অনাথ শেফালী, বয়স প্রায় এগারো ছুঁই-ছুঁই। শহরের এক স্যাঁতসেঁতে বস্তিতেই থাকে। সে জানে না তার বাবা-মা কে? কেন না, জন্মের পর সে শুধু একজনকেই দেখেছে; সালমা খালা। তার কাছেই মানুষ। অনেকেই বলে মা-বাবার অবৈধ সন্তান, পাপের ফল। শেফালীকে নাকি জন্মের পরপরই পাওয়া যায় বস্তির পাশের ডাস্টবিনের ধারে। যদিও শেফালী এসবের কিছুই বুঝে না, বুঝতেও চায় না। কেননা তার তো সালমা খালা আছে।
পছন্দের শাকপাতা দিয়ে ভাত খেতে ইচ্ছে হলে বিল থেকে শাকপাতা কুড়িয়ে আনে আবার অনেক সময় খুব মাছ খেতে ইচ্ছে করলে কোনও ডোবায় বন্ধু-বান্ধবীদের সাথে বড়শি পেতে মাছ ধরে, সেগুলো খালার কাছে এনে দিলে খুব সুন্দর করে রান্না করে দেয়। শেফালীও পেট ভরে খায় এবং প্রশংসাও করে। বলে, খালা তোমার হাতে যাদু আছে। খালার আবার দুই ছেলে, এক মেয়ে। মাঝে মধ্যেই শেফালীর সাথে খাবার ভাগাভাগি নিয়ে ঝগড়া করে। তাই তো শেফালী ইদানীং ভালো-মন্দ খাওয়ার জন্য বোতল-কাগজের টুকরো কুড়ায় এবং রহমত চাচার কাছে বিক্রি করে। প্রায় সারাদিনই এসব কুড়ানোর মধ্যে থাকে। মাঝে মধ্যে আবার কাজের ফাঁকে-ফাঁকে খেলাধুলাও করে; কানামাছি, কুত-কুত; এগুলো তার প্রিয় খেলা।
যে বস্তিতে সে থাকে তার পাশেই সেলিম চাচার চায়ের দোকান। মাঝে মধ্যেই চায়ের কাপ ধোয়ার জন্য বালতি ভরে পানি এনে দেয়। অনেক সময় চায়ের কাপগুলোও ধুয়ে দেয়; বিনিময়ে কিছু বিস্কুট খেতে পায়। সেলিম চাচার দোকানের হাল্কা লালচে বিস্কুট খেতে শেফালীর খুব ভালো লাগে। একবার তো বলেই বসলো চাচাকে, “তুমি আমার এক বাক্স লালচে বিস্কুট দিয়ে তো, তার বিনিময়ে যত কাম করানোর আমারে দিয়া করাই লইয়ো।”
এ কথা শুনে দোকানদার চাচা মুচকি হাসে। বলে, “কাজ করে দিতে হবে না রে পাগলী, ব্যবসা ভালো হোক দিবো।”
এ কথা শুনে তো শেফালী খুব খুশি, শুনেই লম্বা-লম্বা চুল উড়িয়ে কোথায় যেন মিলিয়ে গেলো। সেলিম চাচা এবং দৃষ্টিতে শেফালীর যাওয়ার পথে তাকিয়ে রইলো এবং অজান্তেই চোখ বেয়ে জল গড়িয়ে পড়ল এই ভেবে যে, এমন লক্ষ্মী, সুদর্শন মেয়েও বুঝি কেও ডাস্টবিনের কাছে ফেলে যায়!
বেশির ভাগ সময়ই শেফালী পার্কের ভিতরে খালি বোতল এবং কাগজের টুকরো কুড়াতে যায়। এতে তার ফায়দা বেশি হয়, কেন না অনেক সময় অনেক প্রেমিক-প্রেমিকা যুগল তাদের প্রেমে এতোটায় ব্যস্ত থাকে যে তাদের বিভিন্ন খাদ্য দ্রব্য তেমনি ফেলে রেখে যায়। তাতে শেফালীর মতো মানুষের খাওয়ার অভাব কিছুটা হলেও পূরণ হয়। তাছাড়া ঠোঙ্গা, বোতলও তো পাওয়া যায়। মাঝে মধ্যে পার্কের বিভিন্ন জায়গা থেকে কিছু ফুল ছিঁড়ে নিয়েও শেফালী ভালো দামে বিক্রি করে। এতেও শেফালীর অনেক সুপ্ত ইচ্ছে পূর্ণতা পায়। তবে শুধু যে পার্কে তার সবকিছু ভালোই যায় এমন না, অনেক সময় তাকে কঠিন সময়ের মধ্যে দিয়েও যেতে হয়।
যখন সে দেখতে পায়, বাবা-মায়েরা তার ছোট্ট সন্তানকে জুস, চকলেট খাওয়ার জন্য জোর করছে, ঘর্মাক্ত কপাল মুছে দিচ্ছে ;তখন শেফালীর চোখ দিয়ে অশ্রু ঝরে। তারও তো এসব পাওয়ার কথা, নাকি শেফালী অনেক বড় হয়ে গেছে? কখনো আবার সে ভাবে, “আচ্ছা, বড় হলে কি সন্তানেরা আদর-ভালোবাসা কম পায়?” পরক্ষণেই বাস্তবতা তাকে গ্রাস করে বসে। যায় কিনা তিন বেলা ঠিক মতো খাবারই জুটে না তার আবার খাবার খাওয়ানোর জন্য জোর করতে হবে! এসব যেন শেফালীর কাছে বিলাসিতা মনে হয়। সে ভাবে, “যার মা-বাবা নেই সেই ভালো বুঝে এ জ্বালা। এ যেন প্রতিদিন তীব্র যন্ত্রণাকে নিজ থেকে আলিঙ্গন করা।”
এভাবেই দিনকাল যাচ্ছে শেফালীর। একদিন যথারীতি পার্কে বোতল কুড়চ্ছে, দেখা হল একজন ভদ্রমহিলার সাথে তিনি নিজেই বললেন, “কোথায় থাকো তুমি?”
উত্তরে শেফালী বলল, “তই যে পার্কের থেইক্কা একটু দূর একখান বস্তি আছে অই-হানে।”
তিনি বললেন, “আমার বাসায় ভালোই খালি বোতল জমা হয়েছে। তুমি চাইলে এসে নিয়ে যেয়ো কেমন?”
শেফালী মাথা নাড়ল এবং ঠিকানা জেনে নিল। একদিন সময় করে বোতল আনতে যাবে ঐ ভদ্রমহিলার বাড়িতে ঠিক করলো। যেদিন সে ঐ বাড়িতে যাবে ঠিক করলো সেদিন সেলিম চাচার দোকানের সামনে দিয়ে যাচ্ছিলো। শেফালীকে দেখতেই সেলিম চাচা ডাক দিল, “শেফালী!”
শেফালী তো জানেই কি কাজ করতে হবে, তাই বলল, “বালতি দাও। তাড়াতাড়ি পানি নিইয়া আসি। আইজ আবার আমার কাম আছে। পানি নিইয়া এসে চইলে যাবে।”
চাচা বলল, “এক বাক্স বিস্কুট লাগব না আমার শেফালী সোনার?”
শেফালী বলল, “সত্যিই দিবা লালচে এক বাক্স বিস্কুট..!”
চাচা বলল, “অবশ্যি, নিইয়া যা।”
“না এহন না, কামডা কইরা আমি আগে ফিরা আইসা নিমু নে।”
সেলিম চাচার মনটা কেন যেন কু ডাকে আজ, খারাপ কিছু না হয় মেয়েটার সাথে। শেফালীকে থামাতে চেয়েও কেন যেন নিষেধ করলো না।
শেফালী তো আজ খুব খুশি। তার পছন্দের এক বাক্স লালচে বিস্কুট সেলিম চাচা দিতে চেয়েছেন। খুশি মনেই সে ঐ ভদ্রমহিলার বাসার ঠিকানায় গেলো খালি বোতলের খোঁজে। কলিং বেল চাপতেই দরজা খুলল এক ভদ্রলোক, বলল, “কি চাই?”
শেফালী বলল, “এক খালায় আমারে কইছিল তার কাছে নাকি অনেক খালি বোতল জমা আছে!”
ভদ্রলোক বুঝতে পারলো যে সে তার স্ত্রীর কথা বলছে। তার স্ত্রী এবং সন্তান দুই দিন হয়েছে দেশের বাড়ি গেছে। বাসায় কেউ নেই। ভদ্রলোকের লালসাময় চাহনি শেফালীকে কেমন যেন বিব্রত করছিলো। বার-বার কেন যেন শেফালীর মন হচ্ছিলো যে, এই লোক তার কাছ থেকে জোরপূর্বক কিছু ছিনিয়ে নিতে চায়।; ঠিক কি, সেটা জানে না। ভদ্রলোক বলল, “আমার স্ত্রীর কথা বলছ মনে হয়! ও তো এখন বাসায় নেই। ভিতরে আসো আমি তোমাকে খালি বোতল দিচ্ছি।”
শেফালী বাসার ভিতরে আসতেই, ভদ্রলোক দরজা আটকে দিল। বলল,” আজকে বাসায় যতো বোতল আছে তোমাকে দেওয়া হবে, কিন্তু এক শর্তে। শর্তটা হচ্ছে আমার সাথে একটা খেলা খেলতে হবে। বিনিময়ে তোমাকে ৫০০টাকা দিবো।”
শেফালী কিছু বুঝে উঠার আগেই, হিংস্র পশুর মতো ঝাঁপিয়ে পড়ল লোকটা। এক পর্যায়ে মানুষরূপী হিংস্র পশুর থাবায় শেফালী জ্ঞান হারিয়ে ফেললো। ফিরতেই সে সারা শরীরে খুব যন্ত্রণা অনুভব করতে লাগল। লোকটা শেফালীকে কিছু বোতল আর ৫০০টাকা দিয়ে। বলল, “আগেই তো বলেছিলাম যে এ খেলায় একটু ব্যথা পেতে পারিস। এখন যা।”
শেফালী ব্যথায়, কষ্টে কোনও মতে বোতল ও টাকা নিয়ে বস্তিতে ফিরতে লাগলো। ফেরার পথে ভাবতে লাগলো, “এ কেমন খেলা যেখানে অনুমতির প্রয়োজন পরে না? একজনকে কষ্ট পেতে হয়? শেফালীর মনে হতে লাগলো এ খেলায় বড়লোকটারই জয় হয়েছে।” তারপর ও নিজ শরীরের রক্ত দেখে বড্ড ভয় পেয়ে গেলো, তাই সে ঠিক করলো বস্তিতে গিয়ে কাউকে কিছু জানাবে না। গিয়েই স্নান করে সব ধুয়ে ফেলবে। যেমন ভাবা তেমন কাজ, বস্তিতে গিয়ে কাউকে কিছু না জানিয়ে ই স্নান করে সব কিছু ধুয়ে ফেললো। তবে ব্যথা কি ধুয়ে ফেলা যায়? আর খারাপ লাগার অনুভূতি?
ওই দিনের পর থেকেই শেফালীর শরীরটা কেমন যেন খারাপ লাগতে শুরু করলো এবং কেমন যেন নিজ শরীরে অন্য কিছু একটা অনুভব করতে লাগলো। কিছুদিন যেতে না যেতেই একদিন সে বমি করে আরও অসুস্থ হয়ে গেলো। শেফালীর মুখে সব শুনে খালা কিছুক্ষণ পাথরের মত চুপ হয়ে রইলো, পরক্ষণেই দু’চোখ বেয়ে জল বেয়ে পড়ল। শেফালী জিজ্ঞেস করলো, “কি হয়েছে খালা? আমার কী হয়েছে? তুমি কাঁদছ কেন?”
“ওরে সর্বনাশ হয়েছে, সর্বনাশ হয়েছে রে শেফালী! তুই মা হতে চলেছিস!”
শেফালী ভাবতেই পারে না এসব! কিভাবে সে বিয়ে ছাড়াই মা হতে পারে? মা হতে গেলে তো বিয়ে করতে হয়। আর সবচেয়ে বড় প্রশ্ন, সে যদি মা-ই হয় তবে তার এ সন্তানের বাবা-ই বা কে?
খালা বলে, “আইজ আমরা গরীব বইল্লা হগলেই সুযোগ নেয়!”
পরদিন খালা আর শেফালী থানায় যায়, সব খুলে বলে পুলিশকে। পুলিশ ঐ লোকের ঠিকানা জানতে চায় আর আশ্বস্ত করে যে, এর বিচার হবে। কিন্তু মোটা অঙ্কের টাকার বিনিময়ে খেলা পাল্টে গেল। যতবারই সালমা খালা থানায় আসে, পুলিশ তাকে শুধু আশায় দিয়ে যায়। এ আশা কিসের আশা সেটা হয়তো স্বয়ং পুলিশও জানেন না, তবুও দেওয়ার কাজ তাই দেন!
দিন-কে দিন শেফালীর ‘মা’ হয়ে উঠার শারীরিক পরিবর্তন হতে শুরু করে। সমাজ কী আর তাকে ছেড়ে কথা কয়? “এক পাপের ফল আরেক পাপের জন্ম দিচ্ছে..পাপের রক্ত তো পাপকেই জন্ম দিবে! তাই না?” অনেকেই তাকে দেখে হাসে, টিটকারি দেয়।
শেফালী খুব কষ্ট পেয়ে ভাবতে লাগে, এতে সে পাপের কি কাজ করেছে? সে তো আর এমন কিছু কখনো চায় নি! তবে কি ধর্ষকরা সমাজের চোখে ভালো মানুষ আর ধর্ষিতরা হাসির পাত্র? নাকি গরীব, পথের মানুষদের ধর্ষণ করলে কোন সমস্যা নাই…?” নিজের প্রশ্নের কোন উত্তর পায় না শেফালী। তবে এটা বুঝতে পারে, তার জন্ম নিয়ে কেন মানুষ তখন অইসব কথা বলতো! তবে কি তার বাচ্চাকেও এ সমাজের মানুষ পাপের ফসল বলেই আখ্যায়িত করবে? না! এমন জীবনটা খুব কষ্টের; শেফালীর এ অল্প বয়সেই সে দেখেছে এ সমাজে পাপের ফসল হয়ে বেচে থাকা কতো কঠিন। সে মোটই চায় না যে তা
র সন্তানও এভাবে বাঁচুক। যেখানে নিষ্পাপকেই এত ঘৃণা, সেই সমাজ, সেই পৃথিবীটাকেই আজ সে ঘৃণা করতে শুরু করল। না এখানে আর থাকা চলে না। এমন সময় একটা ট্রাক আসতেই সে তার তলে ঝাঁপিয়ে পড়ল। মৃত্যুর আগ মুহূর্তে সে ভাবতে লাগলো, “পাপীর লাশটা মরার পর কেউ রাস্তা থেকে উঠাবে তো?”