দির্ঘ ৫ বছর পর আমার এক্স গার্লফ্রেন্ড টিনা ও তার বর্তমান স্বামি বসে আছে আমার কাটগরায়। হাতে তাদের দুজনের সম্পর্ক বিচ্ছিন্ন করার একটা পেপার, মানে ডিভোর্স পেপার। আমার সামনে বসে এক মুহুর্তের জন্যও মাথা তুলে আমার দিকে তাকানোর সাহস পাচ্ছেনা সে। তার স্বামি মোজাম্মেক হকের চোখ আবছা আবছা ভেজা তা স্পস্ট বুঝা যাচ্ছে। পরনে তার একটা সাধারন পোশাক। দেখে মনে হচ্ছেনা অত বড়লোক। কিন্তু এক সময় তার প্রচুর অর্থ ছিলো।
আজও মনে পড়ে সেই দিনটার কথা, যেই দিন টিনা এই অর্থের মায়ায় পরে আমায় ছেরে ধরেছিলো অন্য একটা মানুষের হাত। পাঁচ বছর আগের কথা, টিনা পার্কে বসে পা দোলাতে দোলাতে অপেক্ষা করতো আমার জন্য। হাতে কিছু বাদাম নিয়ে গিয়ে টিনার পাসে বসতাম। এর থেকে বেশি কিছু নিয়ে যাওয়ার সামর্থ আমার মাসেও একবার হয়ে উঠতোনা। মধ্যবিত্ত পরিবারের সন্তাম ছিলাম আমি। ধিরে ধিরে টিনার মনে আমার প্রতি অবহেলা বেড়ে উঠতে থাকে। বুঝতে পারতাম তবুও ভালোবাসার মানুষটার অবহেলাগুলো আকড়ে ধরে মিশিয়ে নিতাম নিজের সাথে। বোকার মতো ভাবতাম এটাও এক প্রকার ভালোবাসা। অবহেলা করুক তাতে কি একটু হলেওতো ভালোবাসে।
একদিন পার্কে দাড়িয়ে অপেক্ষা করছিলাম টিনার জন্য। যেই মেয়েটা আগে আমার জন্য অপেক্ষা করতো এখানে দাড়িয়ে। টাইমের আধা ঘন্টা আগে এসে বসে থাকতো আমার অপেক্ষায়। আর আজ এক ঘন্টা অপেক্ষা করার পরও তার দেখা মিললোনা। তবুও দাড়িয়ে আছি টিনা আসবে বলে। অবশেষে এসেছিলোও। কিন্তু সেই দিনটা ছিলো আমার আর ওর মাঝে সম্পর্কের শেষ দিন। হটাৎ সে এসে বললো, তোমার সাথে রিলেশান রাখা আমার পক্ষে সম্ভাব না, আমায় ভুলে যাও। কিন্তু সেইদিন আমি একটুকুও অবাক হইনি। কারণ ওর কাছ থেকে এটাই আশা করেছিলাম আমি। কারন মধ্যবিত্ত পরিবারের ছেলেগুলোর মুখে প্রতিবাদ শব্দটা শোভা পায়না। মাঝে মাঝে প্রিয় মানুষটাকে ভালো থাকার জন্য ভালোবেসেও ছেরে দিতে হয়। যদি সে ওখানে সুখি হয়। আর সে তো ঠিকই বলেছে, আমার নেই কোনো ভবিষ্যৎ, নেই কোনো বাবার বিজনেস।
বাবার বিজনেস থাকলে আর কিছু না করুক আপাতত বিজনেসটার হাল ধরে সুন্দরে জিবন কাটাতে পারে। আর মধ্যবিত্ত ঘরের ছেলেগুলো নিজের ভবিষ্যৎ নিজেকেই গড়ে তুলতে হয়। তারাই যানে জিবন কত কষ্টের। মাথায় থাকে অনেক চিন্তা। কিভাবে একজন বড় মানুষ হিসেবে নিজেকে পরিচিত করা যায়। নিজেকে নিয়ে যতটা না ভাবে তার চেয়ে বেশি ভাবে নিজের ভবিষ্যৎটা নিয়ে। এর মাঝ থাকে নিজের প্রিয় মানুষটাকে হারিয়ে ফেলার ভয়। কিন্তু অধিকাংশ মেয়েই এটা বুঝার ক্ষমতা রাখেনা। ওরা বর্তমানটাকেই প্রধান্য দিয়ে ভবিষ্যতের কথা ভাবে। হয়তো নিজ প্রচেস্টায় ছেলেগুলো একসময় প্রতিষ্টিত হয়, কিন্তু ফিরে পায়না অর্থের অভাবে হারিয়ে ফেলা প্রিয় মানুষটাকে। টিনার বাবা তার বিয়ে ঠিক করেছে এক প্রতিষ্ঠিত ছেলের সাথে। বিজনেস করে ভালো পজিশন। যার তোলনায় আমি তুচ্ছ।
টিনা আমার ভালোবাসাটা তুচ্ছ করে অর্থকে প্রাধান্য দিয়েই চলে গিয়েছিলো অন্য মানুষের হাত ধরে। জমে যায় মেয়েদের প্রতি আমার একরাশ ঘৃনা। মনে হলো সব মেয়েরাই সার্থপর, সার্থের জন্য নিজের প্রিয় মানুষটার সাথে বেইমানি করতেও দিধা বোধ করেনা। আচ্ছা, আমি কি ওর কাছে প্রিয় ছিলাম? মেয়েদের প্রতি আমার অসুস্থ মানসিকতাটা তখনই বদলাতে শুরু করে যখন কেয়া নামক একটা মেয়ে আমার জীবনে আসে। মায়ের জোড়াজুরিতে তার পছন্দ করা মেয়েকেই বিয়ে করেছিলাম আমি। এখন আমি বিশ্বাস করি। না, মানতে আমি বাধ্য যে সব মেয়ে এক না। কিছু কিছু মেয়ে হিরের টুকরুও হয়ে থাকে। যারা প্রিয় মানুষটার জন্য নিজের জীবন দিতেও প্রস্তুত।
আপনাদের একটা বাস্তব ঘটনা বলি, আমাদের এদিকেরই ঘটনা। লোকটি ছিলো একজন নাম করা রাজনিতিবিদ। অনেক সফলতা ছিলো তার। রাতের আধারে সন্ত্রাসিরা হামলা করে তার বাড়িতে। একের পর এক ছুরির আঘাত করছে তার উপর। তখনি তার স্ত্রী দৌড়ে এসে তাকে জড়িয়ে ধরে যেনো স্বামির গায়ে কোনো আঘাত না লাগে। এতো অনেক আঘাতের স্বিকার হয় স্ত্রীও। তবুও নিজের স্বামিকে ছারেনি সে। লোকজনের আনাগোনা দেখে পালিয়ে যায় সন্ত্রাসি দল। স্ত্রী অজ্ঞান পয়ে পরেছিলো তার উপর। পরলে সেই দিন স্ত্রীও তাকে সন্ত্রাসির হাতে রেখে পালিয়ে যেতে পারতো। কিন্তু যেতে পারেনি ভালোবাসার টানে।
টিনা বিয়ে করে নিয়েছিলো তার বাবার পছন্দের ছেলেকে। কিন্তু ধিরে ধিরে লোকটা ব্যাবসায় অসফল হতে থাকে। এখন লোকটা তেমন একটা সফল মানুষ না। যার কারনে সংসারে অশান্তি, টিনা ডিভোর্স দিয়ে দিচ্ছে তাকে। আমার সামনেই লোকটা বসা হয়তো ডিভোর্স পেপারে সাইন দিতে তার কষ্ট হচ্ছে। সাইন দিতে দিতে গিয়ে টিনার দিকে বারবার তাকাচ্ছে এই ভেবে যে, টিনা হয়তো তার সিদ্ধান্ত পাল্টে নিবে। কিন্তু না, টিনার কোনো রেসপন্স পাচ্ছেনা সে। চোখের টলমল পানি নিয়ে সাইন করে দিচ্ছে সে। টিনার হাতে যেতে টিনাও সাইন করে দিলো। হয়ে গেলো তাদের পাঁচ বছরের সম্পর্ক বিচ্ছেদ। টিনা দ্রুত হেটে বাইরে চলে গেলো, লোকটা এখনো ওই অবস্থায় বসে আছে। উঠে গিয়ে লোকটার পাসে গিয়ে বসলাম। কেনো যানি মনে হচ্ছে লোকটা সেই পাঁচ বছর আগের আমি। যে অসহায়ের মতো বসে বসে সুধু কান্না করেছিলাম।
লোকটার কাধে হাত রেখে বললাম, ভাই কষ্ট পাবেন না, যে যাওয়ার তাকে যেতে দিন। যে দুঃসময়ে আপনার পাসে থাকবেনা, সে কখনোই আপনার জীবন সঙ্গি হওয়ার জোগ্য নয়। পারপেক্ট জীবন সঙ্গি সেই, যে দুঃসময়ে আপনার পাসে থেকে বলবে, কিচ্ছু হবেনা সব ঠিক হয়ে যাবে, আমি আছিতো। বাসায় ফেরার পথে, এক গুচ্ছ গোলাফ আর এক ডজন কাচের চুরি নিয়ে রওনা দিলাম বাড়ির উদ্দেশ্যে। অতিতের জন্য তেমন আপসোস নেই আমার। যে যাওয়ার সে চলে গেছে। থাকলেও হয়তো মানুষটার যায়গায় আজ আমায় থাকতে হতো। বাকি সব ঠিকই থাকতো। পার্থক্য থাকতো শুধু আমার আর লোকটার মাঝে।
অনেক রাত হয়ে গেছে আজ বাসায় ফিরতে। কেয়া দরজাটা খুলেই আবার ভিতরে চলে গেলো। বুঝতে বাকি নেই এতো রাত করায় সে রাগ করেছে। পেছন থেকে তাকে জড়িয়ে ধরে তার কাধে থুতনিটা রেখে বার বার বললাম সরি। গোলাফ গুচ্ছ ও কাচের চুরি গুলো তার সামনে ধরতেই তার মলিন মুখটায় হাসি ফুটে উঠে। ঠিক যেমন, কালো মেঘের আড়াল থেকে সুর্যটা উকি দিয়ে উঠে। আসলে ভালোবাসা শুধু অর্থেই থাকেনা, সামান্য কিছু উপহারেও গড়ে উঠে অসমাপ্ত ভালোবাসার অধ্যায়।
গল্পের বিষয়:
গল্প