২০১৫ সাল এস.এস.সি পরীক্ষার আর মাত্র দুই দিন বাকী। অথচ তখনো এডমিট কার্ড হাতে পাইনি। এডমিট কার্ড ছাড়া তো পরীক্ষার হল এই ঢুকতে দেবে না। কয়েক জন বান্ধবীকে সাথে নিয়ে স্কুলে গেলাম এডমিট কার্ড আনার জন্য। কিন্তু হ্যাড স্যার আমাদের বললেন- তোমরা চিন্তা করো না। পরীক্ষার দিন হল এ ঢোকার আগেই সবাই এডমিট কার্ড হাতে পেয়ে যাবে। আমি নিজে গিয়ে দিয়ে আসবো।
স্যার কে বললাম- কিন্তু স্যার এডমিট কার্ড টা তো আমাদের এক বার দেখে নেওয়ার দরকার ছিল। স্যার বললেন- চিন্তা করো না, দেখার দরকার নেই সব ঠিক আছে। আসলে তোমাদের কার্ড গুলো ভুল করে আমি বাড়িতে রেখে এসেছি। তোমাদের পরীক্ষার দিন আমি নিজে গিয়ে দিয়ে আসবো। তোমরা বাড়ি গিয়ে পরীক্ষার প্রস্তুতি নাও। স্যারের কথা মত আমরা যে যার বাড়ি চলে আসলাম। পরীক্ষার দিন সব বান্ধবীরা হল এর সামনে দাড়িয়ে আছি স্যারের অপেক্ষায়। কিন্তু স্যারের তো দেখাই নেই। অন্যান্য স্কুলের ছাত্রছাত্রি হল এ ঢুকে পড়েছে। এডমিট কার্ড ছাড়া তো আমাদের হল এ ঢুকতেও দেবে না। সবাই চিন্তায় পড়ে গেলাম যে এখন কি করব। পরীক্ষা শুরু হতে মাত্র কয়েক মিনিট বাকী। এমন সময় স্যার এসে আমাদের এডমিট কার্ড গুলো দিলেন। সবাই যেন হাঁফ ছেড়ে বাঁচলাম। এডমিট কার্ড নিয়েই সবাই হল এ ঢুকলাম। পরীক্ষা মোটামোটি ভালোই হলো।
শুধু ঐচ্ছিক বিষয় টা ছাড়া বাকী সব পরীক্ষা শেষ হয়ে গেল। আমার ঐচ্ছিক বিষয় ছিল কৃষি শিক্ষা। আমাদের যে কয়জন বান্ধবীর ঐচ্ছিক বিষয় কৃষি ছিল সবাই এক সাথে গেলাম পরীক্ষা দিতে। পরীক্ষার প্রশ্নপত্র হাতে পেয়ে খুব খুশি হলাম। সব প্রশ্নই কমন পড়েছে। ঐচ্ছিক বিষয়ে নিশ্চিত প্লাস থাকবে। প্রথম প্রশ্নটা লেখা শেষ। যে স্যার ডিউটি দিচ্ছিলেন তিনি খাতায় সাক্ষর করতে এলেন। স্যার সাক্ষর করতে গিয়ে বললেন- একি এডমিট কার্ডে তো কম্পিউটার আছে তুমি কৃষি পরীক্ষা দিচ্ছো কেন? স্যারের মুখে কথাটা শুনে যেন মাথার ওপর আকাশ ভেঙ্গে পড়লো। বললাম- স্যার আমার ঐচ্ছিক বিষয় তো কৃষিশিক্ষা। ক্লাস নাইন টেন কৃষি পড়েছি কৃষিই পরীক্ষা দিয়েছি। তাহলে কম্পিউটার হবে কেন?
স্যার বললেন- কিন্তু তোমার এডমিট কার্ডে তো কম্পিউটার আছে। তোমাকে কম্পিউটার পরীক্ষাই দিতে হবে কিছু করার নেই। দেখা গেল আমাদের কয়েক জন বান্ধবীর এডমিট কার্ডেই কৃষির পরিবর্তে কম্পিউটার এসেছে। স্যার আমাদের হাত থেকে কৃষির প্রশ্নপত্র নিয়ে কম্পিউটার প্রশ্নপত্র দিলেন। প্রশ্নপত্র হাতে নিয়েই চোখ দিয়ে পানি গড়তে শুরু করল। কি লিখব কম্পিউটারের ‘ক’ টাও তো জানি না। আমাদের কয়েক জন বান্ধবীরই যেন দিশেহারা লাগছিল।
আমাদের অবস্থা দেখে যে স্যার ডিউটি দিচ্ছিলেন তিনি পাশের রুম থেকে আমাদের স্কুলের এক স্যার কে ডেকে আনেন। স্যার আমাদের সব কথা শুনলেন। কিন্তু স্যারেরও কিছু করার নেই। আমাদের কম্পিউটার পরীক্ষাই দিতে হবে। কিন্তু লিখব টা কি। অবশেষে আমাদের স্যার প্রধান পরীক্ষকের অনুমতি নিয়ে আমাদের একটু সাহায্য করার সুযোগ পেলেন। কিন্তু ততক্ষণে অনেকটা সময় পেড়িয়ে গেছে। একেতে কোনো প্রশ্নেরই উত্তর জানি না। তার ওপর হাতে সময়ও খুবই কম। স্যারের সাহায্য নিয়ে আমরা কোনো রকমে কয়েকটি প্রশ্নের উত্তর লিখলাম। ভালো ভাবেই বুঝতে পারলাম যে, এতে পাশ নাম্বার উঠবে না। পরীক্ষা শেষে বাড়ি এসে কাঁদছিলাম। বাড়ির সবাই জিজ্ঞাসা করল যে কি হয়েছে? সবটা বললাম। সবাই সান্ত্বনা দিল। কিন্তু নিজেকে কিছুতেই শান্ত করতে পারছিলাম না। সব বান্ধবীকে ডেকে পাঠালাম।
সবাইকে বললাম- হ্যাড স্যারের জন্যই তো আজ আমাদের সাথে এই রকম একটা বাজে ঘটনা ঘটলো। বেশি কিছু না হোক সামান্য পদক্ষেপ তো আমরা হ্যাড স্যারের বিরুদ্ধে নিতেই পারি। উনাকে নিজের ভুলটা বোঝাতে হবে। যাতে আর কোনো দিন কোনো শিক্ষার্থীর জীবন নিয়ে এরকম ছেলে খেলা না করতে পারে। সবাই আমার সাথে একমত হলো। সবাই মিলে উপজেলা শিক্ষা অধিদপ্তরে গেলাম হ্যাড স্যারের বিরুদ্ধে অভিযোগ করার জন্য। ওখানকার অফিসারের সাথে দেখা করে সব ঘটনা খুলে বললাম। তিনি আমাদেন বিভিন্ন প্রশ্ন করেন। বলেন- সব স্কুলের নিয়ম পরীক্ষা শুরুর বেশ কিছু দিন আগেই এডমিট কার্ড ভালোভাবে দেখে শিক্ষার্থীরা সাক্ষর করে এডমিট কার্ড গ্রহণ করবে। তাহলে তোমরা কেন তা করোনি?
অফিসার কে বললাম- আমাদের আগে এডমিট কার্ড দেওয়া হয়নি। আমরা অনেক দিন স্কুলে গিয়েও এডমিট কার্ড না পেয়ে ফিরে এসেছি। তারপর উনাকে বললাম যে, কিভাবে এডমিট কার্ড আমাদের হাতে এসে পৌঁছেছে। আমাদের থেকে হ্যাড স্যারের ক্ষমতা বেশি হওয়ায় ইচ্ছে মত পদক্ষেপ নিতে পারলাম না। তবে ওখানকার অফিসার হ্যাড স্যার কে ডেকে পাঠালেন। তারপর সবার সামনে স্যার কে রীতিমতো অপমান করলেন তার এই কৃতকর্মের জন্য। স্যার আমাদের কাছে ক্ষমা চেয়ে বললেন, ভবিষ্যৎ এ আর কোনো দিন এইরকম ভুল কখনো হবে না। কিছু দিন পর আমাদের রিজাল্ট বের হয়ে গেল।
তখন নিয়ম ছিল ঐচ্ছিক বিষয়ে ফেল আসলেও কোনো সমস্যা হবে না। বাকী সব বিষয়ে পাশ থাকলেই হবে। শুধু নাম্বার টা যোগ হবে না। আগে থেকেই জানতাম ঐচ্ছিক বিষয়ে পাশ নাম্বার থাকবে না, তাই হলো। ৩.৮১ পেয়ে পাশ করলাম। রিজাল্ট পেয়ে স্যারের ওপর প্রচুর রাগ হচ্ছিল। ঐচ্ছিক বিষয় ছাড়াই ৩.৮১ এসেছে। ঐচ্ছিক বিষয়ে সমস্যা না হলে ৪.৩১ পেতাম। কিন্তু আর কিছুই করার নেই। নিয়তি আর নিয়মের বেরাজালে সেটাই মেনে নিতে হলো। বাবা মায়ের সামর্থ্য ছিল না যে, বাহিরের ভালো কোনো কলেজে অনেক টাকা খরচ করে আমাকে পড়াবে। তাই বড় কোনো স্বপ্ন দেখতেও ভয় হতো। সাধ্যের মধ্যেই ছোট একটা স্বপ্ন ছিল যে, প্যারামেডিকেলে পড়বো। যদিও প্যারামেডিকেলের খরচ চালানোই পরিবারের জন্য কষ্টকর।
তবুও ভাবলাম ভর্তি টা তো হই যত কষ্টই হোক একবার চেষ্টা করে দেখি। বাড়ির কাছেই একটা প্যারামেডিকেলে ভর্তি হলাম। খুব ইচ্ছে ছিল ল্যাব টেকনিশিয়ান হবো। তাই সেই বিষয়েই ভর্তি হলাম। যাতে আমার পড়াশোনা চালানোর জন্য বাবা মায়ের কষ্ট না হয় তাই ছোট ছেলে-মেয়ে দের টিউশনি করতে শুরু করলাম। কিছু দিন পর খালাতো ভাই আর ভাবি বললো এখানকার থেকে বাহিরের কোনো প্যারামেডিকেল কলেজে ভর্তি হলে বেশি ভালো হতো। ওদের বললাম- কিন্তু বাহিরের কলেজে পড়তে গেলে তো খরচ বেশি। থাকা খাওয়ারও তো আলাদা খরচ লাগবে। আমি চালাতে পারব না।
ভাবি বললো- তুমি টাঙ্গাইল প্যারামেডিকেলে ভর্তি হও। ওখানে আমার বাবার বাড়িতে থাকবে তাহলে তোমার থাকা আর খাওয়ার খরচটা লাগবে না। পড়ার খরচটা যেকোনো ভাবে ব্যবস্থা হয়ে যাবে। প্রথমে আমার একটু অমত থাকলেও বাড়ির সবার অনুমতি নিয়ে টাঙ্গাইল প্যারামেডিকেলে ভর্তি হলাম। ভাবির বাবার বাড়িতে থাকতে শুরু করলাম। প্রতিদিন কলেজে যেতাম। পড়াশোনাতে মোটামোটি ভালোই ছিলাম। স্যার ম্যাডাম আমাকে ভালোবাসতো। বরাবর কলেজে আমার রিজাল্টও ভালো ছিল। পড়াশোনার পাশাপাশি একটা ক্লিনিকের ল্যাবে টেকনিশিয়ানের কাজ শিখতাম।
দেড় বছর কেটে গেল টাঙ্গাইলে। ৪র্থ সেমিষ্টারে উঠার পর আর্থিক সমস্যা আর অন্যান্য কিছু কারনে ওখানে পড়াশোনা টা আমাকে বাদ দিতে হয়। ওখানে পড়া বন্ধ করে বাড়ি চলে আসি। কিন্তু পড়াশোনা বন্ধ করে বাড়িতে বসে থেকে কি করব। এভাবে তো দিন যাবে না। তাই নতুন করে ইন্টারে ভর্তি হলাম। মাঝখানে ২বছর গ্যাপ দিয়ে আবার ইন্টারে পড়তে শুরু করলাম। আবার ছোট ছেলে-মেয়ে দের টিউশনি করতে শুরু করলাম। ল্যাব টেকনিশিয়ান হওয়ার স্বপ্নটা তো আর পূর্ণ হলো না। তাই ভাবলাম ইন্টার পাশ করে অনার্সেই পড়বো। ইন্টারে খুব ভালো ছাত্রী না হলেও একে বারে খারাপও ছিলাম না। মাঝে মাঝে খুব খারাপ লাগত যে, প্যারামেডিকেলে পড়াটা বন্ধ হয়ে গেল। আমার ক্লাসমেটরা আমার থেকে পড়াশোনাতে কত এগিয়ে গেল। তারপরই আবার নিজেকে বোঝাতাম যে, আমার নিয়তিতে যে টা ছিল সেটাই হয়েছে। অনেক চাপের মধ্যে থেকেও ২০১৯ সালে ইন্টার পরীক্ষা দিলাম। ৪.১৭ পেয়ে পাশ করলাম।
খুব ভালো করেই জানতাম বাহিরের ভালো ভার্সিটিতে পড়ানোর সাধ্য পরিবারের নেই। তাই সিদ্ধান্ত নিলাম বাড়ির কাছেই অনার্সে ভর্তি হবো। কয়েক দিন পর ভর্তি হওয়ার জন্য অনলাইনে অ্যাপ্লাই করতে গেলাম। যিনি কম্পিউটারে কাজ করছেন তিনি আমার কাগজপত্র দেখে বললেন- তুমি অ্যাপ্লাই করতে পারবে না। বললাম- কেন পারবো না? তিনি বললেন- শিক্ষা বোর্ড থেকে নতুন করে নিয়ম করেছন যে ২০১৫ সালে এস.এস.সি পাশ করা শিক্ষার্থী অনার্সে ভর্তি হতে পারবে না। উনাকে বললাম- কিন্তু আমি তো ইন্টার পাশ করলাম এবারই। তিনি বললেন- তাও হবে না। যদি ২০১৬ সালে এস.এস.সি পাশ করতে তাহলেও হতো। এক্ষেত্রে কারো কিছু করার নেই। তুমি অনার্সে ভর্তি হতে পারবে না। তোমাকে ডিগ্রীতেই ভর্তি হতে হবে।
এই বিষয় নিয়ে অনেক স্যারের সাথেই কথা বললাম। কিন্তু কারো কিছু করার নেই। শিক্ষা বোর্ডের করা নিয়ম মানতেই হবে। নিয়মের বেরাজালে জড়িয়ে অনার্সে পড়াটাও হলো না। চোখের সামনে যেন আঁধার ঘনিয়ে এসেছিল। আমার থেকে কম নাম্বার পেয়েও সবাই অনার্সে ভর্তি হলো কিন্তু আমি পারলাম না। খুবই খারাপ লাগছিল। তাও নিজেকে সামলিয়ে নিলাম।
আমার এক বান্ধবী নার্সিং এ এডমিশন দেওয়ার জন্য রাজশাহী কোচিং করতে গিয়েছিল। সে ফোনে আমার অনার্সে ভর্তি না হতে পারার কথাটা শোনে। তারপর আমাকে বলে- মন খারাপ করিস না। তুই ডিগ্রীতে ভর্তি হয়ে যা। আর তুই আমার সাথে নার্সিং এ এডমিশন দেওয়ার জন্য প্রস্তুতি নে। ওকে বললাম- তুই কি পাগল হয়ে গেছিস! ২০১৫ সালে এস.এস.সি পাশ করার জন্য অনার্সে ভর্তি হতে পারলাম না নার্সিং এ এডমিশন দেব কিভাবে?
ও বললো- কোচিং থেকে আমাদের যে বইটা দিয়েছে তাতে লেখা আছে ২০১৫ সালে পাশ করা শিক্ষার্থীও এডমিশন দিতে পারবে। ওকে বললাম- কিন্তু আমি এডমিশন দেব কিভাবে? তুইতো কোচিং করছিস আর আমি বাড়িতে বসে কিছু না জেনে না শুনে এডমিশন দিতে তো পারব না। এডমিশন যদিও দেই কোনো দিনও চান্স পাবো না। ও বললো- তোকে আমি ফোনে বলে দেব কি কি বই পড়তে হবে। আর আমাদের কোচিং এ যা যা পড়াবে সে গুলোও তোকে বলবো। তুই শুধু বাড়িতে বসে মন দিয়ে পড়বি। আমার বিশ্বাস তুই একটু ভালো করে পড়লেই চান্স পাবি।
কি কি বই পড়তে হবে সে গুলো আমাকে বলে দিল। ভাবলাম কিছুই যখন হলো না তখন ভালো করে পড়ে এডমিশন দিয়ে দেখি। চান্স পাই বা না পাই সে টা পরের বিষয় একবার চেষ্টা তো করে দেখি। ডিগ্রীতে ভর্তি হলাম। আর বান্ধবীর বলে দেওয়া বই গুলো ঢাকা থেকে কিনে আনিয়ে পড়তে শুরু করলাম। বই এ দেখলাম লেখা আছে ২০১৫, ২০১৬ ও ২০১৭ সালে যে কোনো বোর্ড থেকে এস.এস.সি পাশ করা শিক্ষার্থী নার্সিং এ এডমিশন দিতে পারবে। আরো লেখা আছে এস.এস.সি তে সর্বনিম্ন ২.৫০ এবং এইচ.এস.সি তে সর্বনিম্ন ২.৫০ মোট ৫.০০ পেলেই চলবে। লেখাটা দেখে নিশ্চিত হলাম যে আমি এডমিশন দিতে পারবো। আর আমার তো দুইটা মিলে ৭.৯৮ আছে। এডমিশনের চার মাস বাকী মনোযোগ দিয়ে পড়তে শুরু করলাম। এডমিশনের জন্য ভালোই প্রস্তুতি নিলাম। সম্ভবত এডমিশনের ২০ দিন আগে গেলাম অনলাইনে অ্যাপ্লাই করার জন্য। যিনি কম্পিউটারে কাজ করছেন তিনি আমার কাগজ পত্র দেখে বললেন- তুমি অ্যাপ্লাই করতে পারবে না তোমার এস.এস.সি ২০১৫ সালে। আবারো সেই একি কথা।
বললাম- হ্যাঁ আমি অনার্সে ভর্তি হতে পারবো না কিন্তু নার্সিং এ এডমিশন দিতে পারবো। আপনি অ্যাপ্লাই করে দিন।
তিনি বলেন- আমার কথা বিশ্বাস না হলে তুমি নিজেই কম্পিউটারে দেখে নাও। বললাম- কিন্তু আমি এডমিশনের জন্য যে বই গুলো পড়ছি তাতে তো লেখা আছে ২০১৫ সালে পাশ করলেও এডমিশন দেওয়া যাবে। তিনি বলেন- হ্যাঁ সে রকমই নিয়ম ছিল। কিন্তু এইবার নিয়ম করেছে ২০১৫ সালে পাশ করলে দেওয়া যাবে না। ২০১৬ সালে হলে চলতো।
নিয়মের বেরাজালে জড়িয়ে আবারও নিরাশ হতে হলো। খুব কষ্ট হচ্ছিল যে কেন বার বার নিয়মের দোহাই দিয়ে আমাকে নিরাশ হতে হচ্ছে। যত নতুন নতুন নিয়ম কি আমার বেলাতেই হওয়ার ছিল। এডমিশন দেওয়ার মত সব যোগ্যতাই তো আমার ছিল। তবুও নিয়মের বেরাজালে জড়িয়ে আমি চেষ্টা টুকুও করতে পারলাম না। বার বার ধাক্কা খেতে খেতে নিজেকে অনেক শক্ত করে নিয়েছিলাম। খুব কষ্ট হওয়া সত্ত্বেও নিজেকে আবারো শক্ত করে নিলাম। ভাবলাম যত বাঁধাই আসুক না কেন থেমে থাকব না।
এস.এস.সি পাশ করার পর প্রথমে নিজের এলাকায় যে প্যারামেডিকেলে ভর্তি হয়েছিলাম সেখানে খোঁজ নিলাম যে আবার নতুন করে ভর্তি হতে পারব কি না। স্যার বলেন- হ্যাঁ ভর্তি হতে পারবে। আর তোমাকে একটা সুযোগ দেওয়া যেতে পারে। যেহেতু তুমি আগেও ভর্তি হয়েছিলে তোমাদের ব্যাচের শিক্ষার্থী দের এই কোর্স টা কমপ্লিট হয়ে গেছে। এখন আমরা যদি ৭ দিনের মধ্যে তোমার ফরম ফিল আপ করে দিতে পারি তাহলে তোমার এক সেমিষ্টার এগিয়ে যাবে। স্যারের কথা শুনে ভালোই লাগল। ভাবলাম আমার তো আগে ৩ সেমিষ্টারের বই পড়াই আছে। এক সেমিষ্টার এগিয়ে দিলে কোনো সমস্যাই হবে না বরং ভালোই হবে। স্যার কে বললাম তেমনি ব্যবস্থা করতে। কয়েকদিন পর স্যার ফোন দিয়ে বলেন- তোমার ফরম ফিল আপ করা গেল না। এক সেমিষ্টার আগানো আর হলো না তোমাকে প্রথম থেকেই শুরু করতে হবে।
বললাম- স্যার আপনি নিজেই তো বলেছিলেন আগানো যাবে। স্যার বলেন- হ্যাঁ আমি ভেবেছিলাম আগের সেই নিয়মটাই আছে। কিন্তু এবার নিয়মটা পরিবর্তন করেছে। আবারো সেই নিয়ম। এত নিয়মের মুখোমুখি হয়ে পারব কি জীবনে এগিয়ে যেতে! প্যারামেডিকেলে পড়াটা প্রথম থেকেই শুরু করার সিদ্ধান্ত নিলাম। কি জানি নিয়মের এই বেরাজাল কে ডিঙিয়ে পড়াটা শেষ করতে পারব কি না। নাকি আবারো অন্য কোনো নিয়মের বেরাজালে জড়িয়ে মাঝ পথে থেমে যেতে হবে। আল্লাহই জানেন নিয়তি আর নিয়মের ফেরে জীবনে কোথায় গিয়ে দাঁড়াতে হবে। নিজেকে অনেক শক্ত করে ফেলেছি। যেমন পরিস্থিতিই আসুক না কেন আর ভেঙ্গে পড়বো না। সবটা মেনে নিতে শিখে গেছি।
আমাদের সমাজে শুধু শিক্ষা ক্ষেত্রেই নয় আরো বিভিন্ন ক্ষেত্রেই এই রকম নিয়মের বেরাজালে আবদ্ধ। সমাজের তো নিয়ম হয়ে গেছে যে, মেয়েদের যতই পড়াশোনা করার ইচ্ছা থাকুক না কেন একটা নির্দিষ্ট বয়সের পর তার ইচ্ছা থাকুক বা না থাকুক বাবা মা তাকে বিয়ে দেবে। তা না হলে সমাজের মানুষেরা নানা রকম কথা বলবে। ইসলাম ধর্ম আর আইনি মতে যৌতুক প্রথা নিষিদ্ধ। অথচ যৌতুক ছাড়া এখন বিয়েই হয় না।বাবা মা মেয়েকে জন্ম দিয়ে কষ্ট করে লালন পালন করেন। এক সময় তাদের আদরের মেয়েকে বিয়ে দিয়ে অন্যের হাতে তুলে দেয়। একদিকে আদরের মেয়ে টাকেও দিতে হয় অন্যদিকে যৌতুক হিসেবে টাকা, গহনা, অন্যান্য জিনিসও দিতে হয়। আর যৌতুক দিতে গিয়ে যদি গরিব বাবা মা কে জায়গা-জমিও বিক্রি বরতে হয় তাতেও কারো কোনো হেলদুল নেই। কারন এটাই সমাজের নিয়ম হয়ে গেছে। সমাজ আর রাষ্ট্রের হাজারটা জটিল নিয়মের জন্য হাজার হাজার ছেলে মেয়ে উচ্চ শিক্ষিত হয়েও চাকরি পাচ্ছে না। কিছু জটিল নিয়মের বেরাজালে জড়িয়ে তাদের বেকার অবস্থায় দিন কাটাতে হচ্ছে।
স্বাধীনতার ৪৯ বছরে দাঁড়িয়ে আজও মানুষ স্বাধীন ভাবে বাঁচতে পারে না। চলার পথে হাজারো নিয়মের মুখোমুখি হতে হয়। যত নিয়মই হোক না কেন থেমে থাকলে চলবে না। সব কিছুর সাথে মোকাবিলা করে এগিয়ে যেতে হবে। সব কিছু মেনে নিয়েই লড়াই টা করতে হবে।