কল্পিত বাস্তব

কল্পিত বাস্তব
বিয়ের ৩দিন পর আমার বাকশক্তি হারিয়ে গেলো ৷ এমন কিছু যে ঘটবে এটা ভালো করে জানতাম ৷ ডাক্তার বলেছিলো এসম্পর্কে— হুট করে একদিন আমি কথা বলার শক্তি হারিয়ে ফেলবো এবং চিকিৎসা করেও বাকশক্তি ফিরে পাবোনা ৷ এমন দুঃসহ ও অপ্রীতিকর বার্তা শুনে হতাশায় নিমজ্জিত হয়ে গিয়েছিলাম ৷ বেঁচে থাকার আশা ফিকে হয়ে গিয়েছিলো ৷
দীর্ঘশ্বাসে প্রতিটা দিন পার করেছিলাম ৷ সিদ্ধান্ত নিয়েছিলাম ভালোবাসার মানুষটিকে সব সত্য খুলে বলবো ৷ বিষয়টা সে কিভাবে নেয় জানা দরকার ৷ বোবা মানুষকে কেউই নিজের জীবনের সঙ্গে জড়াতে চাইনা ৷ আমার ভালোবাসার মানুষটি প্রভাবশালী পরিবারের বিধায় মনে এই বিশ্বাসটা ধারণ করতে পারিনি যে সে আমাকে আগের মতই ভালোবাসবে কিনা? রুপবতী ও শিক্ষিত একটি মেয়ে বাকশক্তি হারানো কাউকে জীবনসঙ্গী হিসেবে গ্রহণ করবে এটা ভাবা খুব কঠিন ৷ যদিও ২ বছর ধরে অনুর সঙ্গে সম্পর্কে জড়িত আছি ৷ এই ২ বছরের সম্পর্কে কোনোরকমের ফাটল ধরেনি ৷ কিন্তু সত্যটা বলার পর সে বিষয়টা কিভাবে নিবে জানিনা ৷ একপর্যায়ে অনুকে সব খুলে বললাম ৷ সত্যটা শোনার পর অনুর প্রতিক্রিয়া ঠিক সেরকমই ছিলো যেরকমটা আমার ভাবনাতে ছিলো ৷ অনু বাকরুদ্ধ হয়ে দাঁড়িয়ে ছিলো ৷ তার চোখে, মুখে এক প্রকার উদ্বিগ্নতা ও আতঙ্কের ছাঁপ স্পষ্ট ছিলো ৷ আর আমার চেহারা ছিলো চিন্তায় আচ্ছাদিত ৷
আর মনে ছিলো প্রিয়জনকে হারানোর ভয় ৷ যখন অনুকে বললাম, “যেহেতু একসময় আমি বাকশক্তি হারিয়ে ফেলবো, তখন থেকে আমার ক্যারিয়ারও ধ্বংস হয়ে যাবে ৷ এবং নিজের অস্তিত্ব বিলিন হয়ে যাবে ৷ সেসময় তুমি নিশ্চয় চাইবেনা অস্তিত্বহীন কারো সঙ্গে সারাজীবন কাটিয়ে দিতে? এজন্য সত্যটা আজ বলে দিলাম! এখন তোমার উত্তরের অপেক্ষায় আছি! এতোটুকু শোনার পর অনু মুখ লুকিয়ে কোনো কথা না বলে আমাকে ফেলে চলে গেলো ৷ জানতাম এমন কিছুই হবে ৷ সে এভাবে কিছু না বলে চলে যাওয়ায় কষ্টের অনলে পুড়ে ছাই হয়ে গেলাম ৷ অথচ এমন ভান করলাম যেনো আমি খুব সুখে আছি ৷ বুক ফাঁটা কান্নাকে চেপে রেখে মনকে শক্ত করে বদনে এক চিলতে মিথ্যা হাসি উদ্ভাসিত করে পছন্দের জায়গাটি ছেড়ে এলাম!
সংবাদপাঠকের সম্মানজনক পেশাটা খুব শীঘ্রই হারাতে যাচ্ছি এটা মনে আসতেই আমার নিকট পুরো দুনিয়া অন্ধকারে আচ্ছন্ন হয়ে যায় ৷ বিষন্নতা ঘিরে ধরে আমাকে ৷ ভাবতে পারিনা কিভাবে বাকি জীবন কাটিয়ে দিবো যদি সত্যি সত্যি বাকশক্তি হারিয়ে ফেলি ৷ এই ভয় নিয়ে প্রতিটা দিন পার করছিলাম ৷ অনু আমার জীবন থেকে চলে গেছে এই কষ্টটা মেনে নিতে পারছিলাম না ৷ যদি সে আমাকে ফেলে না যেতো, তাহলে হয়তো এতোটা দুর্বিষহে কাটাতে হতোনা ৷ দীর্ঘ এক মাস কেটে গেলো ৷ এই ১ মাসে অনুকে অসংখ্যবার ফোন দিয়েছি সে ফোন রিসিভ করেনি ৷ তার বাসায় গিয়ে তাকে পাইনি ৷ আশাহত হয়ে অনুকে ভুলে যাবার চেষ্টা করতে থাকি ৷ যে আমাকে আর চাইনা তার পিছু ছুটে আর কি হবে! আরো ১টা মাস পেরিয়ে গেলো!
আজ আকাশে মেঘ জমেছে ৷ মেঘমালা দেখে মনে হচ্ছে বৃষ্টি নামতে পারে ৷ মেঘাচ্ছন্ন অার বৃষ্টিস্নাত দিনটা আমি কখনই কাজের মাধ্যমে পার করিনা ৷ মেঘে ঢাকা আকাশ দেখে অফিসে না যাওয়ার সিদ্ধান্ত নিলাম ৷ ভাবলাম আজ নদীতে গিয়ে পুরো দিনটা কাটিয়ে দিবো ৷ গাড়ি নিয়ে বের হবার জন্য প্রস্তুত হচ্ছিলাম ৷ অকস্মাৎ, আমার ফোনটা বেজে উঠলো ক্ষণিক সময়ের জন্য ৷ ম্যাসেজ পাঠিয়েছে কেউ ৷ ফোনটা হাতে নিয়ে স্কিনে নজর দিলাম ৷ চমকে উঠলাম ৷ তীব্র আনন্দে বুকের মাঝে ভালোলাগার পরশ অনুভব করলাম ৷ অনু মেসেজ পাঠিয়েছে ৷ সে আমাকে এখনই ৩ নম্বর রোডে দেখা করতে বলছে ৷ ম্যাসেজটা দেখে তীব্র উত্তেজনা নিয়ে চললাম কাঙ্খিত গন্তব্যের দিকে! ৩নম্বর রোডের মোড়ে গাড়ি থামালাম ৷ একটু পরই অনু গাড়ির নিকটে এসে হাজির হলো ৷ অনেক দিন পর তাকে দেখে বুকে জমা কষ্টগুলো নিমিষে বিলিন হয়ে গেলো ৷ অনুর দিকে এক নজরে তাকিয়ে রইলাম ৷ কিন্তু সেটা বেশিক্ষণ স্থায়ী হলোনা ৷ সে আমার হাত ধরে গাড়ির ভিতরে প্রবেশ করতে বাধ্য করলো ৷ অনু নিজে ড্রাইভিং সিটে বসলো ৷ এবং গাড়ি স্টার্ট দিয়ে চালানো শুরু করলো ৷
অনুকে এখনো একটা কথাও বলতে পারিনি ৷৷আসলে আমি বাকরুদ্ধ, আবেগে কথা বের হচ্ছেনা ৷ যদিও ইদানিং কথা বলতে কষ্ট হয় ৷ ডক্টর সেই নিয়তির কথাকে বারবার স্মরণ করে দেন ৷ হঠাৎ, অস্ফুট স্বরে অনুকে বললাম কেমন আছো তুমি? অনু কোনো জবাব দিলোনা ৷ সে একমনে গাড়ি চালিয়ে গেলো ৷ ভাবলাম সে হয়তো যাত্রাপথে কোনো কথা বলবেনা ৷ এরপরও তাকে ফের বললাম, জানো তোমাকে অনেক মিস করেছি ৷ ভেবেছিলাম তোমাকে সত্যি সত্যি হারিয়ে ফেলেছি ৷ অনেক কষ্টে ছিলাম ৷ তবে আজ তোমার দেখা পেয়ে সব কষ্ট দূর হয়ে গেছে ৷ এতটুকু বলে থেমে গেলাম ৷ অনুর দিকে দৃষ্টি স্থির করে চুপচাপ রইলাম ৷ তাকে দেখতে এতো ভালোলাগছে যে ভাষায় প্রকাশ করার মত নয় ৷ অনুর কোনো সাড়াশব্দ পাচ্ছিনা ৷ আমার একটি কথারও প্রতিত্তরও করলোনা সে ৷ আমি আবারো বললাম, আমরা কোথায় যাচ্ছি? ততক্ষণাত তীর্যক কন্ঠে অনু বলে উঠলো,
-চুপ থাকবে তুমি? সেই তখন থেকে কথা বলে যাচ্ছো! নিস্তব্ধ হয়ে রইলাম ৷ ১০ মিনিটের মধ্যে কোনো কথা বললাম না আর ৷ গাড়ি থামলো ৷ গাড়ি থেকে অনু নেমে গেলো ৷ আশ্চর্য হয়ে গেলাম ৷ কাজী অফিসে এসে পৌঁছেছি আমরা ৷ অনু আমার হাত ধরে কাজী অফিসের ভেতরে নিয়ে যেতে লাগলে তাকে থামিয়ে দিয়ে অবাক হয়ে বললাম,
-কি ব্যপার, তুমি কাজী অফিসে নিয়ে এলে কেন? তুমি কি করতে চাচ্ছো পরিস্কার করে বলোতো? অনু আমার দিকে আড়চোখে তাকিয়ে জোরালো কন্ঠে বললো
-সেদিন না বলেছিলে- তোমার বাকশক্তি হারিয়ে গেলে আমি না কি তোমাকে ভুলে যাবো? তোমার সেই কথাটা যে সত্য নয় এটা প্রমাণ করতে এখানে এসেছি ৷ আজকে বিয়ে না করে আমি বাসায় যাচ্ছিনা ৷ আমাকে শাড়ি পরিহিত অবস্থায় দেখে হয়তো তোমার আন্দাজ করা উচিত ছিলো! অনুকে অপরাধীর সুরে বললাম,
-আমি সেদিন যাচ্ছেতাই বলে ফেলেছিলাম ৷ ভয় ছিলো মনে, যেকারণে ওরকমটা বলেছিলাম!
-তোমার ঐ কথা শুনে আমি এতোটা কষ্ট পেয়েছিলাম যে মনে হয়েছিলো তোমাকে খুন করলেও ভালোলাগতো ৷ দু বছরের সম্পর্ক আমাদের ৷ কখনো তোমাকে ছেড়ে যায়নি ৷ আর তুমি বাকশক্তি হারিয়ে ফেলবে, জব চলে যাবে, ক্যারিয়ার ধ্বংস হবে এসবের কারণে তোমাকে ভুলে যাবো ভাবলে কি করে? তুমি সংবাদপাঠকের জব হারালেও কাজ করার অনেক সেক্টর পাবে, সেই ব্যবস্থা আমি করবো ৷ তুমি সেসব চিন্তাভাবনা না করে আমাকে কষ্ট দেবার মত একটা কাজ করে ফেললে ৷৷ভেবেছিলাম তোমার সাথে আর যোগাযোগই রাখবোনা ৷ কিন্তু দিন যতই গড়াচ্ছিলাম ততোই তোমাকে আমি মিস করছিলাম ৷ পারিনি তোমাকে ছেড়ে থাকতে, তাই আজকে চলে এলাম সোজা বিয়ে করতে ৷ আমি দেরি করতে চাইনা!
-অনু তুমি এখানে? কাজী অফিসের সামনে কি করছো? ঐ লোকটা কে? অনুর বাবা উদ্বিগ্ন হয়ে কথাগুলো বললো ৷ অনু তার দিকে তাকাতেই ঘাবড়ে গেলো ৷ অনুর চেহারা ফ্যাকাশে হয়ে গেলো ৷ সে তোতলাতে তোতলাতে বললো,
-কই? না.. এমনি..এমনি এখানে এসেছি ৷
-লোকটা কে?
-তাকে চিনোনা? সে একজন জনপ্রিয় সংবাদপাঠক ৷ টিভিতে তুমি দেখেছো হয়তো!
-খেয়াল নেই ৷ যাহোক, বাসায় যাবেনা তুমি? কাজ শেষ তো?
-হুম, শেষ!
-তাহলে গাড়িতে ওঠো ৷
অনু অপরাধীর চেহারা বানিয়ে তার বাবার গাড়িতে প্রবেশ করলো ৷ কষ্ট পেলাম অনুর ব্যবহারে ৷ সে তার বাবাকে কেন আমাদের আসল সম্পর্কের কথা খুলে বললোনা? তীব্র রাগ নিয়ে মনে মনে অনুকে ভৎর্সনা দিয়ে বাসার দিকে চললাম! রাতে অনু আমাকে ফোন করলো ৷৷ সে কান্নামিশ্রিত কন্ঠে বললো,
-অর্ণব, আমি বাসা থেকে বের হয়ে আসছি ৷ তোমার বাসার দিকে যাচ্ছি ৷ তুমি একটু ২ নম্বর রোডের দিকে আসবে! আতঙ্কিত স্বরে বললাম,
-হ্যাঁ, আমি আসছি ৷ কিন্তু তুমি কাঁদছো কেন? কোনো সমস্যা?
-তুমি তাড়াতাড়ি আসো!
গাড়ি নিয়ে চললাম গন্তব্যের দিকে ৷ ২নম্বর রোডে পৌঁছতেই অনুকে একটি রেস্টুরেন্টের সামনে দাঁড়ানো অবস্থায় দেখতে পেলাম ৷ গাড়ি থেকে নামতেই অনু আমার দিকে এগিয়ে এলো ৷ আমাকে জড়িয়ে ধরে সে ফুঁপিয়ে কাঁদতে লাগলো ৷ তার মাথায় হাত বুলিয়ে দিয়ে চিন্তিত গলায় বললাম,
-কি হয়েছে অনু, কাঁদছো কেন? বেশকিছুক্ষণ পর অনু আমাকে ছেড়ে দিয়ে কাঁপা গলায় বলতে লাগলো,
-তোমাকে ছেড়ে বাসায় যাবার পর বাবা আমাকে জানায় যে তারা আমার বিয়ে ঠিক করেছে ৷ বাবা জোর দিয়ে বলে আমাকে এই বিয়েতে রাজি হতেই হবে ৷ কিন্তু আমি সাহস করে বলি যে কিছুতেই বিয়েটা করতে পারবোনা ৷৷ বিয়ে করলে অর্ণবকেই করবো ৷ তোমার সম্পর্কে সব কথা আব্বুকে বলে দিই ৷ এতে সে রেগে যায়, এবং বলে “আমি যে সিদ্ধান্ত নিয়েছি সেটাই ফাইনাল!” প্রতিত্তরে আমিও আব্বুকে খোলাসা করে বলি যে অর্ণবকে ছাড়া কাউকে বিয়ে করবোনা ৷ তখন সে আমার আসল পরিচয়টা জানিয়ে দেয় ৷ সে বলতে থাকে, “অনু, তবে তুমি এখনই ইয়াতিমখানায় চলে যাও ৷ তোমাকে আর আমাদের দরকার নেই ৷ নিঃসন্তান ছিলাম আমরা ৷ কিন্তু তোমাকে দত্তক নেবার ১০ বছর পর সাইমের জন্ম হয় ৷ তবুও আমরা তোমাকে মেয়ে হিসেবে বড় করি ৷ তোমাকে এতো স্বাধীনতা দিয়েছি ৷ শিক্ষিত করেছি ৷ কিন্তু আজ তুমি এই প্রতিদান দিলে ৷ আমার একটা আবদার পূরণ করতে অস্বীকার করছো? ঠিকআছে, তুমি যদি অর্ণবকে পেতে চাও তবে চলে যাও, কখনই এই বাসায় এসোনা! এমন সত্য আমি মেনে নিতে পারিনি ৷ মেনে নেবার মত নয় ৷ আম্মুর নিকট এটার সত্যতা জিজ্ঞেসা করতে গিয়ে বললাম,
-এসব কি সত্য মা? আম্মু মাথা নাড়লো ৷ ক্ষণিক পর সে বললো,
-তোর আব্বু তোকে এসব কিছুতেই বলতোনা ৷ বাধ্য হয়ে বলেছে ৷ একের পর এক প্রজেক্টে লস যাওয়াই সে ভেঙ্গে পরেছিলো ৷ তার বন্ধু অমিত তাকে আশ্বস্ত করলো যে ৫ কোটি টাকার ঋণ সে দিবে, বিনিময়ে শর্ত দিলো তার ছেলের সঙ্গে তোর বিয়ের ৷ বিয়ের পক্ষে মত না দিলে সে ঋণ দিবেনা ৷ কিন্তু যখন আমি তোর বাবাকে তোর সম্পর্কের কথা খুলে বললাম সে রেগে গেলো ৷ সহ্য করতে পারলোনা ব্যপারটা ৷ তোর মুখ থেকে অর্ণবের নাম শুনে সে নিজের নিয়ন্ত্রণও হারিয়ে ফেললো ৷৷ এতে সে এতোদিনের গোপন সত্য প্রকাশ করে দিলো ৷৷ কিন্তু অনু, তুই দয়া করে তোর বাবার কথায় রাগ করে চলে যাস না ৷ সে রেগে কথাগুলো বলেছে ৷ রাগ কমলে সে নিজের ভুলটা বুঝতে পারবে!
-মা, আমি তোমাদের আসল মেয়ে নই, তোমরা আমার বাবা, মা নও ৷ এটা যে সত্য সেটার প্রমাণ পেয়ে গেছি আমি ৷ তাই আমি চাইনা এই বাসায় থাকতে ৷ জানি এমনটা করা ঠিক হচ্ছেনা ৷ কিন্তু আমি কিছুতে বাবার পছন্দের ছেলেকে বিয়ে করতে পারবোনা ৷ অর্ণবকে আমি ঠকাতে পারবোনা ৷ আমি তাকে মনেপ্রাণে ভালোবাসি ৷ ভালো থেকো তোমরা, পারলে আমাকে ক্ষমা করো! শুধু শেষবারের মত জানতে চাই আমার আসল বাবা, মা কে? আম্মুর চোখে পানি ৷ অশ্রুসজল শাড়ির আঁচল দিয়ে মুছলো এবং ক্রন্দনরত কন্ঠস্বরে বললো,
-ইয়াতিমখানার কেউই তোর প্রকৃত বাবা,মায়ের পরিচয় জানেন না ৷ ইয়াতিমখানার ইমাম তোকে ভোরবেলায় ইয়াতিমখানার বারান্দায় শায়িত অবস্থায় পেয়েছিলো ৷ সেসময় তুই নবজাতক শিশু ছিলি! আমরা তোকে ঐ ঘটনার ১৫দিন পর ইয়াতিমখানা থেকে বাসায় নিয়ে আসি!
অাম্মুর থেকে এতো কঠিন সত্য জানার পর আমি আমার বাবা, মা ও নিজের আসল পরিচয়টা খুব সহজে বুঝে নিতে পেরেছি ৷ অর্ণব, তুমি একদিন বলেছিলো বাকশক্তি হারালে আমি তোমাকে আগের মত ভালোবাসবো কি না, তোমাকে জীবনসঙ্গী করে নিবো কি না! সেই উত্তর তুমি পেয়েছো ৷ কিন্তু আমি আজ বলছি, আমার মত বাবা, মায়ের পরিচয়হীন একটি মেয়েকে তুমি গ্রহণ করবে কি না? আবেগপ্রবণ হয়ে আমার দু চোখের কোণ বেয়ে অশ্রধারা অঝোরে বিয়োগ হচ্ছিলো ৷ নিজেকে ধরে রাখতে না পেরে অনুকে বুকের জমিনে জড়িয়ে নিয়ে ডুকরে কেঁদে বলে উঠলাম,
-অনু অামি তোমাকে শুধুমাত্র একটি পরিচয়ে ভালোবেসেছি, সেটা হচ্ছে তুমি খুব ভালো মেয়ে ৷ যার সঙ্গে পরিচয় হয়ে নিজেকে রাঙাতে পেরেছিলাম ৷ যে মেয়েটি আমাকে মন উজার করে ভালোবাসে তাকে কিভাবে আমি দূরে ঠেলে দিতে পারি, বলো? আমি তো তোমার নিকট আর্জি করি যেনো তুমি আমাকে ছেড়ে না যাও!
অবশেষে অনুকে সারাজীবনের জন্য অর্ধাঙ্গীনি হিসেবে পেলাম ৷ তাকে পাবার পর আমি বলতে বাধ্য যে সৃষ্টিকর্তার দেওয়া উপহারের মধ্যে সে আমার জীবনের শ্রেষ্ঠ উপহার! বিয়ের তিনটা দিন গভীর ভালোবাসায় কাটিয়ে দিলাম ৷ কিন্তু আমার জীবনে শোকের ছায়া নেমে এলো ৷ বিয়ের তিনদিন পর আমি কথা বলার শক্তিটাই হারিয়ে ফেললাম চিরতরে ৷ অনুকে অনেক কিছু বলার ছিলো ৷৷তাকে বিয়ের পর প্রতিটা দিন কবিতা আবৃত্তি করে, গান গাইয়ে শোনাবো এই ভাবনা অনেকদিনের! কিন্তু সেই শক্তিটা আমি হারিয়ে ফেললাম ৷৷ তবে হাত তো আমার সঙ্গেই রয়েছে ৷ অনুকে নিয়ে ডায়েরীতে যাবতীয় মনের কথা লিখতে শুরু করে দিয়েছি ৷ হয়তো সে আমার আনাড়ি হাতের ভালোবাসার কবিতা ও গান পাঠ করে উপভোগ করবে! যখন আমি কথা বলতে পারতাম সেসময়ে চেয়ে এখনই অনু আমাকে বেশি ভালোবাসে! আমার সাধের জবটা হারিয়ে গেছে ৷ কিন্তু আমার প্রতি অনুর ভালোবাসা বিন্দু পরিমাণ হারায়নি! ভালোবাসি আমার স্ত্রীকে!
গল্পের বিষয়:
গল্প
DMCA.com Protection Status
loading...

Share This Post

আরও গল্প

সর্বাধিক পঠিত