প্রতিদান

প্রতিদান
সকালে শ্বাশুড়ি মা কে নিজের রুমে দেখতে পেয়ে বেশ অবাক হলাম। বিয়ের ছয়মাস চলছে অথচ একদিন অনেক ডাকাডাকির পরেও রুমে নিয়ে আসতে পারেনি। আজ আমার অসুখের কথা শুনে এসেছেন বলে মনেমনে খুশিও হলাম।আসলে অসুস্থ হওয়ার পর থেকে মায়ের কথা খুব মনপড়ছিলো,অন্তত মা’কে মিস করাটা একটু হলেও কমবে।কিন্ত শ্বাশুড়ি মা আমার সে খুশি বেশিক্ষণ থাকতে দিলো না। আমি ওনাকে আসতে দেখে বললাম, বাইরে দাড়িয়ে কেন মা? ভিতরে এসে বসেন। শ্বাশুড়ি মা তখন বললেন, কি বসব বউমা?তোমার না-কি সর্দিকাশি, জ্বর সব একসাথে বাধিয়েছে।তোমার ঘরে জীবাণুর ছড়াছড়ি।আমি তো শুধু তোমাকে সাবধান করতে এসেছি,একটু কষ্ট হলেও ঘর থেকে বেরোয়না, ঘরের বাকি লোকদের কথা একটু ভাবিও। উনার এমন কথায় একটু আঘাত ফেলেও সামলে বললাম, আচ্ছা মা,সাবধানে থাকবো।বেরোবো না।
–আমার কথা মানলে বেশ ভালো বউমা,তবে বলছি কি তোমার ঐসব তো দেখে মনে হচ্ছে করোনার লক্ষণ। বলছি,তোমার যদি করোনা হয়ে থাকে তাহলে খামাখা আমাদেরো হবে।তুমি বরং তোমার বাবার বাড়ি চলে যাও।হাসপাতালে গিয়ে পরীক্ষা দাও, সুস্থ হয়ে ফিরে এসো। শ্বাশুড়ি মায়ের সাথে অমত পোষণ করা সাহসে আর কোলালোনা।বাধ্য হয়ে অসুস্থ শরীর নিয়ে বাপের বাড়ি ফিরতে হলো। হাসপাতালে গিয়ে করোনার টেস্ট দিলেও আসলো নেগেটিভ। দুই দিনের মাথায় আমি সুস্থ হয়ে উঠলাম। ভাবলাম শ্বশুর বাড়িতে তো বড় ননদী,মেজো ননদী,আর বাড়ির বড় দাদাভাই এবং উনার স্ত্রী আছেন। আমি বরং একসপ্তাহ টা বাপের বাড়ি থেকে যায়।
কিন্তু হলো কি,চতুর্থদিন খবর এলো শ্বাশুড়ি মায়ের অনেক অসুখ।করোনা পজিটিভ।ঘরে রেখে ওনার চিকিৎসা দেওয়া হচ্ছে। বড় ননদ,মেজো ননদ শ্বশুর বাড়ি পালিয়েছে।এমনকি নিজের প্রিয় পুত্র বধূ-ও।সেবা করার কেউ নেই। তাই আমাকে চলে যাওয়ার জন্য শ্বশুর মশাই খবর পাঠালেন।উনার নাকি শ্বাশুড়ি মায়ের পাশে যেতে ভয় লাগে। কাপড়চোপড় গুছিয়ে আবার চলে আসলাম শ্বশুরবাড়ি।শ্বাশুড়ি মা একটা রুমে পুরোপুরি আবদ্ধ। ঘর থেকে বের হওয়া উনার নিষেধ। খাওয়া-দাওয়া সম্পূর্ণ আমাদের থেকে আলাদা।পিপিই পড়ে খাওয়া,ঔষধ সহ যা যা সেবাশুশ্রূষার দরকার দুই সপ্তাহ ধরে আমি দিয়ে গেলাম।
ভাসুর, ননদী সবাই দূর থেকে ফোন করে মাঝেমধ্যে খোঁজ খবর নেন।শ্বাশুড়ি মা ধীরেধীরে পুরোপুরি সুস্থ হয়ে উঠলেন।ঘরে আবার সবার আনাগোনা শুরু হলো।পাড়াপড়শিরা শ্বাশুড়ি মায়ের সুস্থতার খবর শুনে অনেকে দেখতে এলেন। অনেকে বললেন, বোন, ছেলের বউয়ের মতো বউ পেয়েছ বলতে হয়,যেভাবে তোমাকে সেবাশুশ্রূষা দিয়ে সুস্থ করে তুলেছে, সত্যি তার জন্য প্রাণ খুলে দোয়া করতে হয়। ওসব মহিলাদের কথা আমার শ্বাশুড়ি মায়ের মোটেও পছন্দ হয়না।উনি সবাইকে গলা উঁচিয়ে বলেন,হায়াত না থাকলে, নিজের শরীরের জোর না থাকলে অন্যের সেবায় কেউ সুস্থ হয় নাকি?নিজের শরীরের জোর আর সৃষ্টিকর্তার দয়া ছিলো বলে সুস্থ হয়েছি, কারো সেবা পেয়ে নয়। আমার মনটা তখন হু হু করে কেঁদে উঠলো।সৃষ্টিকর্তা সত্যি কাউকে ছাড় দেয় না।কর্মের মাধ্যমে হলেও প্রতিদান দিয়ে দেয়।
আমার মনে পড়ে গেলো আমাদের ভাবীর কথা।আমার তখন বিয়ে হয়নি।ঘরে বড় ভাইয়ের জন্য বউ আনা হলো।রিলেশনশীপের বিয়ে,ভাবী নিতান্ত সাধারণ ঘরের এক মেয়ে বলে আমার ওঁকে মেনে নিতে ভীষণ আপত্তি। ওর প্রতিটি কাজে ভুল ধরে সবার সামনে বেইজ্জতি করতে পারলে আমার কেমন জানি আনন্দ হতো।সবার কাছে ভাবী অপ্রিয় হয়ে উঠতো।অন্যদিকে ভাবী আমাদের মন জয় করতে সারাদিন কতো কাটুনি খেটে সব কঠিন কাজও একাই করে যেতো।পরিবারের নয় সদস্যের জন্য খাবার তৈরি করা,ঘর ঝাড় দেয়া,কাপড় ঘুচানো,বিছানা ঠিক করা সব ভাবি একাই করতেন। এমনকি আমি একটা সুস্থ-স্ববল ভাবির সম বয়সী মেয়ে হয়েও ভাবিকে কাজে সাহায্য করার সমস্ত শক্তি আমার থাকার পরেও উনাকে দিয়ে নিজের রুমটাও পরিস্কার করিয়ে ছাড়তাম।নিজের কাপড় নিজে না ধুয়ে ভাবিকে দিয়ে ধুয়ে নিতাম।
ভাবি সব কাজ চুপচাপ করে যেতেন, কোনদিন প্রতিবাদটাও করেন নি।আমি ভাবির নির্বাপিত নির্যাতিত উৎসুক দৃষ্টির ক্ষীণ আলোর চেহেরাটার দিকে তাকিয়ে উনার ভিতরের ক্ষোভ-দুঃখ এবং মনোকষ্ট টা ঠিক বুঝতাম, ভাবি এসবের বিনিময়ে কি চায়।সব কিছুর বিনিময়ে একটু সন্তুষ্টি আর সবার মনে একটু জায়গা করে নিয়ে সবার সাথে সুখী মানুষ হিসেবে থাকার যে তীব্র আকাঙ্ক্ষার চাপ ভাবির চেহেরায় প্রতীয়মান তা স্পষ্ট লক্ষ করতাম।
তাও ভাবির এতো খাটুনির পর দিনশেষে আমি যা উপাধি দিতাম তা হচ্ছে ঘরের দাসী। বউ হয়ে যখন এসেছে তারতো এমনিতেই সব করতে হবে।সে না করলে আর কে করবে?আমার মত ছিলো তার শরীর থাকতে পারে তবে অসুখ হতে পারে না,তার কাজ করার ইচ্ছে থাকতে পারে, না করার ইচ্ছে কখনো না থেকে পারে না।
নিজের শরীরের সমস্ত অসুখ কে ছুড়ে ফেলে দিয়ে ঘরের কাজ পুষিয়ে দেওয়াটাই যেন ঘরের বউয়ের দায়িত্ব।
আজ যখন বিয়ের পর আমিও ভাবির মতো অন্যের ঘরে বউ হয়ে আসলাম।যখন আমিও ভাবির মতো সবার কাছে প্রিয় হয়ে উঠার জন্য মরিয়া হয়ে উঠলাম, যখন শরীরের সব ব্যাথা ভুলে খেটে কাজ করছিলাম। যখন কেউ আমার অসুখের কথা বলে না।আমি নিজের শরীরের কথা ভুলে সবার সন্তুষ্টি লাভের মাধ্যমে ওদের মনে নিজের জন্য একটু জায়গা তৈরি করে নেওয়ার আপ্রাণ চেষ্টা করছিলাম তখনই সৃষ্টিকর্তা ভাবির হয়ে উপযুক্ত শিক্ষা দিয়ে প্রতিশোধ টা নিয়ে নিলেন। আর আমাকে আমার অতীত কর্মের প্রতিদান টা দিয়ে বুঝিয়ে দিলেন,প্রকৃতি কর্মফল ব্যতিত কাউকে ছাড় দেয় না।শুধু দরকার সময়ের অপেক্ষা।
গল্পের বিষয়:
গল্প
DMCA.com Protection Status
loading...

Share This Post

আরও গল্প

সর্বাধিক পঠিত