তোমায় ঘিরে

তোমায় ঘিরে
জীবনে প্রথম ভার্সিটিতে পা দিতেই একজনের ওপর চরম লেভেলের ক্রাশ খেয়েছি।যতক্ষণ ক্যাম্পাসে ছিলাম ছেলেটাকে লুকিয়ে লুকিয়ে দেখেছি।কিন্তু বান্ধবীদের কাছ থেকে ইনফরমেশন নিতে গিয়ে শুনলাম,ওনার নাম ঈশান,ফাইনাল ইয়ার স্টুডেন্ট।ভার্সিটির অনেক মেয়েই ওনার ওপর ক্রাশ খেয়ে বসে আছে।কিন্তু ওনি এক চিজ,কাওকেই পাত্তা দিচ্ছেন না।মূহুর্তেই আমার সব আগ্রহ নাই হয়ে গেছে।যেখানে এতো সুন্দরী স্মার্ট মেয়েদের পাত্তা দেন না সেখানে আমিতো নিতান্তই পেত্নী।বড়োসড়ো একটা ছ্যাঁকা খেয়ে সেদিনের মত বাসায় ফিরলাম।
এরপর থেকে আমার প্রতিদিনের রুটিন হয়ে গেল ঈশান কে লুকিয়ে দেখা।ক্লাস করা বাদ দিয়ে তাকিয়ে থাকতাম।কিন্তু ওনাকে মনের ভুলেও একদিন আমার দিকে তাকাতে দেখিনি।উল্টে নবীনবরন অনুষ্ঠানের দিন বেলুন ফাটানো নিয়ে ঈশানের থেকে রামধমক খেয়েছিলাম।তারপর ভেবেছি ওর দিকে আর ফিরেও তাকাবো না।ওকে হাড়ে হাড়ে বোঝাবো তনু কি।কিন্তু আমার পোড়া কপাল।ঈশানের দিকে না তাকিয়ে থাকতেই পারি না।
ভার্সিটির ছুটি কাটাতে বাড়িতে এসেছিলাম।সাতটা দিন ভীষণ আনন্দে কাটিয়েছি।একদমই ফিরতে ইচ্ছে করছে না।কিন্তু ফিরতে তো হবেই।আব্বু আমাকে স্টেশনে নিয়ে এসেছে।ট্রেনের জন্য অপেক্ষা করছি তখনি আমার বেস্টু তিথি এসে পড়লো।তিথি আর আমি একই এলাকার হওয়াতে একসাথেই যাওয়া আসা করি।হুইসেল বাজিয়ে ট্রেন চলতে শুরু করলো।আব্বুকে জানালা থেকে হাত নাড়িয়ে বিদায় জানালাম।এমন সময় আমাদের বগিতে ভার্সিটির কয়েকজন ভাইয়া আপুরা এসে বসলেন।সবাইকেই মোটামুটি চিনি।বেশ ভালোই হয়েছে।সবার সাথে আড্ডা দিতে দিতে ফেরা যাবে।বাড়ি থেকে আসার মন খারাপ ভাবটা নিমিষেই উধাও হয়ে গেল। কিন্তু তখনই গিটার কাঁধে নিয়ে বগিতে প্রবেশ করলেন ঈশান।আর আমার মুখে আপনাআপনি কুলুপ এঁটে গেল।
আজ আমার আনন্দ করার দফারফা হবে বেশ বুঝতে পারছি।তাই আর আড্ডায় মন না দিয়ে উদাস চোখে জানালার বাইরে তাকিয়ে রইলাম।তিথি দু’একবার খোঁচা মেরেছে,সাড়াশব্দ না পেয়ে আড্ডা দিতে লেগেছে।জানালা দিয়ে তাকিয়ে থাকলেও মন পড়ে আছে ঈশানের কাছে।কিন্তু তার কি সেসব দেখার সময় আছে।তিনি গিটার বাজিয়ে গানের লিরিক্স দিতে ব্যস্ত। ছুটি শেষ হতেই পুরোদমে ক্লাস হতে লাগলো।তাই না চাইতেও পড়ালেখায় মনোযোগ দিলাম।কিন্তু তার মধ্যে ও ঈশান নামক অসুখটা বারতেই থাকলো।প্রতিদিন মনে হতো ঈশান কথা বলবে,কিন্তু বলতো না।আমার সামনে আসলেই এমন চোখ মুখ করতো মনে হতো কেও জোর করে করলার রস খাইয়ে দিয়েছে।অন্য ছেলেমেয়েদের সাথে কি সুন্দর হাসিমুখে কথা বলেন,জুনিয়র মেয়েগুলো ওনাকে ভাইয়া ভাইয়া বলে সারাদিন চিল্লায়।তিনি সেই চিল্লানোতে সাড়া দিয়ে তাদের সাহায্য করতে ছুটে যান।আর এসব দেখে হিংসায় জ্বলতে থাকি আমি।।
ক্লাস শেষ করে রেস্টুরেন্টে এসে বসলাম।তিথি দুনিয়ার খাবার অর্ডার করেছে।তিথির সাথে টুকটাক গল্প করতে করতেই খাবার চলে এলো।বেশ আয়েশ করে তিনিদিন উপোশ থাকার মতো গোগ্রাসে খাবার গিলতে লাগলাম।হঠাৎই চোখ গেল সামনের দিকে।আমাদের দুই টেবিল সামনে বসে তীক্ষ্ণ দৃষ্টিতে আমাকে পর্যবেক্ষণ করে চলেছেন ঈশান।ছি,কি লজ্জাকর বিষয়বস্তু।তৎক্ষনাৎ খাওয়া থেকে ইস্তফা দিলাম।কিন্তু একটু পরে চরম অবাক হয়ে খেয়াল করলাম,ঈশান মোটেও আমাকে দেখছেন না।তিনি আরও দুজন ছেলের সাথে কোন একটা বই হাতে কথা বলছেন।আমার খাওয়ার বারোটা বাজিয়ে দিয়ে এখন মনের সুখে গল্প করে চলেছেন। দুটো বই কিনতে বাজারে যাওয়ার উদ্দেশ্যে তিথিকে নিয়ে সিএনজিতে বসেছি।আমরা দু’জন ছাড়া সামনে আর একজন বসে আছেন।তাই সিএনজিতে বসে গুনগুন করতে শুরু করলাম।সাথে দুনিয়ার হাহাহিহি তো আছেই।এমন সময় সামনে বসা মানুষটা পেছনে ফিরে গম্ভীর গলায় বলে উঠলেন,,
—” কোথায় যাচ্ছ তিথি..??
দু’জনেই চমকে উঠে সামনে তাকালাম।ওমা এটাতো ঈশান।এই চিজ এখানে কি করছে।তিথি তড়িঘড়ি করে বলে উঠল,,,
—” আসসালামু আলাইকুম ভাইয়া,,।।কেমন আছেন
—” ওয়ালাইকুমুসসালাম,ভালো তুমি কেমন আছো..??
—” জি ভালো,।একটু বাজারে যাচ্ছি ভাইয়া।
—” ওহহ আচ্ছা। তো সামনের মাসেই তো এক্সাম।প্রিপারেশন কেমন।
—” জি ভাইয়া মোটামুটি ভালো।
—” মোটামুটি হলে চলবে।ভালো করে পড়াশোনা করতে হবে।
—” জি আচ্ছা ভাইয়া।
সারাপথ একবস্তা জ্ঞান বিতরন করলেন।আমি তখন থেকে সিএনজির কোনা ঘেঁষে ঘাপটি মেরে বসে আছি।যদি কোনভাবে জানতে পারতাম ঈশান এই সিএনজিতে থাকবে তাহলে মনের ভুলেও উঠতাম না। বইয়ের দোকানে ঘুরতে ঘুরতে দেখলাম বাজারের মধ্যে কি নিয়ে যেন গন্ডগোল লেগেছে।যে যেদিক পারে ছুটে যাচ্ছে।বইয়ের দোকানেও ঠেলাঠেলি লেগে গেছে।হঠাৎ কারো ধাক্কায় দোকান থেকে ছিটকে বাইরে রাখা একটা রিকশার ওপর পড়লাম।হাতের কনুই থেকে রক্ত পড়া শুরু করলো।অমনি কোথা থেকে ঈশান এসে আমার হাত চেপে ধরলো।আমি চোখগুলো রসগোল্লা বানিয়ে ঈশানের দিকে তাকিয়ে আছি।সেদিকে ভ্রুক্ষেপ না করে আমাকে টানতে টানতে ডিসপেনসারিতে নিয়ে এলো।
তারপর ব্যান্ডেজ করে দিয়ে প্রয়োজনীয় অষুধ দিয়ে বাসায় পৌঁছে দিল।বাসায় এসে মনে হচ্ছে হাতটা আর একটু বেশী কেন কাটলো না।সন্ধ্যার পর থেকে ঈশান তিথির কাছে কল দিয়ে আমার খবর নিচ্ছে।আমাকে ফোন দিলে তার মানসম্মান চলে যাবে কিনা।তাই তিথির থেকে প্রতিমুহূর্তের আপডেট নিচ্ছেন। সপ্তাহখানেক লেগে গেল হাতের ঘা শুকাতে।সারা সপ্তাহেই ঈশান ফোন দিয়েছে।আমি মনে মনে চাইতাম একমাস যেন ব্যাথা থাকে।এরপর ভার্সিটিতে এলে নিজেই আমাকে কেমন আছি,পড়াশোনার কি অবস্থা এসব জিজ্ঞেস করতেন।আর ঈশানের সামনে পড়লে আমি ভাবতাম কোন দিক দিয়ে দৌড় দিলে তাড়াতাড়ি পালাতে পারবো।এ নিয়েও বহুবার ধমক খেয়েছি। ভার্সিটি থেকে রীতিমতো দৌড়ে বাসায় এসেছি।তিথি আমাকে দেখে অবাক হয়ে বললো,,,
—” এভাবে হাঁপাচ্ছিস কেন।পাবলিকের দৌড়ানি খেয়েছিস নাকি।।
—” তার থেকেও বিশাল কাজ করে ফেলেছি আমি।
—” কি করেছিস তুই..??(চেঁচিয়ে বললো)
—” লাইব্রেরিতে ঈশানের এসাইনমেন্ট রাখা ছিল।তার মধ্যে “ভালোবাসি” লেখা চিরকুট রেখে এসেছি।
—” সর্বনাশ।।ঈশান ভাইয়া একবার জানতে পারলে তোর সাথে সাথে আমাকেও আলুভর্তা বানাবেন।
তিথির কথা শুনে আমারও চিন্তা হচ্ছে।কিন্তু বোঝার চান্স খুব কম।কারন ঈশান আমার হাতের লেখা চেনেনা।কিন্তু কোনভাবে যদি বুঝে যায়,আমিতো গেছি। সাড়ে চারটা নাগাদ ঈশানের কল এলো তিথির ফোনে।ফোন দেখেই আমার হাত-পা কাঁপতে শুরু করলো।তারওপর তিথি এসে বললো,,,
—” তনু কথা বল,ঈশান ভাইয়া চাইছে,,, হাত বাড়িয়ে ফোনটা নিলাম।কিন্তু কথা বলার সাহস হচ্ছে না।কি কুক্ষণে যে এই কাজটা করলাম।এখন নিজের চুল ছিঁড়তে ইচ্ছে করছে।কাঁপা কাঁপা গলায় বললাম,,,
—” হ্যালো আসসালামু আলাইকুম।
—” ওয়ালাইকুমুসসালাম।এতো কম বয়সে মাথার মধ্যে এসব চিন্তা আসে কি করে???
—” আমি আসলে আমি,,,,
—” সাটআপ,তোতলাবে না।
লেখাতে তো কোন তেড়াব্যাকা নেই।খুব স্পষ্ট অক্ষরে লিখেছ।তাহলে কথা বলতে গিয়ে তোতলাচ্ছ কেন,ফাজিল মেয়ে। পাঁচটার মধ্যে ক্যাম্পাসে চলে আসো।যদি একমিনিট দেরী হয় তো বুঝবে মজা। রেডি হয়ে বের হলাম।তিথিকে বলেছি ঈশান ডেকেছে।শুনেই ওর মাথা ব্যাথা শুরু হয়েছে।তাই কাথা মুড়ি দিয়েছে।অগত্যা একাই চললাম শহীদ হতে। ভার্সিটিতে পৌঁছেই ঈশানকে দেখতে পেলাম।অন্যদিন খুঁজেও পাওয়া যায় না।সামনে গিয়ে মাথা নিচু করে দাঁড়িয়ে রইলাম।ঈশানের দিকে তাকানোর সাহস হচ্ছে না।শেষে ঈশানই বললো,,,
—” কাল ক্লাসের পরে রাজশাহী যাব।তাই একেবারে রেডি হয়ে বাসা থেকে আসবে।নাও গো।
—” এটুকু বলতে আমাকে ডেকেছেন।
—” হু,বাকি কথা তোমার বাবার সাথে হবে,রাজশাহী গিয়ে।
—” মানে,,,,,,
—” মানে হচ্ছে তোমার বাবার জানা উচিত তার মেয়ে সিনিয়রদের চিরকুট বিলি করে বেড়াচ্ছে।
—” দেখেন আপনি এমন করতে পারেন না।
—” আমি কি পারি সে সম্পর্কে তোমার কোন ধারনা নেই।আর সেসব তোমার মাথায় ঢুকবেও না।অতএব যেটা বলেছি বাধ্য মেয়ের মতো সেটাই করবে।
আমি আম্মুকে কথা দিয়েছি তার বৌমাকে নিয়ে কাল বিকেলের মধ্যে বাড়ি ফিরবো। অবাক চোখে তাকালাম ঈশানের দিকে।ঈশান হাসছে।আরে ব্যাটা যখন রাজিই ছিলি তাহলে এতোক্ষণ ভয় দেখালি কেন।টেনশনে হার্টফেল করার দশা আমার। অবশেষে কাঙ্ক্ষিত সময়টা এসেই গেল।ট্রেনে ঈশানের পাশাপাশি বসে আছি চানাচুর,পিয়াজু,চুইংগাম ইত্যাদি হাবিজাবি চিবুচ্ছি।আর ঈশান রাগী চোখে তাকিয়ে আছে।কিন্তু আমি ডোন্ট কেয়ার লুক নিয়ে একমনে খেয়ে যাচ্ছি।শেষমেশ হাল ছেড়ে দিয়ে ঈশান সিটে গা এলিয়ে দিল।আর ওর চোখে তাকিয়ে আমি স্বস্তির নিঃশ্বাস নিলাম।কালকে বিকেলের পর থেকে এই ছেলেটা নিজেকে আমার হাতে তুলে দিয়েছে।যাকে আগলে রাখার দায়িত্ব শুধুই আমার।
গল্পের বিষয়:
গল্প
DMCA.com Protection Status
loading...

Share This Post

সর্বাধিক পঠিত