আজ থেকে ত্রিশ বছর আগের ঘটনা এটা। দুর্গাপূজোর বিজয়া দশমীর রাত। এই রাতে প্রতিটি বাঙ্গালীর মন স্বভাবসিদ্ধ কারণেই খারাপ থাকে। আকাশ প্রায় সারাদিনই মেঘলা। তাই মাঝে মধ্যে দু-এক পশলা বৃষ্টিও হয়েছে। আমি তখন কলকাতা থেকে পাঁচশো কিলোমিটার দূরে এক অখ্যাত গ্রামে চাকরী করতাম। কোনও এক অজ্ঞাত কারণে আমি সেই বছর পূজোয় বাড়ী আসিনি। সেবার অক্টোবরের শেষে পূজো ছিল। বৃষ্টির পরে ফারাক্কা রেলওয়ে স্টেশনটাতে ওই জমজমাট পূজোর রাতেও এক গা ছমছমে ভাব। অতোবড় প্ল্যাটফর্মে ছোট্ট দুটো হলদে বাল্বের আলো টিমটিম করে জ্বলছিল।
একদম শেষ মুহূর্তের কাটা টিকিট বলে টিকিটটা পড়লো গৌড় এক্সপ্রেসের কাটিহার কোচে। যে ভয়টা পাচ্ছিলাম – সেটাই হল আমার সঙ্গে। পুরো কম্পার্টমেন্টে মহিলা বলতে আমি একাই। তখন রিজার্ভেশন বলতে স্লিপার কোচই বুঝতাম আর তার থেকে ওপরে ওঠার ক্ষমতাও পকেটের ছিল না। ট্রেনে উঠে দেখি বেশ কিছু কমবয়সী বিহারী ছেলে নিজেদের মধ্যে খুব হুল্লোড় করছে। তখন অবশ্য ‘ধর্ষণ’ শব্দটা এতো বহুল প্রচলিত ছিল না! ছোটমামা ট্রেনে তুলে দিতে এসেছিলেন; কামরার অবস্থা দেখে ওঁরও ভালো লাগেনি। কিন্তু, তখন আমাদের কারোরই নিজের জায়গা থেকে ফিরে আসার উপায় নেই। মুখ দেখে বুঝেছিলাম, মামা আমাকে ট্রেনে চড়িয়ে একটুও নিশ্চিন্তে ফিরছেন না। শুধু গম্ভীর হয়ে বলেছিলেন,”পৌঁছে খবর দিও।” সেসময় ল্যান্ডফোন, মোবাইল কিছুই তো ছিল না। খবর মানেই, চিঠি।
সে চিঠি আসতে-আসতে আমি ছুটি কাটিয়ে চলেই আসবো। যাই হোক স্লিপার কোচের টিমটিমে আলোয় দেখলাম আমার সীট পড়েছে লোয়ার-বার্থে। এই জিনিসটিকেই আমার বড়ো ভয়! একে তো ইঁদুর, আরশোলা তার ওপর স্পর্শ-প্রবণ মানুষজন। সীটের পাশদিয়ে আসতে যেতে সবাই একবার ছুঁয়ে দেখে যায় বস্তুটি কি? যাইহোক জুতোজোড়া নিরাপদ স্থানে রেখে একটা চাদর মুড়ি দিয়ে চুপচাপ বসে আছি আর ছেলেগুলোর হৈ-হল্লা দেখছি। সে সময় পাকুড় স্টেশন অথবা তার আশপাশের জায়গাতে ট্রেনে প্রচুর ডাকাতি হতো। ডাকাতরা কিছু না পেলেও নেমে যাবার সময় একটু-আধটু ভালোবাসার নিশান রেখে যেতে দ্বিধা করতো না! বেশ দিশাহারা হয়ে চুপচাপ বসে আছি, ঘুমবো কিনা ভাবছি। এক পেট ভাত খেয়ে ট্রেনে উঠেছি আর এমনিতেই ট্রেন,বাসের দুলুনিতে আমার খুব ঘুম পায়। হঠাৎই বেশ স্যুটেড-বুটেড এক ভদ্রলোক বেশ গায়ে পড়েই বললেন,”আপনি শুয়ে পড়ুন, আমি জেগেই আছি। ভয় নেই।”
একটু অবাক হয়ে আমি মুখের দিকে তাকাতেই বললেন,”আমি উল্টো দিকের সীটেই আছি। আমার রাতে জার্নি করলে ঘুম হয় না। আপনি নিশ্চিন্তে ঘুমোতে পারেন, আমি জেগে আছি।” একে তো বিহারী ছেলেগুলোর উৎপাত তার ওপর এই গায়ে পড়া উটকো লোকটা! কি আর করা? আপাদমস্তক চাদর মুড়ি দিয়ে মটকা মেরে পড়ে রইলাম। বাইরে বৃষ্টির ঠাণ্ডা হাওয়ায় বোধকরি চোখটা একটু লেগে এসেছে, হঠাতই দেখি পায়ের কাছে চাদরে টান। ধড়মড় করে উঠে বসে মুখের চাদর সরিয়ে লোকটির দিকে কটমট করে তাকাতেই লোকটি হেসে বললে,”স্যরি ম্যাডাম! পায়ের কাছে চাদরটা সরে গিয়েছিলো তাই ঠিক করতে গিয়ে আপনার ঘুমটা নষ্ট করে দিলাম!”
আমি কোনও উত্তর না দিয়ে চুপচাপ বসে আছি দেখে, আমার দিকে নিজের ডান হাতটা করমর্দনের উদ্দেশ্যে বাড়িয়ে দিয়ে বললে,”আমি একজন আর্মি অফিসার; দশ বছর বাদে পূজোর ছুটিতে বাড়ী যাচ্ছি। আমি বেলঘরিয়ায় থাকি। আপনি ম্যাডাম?” তার বাড়ানো হাতটা বাড়ানোই রইলো। আমি চাদর থেকে হাত বাড়াতে পারলাম না। দুটো কারণে-
প্রথমত: তখনো একা বাড়ীর বাইরে চাকরী, রাতের ট্রেনে একা যাতায়াত করলেও, সম্পূর্ণ অচেনা একজন পুরুষ মানুষের সঙ্গে করমর্দন করার মতো স্মার্ট হয়ে উঠতে পারিনি।
দ্বিতীয়ত: আমি মানুষটিকে মন থেকে ঠিক বিশ্বাস করতে পারছিলাম না। আর পরিবেশটাও আমার নিজের কাছেই বিশ্বাসযোগ্য মনে হচ্ছিল না। কিভাবে জানিনা, উনি ব্যাপারটা ঠিক বুঝতে পেরে বললেন,”বুঝেছি আপনি আমাকেও বিশ্বাস করতে পারছেন না। যাকগে, ঘুম যখন নষ্টই করেছি, তখন এক কাপ করে কফি হয়ে যাক।”
বৃষ্টির ঠাণ্ডায় আমারও মনে হল, একটু কফি হলে মন্দ হয় না! কফিওয়ালা কফি দিলে আমি পয়সা দিতে গেলে উনি কিছুতেই আমাকে দিতে দিলেন না। বারবারই বললেন,”আমি আপনার ঘুম নষ্ট করেছি আমিই খাওয়াবো।”
শুরু হল আমাদের গল্প। আমার কপালে সিঁদুর দেখেই খুব সম্ভবত: আমাকে ‘বৌদি’ সম্বোধন করে গল্প করা আর পথচলা শুরু হল। অনেকরকম গল্প হল শেষ রাত পর্যন্ত। আমি কোথায় থাকি? আমি কি করি? কোথায় পড়াশোনা করেছি, বাড়ীতে কে কে আছে? কত দিন বিয়ে হয়েছে? হাজব্যান্ড কোন ডিপার্টমেন্টে আছে, ইত্যাদি-ইত্যাদি নানান রকমের প্রশ্ন। আমি শুরুতে খুব একটা সহজ হতে না পারলেও পরে দেখলাম গল্প ভালোই জমে উঠেছে। আমার নাম শুনে ওর এতো ভালো লেগে গেলো যে, শেষে বলেই ফেললো,”আপনাকে বৌদি ডাকতে আমার খুব অসুবিধা হচ্ছে, আফটার অল উই আর ফ্রেন্ডস! আপনার যদি আপত্তি না থাকে আমি আপনাকে নাম ধরেই ডাকতে চাই।”
আমি মনে-মনে ভাবলাম, নিজের যা ইচ্ছে তাইতো করছ বাবা! আবার অনুমতির অপেক্ষা কিসের! আমিও সৌজন্যবশতঃ ওর বাড়ীতে কে-কে আছে, কি পোস্টে চাকরী করে এই রকম কয়েকটা মামুলী প্রশ্ন করতে লাগলাম মাঝে মাঝে। তবে এতো কথার মাঝে ট্রেনের ওই স্বল্প আলোতেও মানুষটার সৌজন্য বোধের আবেশে আমি একটু-একটু করে আমার গাম্ভীর্যের খোলস থেকে বেরিয়ে আসছিলাম। কথায় কথায় আমরা এলাম হবির প্রসঙ্গে। দুজনেরই হবি গল্পের বই পড়া, জানলাম দুজনেরই প্রিয় লেখক একই ব্যক্তি আর তিনি হলেন আমাদের প্রিয় ‘লালাদা’ ওরফে শ্রী বুদ্ধদেব গুহ। তারপরের কয়েক ঘণ্টা আমরা, আমাদের প্রিয় লেখককে নিয়ে মেতে রইলাম। এতক্ষণ যে মানুষটাকে বিশ্বাসই করতে পারছিলাম না, রুচি আর পছন্দ মিলে যেতেই আর মানুষটিকে যেন তেমন অপছন্দের লাগছিলো না।
কথায় কথায় জানলাম, আমাদের জন্মের বছরটাও একই। গোটা একটা রাত আমরা কফি খেয়ে আর গল্প করে কাটিয়ে দিলাম। একটা নির্ভেজাল- নিখাদ জমাটি আড্ডা। আড্ডা দিতে দিতে কখন যে আমরা ‘আপনি’ থেকে ‘তুমি’তে চলে এসেছি টেরই পাইনি। শুধু একটিমাত্র ব্যক্তিগত প্রশ্ন করেছিলো সে,”তুমি তো বাঙ্গালী ঘরের গৃহবধূ। আজতো তোমাকে ঘরে থেকে মা দুর্গাকে বরণ করার কথা। আজকে তুমি ট্রাভেল করছ? চাকরীতে ছুটি পাওনি বুঝি, আমারই মতো?” আমিও অনেক প্রশ্নেরই উত্তর না দেওয়ার মতো এর উত্তরও এড়িয়ে গিয়েছিলাম। ট্রেন ব্যান্ডেল স্টেশনে ঢুকলে সে বলল,”এসো! এবার আমরা চা খাই।”
স্টেশনে নেমে মাটির ভাঁড়ে করে দুজনের জন্য চা এনে বলল,”এবার চায়ের দামটা তুমিই দাও।” আমি চায়ের দাম মিটিয়ে দিয়ে চা খাওয়া শেষ করতেই, আবার হাতটা বাড়িয়ে দিয়ে বলল,”এখন নিশ্চয়ই আর আমার সঙ্গে হ্যান্ডশেক করতে তোমার আপত্তি থাকার কথা নয়। এসো! ভোরের সূর্যকে সাক্ষী রেখে আমরা হাত মেলাই।”
বলার মধ্যে এমন কিছু ছিল যা আমার নিজেরই অজান্তে আমার ভেতর থেকে কেউ আমাকে হাতটা বাড়াতে সাহায্য করলো। কোটের পকেটে হাত ঢুকিয়ে বলল, “আজ থেকে আমরা বন্ধু, আমি ডক্টর সুবীর সেন। আর্মির ডক্টর। তুমি কিন্তু একবারও আমার নাম আর পেশা জানতে চাওনি,” বলেই সুবীর বলল,”আমি তোমাকে মনে রাখবো একজন সাহসী মহিলা হিসেবে। দাঁড়াও, তুমি তো আমার আগেই নেমে যাবে। তোমাকে ‘টোকেন অফ ফ্রেন্ডশিপ’ কিছু গিফট দিই!” এই বলে নিজের ব্রীফকেস খুলে, হাজার মিলির একটা লিকুইড জেল্যুসিলের বোতল, পঁচিশটা ভিক্স লজেন্স, আর অনেকগুলো ক্যাডবেরী বের করে হাতে নিয়ে বলল,”এগুলো তুমি নিলে আমার খুব ভালো লাগবে।”
সেই পবিত্র প্রভাতে এক রাতের গড়ে ওঠা পথচলতি এক সম-মনস্ক বন্ধুর অনুরোধ আমি ফেলতে পারিনি। ওর জোর করে দেওয়া উপহারগুলো ও নিজেই আমার সাইড ব্যাগে ভরে দিয়েছিলো। দেখতে-দেখতে হুগলী সেতু, গঙ্গানদী সব পেরিয়ে নৈহাটিতে ট্রেন ঢুকে পড়তে লাগলো। দূরের আকাশে তখন একটু-একটু করে ভোরের সূর্য রং ছোঁয়াতে শুরু করেছে। আমি নামার তোড়জোড় শুরু করতে, ও-ই আমার ভারী ব্যাগটা স্টেশনে নেমে নামিয়ে দিলে। ট্রেন ছেড়ে না দেওয়া পর্যন্ত দরজার সামনে দাঁড়িয়ে আরো একবার হাতটা বাড়িয়ে নিজেই আমার হাতটা ধরল। ট্রেনটা ছাড়ার মুহূর্ত পর্যন্ত শেষ বারের করমর্দন-রত হাতটা ধরেই ছিল। ট্রেনে থাকতেই ওষুধের প্যাকেটের ওপরে রেজিমেন্টের নাম ঠিকানা লিখে দিয়েছিলো, চিঠি দেবার জন্য। ট্রেনটা নৈহাটি ছেড়ে সামনের দিকে এগোচ্ছিল আর আমি পেছনের দিকে। সুবীরের ঠিকানা লেখা কাগজটা আমি আমার গন্তব্যে নিতে পারিনি। সেদিন পর-পুরুষের ঠিকানা নিয়ে ঢোকা শুধু অবৈধ নয়, নিষিদ্ধও ছিল।