এক পায়ের উপর ভর দিয়ে কান ধরে দাঁড়িয়ে আছে এনায়েত । স্কুলের ছাত্র-ছাত্রী সবাই মাঠে নেমে এসেছে। স্কুল ছুটি হয়েছে তবুও কারোরই বাড়ি ফেরার কোন তাগিদ নেই। এনায়েতকে ঘিরে দাঁড়িয়ে আছে তারা। সহপাঠী একজনকে আয়োজন করে শাস্তি দেয়া হচ্ছে- এমন মধুর দৃশ্য দেখার সুযোগ বারবার আসে না। এনায়েতের ঠিক সামনেই একটা চেয়ার পেতে বসে আছেন সোনাপুর হাইস্কুলের হেড মাস্টার বোরহান উদ্দিন। তিনি কিছুক্ষণ পর পর বিনা কারণেই ধমক দিচ্ছেন। সেই ধমকে এনায়েতের শরীর কেঁপে উঠছে। তবু সে পা ফেলছে না। পা ফেললেই শাস্তির পরিমাণ বেড়ে যাবে। হেড স্যারকে সে জমের মতো ভয় পায়।
“তুই কোন সাহসে এই কাজ করলি বল। তোর কি লজ্জা শরম নাই?” গলা খাকারি দিলেন বোরহান উদ্দিন।
“আমি কিছু করি নাই স্যার।”
“খবরদার মিথ্যা বলবি না। পরশু দিনই তুই সাইলেন্সার পাইপে বালি ভরে রেখেছিস। আজ আবার এই কাজ করলি”
“স্যার, আমি আপনের মোটরসাইকেলের উপরে মুতি নাই। পানি পড়ছে। আমি মুতি নাই।”
“মুতি নাই কিরে ফাজিল? ভদ্র ভাষায় কথা বল। লেখাপড়া করে এই ভাষা শিখতেছিস!”
এনায়েত মোল্লা ভদ্র ভাষা বলার চেষ্টা করল। কিন্তু অন্য কোন শব্দ তার মাথায় এলো না। সে বার বার সেই ভয়াবহ বাক্যটা উচ্চারণ করতে লাগলো। স্যারের পাশের চেয়ারে বসা ম্যাডাম উঠে চলে গেলেন। এই জাতীয় কথাবার্তা শোনার পর বসে থাকাও অসভ্যতার পর্যায়ে পড়ে। বোরহান উদ্দিন আর কিছু বললেন না। রাগে তার গা কাঁপতে লাগলো। ক্লাস সেভেনে পড়ুয়া একটা ছেলে এতটা বেয়াদব কিভাবে হলো তিনি বুঝতে পারছেন না। বাসা দূরে বলে তিনি মোটরসাইকেল কিনে নিয়েছেন। মোটরসাইকেলে চেপে স্কুলে আসেন। কিন্তু ইদানীং এই ছোকরার যন্ত্রণায় তিনি অতিষ্ঠ হয়ে উঠেছেন।
সুযোগ পেলেই এনায়েত, স্ট্যান্ড করে রাখা মোটরসাইকেলটিতে উঠে বসে। উঠে নানা অঙ্গ-ভঙ্গি করতে থাকে সে। একদিন টিফিন টাইমে তিনি প্রথম দৃশ্যটা দেখলেন। এনায়েত মোল্লা তার বাইকে উঠে বসেছে। তার হাতে একটা রুমাল। সে এক হাতে সেই রুমালটা নাড়ছে। অনেকটা বলিউড হিরোদের মতো। সেদিন তিনি তেমন কিছুই বলেননি। ধমক দিয়ে ছেড়ে দিয়েছেন। এই বয়সে ছেলেদের বাইকের প্রতি আগ্রহ থাকবে এটাই স্বাভাবিক। তবে এনায়েতের আগ্রহের কোন সীমা পরিসীমা নেই। সে যখন দেখলো তাকে বাইকে উঠতে দেয়া হচ্ছে না, সে প্রতিশোধপরায়ণ হয়ে উঠলো। একদিন বাইকের সাইলেনসার পাইপে বালি পাওয়া গেল। আরেকদিন চাকা লিক করা হলো। বোরহান উদ্দিন হাতে-নাতে ধরার সুযোগের অপেক্ষায় ছিলেন। আজ সেই সুযোগ পাওয়া গেছে। আজ সকালে ফাজিলটা বাইকের গায়ে পেশাব করে দিয়েছে।
দপ্তরি, রমিজ মিয়া নিজ চোখে এই ঘটনা দেখেছে। বোরহান উদ্দিন উপস্থিত সবার দিকে তাকালেন। তারপর হুংকার ছাড়লেন তিনি, “সবাই এখানে ভীড় করে আছিস কেন? বাড়ি যা বদের দল।” তার এহেন হুংকারের পরও কেউ নড়ল না। তারা এনায়েতের শাস্তি শেষ না হওয়া পর্যন্ত নড়বে না। সেদিন সন্ধ্যায় বোরহান উদ্দিন এনায়েতদের বাসায় গেলেন। তিনি ঠিক করে রেখেছিলেন এনায়েতের বাবার সাথে কিছুটা রাগারাগি করবেন। তার সেই ইচ্ছা বেশিক্ষণ রইলো না। ঐ বাড়িতে পা ফেলেই তিনি ভুনা খিচুড়ির ঘ্রাণ পেলেন। তার রাগ কমে গেল। ভুনা খিচুড়ির ঘ্রাণ নাকে নিয়ে রাগারাগি করা যায় না। এনায়েত মোল্লার বাবা, লিয়াকত মোল্লার সাথে তিনি খোশগল্প শুরু করলেন।
খিচুড়ি খাওয়া যখন প্রায় শেষ, তিনি নরম গলায় বললেন, “এনায়েতকে একটু বোঝাবেন ভাই। এটা ওর ক্রিকেট খেলার বয়স। এই বয়সে মোটরসাইকেলের নেশা তো ভালো লক্ষণ না।” লিয়াকত মোল্লা রাগী মানুষ। হেড স্যারের অনুরোধে সে রাগ চেপে গেল। ঘুমাতে যাওয়ার আগ মুহুর্তে লিয়াকত মোল্লা ছেলেকে বোঝাতে গেল। বাবাকে একটু নরম দেখে এনায়েতেরও সাহস বেড়ে গেল। এই সুযোগে সে বলে বসল- তাকে একটা মোটরসাইকেল কিনে দিতে হবে। ছেলের আবদার শুনে লিয়াকত মোল্লা হেসে ফেললো। ছেলের চোখে মুখে আগ্রহ দেখে তার কিছুটা মায়াও লাগলো। “ঠিক আছে। তুই মেট্রিক পাশ দিলেই একটা হোন্ডা কিনা দিমু তোরে। খুশি এইবার?” হাসিমুখে বলল লিয়াকত মোল্লা। এনায়েত হাসতে পারল না। তিন বছর অপেক্ষা করার মতো ধৈর্য এই বয়সী ছেলেদের থাকে না। বাবার প্রতি এক বুক অভিমান নিয়েই ঘুমাতে গেল সে।
পরদিন ভোরেই সে যখন দেখলো তার জন্য একটা নতুন বাই-সাইকেল কিনে আনা হয়েছে, বাবার প্রতি অভিমান আর রইলো না। বাই-সাইকেলের প্রতি তার কোন কালেই আগ্রহ ছিলো না। তবু সে ভীষণ খুশি হলো কারণ এই বাই-সাইকেলে চেপে সে হাটবারের দিন বড় বাজারে যেতে পারবে। যেহেতু হাটের দিন মানুষ বেশি হয়, কাজেই বাজারে মোটরসাইকেলের সংখ্যাও বেড়ে যায়। দূর গ্রামের ধনী লোকেরা মোটরসাইকেলে করে বাজারে আসে। বট তলায় সারি ধরে রাখা মোটরসাইকেলগুলোর দিকে মুগ্ধ চোখে তাকিয়ে থাকে এনায়েত মোল্লা। সে সারির এ মাথা থেকে ও মাথা হেঁটে যায়। আবার ফিরে আসে। সূক্ষ্ম নজরে প্রতিটি মোটরসাইকেল দেখে সে। বিচার করার চেষ্টা করে কোন মোটরসাইকেলটা সব চাইতে সুন্দর। খুব বেশি ভালো লাগলে সেই মোটরসাইকেলটা ছুঁয়ে দেখে সে। পরম ভালোবাসায় হাত বুলায় মোটরসাইকেলের গায়ে। সে কেমন মোটরসাইকেল কিনবে সেটাও ঠিক করা হয়। তার কল্পনার মোটরসাইকেলের সাথে কোনটাই মেলে না। কারণ কিশোর বয়সের স্বপ্নে রঙের পরিমাণটা একটু বেশিই থাকে।
এক শনিবারের ঘটনা। হাটবার। এনায়েত মোল্লা যথারীতি বটতলায় উপস্থিত হয়েছে। সবটুকু মনোযোগ দিয়ে মোটরসাইকেল দেখছে সে। এমন সময় ইঞ্জিনের শব্দটা কানে এলো। সে বোঝার চেষ্টা করল এটা কোন কোম্পানির মোটরসাইকেল। শব্দ শুনেই সে মোটামুটি ধরে ফেলতে পারে। এবারে ধরতে পারলো না। ইঞ্জিনের শব্দটা নতুন। পেছনে ফিরে তাকালো সে। মুগ্ধ হয়ে দেখতে পেলো সম্পূর্ণ নতুন ধরনের মোটরসাইকেলটি। নীল রঙের অদ্ভুত সুন্দর একটা মোটরসাইকেল। চাকাগুলোও কেমন আধুনিক। এ যেন ঠিক তার কল্পনার সেই মোটরসাইকেল।
বাইক আরোহী ততক্ষণে নেমেছে। এনায়েত মোল্লা ছুটে গিয়ে জিজ্ঞেস করলো, “ভাই, এইডা কোন কোম্পানির মোটরসাইকেল?” যুবক ছেলেটা হাসিমুখে বলল, “হোন্ডা সিবিএস-১২৫, জাপানি বাইক। নতুন আসছে এটা।” এনায়েত আর কোন কথা বলতে পারলো না। সে হোন্ডা থেকে চোখ সরাতে পারছে না।
সেদিন রাতে এনায়েত মোল্লার ঘুম হলো না। চোখ বন্ধ করলেই সে ঐ বাইকটা দেখতে পেল। পরদিন ভোরে আরেক দফা কান্নাকাটি শুরু করলো সে। তার প্রধান অস্ত্রটি ব্যবহার করে বলল যে তাকে “সিবিএস-১২৫” কিনে না দিলে সে ভাত খাবে না। লিয়াকত মোল্লা প্রথমে বোঝানোর চেষ্টা করলেন। এনায়েত মোল্লা বুঝলো না। তার কান্নার বেগ বাড়লো। এবারে লিয়াকত মোল্লা তার স্বভাবসুলভ আচরণ করল। সে একটা পেয়ারা গাছের ডাল ভেঙে আনলো। কিন্তু তার ব্যাবহার করতে হলো না। ডাল দেখেই এনায়েত মোল্লার কান্না থেমে গেল। অপেক্ষা করার মতো কষ্টের কাজ আর নেই। তবুও মানুষ বুকে পাথর চাপা দিয়ে এই কষ্টের কাজটা করে থাকে। পাথরের পরিবর্তে এনায়েত মোল্লার বুকে চেপে বসলো আস্ত এক পাহাড়। কারণ তাকে অপেক্ষা করতে হলো সুদীর্ঘ তিনটি বছর। সময় যে কতটা নিষ্ঠুর হতে পারে বুঝে গেল সে। তার কাছে মনে হলো যুগের পর যুগ ফুরিয়ে যাচ্ছে তবু তিন বছর শেষ হচ্ছে না। সে ধৈর্য ধরেই গেল। প্রতিদিন ঘুম ভাঙতেই সে স্বস্তির নিঃশ্বাস ফেলে। এইতো আরও একটা দিন কমে গেল। এই তিন বছরের প্রতিটি সকাল, সন্ধ্যার হিসেব এনায়েত মোল্লার কাছে আছে।
এক সময় শেষ হলো সেই সুদীর্ঘ অপেক্ষার প্রহর। মেট্রিক পরীক্ষা চলে এলো। এনায়েত মোল্লা পরীক্ষা চলাকালীনই বাইক চালানো শিখে ফেললো। শেষ পরীক্ষাটা দিয়েই সে বাবার সামনে গিয়ে দাঁড়ালো। তাকে কিছু বলতে হলো না। লিয়াকত মোল্লা হাসিমুখে বললেন, “চিন্তার কিছু নাই, মোটরসাইকেল পাবি। সামনের সপ্তাহে কিনা দিলে চলবো?”
এনায়েত মোল্লা কতটা খুশি হলো ঠিক বোঝা গেল না। সে চুপচাপ ঘর থেকে বের হলো। তারপর কোন কারণ ছাড়াই সে দৌড়াতে লাগলো। এক দৌড়ে চলে গেল বড় বাজার পর্যন্ত সেখান থেকে খেলার মাঠ। খেলার মাঠ থেকে ধানখেত। ধানখেত পেরিয়ে নদীর তীর ধরে দৌড়াতে লাগলো সে। সেই মুহুর্তে তার ঠিক কেমন আনন্দ হচ্ছিলো তা অন্য কারো পক্ষে বোঝা সম্ভব ছিল না।
এনায়েত মোল্লার আনন্দের সাথে পাল্লা দিয়ে সোনাপুর গ্রামবাসীর জন্যও একটা আনন্দের সংবাদ চলে এলো। চেয়ারম্যান সাহেব ঘোষণা করল- গ্রামের প্রতিটি রাস্তাতেই ইট বিছানো হবে। গ্রামে আর মাটির রাস্তা খুঁজে পাওয়া যাবে না। পরদিনই উপজেলা থেকে লোক এসে রাস্তা খোড়া শুরু করলো। পানি নিষ্কাশনের জন্য রাস্তার মধ্যে নিয়মিত বিরতিতে গর্ত করা হলো। নতুন রাস্তা হচ্ছে- পুরো গ্রামের মানুষ খুশি। এই খুশিতে এনায়েত মোল্লার চোখে জল চলে এলো। খাওয়া দাওয়া বন্ধ করে দিল সে। লিয়াকত মোল্লা ছেলের মাথায় হাত বুলিয়ে বললেন, “কয়ডা দিন অপেক্ষা কর। রাস্তা ঠিক হইতে এক মাসের বেশি লাগবো না।”
রাস্তা ঠিক হতে চলে গেল পুরো পাঁচ মাস। নতুন রাস্তা উদ্বোধন হওয়ার তিন দিনের মাথাতেই পাশের গ্রামের এক ছেলে বাইক-এক্সিডেন্ট করে মারা গেল। আশেপাশের কয়েক গ্রামে ছড়িয়ে পড়লো সেই খবর। যুবক ছেলেদের যাদের বাইক ছিলো, তাদের বাবা-মার দিন কাটতে লাগলো আতঙ্কে। এই দূর্ঘটনায় এনায়েত মোল্লা পুরোপুরি দমে গেল। এই অবস্থায় মোটরসাইকেল চাওয়ার প্রশ্নই আসে না। ইন্টারমিডিয়েট পরীক্ষার পর এনায়েত মোল্লা আবারও বাবার কাছে গেল। চেহারায় যতটা সম্ভব করুণ ভাব ফুটিয়ে তুলে বলল, “আব্বা, এখন লাগবো না। রেজাল্ট হওয়ার পর কিনা দিলেই হইবো।” লিয়াকত মোল্লা কোন কিছু নিয়ে চিন্তিত ছিলো। সে হাতের ইশারায় কিছু একটা বলল। সেই ইশারা যদিও স্পষ্ট নয় তবু এনায়েত মোল্লা ধরে নিল এবার আর কোন ঝামেলা থাকবে না। সে ঠিক ঠাক পড়াশোনা করেছে। রেজাল্ট ভালো হলে, বাবা নিশ্চয়ই না করবে না।
ইন্টারমিডিয়েট পরীক্ষার রেজাল্ট হওয়ার আগেই এনায়েত মোল্লার বড় বোন, চম্পার বিয়ের আয়োজন শুরু হলো। বাড়ির সবাই বিয়ে নিয়ে ব্যস্ত। জলের মতো টাকা খরচ হচ্ছে। এর মধ্যে মোটরসাইকেলের কথা তোলা যায় না। এনায়েত মোল্লা আর সবার মতোই হাসিমুখেই বিয়ের আয়োজনে মন দিল। বিয়ের অল্পদিনের মধ্যেই শোনা গেল চম্পার জামাই মানুষ ভালো না। সে সংসারে নানা অশান্তি শুরু করেছে। কিছুদিন পর পরই চম্পা বাবার বাড়ি চলে আসে। তাকে ফেরত পাঠানোর সময় সাথে করে অনেকগুলো টাকা দিতে হয়। লিয়াকত মোল্লা এই মানসিক যন্ত্রণা সহ্য করতে পারলো না। এক ভর দুপুরে স্ট্রোক করল সে। এনায়েত মোল্লা বাবাকে নিয়ে সদর হাস্পাতালের দিকে ছুটলো। হাস্পাতাল থেকে বলা হলো- অনেক দেরি হয়ে গেছে। এখন আর তাদের কিছু করার নেই।
পনেরো বছর পরের এক দুপুর। এনায়েত মোল্লা লাঞ্চের পরই অফিস থেকে বেরিয়ে গেল। আজ একটা বিশেষ দিন। সে মোটরসাইকেল কেনার টাকা জমিয়ে ফেলেছে। তার নিজের উপার্জনের টাকা। স্ত্রী-সন্তানের যাবতীয় চাহিদা মেটাবার পর কিছু টাকা সে আলাদা করে রাখতো। দীর্ঘ পাঁচ বছরে অল্প অল্প করে টাকা জমিয়ে আজ টাকাটা পূর্ণ হলো। আজ বিকেলেই সে হোন্ডা – সিবিএস-১২৫ কিনে ফেলবে। সবাই যদিও বলবে এত পুরান মডেলের বাইক কিনে লাভ কী? এতে তার কোন মাথা ব্যথা নেই। তার বহু শখের মোটরসাইকেল এটি। বাসায় ফিরে লম্বা শাওয়ার নিলো এনায়েত মোল্লা। ইস্ত্রি করা পাঞ্জাবি গায়ে দিল সে। সে যে বাইক কিনবে বাসার কেউ জানে না। সন্ধ্যায় যখন বাইক নিয়ে ফিরবে সবাই নিশ্চয়ই চমকে যাবে। এনায়েত মোল্লার সাজগোছ দেখে শায়লা বলল, “কোথাও যাচ্ছো না-কি? এত সাজগোছ করছো যে।”
“এই একটু হেঁটে আসি।”
“একটা জরুরি কথা ছিলো।”
“বলে ফেলো।”
“টগরের সব বন্ধুরই কম্পিউটার আছে। ও রোজ বাসায় ফিরে কান্নাকাটি করে।”
“ওহ আচ্ছা।”
“ওহ আচ্ছা কী? কিছু একটা ব্যবস্থা করো।”
“আচ্ছা দেখি। কিছু করা যায় কি-না।”
“দেখি বললে হবে না। বিয়ের পর থেকে আমিতো তোমার কাছে কখনো কিছু চাইনি। নিজের শখ-আহলাদ বাদই দিলাম। একটাই ছেলে আমাদের। একটা কম্পিউটার চেয়েছে সেটাও যদি না দিতে পারি কেমন দেখায়।”
“কিনে দিবো। সমস্যা নাই।”
“পাঞ্জাবি খুলে ফেললে যে? বাইরে না যেতে চাইলে?”
“নাহ যাব না। শরীরটা ভালো লাগছে না।”
এনায়েত মোল্লা সন্ধ্যার পর ছেলেকে নিয়ে বের হলো। ভালো দেখে একটা কম্পিউটার কিনে দিতে হবে ছেলেকে। টাকা বাঁচলে শায়লার জন্য একটা গলার হারও কিনবে সে। ২০২০ মধ্য দুপুর। এনায়েত মোল্লা রিকশা করে পল্টন যাচ্ছেন। “হোন্ডা সিবিএস-১২৫” মার্কেট-আউট হয়ে বহু বছর আগেই। তিনি খোঁজ পেয়েছেন পল্টনের এক শো-রুমে না-কি পুরাতন বাইকও পাওয়া যায়। নিভে যাওয়া আশার প্রদীপ পুনরায় জ্বেলে এনায়েত মোল্লা ছুটে যাচ্ছেন। গত কয়েক বছর ধরেই তিনি এই বাইকটা খুঁজে বেড়াচ্ছেন। বিষয়টা নিয়ে সবাই আড়ালে হাসাহাসি করে। একদিন টগর আমেরিকা থেকে টেলিফোনে বলেই ফেলল, “বাবা, তুমি কী পাগলামি শুরু করলে?” এনায়েত মোল্লা বললেন, “আমি আবার কী করলাম?”
“তোমার জন্য সবাই আমাকে কথা শোনাচ্ছে। তুমি নিজের ইচ্ছায় দেশে থেকে গেলে, অথচ সবাই ভাবছে আমি ইচ্ছা করে তোমাকে দেশে ফেলে রেখেছি। তোমাকে গাড়ি কিনে দিতে চাইলাম তুমি রাজি হলে না। এখন আবার সেই ছিয়াত্তর সালের বাইক খুঁজে বেড়াচ্ছো। এসব শুনলে মানুষ বলবে কী?” এনায়েত মোল্লা জবাব দেননি। কথার মাঝেই ফোন নামিয়ে রেখেছেন। কারও সাথে মোটরসাইকেল নিয়ে কথা বলতে তার ভালো লাগে না। পল্টনের সেই শো-রুমেও “সিবিএস-১২৫” পাওয়া গেল না। সেলসম্যান বিরক্তি নিয়ে বলল, “এখন ঐ বাইক দিয়া কী করবেন? পালসার, ইমাহা নিয়া যান। গাড়ি চালাবে কে? আপনার ছেলে, না-কি নাতি?” এনায়েত মোল্লা মিনমিন করে বললেন, “ঐ মোটরসাইকেলটা কি এখন আর পাওয়াই যাইবো না?”
“নাহ, চাচা। ঐ গাড়ি পাইবেন না এখন আর। পাইলে পাইতে পারেন পুরান ঢাকার ভাঙারির দোকানে।”
“আসলে বাবা, তোমাকে একটা ঘটনা বলি। আমি তখন স্কুলে পড়ি এনায়েত মোল্লার কথা শেষ করার আগেই সেলসম্যান বিরক্ত হয়ে বলল, “চাচা, আজ একটু ব্যস্ত আছি। পরে একদিন আইসেন। আপনের গল্প শুনবো।” এনায়েত মোল্লা মাথা নিচু করে দোকান থেকে বের হলেন। সেলসম্যান ছেলেটা ঠিকই বলেছে। এখন আর মোটরসাইকেলটা পাওয়া যাবে না। মানুষের স্বপ্ন সব সময়ই রঙিন হয়। সময়ের সাথে সাথে স্বপ্নের রঙ ফিকে হয়ে আসে। সেই রঙ উজ্জ্বল থাকা অবস্থাতেই স্বপ্ন পূরণ করতে হয়। অন্যথায় শুধু স্বপ্নটাই থাকে, স্বপ্নের রঙ থাকে না।
গল্পের বিষয়:
গল্প