কুলখানি

কুলখানি
বড় চাচা দিয়েছেন ১৫০০০ টাকা, মেজ চাচা ১৫০০০ না দিয়েছে, বড় ভাবি ?
– হ্যাঁ, ১৫০০০ দিবেন বলেছে শিমু এখনও দেন নাই।
– দিবেন যখন বলেছেন তাহলে দিয়ে দিবেন। আর খালারা কে কত দিল ?
– বড় খালা দিয়েছেন ১৮০০০, মেজ খালা ১২০০০ আর ছোট খালা দিলেন ৫০০০ টাকা।
– কি!! ছোট খালা মাত্র ৫০০০ দিয়েছেন !! অথচ আব্বা ছোট খালাকে সবসময় বেশি দামি শাড়ি দিতেন।
অন্যান্য খালাদের থেকে ছোট খালার দিকে আব্বার আদর ছিল বেশি। আর উনি কিনা আব্বার কুলখানিতে এত কম টাকা দিলেন ?
তাও এটা আমার হাতে দিয়ে বলে কিনা খালুর নাকি আরও বেশি দেয়ার ইচ্ছা ছিল কিন্তু ব্যবস্থা করতে পারেন নাই তাই দিতে পারেন নাই। এ কথা বলেই বড় ভাবি মুখ বাঁকাল। গত পরশুদিন আমার শ্বশুর মারা গিয়েছেন। আগামীকাল উনার কুলখানি হবে। আজকেই বাজার সদাই করতে হবে। তাই সকাল সকাল আমার এক ননদ আর আমরা পাঁচ জা মিলে আত্মীয়রা কে কত টাকা দিয়ে মিলাদে সামিল হয়েছে সেটার হিসাব করতে বসেছেন। বড় ভাইয়া দোকানে যাবার আগে বলে গেছেন সব টাকা একসাথ করে কাজের ছেলেটাকে দিয়ে যেন দোকানে পাঠিয়ে দেয়। উনি আর মেজ ভাই গিয়ে সব বাজার করে আনবে। আর দোকান সামলাবেন অন্য তিনভাই। জুরাইন বাজারে আমাদের দুইটা মুদি দোকান আছে। ওরা পাঁচ ভাই মিলেই দোকানগুলো দেখাশোনা করে। আগে আব্বাও বসতেন দোকানে। কিন্তু ছয়মাস থেকে স্ট্রোক করে আব্বা বিছানায় ছিলেন। গত পরশু রাতে আবার স্ট্রোক করে হাসপাতালে নিবার আগেই উনি মারা গেলেন।
এই পরিবারের ছোট ছেলে ফারহানের সাথে গত দুইবছর আগে আমার বিয়ে হয়েছে। আমি গ্রামের মেয়ে। আমার বাবা প্রাইমারী স্কুলের একজন শিক্ষক। কিন্তু ফারহানের আমাকে খুবই পছন্দ হয়েছিলো তাই আমার শ্বশুরের ইচ্ছাতেই আমাদের বিয়েটা হয়ে গেছে। আমার বাবার বাড়ি থেকে বিয়ের পরে কোন ফার্নিচার দেয় নাই বলে বিয়ের পর থেকেই আমার জায়েরা আমাকে নানা কটু কথা শুনায়। কিন্তু আমার শাশুড়ি আমাকে কখনো এসব নিয়ে কথা না শুনালেও আমার সাথে কথা খুব কম বলেন। আমার শ্বশুর মারা গিয়েছেন শুনে আমার বাবাও গ্রাম থেকে এসেছেন। কিন্তু আব্বার কুলখানির জন্য কোন টাকা দিয়ে যেতে পারেন নাই।বাবার ঢাকায় আসা- যাওয়ার ভাড়াও আমার চাচা থেকে ধার করে এনেছেন। কিছুক্ষন পরেই কোন বউয়ের বাবার বাড়ি থেকে কত টাকা আসলো সেটার কথা উঠবে। সব ভাবিদের বাপের বাড়ীর অবস্থা ভালো। তাই জানা কথা ওদের বাড়ি থেকে টাকা দিবে। আমি খুব চিন্তায় আছি কিছুক্ষন পরেই আমাকে অনেক কথা শুনতে হবে। আমি বড় ভাবির দিকে তাকিয়ে বললাম – ভাবি আমি একটু আম্মাকে উনার রুমে দেখে আসি।
-আম্মা তো ঘুমায় আম্মাকে কি দেখতে যাবা?
– যদি ঘুম থেকে উঠে কিছু চান। কয়েকদিন থেকে তো কিছুই খাচ্ছেন না।
-ঘুম থেকে উঠলে আম্মা ডাকবে। তখন যেও। এখন বস এখানে। সেজ ভাবি হটাৎ করে বলে উঠল
-কি, রূপা আম্মাকে দেখার কথা বলে এখান থেকে উঠে যেতে চাইছ ?
-কেন রে মেঝ এই কথা বললি কেন?
– আরে বড় ভাবি রুপার বাবা তো আব্বার কুলখানিতে শরীক হবার জন্য কোন টাকা দিয়ে যান নাই। কালকে রুপাকে জিজ্ঞাসা করেছি পরে বলল। এখন যদি সবাই জিজ্ঞাসা করে তাই মনে হয় রূপা এখান থেকে সরে যেতে চাইছে বলে সেজ ভাবি মিটমিট করে হাসতে লাগলো। এই কথা শুনে সবাই আমার দিকে অবাক হয়ে তাকিয়ে রইল। আমার ননদ কপাল কুঁচকে আমার দিকে তাকিয়ে বলল
-এতই অভাব ওদের!! সামান্য কিছু টাকাও ওরা কুলখানিতে শরীক হবার জন্য দিতে পারলো না! বিয়ের পরে ভাইয়াকেও কিছু দেয় নাই। আমাদের কাউকে কিছু দেয়া তো দুরের কথা।
-এটা কোন কথা রূপা ? তোমার বাবার কাছে সামান্য কয়েক হাজার টাকাও ছিল না ? কুলখানিতে শরীক হলে সওয়াব হয়। তাই সকলেই কম বেশি টাকা দিয়ে শরীক হয় এটা তোমাদের বাবার বাড়ীর লোকেরা জানে না? ফকিরদের কাছেও তো দুই তিন হাজার টাকা জমানো থাকে। তোমার বাবার কাছে সেটাও ছিল না !!! আমি আর কান্না সামলাতে পারি নাই। আঁচল দিয়ে চোখের পানি মুছতে লাগলাম। বড় ভাবি আমাকে ধমকে উঠে বললেন – চুপ কর। কিছু বললেই কাঁদবা না। ঢং যত সব। আমার ননদ চিবিয়ে চিবিয়ে বলল – বেঁচে থাকতে তো আব্বাকে তোমারা কিছুই দিতে পারলে না। এখন আব্বার জন্য দোয়ার অনুষ্ঠানেও শরীক হলে না। অথচ আব্বা তোমাকে কত আদর করত।
-ঠিক বলেছিস শিমু। তোর আব্বা বেঁচে থাকতেও তোরা তোর আব্বাকে কিছু দিতে পারিস নাই। এখন মারা গেছেন দোয়া করবি সেটাও তোরা করতে পারিস না। আম্মাকে রুম থেকে বের হয়ে আসতে দেখে আমি দৌড়ে গিয়ে আম্মাকে ধরলাম। আব্বা মারা যাবার পর গত দুইদিন থেকে আম্মা বিছানায় পড়ে গেছেন। কোন কিছুই খাচ্ছেন না। তাই শরীর খুব দুর্বল হয়ে গেছে। আমি ধরে এনে আম্মাকে চেয়ারে বসালাম। বড় ভাবি আম্মার দিকে তাকিয়ে বললেন
– আম্মা আপনি আসলেন কেন? ডাকলে আমরাই আপনার রুমে যেতাম।
-আমি সেই কখন থেকে একটু পানি খাব বলে তোমাদের ডেকেছি। আমার ডাক তোমাদের কানে আসে নাই।
আসবে কিভাবে; তোমরা তো ছোট বউকে কথা শুনাতে ব্যাস্ত। গত দুইদিন থেকে আমি বিছানায় পড়ে আছি। কয়বার গিয়েছ আমার রুমে বড় বৌমা ? আমাকে খাওয়ানো, গোসল করানো, বাথরুমে নিয়ে যাওয়া সবইতো ছোট বৌমা করল। আর এই যে শিমু ; তুই যে বললি ছোট বৌমার বাপের বাড়ীর লোকেরা তোর আব্বাকে বেঁচে থাকতে কিছু দেয় নাই। তুই কি দিয়েছিস তোর আব্বাকে বেঁচে থাকতে ?
-আম্মা আমি আব্বাকে কিছুই দেই নাই!! তুমি এই কথা বলতে পারলা ? প্রতি ঈদেইতো তোমার জামাই তোমাদের সবাইকে জামা কাপড় দেয়।
-জামা কাপড় দিলেই সব দেয়া হয় শিমু? টাকা দিয়ে জিনিস কিনে দিলেই সেটা কে দেয়া বলে তাই নারে? তোর বিয়ের আগ পর্যন্ত তো আমরাও তকে সব জামা কাপড় দিয়েছি। আবার তুই অসুস্থ হলে তোর সেবাও করেছি। তোর আব্বা যে ছয় মাস বিছানায় ছিল একদিনও তোর আব্বার বিছানা পরিষ্কার করেছিস ? বিছানা কি পরিষ্কার করবি ; তোর ছেলেকে তুই আমাদের রুমে যেতে নিষেধ করে দিয়েছিস। কারন আমাদের রুমে পেশাবের গন্ধ লাগে তোর কাছে। অথচ আমি যখন দুইদিনের জন্য জ্বরে ভুগলাম। এই ছোট বউই কিন্তু তোর আব্বার বিছানা পরিষ্কার করেছে। মাঝে মাঝে সেজ বউ গিয়ে তোর আব্বাকে খাইয়ে দিত। না হয় প্রতিদিন ছোট বউই তোর আব্বাকে খাওয়াত। এই যে বড় বৌমা বলল কুলখানিতে শরীক হলে সওয়াব হয়। কোন হাদিসে আছে আত্মীয়- স্বজন থেকে টাকা নিয়ে বাবার কুলখানি করতে হবে? এসব নিয়ম আমরা আমাদের সুবিধার জন্য বানিয়েছি। তোদের আব্বা মারা গেছে যদি তোদের কাছে টাকা থাকে তাহলে তোরা এতিম মিসকিনদের খাওয়াবি। ওরা দোয়া করবে। আর টাকা না থাকলে নামাজ, কুরআন পড়ে তোদের আব্বার জন্য দোয়া করবি।
কি’রে শিমু তোর আব্বা মারা যাবার পরে শুধু হাউমাউ করে কেঁদেছিস। কয় রাকাত নফল নামাজ পড়েছিস উনার আত্মার মাগফেরাতের জন্য ? পড়িস নাই তো। এতগুলো ছেলে,মেয়ে ছেলের বউ, নাতি নাতনী রেখে মানুষটা মারা গেলেন। কিন্তু উনার জন্য কোরআন খতম তোরা মাদ্রাসা থেকে হুজুর এনে করিস । আহ! এর থেকে বড় কষ্ট আর কি হতে পারে ? যে সময় নিয়ে হুজুরদের জন্য তোমরা রান্না করেছ। বাসার সবাই মিলে বসলে সেই সময়ে দুই বার কোরআন খতম দিতে পারত। হুজুর ভাড়া করে বাবার জন্য দোয়া করাবি কেন ? তোদের কে কি তোদের বাবা নামাজ, কোরআন পড়তে শিখাই নাই ? হুজুরদের কে পরে অন্য একদিন ডেকে এমনেতেই খাওয়াবি। দোয়া চাইতে হবে কেন? উনারা নিজে থেকে দোয়া করবেন।
আমার শরীর ভালো নেই। বেশি কথা বলতে পারি না। আমার ছেলেরা বাসায় আসলে ওদের বলে দিবা কোন কুলখানির অনুষ্ঠান করা হবে না। যদি ওদের কাছে টাকা থাকে তাহলে যেন এতিমখানায় কিছু টাকা দিয়ে দেয়া হয়। আর যদি ওদের কাছে টাকা না থাকে তাহলে কিছুই দিতে হবে না। উনার জন্য আমি নামাজ, কোরআন পড়ে দোয়া করব। তোদের কিছুই করতে হবে না।
যারা যারা টাকা দিয়েছে সবার টাকা যেন সবাই কে দিয়ে দেয়া হয়। আর হ্যাঁ ;একটি কথা বলে রাখি, কান খুলে সবাই শুনে রাখো। কার বাবার কত টাকা আছে সেই কথা যেন আমার বাসায় আর কোনদিন না উঠে। তোমরা সবাই এক পরিবারের বউ। তাই অধিকারটাও সকলের সমান এটা মনে রাখবে। ছোট বৌমা পানি নিয়ে দাঁড়িয়ে আছ কেন ? দেও গ্লাসটা আমাকে দেও। আমি নিজেই খেতে পারব।
গল্পের বিষয়:
গল্প
DMCA.com Protection Status
loading...

Share This Post

আরও গল্প

সর্বাধিক পঠিত