মা

মা
আমার মায়ের স্বভাব হচ্ছে পুত্রবধূদের কাছে আমাদের শৈশবের দুঃসময়ের গল্প করে হাপুস নয়নে কাঁদা। মায়ের এই ছিঁচকাদুনে স্বভাব সাথে আগে ছিল না। বাবার মৃত্যুর পর লুকিয়ে লুকিয়ে কাঁদত। এখন আর স্থানকাল কিছুই মানেন না। যেকোন প্রসঙ্গে কথা বলতে বলতে বাবার প্রসঙ্গ টেনে আনেন এরপর আঁচলে ঠোঁট চেপে আর্তনাদ করে উঠেন।
-আহা! লোকটা বড় ভালো ছিল। অভাবের সংসার ঠিকমত যত্ন-আত্তি করতে পারি নাই। একটা ডিম ভেজে দিলে ওদের চার ভাই-বোনের প্লেটে ভাগ করে দিয়ে নিজে আলুভর্তা দিয়ে ভাত খেত। মায়ের চোখে জল আসে।
বড় ভাই নামকরা বেসরকারি ব্যাংকে মহাব্যবস্থাপক পদে আছেন। উত্তরায় ১৬০০ স্কয়ার বর্গফুটের ফ্লাট কিনেছেন। আমাদের ছোট দুই ভাইয়ের স্ত্রী চাকুরি করে বিধায় মা বড় ভাইয়ের সাথেই থাকেন। ঈদ-উৎসবে আমরা পরিবার সমেত বড় ভাইয়ের বাসাতেই মিলিত হই। ভাবী খাসির মাথা দিয়ে বুটের ডাল রান্না করেছেন, পুই শাক দিয়ে দেশি কৈ মাছের ঝোল। মায়ের অত্যন্ত প্রিয় খাবার।সবাইকে অবাক করে দিয়ে মা প্লেটে কিছুই নিলেন না। সামান্য ভর্তা-ভাজি দিয়ে খেয়ে উঠে গেলেন৷ ছোট ভাই সজীব চাপা স্বরে প্রশ্ন করল,
-মায়ের কি হয়েছে? বড় ভাবী মুখ গোমড়া করে উত্তর দিলেন,
-বাবার যে জিনিস খেয়ে আকুতি মিটে নাই তা আর মাও খাবেন না।
স্বভাবই খাবার টেবিলে আমরা তিনভাই লজ্জা পেলাম। বাবার যখন মারা যান বড় ভাই সবে ব্যাংকে জয়েন করেছেন, আমি ইউনিভার্সিটিতে, সজীবের গণ্ডি তখনও কলেজ অবধি পৌঁছায় নাই। বড় ভাই চাকুরির প্রথম চাকুরির বেতন মানিঅর্ডার করে গ্রামে পাঠালেই বাবার কাছ থেকে চিরকুট এল,
-শরীফকে তোর কাছে এনে রাখ৷ ওকে আর টিউশনি করতে দিস না। সামনে ওর অর্নাস ফাইনাল। বাড়িতে আমরা বেশ আছি, টাকা নিজের কাছে জমাতে শিখো। প্রথম বেতনের টাকা থেকে মায়ের জন্য একখানা শাড়ি আর ছোট বোন রিনির জন্যে লাল টুকটুক ফ্রক ছাড়া এক টাকাও খরচ হয় নাই। প্রথমে বাবা এরপরে মা সযত্নে সেই টাকা তুলে রেখেছেন। তাদের সন্তানের প্রথম আয়ের টাকা। মা কিন্তু গরীব ঘরের মেয়ে ছিলেন না,মোড়লবাড়ির বড় মেয়ে। নানাজান, আমার প্রাইমারী স্কুলের শিক্ষক বাবার সততা আর পুরুষোচিত চেহারা দেখে মজেছিলেন।মাও খুব সহজে মানিয়ে নিলেন। রোজ সকালে গরম ভাতে আলু ভর্তা, কালোজিরা ভর্তা মেখে গপাগপ খেয়ে আমরা স্কুলে ছুটতাম। হাঁস-মুরগির ডিম সেদ্ধ আমাদের পাতে জুটত না। সেগুলো কাজে লাগত বছর শেষে পরীক্ষার ফী দেবার সময়৷ সত্যি বলতে কি, এযুগের বাচ্চাদের ঈদে চার চারটে জামা , বৈশাখে, ফ্লাগুনে রঙিন পাঞ্জাবি পরার শখ আমাদের ছিল না। শুক্রবারে মায়ের হাতে পোলাও আর মুরগির গোশত, শীতের দিনে ভাপা পিঠা ছিল অনাবিল আনন্দের উৎস।যাদের বাড়িতে টিভি আছে তারা বড়লোক।
আমাদের টিভি ছিল না তবে পাড়ার ছেলেদের সাথে দাড়িয়াবান্ধা খেলার জন্যে বিরাট বড় উঠান, পুকুরে বরশি দিয়ে পুঁটি মাছ ধরা। নিজের হাতে ধরা পুঁটি মাছ ভাজা দিয়ে ভাত খেতে বুকটা গর্বে একহাত ভরে যেত। শৈশবে আমরা নিজেদের দুনিয়ায় এতটাই মশগুল ছিলাম তাই বাবা-মায়ের কষ্ট উপলব্ধি করতে পারি নাই। মনে পরে, মাসের শেষ দশদিন শাক-আলুর চচ্চড়ি আর মসুর ডালে খাওয়া দুপুরের খাওয়া হত৷ মায়ের রান্না আমাদের কাছে অমৃতসম লাগলেও মায়ের মুখ থাকত বিষণ্ন। সন্তানের পাতে এক টুকরো মাছ তুলে দিতে না পেরে হীনমন্যতায় ভুগছেন। ছেড়া শার্ট গায়ে দিব্যি বাজারে ঘুরে বেরিয়েছি। মা সযত্নে রিফু করে দিয়ে চোখের জল মুছতেন। অথচ পরীক্ষা ফী, অঙ্ক স্যারের বেতন দিতে কোনোদিন দেরি করেন নাই। মায়ের আঁচলে বাঁধা দশ-বিশ টাকার প্রতি বরাবরই লোভ ছিল। স্কুলে যাবার সময় ঘ্যানঘ্যান শুরু করতাম।
-এক টাকাও পাবি না। পেট ভইরা ভাত খাইছস। দোকানের হজমি খাইলে পেটে কেঁচো হয়। একজনকে দু’টাকা দিলে তিনজনকে ছয় টাকা দিতে হয় তাই মা কাউকেই দিতেন না। জগন্নাথে ভর্তি হবার পর বাবার কাছে যখন টাকা নাই মা নিজের সঞ্চয় থেকে পাঁচ হাজার টাকা বের করে দিলেন মেসে থাকার জন্যে লেপ,তোশক ইত্যাদি সরঞ্জাম কিনতে।এই আমাদের মা একখানা লিকলিকে সোনার চেইন আর চাঁপা ফুল আকৃতির ছোট্ট কানের দুল পরে জীবন পাড় করে দিলেন নিতান্তই অনাড়ম্বরে। আমি সরকারি কলেজের রসায়নের প্রভাষক, ছোট ভাই মাল্টিন্যাশনাল কোম্পানিতে আছে। সবার ছোট বোন রিনি অস্ট্রেলিয়ায় আছে। তবু মায়ের দুঃখ খুঁচে না। ইনিয়েবিনিয়ে বউদের কাছে দুঃসময়ের গল্প বলে। বউরাও হা করে শ্বাশুড়িমায়ের গল্প মুগ্ধ হয়ে শোনে।মা কিছুতেই বুঝতে চায় না,
– ওরা বড় ঘরের মেয়ে।পাত্রের শিক্ষাগত যোগ্যতা এবং আর্থিক নিরাপত্তা দেখে এবাড়ির পুত্রবধূ হয়ে এসেছে শৈশবের যেই ছেলেটা ন্যাংটো হয়ে পুকুরে ঝাপিয়ে পরত একে কেউ চিনবে না, বরং স্যুট-টাই পরা শরীফুর রহমান স্বামী হিসেবে প্রযোজ্য।
মা তবু গল্প বলেন। বড় ছেলের পুরানো স্কুল ড্রেসে মেজ ছেলের স্কুল জীবন পাড় হবার গল্প, ভাঙারির দোকান থেকে কেনা সাইকেল মেরামত করে ছোট ভাইকে জন্মদিনে চমকে দেবার গল্প।শীতের ভোরে তিন ভাইয়ের মটরশুঁটি পুড়িয়ে মজা করে খাওয়ার গল্প।রকমারি ফার্নিচারে সাজানো আধুনিক ফ্লাটে থাকতে থাকতে মায়ের গল্প নিজেদের কাছেই কেমন পরাবাস্তব ঠেকে। মা কিন্তু ভুলেন। তার আলমিরা ভর্তি দামী শাড়িতে ঠাসা থাকলেও মা সাধারণ সুতির বাড়িতেই স্বাচ্ছন্দ্য। সব ভাই হাতখরচের জন্য কিছু টাকা মায়ের বালিশের নীচে রেখে আসি। রিনি ঈদ-উৎসবে একটা বড় অঙ্কের টাকা মায়ের অ্যাকাউন্টে পাঠায়।
মায়ের গহনার শখ ছিল, সেই শখ পূরণ করছে জমানোর টাকায় ইচ্ছামত গহনা বানিয়ে৷ যদিও নিজের জন্যে নয়। এমাসে বড় ভাইয়ের ছেলেকে চেইন উপহার দিলে পরের মাসে আমার মেয়ে হাতে সোনার বালা পায়। সজীবের বাচ্চাকাচ্চা হয় নাই, ওর অনাগত সন্তানের কথা ভেবে ব্রেসলেট বানিয়ে রেখেছেন। যদি আশীর্বাদ করে না যেতে পারেন।আমাদেরও তো ইচ্ছা হয়, মা গায়ে ভারী একখানা গহনা পরুক, একটা ভালো শাড়ি মায়ের গায়ে উঠুক। মা হাসতে হাসতে বলেন,
-রায়হান, সজীব,শরীফ আমারে আল্লাহপাক তিন তিনখানা রত্ন দান করেছেন। আমার আর দুই চাইর টাকার গয়না দিয়া কি হইব! আমরা তিনভাই ফোনের আলাপচারিতায় মায়ের কথা বলি। মা দুধ খেতে চান না, রাতের খাওয়া একেবারে বাদ দিয়েছেন,বউদের বারণ সত্ত্বেও সারাদিন টুকিটাকি কাজ করতেই থাকেন। এমনকি মায়ের জন্য তার নাতিনাতনিদের সামান্য বকাঝকা করা যায় না। তাদের সমস্ত দোষ আঁচলের তলায় ঢেকে আহ্লাদী স্বরে বলেন,
-থাউক, তোরাও তো ছোডকালে কত দুষ্টামি করতি,বড় হইলে ভালো হইয়া যাইব। মায়ের প্রতি অফুরন্ত অভিযোগ শেষে তিন ভাই সৃষ্টিকর্তার কাছে একটাই ফরিয়াদ করি,
-পরম করুণাময় যেন আরো বহু বছর মাকে আমাদের সাথে থাকার তৌফিক দান করেন।
গল্পের বিষয়:
গল্প
DMCA.com Protection Status
loading...

Share This Post

সর্বাধিক পঠিত