ডাক্তারী ইন্টার্নি যেদিন শেষ করলাম সেদিন অন্যান্য স্টুডেন্টদের থেকে বোধহয় আমিই সর্বাপেক্ষা খুশি ছিলাম। কারণ এখন থেকে আর মায়ের কষ্ট করে শুধু ঔষধ খেয়েই বেঁচে থাকতে হবেনা বরং আমি নিজেই মা কে ফ্রিতে ট্রিটমেন্ট দিতে পারবো। এসব ভাবতে ভাবতে যখন মেডিকেলের হল থেকে সবকিছু গুছিয়ে বাড়িতে রওয়ানা দিবো ঠিক তখনি ছোট বোনের ফোন,
-হ্যালো মনি বল, মায়ের শরীরটা কেমন আছে? ছোটবোন আমার কথা শুনে হাউ মাউ করে কান্না শুরু করে দিলো। ওর কান্নাটা শুনে হৃদয়ে কেমন যেন একটু চিনচিনে ব্যথা অনুভূত হলো। কারণ সচরাচর মনি ফোন দিয়ে আমার সাথে কান্না করেনা।
-আরে কান্না কেন করছিস? কী হয়েছে বলবিতো।
-ভাইয়া মা আর কথা বলছে না।
-মানে?
-মা আমাদের ছেড়ে চলে গেছে।
ছোটবোনের কথা শুনে আমার হাত থেকে মোবাইলটা মেঝেতে পরে কয়েক টুকরো হয়ে গেলো। আমার রুমমেট আশিক আমার এহেন কান্ড দেখে দৌড়ে এসে আমার অবলম্বনহীন দেহটিকে শক্ত করে ধরে বললো,
-কী হয়েছে মারুফ? আশিককে জড়িয়ে ধরে এক আত্মচিৎকার দিয়ে বললাম,
-মা আমাদের রেখে চলে গেছে।
আশিক ছেলেটি আমার কথা শুনে নিজেও কিছুটা নিস্তব্ধ হয়ে গেল। ও ভাবতে পারছেনা যে কীভাবে আমাকে শান্তনা দিবে। ছোটবেলা থেকেই মায়ের ইচ্ছা ছিল আমি ডাক্তার হবো। পাড়া পড়শিদের নিকট আমার মা অনেক গুণগান গাইতো আমার ব্যপারে। যদিও আমার পরিবারটা ছিল নিম্ন মধ্যবিত্ত লেভেলের তবুও আমার যথেষ্ট মেধা থাকায় মা আমাকে নিয়ে গর্ববোধ করতো। আশেপাশের মহিলারা প্রায়ই মাকে নিয়ে তুচ্ছ তাচ্ছিল্য করে বলতো,
-বামন হয়ে চাঁদ ধরার স্বপ্ন দেখে লাভ নেই। আমিও যখন এসব তাচ্ছিল্যের স্বরে কথাগুলো শুনতাম তখন নিজের ভিতরেও এক জেদ কাজ করতো যে আমাকে ডাক্তার হতেই হবে। মায়ের যেদিন প্রচন্ড পেটব্যাথা শুরু হয় সেসময় আমি ডাক্তারীতে চান্স পাওয়ার জন্য আপ্রাণ চেষ্টা করছিলাম। মাকে নিয়ে তখন হসপিটালে যাওয়ার কথা বললেও মা বারবার বলতেন,
-কী দরকার হসপিটালে যেয়ে টাকা নষ্ট করার? আমি ঔষধ খেয়েই ভালো হবো। তুই ভালো করে পড়ালেখা কর। তুই যেদিন ডাক্তার হবি সেদিন আমাকে ফ্রিতেই দেখতে পারবি। সেদিন মায়ের ব্যাথার আর্তনাদ খুব নিকট থেকে দেখলেও মাকে হসপিটালে নিয়ে যেতে পারিনি। কারণ তার একটাই কথা হসপিটালে গেলে টাকা নষ্ট হবে। এভাবে দিন দিন যখন মায়ের ব্যাথা ক্রমশই বাড়ছিল তখন আমি আর একমুহূর্ত দেরী না করে মামাদের থেকে টাকা নিয়ে মাকে নিয়ে হসপিটালে যাই। বিভিন্ন পরীক্ষার পর জানা যায় মায়ের জরায়ুতে ঘাঁ হয়েছে। অপারেশন না করলে নাকি সুস্থ হবার সম্ভাবনা নেই। মা সেদিন ডাক্তারকে বলেছিলেন,
-আমি অপারেশন করবোনা, ওসব কাঁটাছেড়া খুব ভয় পাই। আপনি বরং আমাকে ঔষধ লিখে দিন। মায়ের এই কথার মানেটা বুঝতে আমার একমুহূর্ত দেরী হয়নি। কারণ আমি জানি টাকার কারণেই মা অপারেশন করতে রাজি হচ্ছেনা। আমারও কিছু বলার ছিলনা সেদিন, কেননা টাকাইতো নেই আমাদের তো মাকে অপারেশন করাবো কী করে? সেদিন নিজেকেই নিজে গালি দিয়েছিলাম এই বলে, তুই কেনো এই নিম্নবিত্ত ঘরে জন্ম নিলি যে নিজের মায়ের চিকিৎসাই করতে পারিস না?
এরপরে ঔষধগুলো খেয়ে মা কিছুটা সুস্থ হলেও মাঝেমধ্যেই ব্যাথায় আর্তনাদ করে উঠতেন। যেদিন মেডিকেল ভর্তি পরীক্ষার রেজাল্ট দিবে সেদিন উত্তেজনায় আমার জ্বর চলে এসেছিল। কারণ আমি যদি ডাক্তারী চান্স না পাই তবে মায়ের এতো স্বপ্ন, আশা আর আকাঙ্ক্ষা পূরণ হবে না যে। অনলাইনে যখন মেধাতালিকায় নিজের রোল নাম্বারটা দেখলাম তখন মনে হচ্ছিল জীবনের সবকিছুই আমি পেয়ে গেছি। মাকে সেদিন টানা পাঁচ মিনিট নিজের বুকের সাথে লেপ্টে ধরেছিলাম। কারণ ইনিই তো আমার সেই কাঙ্ক্ষিত অনুপ্রেরণা। সেদিন আশেপাশের সেই নিন্দুকেরাও আমাকে সংবর্ধনা দিতে এসেছিলো। এরপর মেডিকেলে ভর্তি, বিভিন্ন বই এবং যন্ত্রপাতি কিনতে আমার প্রায় অনেক টাকারই প্রয়োজন ছিল। মা সেদিন নিজের প্রিয় গলার হারটা নিশ্চিন্তে আমার হাতে তুলে দিয়ে বলেছিলেন,
-এটা বিক্রি করে ফেল। তুই ডাক্তার হলে এরকম হাজারটা কিনতে পারবো।
সেদিন আমার মনে হচ্ছিল, যেই মা নিজের কথা চিন্তা না করে সন্তানের ভবিষ্যত গড়ায় বদ্ধ পরিকর সেই মা কে আমি কীভাবে অবহেলা করতে পারি? এর পরবর্তী দিনগুলো ছিলো আমার সুখ দুঃখে মিশ্রিত অবস্থায়। একদিকে মায়ের অসুস্থতা অন্যদিকে নিজের স্বর্ণশেখর পড়ালেখার জীবন। এমবিবিএস দ্বিতীয় বর্ষে থাকা অবস্থায় মায়ের অবস্থার এতোটাই অবনতি হয় যে যার কারণে আমি স্থির থাকতে পারিনি। ফের মায়ের পরীক্ষা করে যা জানতে পারি তা সত্যিই আমার জীবনের সফলতার মাঝে এক কালো দাগ স্বরূপ। হ্যাঁ, অপারেশন না করার কারণে মায়ের জরায়ুতে ক্যান্সার হয়ে গেছে। সেদিন মনে হচ্ছিল আজ যদি আমি পূর্ণাঙ্গ ডাক্তার হতাম তবে মায়ের কখনোই এই পরিস্থিতিতে আসতে হতোনা। প্রভু কেনো বারবার আমাকে পেছনের সারিতে ফেলে রাখেন? তখনও আমি মায়ের পূর্ণাঙ্গ চিকিৎসা করতে পারিনি একমাত্র টাকার অভাবেই। আমার রুমমেট আশিক একপ্রকার আমাকে আধমরা হিসেবেই নিয়ে এসেছে বাড়িতে। মায়ের নিথর দেহটি দেখামাত্রই আমি নিজেকে সংযত করতে না পেরে মাকে জড়িয়ে ধরে হাউমাউ করে কান্না করতে লাগলাম। মাকে চিৎকার করে বলছিলাম,
-মা দেখো তোমার ছেলে ডাক্তার হয়েছে। আজ থেকে তোমাকে ফ্রিতে ট্রিটমেন্ট দিবে। তুমি কথা বলছোনা কেন?
কিন্তু মাতো আর নেই। কীভাবে শুনবে আমার কথা? তিনিতো পাড়ি জমিয়েছেন প্রভুর নিকট ঐ নীল আকাশের অন্তরায়। ফিরে আসবেন না কভু আর।। আমার কান্না দেখে আশেপাশের অনেকেই নিজের অশ্রুজল বিসর্জন দিচ্ছেন। কারোরই হয়তো ভাবনাতেই ছিলোনা যে একটি ছেলে কতটা ভালোবাসলে নিজের মায়ের জন্য এতোটা কান্না করতে পারে।
এভাবেই অজস্র কষ্টার্জিত সফলতার গল্প শুনতে পাবেন যেখানে সফলতা অর্জিত হয়ে গেলে কাঙ্ক্ষিত মানুষটি আর নিকটে থাকেনা। তখন আপনার মনে হবে কাঙ্ক্ষিত মানুষটিই যেহেতু নেই তবে এতো এতো সফলতা দিয়ে আজ আমি কী করবো? এই সফলতাতো আজ মূল্যহীন বস্তার সমতুল্য। আমি প্রভুর নিকট বারবার প্রার্থনা করি যেনো এরকম সফলতা কারোর না আসে যেখানে নিজের প্রিয় অনুপ্রেরণার মানুষটিই হারিয়ে যাবে।
গল্পের বিষয়:
গল্প