কচু পাতা

কচু পাতা

সাবিত্রী 25 বছরের একটি অবিবাহিত মেয়ে। অভাবের সংসারের তার তিন বোন, দুই ভাই আর মা। সকলের দায়িত্ব তার ওপর। গ্রামের অশিক্ষিত মেয়ে সাবিত্রী সবজি বিক্রি করে বাড়ি-বাড়ি গিয়ে। সাবিত্রী কচু-ই বেশি বিক্রি করে। বাড়িতে মা আর দুই বোন সমস্ত রকমের কচুর চাষ করে। মানকচু, গাটিকচু, ওলকচু, বনকচুদ, দুধকচু থেকে শুরু করে কচু-শাক এসবই প্রধানত বিক্রি করে সাবিত্রী।

প্রকাশ বাবু বিপত্নীক, তার একমাত্র ছেলে মূলত কলকাতায় থাকে। ছেলে পেশায় ফ্যাশন ডিজাইনার। প্রকাশ বাবু ধার্মিক মানুষ, তাই ছেলের নাম রেখেছিলেন যুধিষ্ঠির। বড় কাজের অফার পেয়ে তার ছেলে বিদেশে ছিল বহুদিন। পাঁচ বছর পর দেশে ফিরেছে সে, প্রথমেই বাবার কাছে আসবে জানিয়েছে যুধিষ্ঠির। প্রকাশ বাবু তাই ভীষণ খুশি। একই গ্রামে থাকে সাবিত্রী আর প্রকাশ বাবু। সাবিত্রী প্রকাশ বাবুকে নিজের বাবার মত শ্রদ্ধা করে। কাজের পরে বেশির ভাগ সময়টা সে প্রকাশ বাবুর কাছেই থাকে। প্রকাশ বাবু সাবিত্রীকে নিজের মেয়ের মত স্নেহ করেন। যুধিষ্ঠিরের পাঁচ বছর পর দেশে ফেরার কথাটা সাবিত্রীকেও বলেন প্রকাশ বাবু। সাবিত্রী উদ্যোগ করে প্রকাশ বাবুর বাড়ির কাজের লোক নিতাইকে সঙ্গে নিয়ে যুধিষ্ঠিরের থাকার ঘর গোছগাছ করে দেয়।

নির্দিষ্ট দিনে যুধিষ্ঠির ফেরে বাড়িতে। অনেকদিন পর ছেলেকে কাছে পেয়ে প্রকাশ বাবুর আনন্দের সীমা নেই। সাবিত্রীর সঙ্গেও পরিচয় হল যুধিষ্ঠিরের। প্রকাশ বাবুর বাড়ি যাতায়াতের জন্য সাবিত্রী সঙ্গে যুধিষ্ঠিরের পরিচয় বাড়তে থাকে। বহুদিন বিদেশে থাকার পর শহরের যান্ত্রিক পরিবেশ থেকে গ্রাম্য পরিবেশে যেমন মনে স্বস্তি অনুভব করছে যুধিষ্ঠির, তেমনই শহরের জটিল মানুষের ভিড় থেকে গ্রামের সরল সাদাসিধে মেয়েটির সাথে কথা বলেও মনে অত্যন্ত স্বস্তি অনুভব করে সে। একটি 25 বছরের মেয়ে এত নিষ্পাপ হতে পারে, সাবিত্রীকে না দেখলে জানতেই পারতো না যুধিষ্ঠির। যুধিষ্ঠির সাবিত্রীকে শহুরে জীবনের গল্প শোনায় আর সাবিত্রী তাকে গ্রামের জীবনের। সরলমনা সাবিত্রী ভালবেসে ফেলে যুধিষ্ঠিরকে। কিন্তু যুধিষ্ঠির, শহরের আর পাঁচটা মেয়ের সাথে যে স্বাভাবিক বন্ধুত্ব, সাবিত্রীকেও সেই চোখেই দেখে।

একদিন গ্রামে ঘুরতে বেরিয়ে যুধিষ্ঠির মাঝ রাস্তায় বৃষ্টির মধ্যে পড়ে। তার সাথে দেখা হয়ে যায় সাবিত্রীর। সাবিত্রী ফ্যাশন ডিজাইনিং বোঝে না। সে যুধিষ্ঠিরকে ‘দর্জি বাবু’ বলে ডাকে। ‘দর্জি বাবু, ছাতা তো নেই। কিন্তু বড় কচু পাতা আছে। এটাই আমার ছাতা। যাবেন নাকি আমার ছাতায়?”

দুজনে দুটো কচু পাতা মাথায় গ্রামের কাঁদা ভরা রাস্তা দিয়ে গন্তব্যে পৌঁছল। এরপর থেকে সাবিত্রী প্রতিদিন কচুর নানান পদ রান্না করে আনতে শুরু করে যুধিষ্ঠিরের জন্য। মুখে সে নানান কথা বললেও প্রকাশ বাবু ঠিক বুঝতে পারেন সাবিত্রীর মনের কথা। যুধিষ্ঠির ব্যস্ত থাকে তার নিজস্ব শোরুম খোলার পরিকল্পনায়। যুধিষ্ঠির প্রতিদিন তার কাজ করার টেবিলে একটা করে কচু পাতা দেখে আর নিরাদরে তা ফেলে দেয়। কাজের লোক নিতাইকে বকাবকি করে কিন্তু রোজ টেবিলে কোথা থেকে যে কচু পাতা আসে, এক মহা বিরক্তিতে পড়েছে সে। আসলে সাবিত্রী কচু পাতাগুলি রেখে যায় ভালবেসে।

যুধিষ্ঠিরের ফেরার সময় হয়ে যায়। অনেকদিন গ্রামে বাবার সাথে থাকল এবার কলকাতায় ফিরতে হবে তাকে। নিজস্ব একটা শোরুম খুলবে সে। বাবাকে ওর নিজের কাছে নিয়ে যাবে যুধিষ্ঠির, সবকিছু ব্যবস্থা করতে হবে। সাবিত্রী যুধিষ্ঠিরের চলে যাওয়ার খবর পেয়ে কিন্তু সেদিন আর প্রকাশ বাবুর বাড়ি যায় নি। রোজকার মত কচু পাতাটাও দেয়া হয় না তার। যুধিষ্ঠির যাওয়ার আগেই নিতাইয়ের কাছে খোঁজ করে সাবিত্রীর। কিছুক্ষণ অপেক্ষা করে অবশেষে স্টেশনের দিকে রওনা হয় যুধিষ্ঠির। প্রকাশ বাবু আর নিতাই ও তার সাথে যায়। আর সবার অগোচরে যায় সাবিত্রী, তার সাথে এক ব্যাগ কচু শাক।

স্টেশনের বাইরে রাধাচুডা গাছটার আড়াল থেকে যুধিষ্ঠিরকে দেখতে থাকে সে। অটোরিকশা থেকে নেমে নিতাই যুধিষ্ঠিরের মালপত্র নিয়ে প্ল্যাটফর্মের দিকে যাচ্ছে আর প্রকাশ বাবু গেছেন টিকিট কাটতে। অটো-ওয়ালাকে ভাড়া মিটিয়ে গ্রামের রাস্তার দিকে তাকিয়ে আনমনা হয়ে দাঁড়িয়ে আছে যুধিষ্ঠির। সাবিত্রীর দৃষ্টি শুধু যুধিষ্ঠিরের ওপর ছিল। হঠাৎ সে ছুটে গিয়ে ধাক্কা দিয়ে ফেলে দেয় যুধিষ্ঠিরকে, মুহূর্তের মধ্যেই একটি লরি চাপা দেয় সাবিত্রীকে। সাবিত্রীর হাত থেকে ছিটকে পড়ে যাওয়া কচু-শাকের পাতাগুলো রক্তাক্ত হয়ে যায় সাবিত্রী রক্তে।সেই রক্তাক্ত লাল কচি কচু পাতাগুলি যুধিষ্ঠিরকে রোজ তার টেবিলে রাখা কচু পাতাগুলির মানে বুঝিয়ে দেয়।

হাসপাতালে নিয়ে যাওয়া হয় সাবিত্রীকে কিন্তু ততক্ষণে সবকিছু শেষ। সাবিত্রীর শেষ কাজ সমাপ্ত করে বাড়ি ফেরে যুধিষ্ঠির। বার-বার সাবিত্রীর শেষ দৃশ্যটা মনে পড়ছে তার, ঘুমাতে পারছেনা। সে মেয়েটা তাকে এতটা ভালবেসেছিল যে তার জন্য নিজের জীবন দিয়ে দিল আর সে এতদিন তা বুঝতেই পারল না। সাবিত্রী তাকে ভালবেসে তার ঘরে যে কচু পাতা দিত, সেই কচু পাতার আকার যে হৃদ-চিহ্নের মতই তা এতদিন বুঝতে পারেনি যুধিষ্ঠির। সাবিত্রীর আবেগ ভরা ভালবাসাকে সে অবহেলায় ফেলে দিয়েছে বার-বার।

পরে দিন সকালে সাবিত্রীর বাড়ি যায় সে। সারল্যের আবরণের ভীতরে যে দায়িত্ববান একটি মেয়ে ছিল, সেটা বুঝতে পারে যুধিষ্ঠির। কীভাবে সাবিত্রী অতি কষ্ট রোজকার তাদের সংসার চালাত সব কিছু একে-একে জানতে পারে যুধিষ্ঠির। সরল-দায়িত্ববান মেয়েটি তার জন্য নিজের জীবন দিয়ে দিয়েছে, আজ নিজেকে অপরাধী মনে হয় তার। যুধিষ্ঠির ঠিক করে সাবিত্রীর পরিবারের সমস্ত দায়িত্ব সে নেবে। সাবিত্রী জীবিত থাকতে যে ভালবাসা যুধিষ্ঠির অনুভব করতে পারেনি, সাবিত্রীর চলে যাওয়ার পর যুধিষ্ঠির তা অনুভব করে। যুধিষ্ঠির ঠিক করে সে আর কলকাতায় ফিরবে না, এখানেই থাকবে সারা জীবন।

সাবিত্রীর চলে যাওয়ার শোক কাটিয়ে ওঠার পর যুধিষ্ঠির গ্রামে মাঝে পোশাক তৈরির একটি কারখানা তৈরি করে, যাতে গ্রামের মানুষদের রোজগারের কষ্ট লাঘব হয়।শহরের বড়-বড় ফ্যাশন শোতে যায় গ্রামের কারখানার পোশাক। যুধিষ্ঠির এখন একজন নামকরা ফ্যাশন ডিজাইনার। আর তার বেস্ট ডিজাইন হল কচু পাতার নকশা করা ড্রেস। গ্রে রঙের ব্লেজার ওপর সবুজে কচু পাতার ছাপ। আর কচু পাতার মাঝে দুধে আলতা ফোটা। শহরে এখন কচু পাতার ছাপা ডিজাইনার শাড়ির ডিমান্ড সব থেকে বেশি। কুর্তি থেকে শুরু করে স্কাট, শার্ট, প্যান্ট সবকিছুতে এখন তার স্টাইল বাজারে বেস্ট ফ্যাশন স্টাইল।

গ্রামের বহু মেয়ে কাজ করে এখন যুধিষ্ঠির এর কারখানায়। তাদের আর সাবিত্রীর মত কষ্ট করতে হয় না। সাবিত্রীর মা আর দু’ভাই এখন যুধিষ্ঠিরদের বাড়িতেই থাকে। সাবিত্রীর তিন বোনের খুব ভাল পাত্রের সঙ্গে বিয়ে দিয়েছে যুধিষ্ঠির। সাবিত্রীর দু’ভাই এখন কলেজে পড়ে, তাদের সমস্ত খরচা যুধিষ্ঠির চালায়। যুধিষ্ঠির তার কারখানা আর শোরুমের নাম রেখেছে ‘সাবিত্রী গার্মেন্টস’।

গল্পের বিষয়:
গল্প
DMCA.com Protection Status
loading...

Share This Post

সর্বাধিক পঠিত