সময়ের প্রতিশোধ

সময়ের প্রতিশোধ
প্যান্টের চেইনটা লাগালাম। এদিক ওদিক তাকালাম। কেউ দেখেছে? না, কেউ দেখেনি। আমার স্ত্রী রমিজা মাসে ত্রিশ দিনের বিশ দিনই অসুস্থ থাকে। ওর অসুস্থতার জন্য আমার শারীরিক চাহিদা ঠিকমতো মেটাতে পারিনা। রবিউল সাহেবের মেয়ে নিসা ক্লাস ফাইভে পড়ে। দেখতে বেশ নাদুসনুদুস, বাড়ন্ত। ওকে দেখলেই আমার লোভ হয়।
প্রতিদিন ওকে দেখি কিন্তু সুযোগ পাইনা। আজ সুযোগ পেয়ে ওকে এই ঝোঁপের আড়ালে জোর করে টেনে এনেছি। ও বারবার বলছিলো, “আঙ্কেল আমাকে মারছেন কেন? আমি অনেক ব্যথা পাচ্ছি।” কিন্তু আমি শুনিনি। কেন শুনবো? এমন সুযোগ বারবার আসে? সমাজে বেশ সম্মান থাকার কারণে পতিতালয়ে যেতে পারিনা। বউয়ের কাছেও সব চাহিদা মেটেনা। কিন্তু এভাবে কতদিন থাকা যায়? আমি তো পুরুষ মানুষ তাইনা? কতক্ষণ নিজেকে ধরে রাখবো? আজ মেয়েটা কোচিং থেকে আসতে একটু সন্ধ্যা হয়ে যায়। আমিও সুযোগ বুঝে কাজ সেরে ফেলি। ও যখন চিৎকার করছিলো ওর মুখ চেপে ধরে বলেছিলাম, “একদম চুপ। একটুও চিৎকার করলে এখানেই গলা টিপে মেরে ফেলবো”। মেয়েটা ভয়ে আর কিছু বলেনি। তবে গোঙাচ্ছে এখনও। “কাউকে যদি এসব বলেছিস তাহলে তোকে জানে মেরে ফেলবো। আর তোর যে ছোটো বোনটা আছেনা? ওকেও এভাবে মারবো। একদম মুখ খুলবিনা।”
কথাগুলো বলে ওকে ছেড়ে দিলাম। ও ক্লান্ত শরীরে খোঁড়াতে খোঁড়াতে বাসার দিকে গেলো। ছেড়ে তো দিলাম কিন্তু মনের সন্দেহ যাচ্ছেনা। কাউকে বলবেনা তো? ধুর, বললেই বা কি? সবাই আমাকে খুব সম্মান করে। এতটুকু পিচ্চি মেয়ের কথা কেউ বিশ্বাস করবেনা। আমাকে কিছু বললে আমি বলবো যে, সন্ধ্যাবেলায় কাকে না কাকে দেখেছে, কে কি করেছে আর আমার নাম বলছে। কয়েকদিন হলো দেখছি রবিউল সাহেবের বাসায় তালা দেওয়া। বাড়িওয়ালাকে জিজ্ঞেস করাতে উনি বললেন যে ওনারা বাসা ছেড়ে চলে গেছেন। আমিও হাফ ছেড়ে বাঁচলাম। যাক, কেউ কিছু জানতে পারেনি। আমাকে নিয়ে তাহলে টানাটানি হবেনা।
১৪ বছর পর আজ আমার ছেলে নেহাল একটা মেয়েকে বিয়ে করে সোজা বাড়িতে এসে উঠেছে। ওরা একে অপরকে ভালোবাসে। নেহাল মেয়েটার বাবার সাথে কথাও বলেছে। কিন্তু উনি আমার ছেলেকে পছন্দ করেন নি। কিসের কমতি আমার ছেলের? শিক্ষিত, ভালো চাকরি করে, দেখতেও ভালো। নেহাল ওনাকে বলেছে আমাকে নিয়ে ওনাদের বাসায় যাবে। কিন্তু উনি সাফ মানা করে দিয়েছেন যে ওনার মেয়ের বিয়ে এখানে দিবেন না। পরে ওনারা জোর করে মেয়েকে অন্য কোথাও বিয়ে দিচ্ছিলেন। তাই নেহালের সাথে পালিয়ে এসেছে। এসব কেমন কথা? এটা মডার্ন যুগ। এখন ছেলে মেয়ের পছন্দ থাকাটা খারাপ কিছুনা। কিন্তু বাবা-মায়েরা মনে করেন মেয়ে যার সাথে প্রেম করছে তার সাথে কোনোভাবেই বিয়ে দেওয়া যাবেনা। আমার অবশ্য প্রেম-ভালোবাসায় কোনও আপত্তি নেই।
আমাদের পরিবারে সদস্য বলতে আমি, নেহাল আর একটা কাজের ছেলে। আমার স্ত্রী গত হয়েছে পাঁচ বছর হলো। নেহাল বউ নিয়ে আসার পর প্রতিবেশীরা ভিড় করেছেন। নতুন বউ দেখছে সবাই। মিষ্টি আনিয়ে ওনাদের মিষ্টিমুখ করালাম। কাজের ছেলেটাকে টাকা দিলাম। ফুল এনে বর-বউয়ের রুমটা সাজিয়ে দিতে বললাম। রাতে সবাই একসাথে খেতে বসেছি। বউমা বাড়িতে এসে আমাকে সালাম দিয়েছিলো। তারপর প্রতিবেশী মহিলারা সবাই ভেতরের রুমে গিয়ে নতুন বউয়ের সাথে গল্প শুরু করে দিলো। আমি আর মহিলাদের মধ্যে যাইনি। তাই বউমার সাথে সেভাবে কথা হয়নি, মুখটাও ভালোভাবে দেখা হয়নি। এখন খাওয়ার জন্য বউমা ঘোমটা সরাতেই ওকে দেখে আমি কেঁপে উঠলাম। সেই পরিচিত মুখ। এতো এতো রবিউল সাহেবের মেয়ে নিসা! ওকেই আমার ছেলে বিয়ে করে আনলো? নিসাও আমাকে দেখে আঁতকে উঠলো। ও ঘামছে।
চোখগুলো বড়ো হয়ে গেছে। ভয়ার্ত চোখে তাকিয়ে আছে আমার দিকে। একটুপর জ্ঞান হারালো। চোখে-মুখে পানি ছিটিয়ে নিসার জ্ঞান ফেরানো হলো। এখনও ভয় পেয়েই আমার দিকে তাকাচ্ছে। নেহাল এতবার জিজ্ঞেস করছে কি হয়েছে কিন্তু কোনও কথা বলছেনা। কিই বা বলবে! কিভাবে বলবে যে আজ শ্বশুর নামে পরিচিত লোকটা একদিন একা পেয়ে ওকে ধর্ষণ করেছিলো। স্বামীকে কিভাবে বলবে যে তার বাবা তারই স্ত্রীর ধর্ষক! বারান্দায় পায়চারি করছি। ঘুমাতে পারছিনা। নেহাল আমাকে বলেছিলো যে ওর প্রেমিকার বাবা ওকে পছন্দ করেনা। আমি তেমন গুরুত্ব দেইনি। কিন্তু আজ যে হুট করে বিয়ে করে বাড়িতে বউ আনবে সেটা ভাবতে পারিনি।
ও যে ওনাদের সাথে যোগাযোগ করেছে, এত কথা বলেছে তাও আমাকে খুলে বলেনি। এখন ভাবছি এরপর কি হবে? নিসা কি নেহালকে সবকিছু বলে দেবে? যদি বলে তাহলে আমার ছেলের সামনে মুখ দেখাবো কিভাবে? যদি না বলে তবুও বউমার সাথে একই বাড়িতে থাকবো কিভাবে? বউমা কি কখনও আমাকে শ্বশুর বা বাবা ভাবতে পারবে? পারবে না হয়তো। সারাজীবন আমাকে ঘৃণা করবে। ওর এই ঘৃণা নিয়ে আমি কিভাবে এই বাড়িতে থাকবো? এমন পরিস্থিতিতে পড়ার আগে আমার মরে যাওয়া ভালো ছিলো। সারারাত নির্ঘুম কাটালাম। সকাল হলো। বউমা রান্নাঘরে নাস্তা বানাচ্ছে। নেহাল ফ্রেশ হতে ওয়াশরুশে ঢুকলো। এই সুযোগে আমি রান্নাঘরে গেলাম। আমাকে দেখে বউমা আঁতকে উঠে পেছনে সরে গেলো। ওর চোখেমুখে ভয়। আমি ওর দিকে এগোচ্ছি আর ওর ভয় বাড়ছে। ওর সামনে গিয়ে আমি ওর পা জড়িয়ে ধরলাম,
– আমাকে ক্ষমা করে দাও মা। আমি তোমার সাথে অন্যায় করেছি।
– কি করছেন আপনি? ছাড়ুন।
– আমাকে ক্ষমা করো মা। আমি যে মনে একটুও শান্তি পাচ্ছি না।
– দেখুন, আপনার ছেলেকে আমি কিছুই বলিনি। ও যদি এখন হুট করে এখানে চলে আসে আর আপনাকে এভাবে দেখে তখন অনেক প্রশ্ন করবে। বাধ্য হয়ে আমাকে সত্যিটা বলতে হবে। তার চেয়ে ভালো আপনি এখান থেকে চলে যান। প্লিজ উঠুন।
– আমি কি ক্ষমা পাবো না? নিসা কোনও কথা না বলে অন্য দিকে মুখ ঘুরিয়ে নিলো। ওর চোখ দিয়ে ঘৃণা বের হচ্ছে তা স্পষ্ট দেখা যাচ্ছে। আমি উত্তর পেয়ে গিয়েছি। সবাই একসাথে নাস্তা করতে বসেছি। বউমা মাথা নিচু করে খাবার টেবিলে বসে আছে। নীরবতা ভেঙে আমিই বলতে শুরুকরলাম,
– নেহাল, তোর সাথে কিছু কথা ছিলো।
– বলো বাবা।
– আমি সিদ্ধান্ত নিয়েছি আমি বৃদ্ধাশ্রমে চলে যাবো।
– কি বলছো বাবা? নিসা মাত্রই বাড়িতে আসলো। এতদিন বলতে তোমার সেবাযত্ন করার মতো কেউ নেই। এখন যখন নিসা এসেছে তুমি বৃদ্ধাশ্রমে যেতে চাইছো কেন?
– আমার বড়ো একা লাগে। গল্প করার জন্য সঙ্গী দরকার। বৃদ্ধাশ্রমে গেলে অনেক সঙ্গী পাবো। সময় কাটবে।
– তোমাকে আমি যেতে দেবোনা বাবা। তুমি ছাড়া আমার কেই বা আছে? আমি যতদিন পৃথিবীতে আছি তুমি আমার কাছেই থাকবে। আর তুমি এভাবে বৃদ্ধাশ্রমে গেলে লোকে কি বলবে? সবাই এটাই ভাববে যে আমি তোমাকে তাড়িয়ে দিয়েছি। কিন্তু আমি নিজেই তো চাইনা যে তুমি বৃদ্ধাশ্রমে যাও। তাহলে….
– আমার সিদ্ধান্ত নড়চড় হবেনা। যা বলেছি তাই হবে। তুই যখন ইচ্ছা আমাকে গিয়ে দেখে আসবি। আর এখন তো
প্রযুক্তির যুগ। ফোনে কথা বলতে পারবি যেকোনও সময়।
– ঠিক আছে বাবা। তুমি যখন সিদ্ধান্ত বদলাবেই না তাহলে যেটা ভালো বোঝো করো। খাবার টেবিল থেকে চলে আসলাম। বউমা একবারের জন্যেও আমার সিদ্ধান্তে বাঁধা দেয়নি। কেনই বা দেবে? যার জন্য মনে এত ঘৃণা তার সাথে একই বাড়িতে থাকতে বউমা নিজেও হয়তো চায় না। প্রকৃতি কখন কিভাবে বদলা নেয় কেউ জানেনা। এখন শুধু একটাই আশা, তওবাহ করে ক্ষমা চাওয়ার পর সৃষ্টিকর্তা যদি দয়া করে আমাকে ক্ষমা করেন!
গল্পের বিষয়:
গল্প
DMCA.com Protection Status
loading...

Share This Post

সর্বাধিক পঠিত