বাবার মেডিসিনের জন্যে কলাবাগানের লাজফার্মার সামনে লাইনে অপেক্ষা করছিলাম , আজকে বেশ ভিড়ই হঠাৎ করে সামনে থেকে পরিচিত একজনের কন্ঠস্বর শুনে সামনে এগিয়ে গেলাম —প্রায় পাঁচ বছর পর দেখা হলেও কারোই চিনতে ভুল হলো না
“কেমন আছো তুমি ?” এই প্রথম উনার মুখে মা শব্দটা না শুনে খারাপ লাগলেও বুঝতে দিলাম না
“আলহামদুলিল্লাহ ভালো আছি , আপনাদেরকে কতো যে খুঁজেছি আন্টি !”
“যারা ইচ্ছা করেই হারিয়ে যায় তাদেরকে না খুঁজে পাওয়াই মনে হয় ভালো”
কণ্ঠে অভিমানের সুর বুঝতে দেরী হলো না তবে লাইনে উনি এগিয়ে থাকায় কথা আর বাড়ল না , মেডিসিন নিয়ে বিদায় নেবার সময় আমি উনার সেল নাম্বারটা চাইলেও উনি এড়িয়ে যাবার পর আমারটা দিলাম
“আন্টি সময় পেলে ফোন দিয়েন”
“আচ্ছা আমি এখন আসি”
বলেই উনি হাঁটা শুরু করলেন একবারের জন্যেও পিছনে ফিরে তাকালেন না ,উনার স্বভাবের বিপরীতে হলেও চেয়ে চেয়ে দেখলাম । আন্টি আর আমরা একই পাড়ায় থাকতাম আর উনার ছেলে রাশিক আমার সহপাঠী ছিল , স্কুলে আন্টিকে আমরা সবাই খুবই পছন্দ করতাম –কো- এডুকেশন সেই স্কুলে আন্টি সবাইকে মা আর বাবা ধরে বলতেন । যেকোনো সমস্যায় সব অভিভাবক মিটিং এ আন্টিকেই সব বলতে স্বাচ্ছন্দ্য বোধ করতো ,সবকিছু গুছিয়ে বলার এক অদ্ভুত ক্ষমতা ছিলো উনার , একবার স্কুলে সামান্য অপরাধে এক বাচ্চাকে মারার পর শুনে আন্টি স্কুল কর্তৃপক্ষকে বাধ্য করলেন প্রকাশ্যে ক্ষমা চাইতে আর উনার ছেলে রাশিকের সাথে আমার বোঝাপড়ার রসায়ন ছিলো অদ্ভুত , রাশিক আমাকে খুবই পছন্দ করতো হাইস্কুলে উঠার পর প্যারেন্টস মিটিং হলেই অন্য বান্ধবীরা এই বলে ক্ষ্যাপাতো –
“তোর শ্বাশুড়িমা এসেছেনরে”
মিথ্যা বলবো না আমারো রাশিকের প্রতি দুর্বলতা ছিলো হয়তো সেটা বয়সজনিত অথবা হরমোনের আধিক্য!
এসএসসির কোচিং এর সময়ে রাশিক আমাকে বাসার গলির মুখে দিয়ে বাসায় যেতো বলে বড়দা একদিন দেখে খুব বকাঝকা করলেন আমাকে—
“তুই আর আমার সাথে আসিস নাতো ,বড়দা বকা দেয়”
“আচ্ছা গ্রুপ বেঁধে আসবো তখন তোর বড়দা বকা দেবার সুযোগ পাবে না”
রাশিক এমনই ছিলো পড়ালিখা নিয়েও একদমই সিরিয়াস ছিলো না , রেজাল্ট সে রকমভাবে আশানুরূপ হলো না তাও কলেজে উঠেই আমাকে প্রেমের প্রস্তাব দিয়ে বসলো—
“তুই কি কিছুই বলবি না লিয়া?”
“আমার পরিবার তোকে মেনে নিবে না আর বাবাকেতো জানিস , সে সবকিছুই হিসাব কষে করে”
“আমি প্রতিষ্ঠিত হলেও কি মেনে নিবে না?”
“রাশিক আমরা ভালো বন্ধু হয়েই থাকি,অন্য চিন্তা মাথা থেকে ঝেড়ে দে”
মুখে বললেও আমি কিন্তু রাশিককে পছন্দই করতাম কিন্তু আমার বাবাকে চিনতাম বলে চুপ থাকতাম , চার ভাইবোনের জীবনের সবকিছুই সে ছক করে রেখেছে –এর বাহিরে পা ফেলার সাহস আমার ছিলো না বলেই চুপ থাকতাম, আমাদের দুই বোনকে নিয়ে বাবার স্বপ্ন ছিলো আকাশকুসুম । ছুটিছাটায় দেখা হতো না বলে রাশিক দুইবেলা রাস্তার মোড়ে এসে দাঁড়িয়ে থাকতো ,যথারীতি ইন্টারেও রাশিকের রেজাল্ট আহামরি কিছু আর হয়নি দেখে ও কলেজেই ভেংগে পড়েছিল –
“এই রেজাল্ট তোমার কিছুই করতে পারবে না, তুমি তোমার স্বপ্নপুরণের পথে হাঁটো আর আমিতো তোমার পাশে আছিই” হ্যাঁ রাশিকের মা সবসময় পজেটিভ ভাবনা ভাবতেন , স্কুলে সামান্য নাম্বার কম পেলে যেখানে আমাদের মায়েরা বকাঝকা করতেন আন্টিকে কখনো জিজ্ঞেস করতেও দেখিনি উল্টো সবাইকে বলতেন –
“ওদের আত্মসম্মানবোধ আছে , বাসায় নিয়ে এই কাজটা করেন প্লিজ” আমার আম্মু প্রায়ই বলতেন—
“এই মহিলা নিজে বাচ্চাকাচ্চা শাসন করে না এরা জীবনেও মানুষ হবে না”
অনেক অভিভাবক বিরক্ত হলেও আন্টিকে আমরা সবাই খুব পছন্দ করতাম, ভর্তি পরীক্ষার যুদ্ধে সবাই ব্যস্ত হয়ে পড়লেও রাশিক দেখতাম আড্ডা দিচ্ছে অথবা ঘুরে বেড়াচ্ছে
“রাশিক এখন অন্তত সিরিয়াস হ ,ভালো কোথাও সুযোগ না পেলে তখন কি করবি ?”
“তুই কথা দিলে আমি সত্যি জীবন নিয়ে সিরিয়াস হয়ে ঝাঁপিয়ে পড়বো কথা দিচ্ছি”
আমি হাসতাম ওর এসব কথা শুনে যাই হোক ভর্তি যুদ্ধে আমি প্রাচ্যের অক্সফোর্ডে সুযোগ পেলাম তাও নাম্বার শেষের দিকে ছিলো বলে ভালো সাবজেক্ট পাইনি আর রাশিক প্রায় পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ে সুযোগ পেলেও সাবজেক্ট পছন্দ হওয়ায় কুয়েটে ভর্তি হলো, যাবার আগে বিদায় নেবার সময় হাত ধরে অনুরোধ করলো—
“কথা দে লিয়া দুরত্ব কখনই আমাদের মাঝে দেয়াল হয়ে দাঁড়াবে না”
“আরে এই যুগে দুরত্ব কোনো ব্যাপার নাকি রাশিক?”
কিন্তু নতুন বন্ধুবান্ধব আর অহংকার আমাকে পেয়ে বসলো ,আমি ওকে এড়িয়ে চলতে শুরু করে দিলাম ভার্চুয়াল জগতে লাইক কমেন্টে সেটা সীমাবদ্ধ হয়ে গেলো আমার পোস্টে ফান করে কিছু লিখলে আমি ওকে ব্লক দিতাম আবার ফোনে কাতর মিনতি শুনে ব্লক উঠাতাম সেকেন্ড ইয়ারে উঠার পর বড় আপুর বিয়ে ঠিক করলেন বাবা – আসলে বলা যায় আমার বাবা টাকা দিয়ে পাত্র কিনে নিলেন সরকারী প্রথম শ্রেণির কর্মকর্তা দেখে আমাদের ভাবই বদলে গেলো । ব্যবসায়ী বাবার শিক্ষা তেমন না থাকলেও সেটাকে খুব গুরুত্ব দিতেন ,আপুর বিয়েতে বাবা পুরো এলাকা লাইটিং করলেন আর হাজারের উপরে দাওয়াত করলেন পাত্রপক্ষ সরাসরি যৌতুকের কথা বলেনি তবে ইনিয়েবিনিয়ে সেটাই চেয়েছিল ! বিয়েতে রাশিক আসতে পারেনি পরীক্ষা ছিলো বলে,তবে বিয়ের পর আমাদের পরিবারের সবার মধ্যে একটা অহংকার চলে এসেছিল অস্কীকার করবো না ,আমি রাশিককে এড়িয়ে চলতে শুরু করে দিলাম সব জায়গায় ব্লক করে এড়িয়ে যাওয়া শুরু করলাম বলে ও আমার বান্ধবীদের কাছে খবর নেওয়া শুরু করলো ,হুট করে একদিন দেখি ডিপার্মেন্টের সামনেই হাজির
“আমাকে অন্তত বল আমার ভুল কোথায়?”
“তুই কেন না বলে আমার ডিপার্মেন্টের সামনে আসলি রাশিক”
“তুই কোন কারণ না দেখিয়ে এভাবে যোগাযোগ বন্ধ করে দিলি কেনো আমার অপরাধ কি?”
“তুই বড় গায়েপড়া স্বভাবের রাশিক আর বাবা আমার জন্যে বিসিএস ক্যাডার ছাড়া অন্য পেশার কারো সাথে বিয়ে দিবেন না বলেছেন”
“আমাকে একটু সময় দে ,আমি প্রস্তুত হয়ে আসবো কিন্তু কথা দে তুই শুধু আমার হয়ে থাকবি”
তৃতীয়দিন ডিপার্মেন্টের সামনে দেখে আমি আন্টিকে ফোন করে ছেলের বখাটেপনার কথা জানালাম উনি আমার সাথে দেখা করতে চাইলেন—
“আমি যতটুকু জানি তোমাদের মধ্যে একটা ভালো বোঝাপড়া আছে হুট করে সব বদলে গেলো কেন ?”
“রাশিক আমার শুধু বন্ধু অন্যকিছুই নাহ ব্যস আর বাবা আমার বিয়ে ঠিক করে রেখেছেন”
“আমার জানায় ভুল ছিল দেখছি অথবা আমার ছেলে ভুল বুঝেছিল তবে আমি কথা দিতে পারি তুমি ওর পাশে থাকলে তোমার পরিবার নিশ্চয়ই একদিন মেনে নিবে”
আমি অপারগতার কথা জানিয়ে দেবার পরে আন্টি কিছু না বলেই সেদিন রেস্টুরেণ্ট থেকে বেরিয়ে গিয়েছিলেন কিছুদিন পর অন্য বন্ধুদের কাছে শুনেছিলাম রাশিক নাকি নেশায় জড়িয়েছে , দুলাভাইয়ের চাচাতো ভাই আমার ব্যাপারে খুব আগ্রহ দেখাচ্ছেন আর মা-বাবাও খুব খুশি কারণ তুখোড় ছাত্র সে ,রাশিক আমার কাছে তখন পুরানো অধ্যায় । যাই হোক একদিন বাসায় ফিরে শুনি আন্টি নাকি মা-বাবার কাছে আমাকে চাইতে এসেছিলেন কিন্তু বাবা উনাকে চুড়ান্ত রকমের অপমান করেছেন আর আন্টির সবচেয়ে দুর্বল ব্যাপারে কথা বলার পরে উনি নাকি কাঁদতে কাঁদতে ঘর থেকে বেরিয়ে গেছেন , আমার যে মা আজীবন বলে এসেছেন – “এই মহিলা সন্তানদের শাসন করে না এরা মানুষ হবে না” সেও বাবার এই কথায় আহত হইছে, হ্যাঁ রাশিকদের একটা দুর্বল জায়গা ছিলো রাশিকের বাবা দুই সন্তান রেখে উনার সহকারীকে হুট করে বিয়ে করার পর আন্টি দুই বাচ্চা নিয়ে বেরিয়ে এসে একাই ফাইট করেছেন তবুও কারো অনুগ্রহ নিয়ে বাঁচতে চাননি ,আমার বাবা অহংকার বলে বলেছিলেন ব্রোকেন ফ্যামেলিতে তিনি মেয়ে দিবেন না আর ছেলে যে বাবার স্বভাব পাবে না সেটার গ্যারান্টি কি ?
তারপর থেকে রাশিকের খবর আর পাইনি ,ফোন বন্ধ ছিল ভার্চুয়াল জগতে ছিলো না বন্ধুদের কাছেও পাইনি – এলাকা ছেড়ে কোথায় যে চলে গেলো ওরা ? রাশিক হারিয়ে যাবার পর আমি অনুভব করলাম বাহিরে বের হলেই আমার চোখ ঠিকই ওদের খুঁজে বেড়াতো – ওদের দেখা পাইনি কিন্তু প্রকৃতির প্রতিশোধ কি জিনিস টের পেতে খুব বেশিদিন সময় লাগেনি আমাদের , যে আপুকে বিয়ে দিয়ে বাবা মা অহংকারে ডূবেছিলেন সে ফেরত এলো শ্বশুরবাড়ির শারিরীক আর মানসিক যন্ত্রণায় আসলে ওদের কি দোষ ! গুষ্ঠিতে একটা ছেলে এমন পাশ দিলে কি আর স্বভাব যায় ?
তাদের পরিবার বউকে স্রেফ বাড়ির দাসীই ভাবতো আর দুলাভাই পরিবারের বিপক্ষে কখনই যেতেন না , দুলাভাইয়ের চাচাতো ভাই বিসিএস প্রশাসনে সুযোগ পেয়ে এক সচিবের মেয়েকে বিয়ে করলো খুব গোপনেই অথচ কথা ছিল আমার সাথেই বিয়ে হবার , তারপর বাবার ব্যবসায়িক পার্টনার বিশাল অংকের টাকা নিয়ে বিদেশ চলে গেলো – বাবা আর সামলে উঠতে পারলেন না স্ট্রোক করে বসলেন , সংসার কিংবা ব্যবসা আগে কখনই বড়দা দেখেনি বাবাই সামলেছে সবকিছু এখন আমরা পুরোপুরি নিঃস্বই হয়ে গেছি এক সময়ে বাবা যাদেরকে সাহায্য করেছে তারাও এখন আমাদের দিকে ফিরে তাকায় না বাবার মাথার ভেতরে গেঁথে গেলো উনি অন্যায় করেছেন বলেই তার শাস্তি পাচ্ছেন কিন্তু রাশিকদের খবর আর কোথাও পাইনি পাশ করে আমি একটা প্রাইভেট ফার্মে আছি ,বডদাও টুকটাক ব্যবসা করছে – দুজনে মিলে সংসারটা চালাই নাহ বিয়ে আর করিনি সেই মানুষটার জন্যে অধীর আগ্রহে অপেক্ষায় আছি যাকে একদিন লোভের ফাঁদে পড়ে ফিরিয়ে দিয়েছিলাম,
অচেনা নাম্বার থেকে একদিন ফোন করে আমাদের বাসার ঠিকানা চাইলেন রাশিকের মা আমরা ধরে নিলাম উনি হয়তো বাসায় আসবেন কিন্তু কুরিয়ারে আমাদের জন্যে বিয়ের কার্ড আর একটা চিরকুট এলো– “দুজনেই এখন টরেন্টোতে কর্মরত,শুধুমাত্র বিয়ের জন্যে দেশে এসেছেন নব দম্পতির জন্যে দোয়া চাই আর বিয়েতে অবশ্যই সবাই আসবেন” কার্ডের গায়ে স্বনামধন্য এক ভার্সিটি থেকে দুজনের পাশ করা দেখে বুঝতে কষ্ট হয় না পরিচয়ের সূত্রটা হয়তো সেখানেই ।আচ্ছা আমি কি অন্যকিছু আশা করেছিলাম ? প্রকৃতি যে মাঝেমধ্যে ভয়ংকর প্রতিশোধ নেয় ভুলে গিয়েছিলাম! আমাদের অহংকার আর লোভী মন একদিন যাদেরকে তুচ্ছ ভেবে ফিরিয়ে দিয়েছিল তারা সেটায় একদম ভেঙ্গে পড়েনি বরং আরো শক্তিশালী হইছে অথচ আমাদের জীবন থেকে কতো কি হারিয়ে গেছে শুধু আমরাই অনুভব করতে পারছি ।
গল্পের বিষয়:
গল্প