন্দের কোন কারণ খুঁজে পাইনি। তাছাড়া বাড়ির সবাই জামসেদকে দেখে এক প্রকার সিদ্ধান্ত নিয়ে রেখেছে এই বিয়ে হচ্ছে না। শুধুমাত্র ভদ্রতার খাতিরে মেয়ে দেখানো হচ্ছে। আমাকেও সেভাবে বলা হয়েছে। এই কারণেই আমি খুব স্বাভাবিকভাবে তার সাথে কথা বলছি। ছেলেটার ভয় আর লজ্জা দেখে আমার খুব মজা লাগছে। আমি ইচ্ছে করেই জামসেদের সাথে খুব মজা করে নানা গল্প জুড়ে দিলাম। দেখলাম ছেলেটা আস্তে আস্তে স্বাভাবিক হচ্ছে।
খুব সহজভাবে জামসেদ বলা শুরু করল, আমি থাকি ওমান। সেখানে আমার ফলের ব্যবসা। দুই দুইটা ফলের দোকান। ওমান গিয়েছি দশ বছর আগে । ঠিক ইন্টারমিডিয়েট পাশের পর পর। ইন্টারমিডিয়েট পরীক্ষা শেষ হতেই হুট করে বাবা মারা গেলেন। রেজাল্ট তিনি দেখলেন না। ষ্টার পাওয়া রেজাল্ট। নানা স্বপ্ন নিয়ে দিনের পর দিন পরিশ্রমের ফসল এই ষ্টার মার্কস। হুট করে বাবা মারা যাওয়া, পরিবারের বড় ছেলে, অল্প সময়ের মাঝেই অভাবের সাথে পরিচয় হয়ে গেল। সব মিলিয়ে নিজের ভেতর বিশাল একটা ভয়ের জগৎ তৈরী হয়ে গেল। সেই সময় ছোট চাচা ওমান নিয়ে গেলেন। যুদ্ধ তখন থেকেই শুরু। যুদ্ধ করতে করতে এখন এখানে এসে দাঁড়িয়েছি। যদিও অনেকটা গুছিয়ে ফেলেছি এখন। কিন্তু তা অনেক স্বপ্ন হারিয়ে।
এক নাগাড়ে কথাগুলো বলে জামসেদ থামল। ছেলেটাকে আমি ভীষণ বোকা ভেবেছি। হয়তো আমার চঞ্চলতা বা স্বাভাবিকতা দেখে খুব আপন মনে তার কথাগুলো বলেছে। খুব অল্প বলেছে। হয়তো দশমিনিট। আমি মুগ্ধ হয়ে তাঁর দিকে তাকিয়ে আছি। জামসেদের কথা বলার সময় আমার একটুও কথা বলতে ইচ্ছে করেনি। এমনটা খুব কম হয়। আজ হয়েছে। আমি জামসেদের দিকে তাকিয়ে আছি। অল্প অল্প করে বলেছে। বলার সময় তাঁর মধ্যে তিল পরিমাণ লজ্জা, ভয় বা অস্বস্তি আমি দেখিনি। খুব স্বাভাবিক। জামসেদের কথা শেষ হবার সাথে সাথে আমি সিদ্ধান্ত নিয়ে ফেলেছি আমি এই ছেলেকে বিয়ে করবো। কেন জানিনা। তবে, কী এক মায়া আমাকে মোহগ্রস্ত করে ফেলেছে। এটা সত্য যে এই মায়া অবশ্যই কোনো সহানুভূতি বা দয়া নয়। এটা অন্যকিছু। কী আশ্চর্য, যখনই আমি ভেবেছি জামসেদের সাথে আমার বিয়ে হবে অমনি আমার বেশ লজ্জা লাগতে শুরু করলো। আমি আর জামসেদের সাথে সহজ করে কথা বলতে পারছি না। বেশ লজ্জা লাগছে। আগের মত আমার মুখ দিয়ে ফটফট কথাও কেনজানি বেরুচ্ছে না। ভেতরের রুমে গিয়ে আমি জানিয়ে দিলাম এই ছেলে আমার পছন্দ হয়েছে। বিয়ে করলে আমি এই জামসেদকে করবো।
আমার পড়ালেখাও বেশ ভালো। ইংরেজীতে অনার্স শেষ হলো। মার্ষ্টাসে এখনো ভর্তি হয়নি। আমার দাদা ভাইয়ের ইচ্ছা খুব ভালো একজন চাকরিজীবির সাথে আমার বিয়ে দিবেন। বিসিএস-টিসিএস বোধহয় পছন্দ। দাদা ভাইয়ের সাথে বাড়ির সবারই একই মত। আমার কোন পছন্দ-টছন্দ ছিলো না। বাড়ির লোকজন দেখেশুনে ভালোমন্দ বিবেচনা করে দিলেই হয়। কিন্তু এখন আমার মত পাল্টেছে। আমি তো জামসেদকে বিয়ে করবো। জামসেদ আর মেঝো মামা বসার রুমে এখনো অপেক্ষা করছেন। বাইরে তুমুল বৃষ্টিপাত শুরু হয়েছে। এই বৃষ্টির জন্য তারা বেরুতেও পারছে না। বাড়ির মধ্যে কেমনজানি একটা অস্থিরতা শুরু হয়ে গেল। সবার এককথা, এই বিয়ে কিছুতেই হবে না। পড়ালেখা কম, প্রবাসী ছেলের কাছে বিয়ে দিতে কেউ রাজি হচ্ছে না। আম্মা ফুপিয়ে ফুপিয়ে কাঁদছেন।
তিনি মেঝো মামাকে ডেকে বেশ বকাঝকাও করলেন। আম্মা বললেন, হারামজাদা তোরে কি বলেছিলাম, এমন একটা পাত্র আমার মেয়ের জন্য নিয়ে আসতে? তুই আমার ভাই হয়ে এমন একটা কাজ করতে পারলি?
আম্মার কথা শুনে মেঝো মামা খুব লজ্জা পেয়েছেন। তিনি মন খারাপ করে বললেন, তোমরা মেয়ে বিয়ে, দিলে দিবে না দিলে দিবে না। ছেলে তো আর জোর করে মেয়ে নিতে আসেনি। তোমাদের এমন পেরেশান হওয়ার দরকার নাই। বৃষ্টি কমলে আমরা চলে যাচ্ছি। বৃষ্টির বেগ শুধু বাড়ছে। আব্বা নামাজ পড়ে এসে মন খারাপ করে নিজের রুমে বসে আছেন। দাদাভাই একটু পর পর এসে আমাকে বকাঝকা করে যাচ্ছেন। আমি বললাম, তুমি আমাকে এতকিছু না বলে কিছুক্ষণ ঐ রুমে গিয়ে ছেলেটার সাথে কথা বলো। দেখবে তোমার ভালো লাগবে। আমার কথা শুনে দাদাভাই আরো ক্ষেপে গেলেন। চিৎকার করে বলতে লাগলেন, মেয়েটার লজ্জা শরম সব শেষ হয়ে গেল। এই মেয়ের সাথে আমি আর কোনো কথা বলবো না।
রাত প্রায় দশটা। বৃষ্টি থামার কোন নাম গন্ধ নেই। এত বৃষ্টি কোথ্থেকে নামলো আল্লাহ মালুম। রাস্তা ঘাটের অবস্থা ভালো না দেখে মামারা বের হতেও পারছেন না। আব্বা ভদ্রতার খাতিরে বসার রুমে গিয়ে জামসেদ আর মেঝো মামার সাথে কথা বলছেন। কিছুক্ষণ পর দাদাভাইও গেলেন। আস্তে আস্তে তাদের মধ্যে কথা জমে উঠেছে। দাদাভাই জামসেদকে অনেককিছু জিজ্ঞেস করছেন। দুজনের মধ্যে বেশ কথাবার্তা হচ্ছে। দাদাভাই এখন বেশ স্বাভাবিক। ভেতরের রুম থেকে সেই কথাবার্তার টুকটাক আমরা শুনছি। কথার ফাঁকে আব্বা ভেতরের রুমে এসে মেঝো মামাদের জন্য রাতের খাবার রেডি করতে বলে গেলেন। আব্বার গলার সুর বেশ নরম। আব্বার বলে যাওয়ার কিছুক্ষণ পর দাদা ভাইও ভেতরের রুমে এসে ভালো করে খাবার দাবার তৈরী করতে বললেন। দাদাভাই আমার কাছে এসে বললেন, ছেলেটা আসলেই ভালো রে।
পরিবারের হাল ধরতে গিয়ে পড়ালেখা করতে পারেনি। তবে তার মেধা বেশ। তোর মত গাধা না। পড়ালেখা তোর চেয়ে কম করলেও ছেলেটার মেধার জোর প্রচুর। তুই জানিস জামসেদ আমাকে কী বলেছে? আমি খুব আগ্রহ নিয়ে বললাম, কী? দাদাভাই হাসতে হাসতে বললো, ছেলেটা কিছুক্ষণ চুপ করে থেকে বললো, আমি জানি এই বিয়েতে আপনাদের খুব অমত। এটাও জানি মিলি এই বিয়েতে রাজি এবং এই বিয়ের জন্য জোর করছে। আপনাদের কাছে আমার অনুরোধ, এই নিয়ে মিলির উপর বকাঝকা করার কোন দরকার নাই। মিলির বয়স কম। না বুঝে অনেককিছু বলছে। সত্যি তার জন্য আমার চেয়ে ভালো পাত্র প্রয়োজন। মিলি বেশ ভালো মেয়ে। আমি বললাম,তুমি কী বললে দাদাভাই? দাদাভাই বললো, তার কথা শুনে আমার খুব আগ্রহ জন্মালো। আমার খুব জানতে ইচ্ছে করলো আসলে ছেলেটার ভেতরের মানুষটা কেমন। তাই আমি বললাম, তবে তুমি কি নিজেকে ভাল পাত্র মনে করছো না?
ছেলেটা চুপ করে আছে। আমিও চুপ। বেশ কিছুক্ষণ চুপ করে থাকার পর ছেলেটা বলল, নিজেকে ভালো বলার সাহস খুব কম মানুষের আছে। আমরা সব সময় দ্বিধায় থাকি। তাদের মধ্যে আমিও একজন। বিশ্বাস করেন আমি কখনো অবহেলা করে কোন কাজ করি না। সবকিছু ভালোবেসে করি। মায়া দিয়ে করি। তারপরও মাঝে মাঝে আমি হেরে যাই। যখন হেরে যাই তখন নিজেকে খুব অসহায় লাগে। দিনের পর দিন পরিশ্রম করার পর হেরে যাওয়াটা নিজের ব্যর্থতা মনে হয়। তখন সাহস হারিয়ে ফেলি। এই সাহস হারানোর পর নিজেকে ভালো বলার ক্ষমতাটা কমে যায়। আজও হয়তো আমার হেরে যাওয়ার দিন। দাদাভাই বললো, জানিস মিলি, আমি খুব কম মানুষকে এতটা সুন্দর আর গুছিয়ে কথা বলতে শুনেছি। নিজের ভেতরের কথাগুলো কত সহজ আর সাবলিলভাবে বলে গেল ছেলেটা। তুই জানিস কথাগুলো বলতে গিয়ে ছেলেটার চোখ দুটি পানিতে টলমল করছিলো। বোধহয় তার কান্না পাচ্ছিলো। আমি জানিনা কেন, তার কথা শুনে আমার নিজরে ভেতরটা এক ধরণের অপরাধবোধ জেগে উঠলো। পড়ালেখা থামিয়ে দিনের পর দিন, বছরের পর বছর পরিশ্রম করে যে মানুষ নিজেকে সফল করেছে।
সমাজে নিজের একটা জায়গা তৈরী করেছে তাদের আমরা কতটা অসহায়ভাবে দেখি। প্রবাসী বলে কটুক্তি করি। এটা অন্যায়। জামসেদ ভীষণ মেধাবী আর ভালো ছাত্র ছিলো। ভালো ছিলো বলেই আজ তার জায়গা এত মজবুত। হয়তো সে পড়ালেখায় তোর চেয়ে কম কিন্তু মেধাবী বলে সেই কমতিটা নিজে নিজে পুষিয়ে নিয়েছে। জামসেদের কথা শুনে আমার এই উপলব্ধিটা বেশ ভালো করে হয়েছে যে, একাডেমিক শিক্ষা ছাড়াও একটা মানুষের শিক্ষা অর্জনের অনেককিছু আছে। যে অর্জনটা জামসেদ করেছে। দাদাভাইয়ের কথা শুনে আমার ভীষণ কান্না পাচ্ছে। কেন কান্না পাচ্ছে জানিনা। রাত আটটা থেকে জামসেদ আমাদের বাসায় বসে আছে। এতক্ষণ আমরা সবাই জানি এই বিয়ে হচ্ছে না। জামসেদও জানে তাকে অযোগ্য করা হয়েছে পাত্র হিসেবে। জামসেদের সাথে কথা বলে এসে আমি বুঝতে পারি কতটা অসহায়ত্ব নিয়ে সে এতক্ষণ বসে আছে।
অযোগ্য বিবেচিত হওয়ার পরও একটা মানুষের ভেতর কেমন হতে পারে তা খুব ভালো করে অনুমান করা যায়। হয়তো খারাপ আবহাওয়ার জন্য বেরুতে পারছে না। কিন্তু একটা মানুষের ভেতরের অবস্থা আমি বেশ ভালো করে বুঝতে পারছিলাম। বুঝতে পারছিলাম বলেই নিজের ভেতর আস্তে আস্তে একটা ভালোবাসা আর মায়া তৈরী হয়ে গেল। দাদাভাইয়ের কথা শুনে আমার সেই ভালোবাসা আর মায়াটা কান্না হয়ে গেল। আমি লুকিয়ে কাঁদছি। আমি নিজেও খুব অবাক হচ্ছি দুই ঘন্টা আগে দেখা এবং কথা বলা একটা মানুষের জন্য আমি লুকিয়ে কাঁদছি। নিজের কাছে ভীষণ লজ্জা লাগছে তারপরও কেনজানি আমি কান্না থামাতে পারছি না। পরের শুক্রবার জামসেদের সাথে আমার বিয়ে হয়ে গেল। সেদিনও কেনজানি সন্ধ্যা অবধি বেশ বৃষ্টি হলো। আমি বউ সেজে বসে আছি। এদিকে বৃষ্টির জন্য বরযাত্রী আসতে অনেক দেরি হলো। জামসেদ জামাই সেজে ভিজে জুবুথুবু হয়ে এসেছে। তাকে দেখে আমার খুব হাসি পেল।
সেই বিয়ের আয়োজন শেষ হতে হতে সন্ধ্যা হয়ে গেল। আমি আর জামসেদ দাঁড়িয়ে আছি আমাদের দোতলা বাড়ি ছাদে। এই ছাদে যাওয়ার সিঁড়িটা আলাদা করে লাগানো। লোহার সিঁড়ি। আমি জোর করে জামসেদকে ছাদে নিয়ে আসলাম। এই ছাদে আমার প্রিয় একটা গাছ আছে। হাসনাহেনা। টবে লাগানো। বিশাল বড় টব। এই টবে একটা ডালিম গাছ ছিলো। সেটা মরে যাওয়ার পর আমি এই হাসনাহেনার গাছটা লাগিয়েছি। গাছটায় এত ফুল হয়েছে যে, ফুলের ভারে ডালগুলো নুইয়ে পড়েছে। বৃষ্টি থামার পর আকাশটা একেবারে পরিস্কার। কোন মেঘ নেই। আজ জোছনাও বেশ। মনে হচ্ছে আজ পূর্ণিমা। ছাদ থেকে চারিদিক সবকিছু পরিস্কার দেখা যাচ্ছে। আমি আর জামসেদ দাঁড়িয়ে আছি হাসনাহেনা গাছটার সামনে। আমি কিছুই বলিনি তারপরও জামসেদ বললো, এই গাছ বুঝি তুমি লাগিয়েছো? আমি মাথা নাড়লাম।
জামসেদ বললো, আমার ভীষণ প্রিয় ফুল। আমি যখন স্কুলে পড়ি তখন আমাদের বাসার সামনে লাগিয়েছিলাম। বেশ বড়োসড়ো হয়েছিলো। বিদেশ থেকে আসার পর দেখি গাছটা নেই। সেদিন খুব কষ্ট পেয়েছিলাম। আমি অনেককিছু হারিয়েছি। কত স্বপ্ন, কত চাওয়া পাওয়া। অনেককিছু। জোছনার আলোয় জামসেদের মুখ ঠিক ষ্পষ্ট দেখা যাচ্ছিলো। সে আমার কাছ থেকে মুখটা ঘুরিয়ে উল্টো দিকে তাকিয়ে আবার বলা শুরু করলো, যেদিন আমি দেশ ছেড়ে ওমান যাচ্ছিলাম তখন অনেক কেঁদেছি। খুব পড়ালেখা করতে ইচ্ছে করছিলো। জানো, আমার কেমিস্ট্রি পরীক্ষার দিন একশ তিন ডিগ্রী জ্বর ছিলো। আম্মা বললেন পরীক্ষা দেওয়ার দরকার নেই। এই শরীরে পরীক্ষা দিতে পারবি না। তারপরও আমি জোর করে পরীক্ষা দিয়েছি। আমার মনে হয়েছে পরীক্ষা দিতে না পারলে আমি বোধহয় বাঁচব না। আমার যে ইঞ্জিনিয়ারিং পড়ার খুব শখ। যখনই মনে হচ্ছিলো আমার সেই শখ শেষ হতে চলেছে তখন আমি ঐ জ্বর নিয়ে পরীক্ষার দিতে গেলাম।
সময় অনেক পেরিয়েছে। যেদিন পড়ালেখা ছেড়ে ওমান যাচ্ছিলাম সেদিন মনে হচ্ছিলো কোথাও পালিয়ে যায়। কিন্তু আমিতো পালাতে পারি না। সেই জায়গা আমার নেই। ওমান গিয়ে দিনের পর দিন পরিশ্রম করেছি। এখনো করি। আমার পড়ালেখা হয়নি তারপরও আমি স্বপ্ন দেখতাম এমন একটা মানুষকে আমি কাছে পাবো যে পড়ালেখায় বেশ ভালো। কেন জানিনা, অনেকে আমাকে অবহেলা করেছে। প্রত্যাখান করেছে। প্রবাসী বলে কটুক্তি করেছে। বিশ্বাস করো মিলি, আমি নিজেকে কখনো অবহেলা করিনি। নিজেকে অবহেলা করার সাহস আমার কখনো হয়নি। নিজের পরিবারকে আগলে রাখতে হলে নিজেকে কখনো অবহেলা করা যায় না। এতে নিজের পরিবারই অবহেলিত হয়।
জামসেদের শেষের কথাগুলোতে কেমনজানি তার গলাটা ভারী শোনালো। আমি উল্টো ঘুরে থাকা জামসেদের সামনে গিয়ে দাঁড়ালাম। হ্যাঁ, জামসেদ কাঁদছে। পুরুষ মানুষ কাঁদলে আমার সব সময় বিশ্রী আর অসহ্য লাগে।
আজ লাগছে না। আজ মনে হচ্ছে জামসেদের কান্নাটা ভীষণ জরুরী। এই কান্নাটার জন্য জামসেদ দিনের পর দিন অপেক্ষা করেছে। সবার নিজের একটা জায়গা লাগে। একান্ত নিজের অনুভূতিগুলো জমিয়ে রাখার জায়গা। আজ হয়তো জামসেদ সেই জায়গাটা পেয়েছে বলে বিশ্বাস করছে। আমি জামসেদের একটা হাত মুঠো করে ধরলাম। আমার কিছু বলতে ইচ্ছে করছে না। আমারো কান্না পাচ্ছে। আমি জামসেদের মত কাঁদতে চাই না। আমি সত্যি সত্যি জামসেদের মত করে কাঁদছি। তারপরও আমার ভীষণ ভালো লাগছে। কারণ, এখন আমি প্রবাসী জামসেদের স্ত্রী।
গল্পের বিষয়:
গল্প
DMCA.com Protection Status
loading...

Share This Post

সর্বাধিক পঠিত