কামিনী কথা

কামিনী কথা

“হ্যাঁগো, দেখো কামিনীও কেমন ঝলসে মতন গেছে।” “আমাদের বিরহ হয়তো সহ্য করতে পারেনি ও।” কামিনী গাছটার নীচে দাঁড়িয়ে পরমা আর সুনীল। ঝোলা চামড়ার হাত দুটো একে অপরকে জড়িয়ে আছা। সুনীলের এক হাতের লাঠিতেই ভর দুজনের। সুনীলের লাঠি আর পরমার সুনীলের হাত। কামিনী গাছটার নিচে সাদা ফুলে একেবারে বন্যা বয়ে গেছে। সিমেন্ট দিয়ে বাঁধানো উঠানটা সাদা হয়ে আছে। গাছের নীচে বসে পড়ল দুজনে। অনেক যত্নে মানুষ তাদের এই কামিনী।

“আচ্ছা আমাদের ছেলেদের মত কামিনীও বড়ো হয়েছে বল?” প্রশ্ন করল পরমা।

“হ্যাঁ, তা তো হবেই। সেই কবে ছোট্ট একটুখানি এনে লাগিয়েছিলাম বলতো।”

“মনে আছে তোমার?”

“হ্যাঁ, আছে বৈকি।”

“তুমি গর্ত খুঁড়লে আর আমি ওকে পুঁতে জল দিলাম। একবারে ধরে গেছিল বল।”

“হ্যাঁ, তুমি পুঁতেছিলে কিনা!”

“আ-আ-আ-আ মও যা। এই বয়সেও মন রাখার কথা বলছ!”

“কেন এই বয়সে মন রাখার কথা বলা যায় না?”

“কে বলেছে বলা যায় না!”

“তোমার মনে পড়ে যেদিন তুমি এই বাড়িতে বউ হয়ে এসেছিলে -”

“সে কি আর ভুলা যায় বল? আমার জীবনের সব থেকে বড় পাওয়া তো ওই দিনটাই। আর তো কিছু পেলাম না।”

“সবই তো পেলাম, না পাওয়া এখনও কিছু বাকি আছে?”

“আছে বৈকি, অনেক আছে।”

“আর কি চাও বল?”

“এই বয়সে দিতে পারবে যা চাইবো?”

“চেয়েই দেখো না একবার।”

“আমি চাই আমার মৃত্যু যেন এই কামিনীর তলায় হোক। ওর ছায়ায় আমি মরতে চাই। দেবে তো আমায়?”

“আর তোমার আছে যদি আমি মরি?”

“আঃ! আমার আগে তুমি মরতে পারো না। তুমি কথা দিয়েছ আমার শাঁখা সিঁদুর তুমি কোনোদিন মুছবে না। আমার কত সখ আমি মরলে শাঁখা সিঁদুর নিয়ে পুড়ব।”

“তোমার এরকম সখ কেন?”

“অনেকের শখ তো অনেক ধরনের হয়। তাই আমার শখটা এই ধরনের-”

“আমারা এ বাড়িতে ফিরতে পারব কোনোদিন, পরমা?”

একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলল পঁয়ষট্টি বছরের বুড়িটা। পাসে বাহাত্তরটা বসন্ত দেখে বুড়োটা তার চোখের দিকে তাকিয়ে। কোনও কথা নেই কারোর মুখে। হালকা হাওয়ায় কামিনী তখনো ঝরছে। সময়ের চাকা ঘুরিয়ে একটু পিছিয়ে নিয়ে যাওয়া যাক। দুর্গাপূজার ষষ্ঠীর দিন সুনীল পরমাকে নিয়ে করে বাড়িতে নিয়ে এল। বুড়ি মা ছাড়া আর কেউ ছিল না তার। পরমাকে বরন করে ঘরে তুলে শাশুড়ি মা বলেছিল, “মা এই ঘরটাকে সাজিয়ে নিস নিজের মত। আর আমার ছেলেটাকে গুছিয়ে দিস। বড্ড অগোছালো ও।” পনেরো-ষোল বছরের মেয়েটা মাথা নেড়ে সায় দিয়েছিল। সেই থেকে তার সংসার সংগ্রাম শুরু।”

বৌভাতের দিন নতুন বউকে তার স্বামী কিছু-না কিছু উপহার দিয়ে থাকে। পরমা গভীর আগ্রহে নিজের উপহারের অপেক্ষা করছে। হঠাৎ একটা ছোট্ট কামিনী চারা এনে সুনীল বলল, “এই নাও, এটা তোমার উপহার; আজকে আমাদের ফুলশয্যা কিনা।” পরমার কামিনী ফুল খুব পছন্দ আর সেটা সুনীল তার বোনের কাছ থেকে জেনে নিয়েছিল।

দুজনে মিলে সেই কামিনী গাছটাকে রোপণ করে নিজেদের সংসার শুরু করেছিল। তখন সুনীলের চাষবাসের কাজ। জমিতে চাষ করে দুজনে টাকা জমিয়ে বানিয়েছিল এই বাড়িটা। রক্ত বিক্রির টাকায় তৈরি তাদের এই বাড়ি। ততক্ষণে সুনীলের মা পরলোক-বাসী হয়েছেন। নিজের হাতে সাজিয়েছিল পরমা এই বাড়ি। ক্ষুদ্র-ক্ষুদ্র কণা মিশিয়ে তৈরি করেছিল তাদের ‘স্বপ্ননীড়’ আর তাদের এই সংগ্রামের সাক্ষী হিসাবে ছিল কামিনী।

বাড়িটার সাথে-সাথে বেড়ে উঠেছিল এই কামিনী গাছ। তারপরে একে-একে দুই ছেলে ভাস্কর আর পুষ্কর। তাদের সংসারে টানাটানি থাকলেও ভালোবাসায় কোনও কমতি ছিল না। অল্পতে খুশি থাকতে জানত পরমা, মানিয়ে নিত দু’জনে। ভাস্কর আর পুষ্কর ছোটবেলা থেকেই জানত, এই কামিনী তাদের বড় বোন। পরমা বলতো, “কামিনী দিদি তোমাদের ফুল দেবে, ছায়া দেবে। বড় হয়ে একে কোনোদিন মেরে ফেলিস না যেন।” দুই ভাই জড়িয়ে ধরত মাকে, আর কামিনী তার ফুল ঝরিয়ে তার অস্তিত্বের পরিচয় দিত।

ধীরে-ধীরে দুই ভাই বড় হল। পরমা আর সুনীল নিজেদের জীবনের সব দিয়ে দুটো ছেলেকে পড়তে কোলকাতা পাঠাল। ছেলেরা কলকাতা এসে দুজনেই পড়াশুনায় মন দিল। পরমা আর সুনীল তাদের কামিনীকে নিয়ে দিন গুনতে লাগল, করে তাদের ছেলেরা ইঞ্জিনিয়ার হয়ে গ্রামে গিয়ে তাদের দুঃখ ঘোচাবে। নিজের বাপের বাড়ির দেওয়া শেষ গয়নাটাও বিক্রি করল পরমা। তাতেও খরচা কুলানো যাচ্ছিল না। শেষে একবেলা ভাত খেয়ে একবেলা মুড়ি খেয়ে কাটল দম্পতির দিন। বয়সও এদিকে থেমে ছিল না। কেটে গেল এই ভাবে প্রায় তিন বছর। কামিনী এখনও নিজের অস্তিত্ব টিকিয়ে দাঁড়িয়ে। হঠাৎ একদিন দুপুরে এই ভাই এসে উপস্থিত। পরমা আর সুনীলের তো আনন্দের সীমা রইল না। ভাস্কর ব্যাগ থেকে একটা প্যাকেট বের করে দিল পরমার হাতে। “মা এটা নাও। তোমার আর বাবার জন্য আমাদের দুই ভাইয়ের তরফ থেকে উপহার।” ভিজে চোখে প্যাকেটটা খুলল সুনীল।

“এ তো মোবাইল ফোন। কিন্তু আমরা তো ব্যবহার করতে পারব না বাবা।” পুষ্কর বলল, “ফোন বাজলে এই সবুজ সুইচটা টিপেই কানে দিয়ে কথা বলবে। আর কিছু করার দরকার নেই।” সেদিন পুরো গ্রামে ঘুরে-ঘুরে দেখাল সুনীল, তার ছেলেরা তাকে মোবাইল ফোন দিয়েছে। এক আনন্দে আত্মহারা বাবাকে সেদিন পুরো গ্রাম দেখেছিল। সুনীল রূপে সেদিন গ্রামে ঘুরেছিল একটা বাবা যার জীবনের সবটুকুই তার সন্তানের জন্য গচ্ছিত থাকে। পরদিন সকালে ভাস্কর বলল, “বাবা আমাদের এখনো কিছু টাকা লাগবে। তা না হলে এত বছরের সব চেষ্টা পড়াশুনা বিফলে যাবে বাবা।”

তিন লক্ষ টাকার কথা শুনে সুনীল আঁতকে উঠেছিল, আর পরমার বুকটা কেঁপে উঠেছিল। কিন্তু পিছু হটেছি ওই মা-বাবা। বাড়িটা বন্ধক দিয়ে তিন লক্ষ টাকা তুলে দিয়েছিল ছেলেদের হাতে। দমকা হওয়ায় সেদিন কামিনীর নরম একটা ডাল ভেঙ্গে পড়েছিল। হয়তো বড় সন্তান হিসেবে নিজের মা-বাবাকে সাবধান করেছিল, কিন্তু মা-বাবা সেসব শোনেনি।

ছেলেরা প্রতিশ্রুতি দিয়েছিল – ” চাকরি পেলেই আগে বাড়ি ছাড়িয়ে নেব বাবা, কোনও চিন্তা করবে না।” কিন্তু ছেলেদের প্রতি এই বিশ্বাস আজ তাদের এই বাড়িতে ফেরার সংশয় নিয়ে এসেছে। কামিনীর টানও কোনও কাজে লাগেনি সুনীলের আর পরমার। তারা বোঝেনি ঘরটার সাথে-সাথে তারা তাদের কামিনীকেও বন্ধক রেখেছে। হয়তো কামিনী গাছটাও গুমরে-গুমরে কেঁদেছিল সেদিন, কিন্তু বুঝতে দেয়নি কাউকে।

তারপর বছর কেটে গেলেও কোনও খবর আসেনি ছেলেদের। প্রথম দিকে ফোন এলে সবুজ বোতামটা টিপে ছেলেদের সাথে কথা বলতো বুড়ো-বুড়ি। তারপর ছেলেদের একে-একে বিয়ের পর সেটাও বন্ধ হল, আর সবুজ বোতামটা টেপার সুযোগ হচ্ছিল না তাদের। বহুদিন কোনও খবর না পেয়ে একদিন গ্রামের একজনকে দিয়ে ফোন করল সুনীল ভাস্করের কাছে। ফোন তুলে ভাস্কর বলল, “বাবা আমরা আগামী সপ্তাহে আসব, চিন্তা করো না।” আশ্বস্ত হয়ে ফোনটা রেখে দিয়েছিল সুনীল।

হ্যাঁ, ভাস্কর আর পুষ্কর এলো পরের সপ্তাহে। বুড়ো-বুড়ি ভাবল এবার বোধহয় ছেলেরা ঘরটাকে ছাড়িয়ে নেবে। কিন্তু পুষ্কর বলল, “বাবা, শহরে ফ্ল্যাট নিয়েছি। কাল তোমাদের নিয়ে যাব যেখানে। এবার থেকে ওখানেই থাকবে তোমরা। এখানে তোমাদের দেখাশোনা করার জন্য কেউ তো নেই। ওখানে তোমাদের বৌমারা আছে। তোমাদের দেখবে।” ছেলেদের এরূপ ভালোবাসা দেখে আনন্দে চোখে জল এলো পরমার। সেদিন রাতে কামিনীর কাছে অনেক ক্ষমা চাইল পরমা আর সুনীল। কামিনীও তাদের এই পরিবর্তনে বাধা দেয়নি; শুধু ভেবেছিল, এইভাবে পরের হাতে ছেড়ে দিয়ে চলে গেল তার মা-বাবা? নিজের ফুল ছড়িয়ে মনের দুঃখ ও আনন্দ প্রকাশ করেছিল কামিনী। তার কাছে সুখ-দুঃখ প্রকাশের আর অন্য কোনও পথ ছিল না। পরদিন ছেলেরা দু’জনকে নিয়ে চলে এলো কলকাতা। পড়ে রইল ‘স্বপ্ননীড়’ আর কামিনী। একটা তেতলা বাড়িতে এসে বাবা মাকে রেখে ছেলেরা বলল, “বাবা, মা, এখানে কিছুদিন তোমরা থাক। তোমার বৌমারা এখন বাপের বাড়ি গেছে; আসলেই আমরা তোমাদের নিয়ে যাব।”

সুনীল মাথা নেড়ে সম্মতি দিল। একটা লোক তাদের ভিতরে নিয়ে গেল। ভিতরে তাদের মত আরও অনেক বুড়ো-বুড়ি দেখে চমকে গেল সুনীল আর পরমা। পরিচয় হল বাকিদের সাথে। জানতে পারলো সুনীল, ছলেরা তাদের বৃদ্ধাশ্রমে ছেড়ে গেছে। কিন্তু পরমা সবাইকে বলল, “আমার ছেলেরা এক সপ্তাহের মধ্যে আমাদের নিয়ে যাবে।” বাকিরা শুনে কেমন একটু মুচকি হাসি হাসল। তাদের সেই হাসির কারণ বুড়ো-বুড়ি বুঝল না। কেটে গেল এক সপ্তাহ, কিন্তু তাদের ছেলেরা এল না। বৃদ্ধাশ্রম এর ফোন থেকে ভাস্করকে ফোন করল সুনীল। সে ফোনটা তুলে বলল, “বাবা, তোমরা ওখানেই থাক। এখানে তোমাদের আনতে পারব না। তোমাদের বৌমারা রাজি হচ্ছে না।”

সুনীল বলল, “ঠিক আছে বাবা। আমাদের তাহলে গ্রামে ছেড়ে আয়। আমরা আর তোদের ফোন করব না। ওই গ্রামের বাড়িতেই মরতে চাই, এখানে এই অজানা জায়গায় নয়।” ভাস্কর, “বাবা, কিছু মনে করো না, যার কাছে বাড়িটা বন্ধক ছিল তার থেকে আরও কিছু টাকা নিয়ে ওই বাড়িটা আমরা বিক্রি করে দিয়েছি। সেই টাকায় শহরে বাড়ি কিনলাম। তোমাদের তো জীবন শেষ বাবা। যেখানে আছো সেখানেই বাকি ক’টা দিন কাটিয়ে দাও না। রাখছি বাবা। বেশী ফোন করো না। ব্যস্ত থাকি আমি, কাজের প্রচুর চাপ।” সুনীলের মাথায় আকাশ ভেঙ্গে পড়ল। মুহূর্তে সারা পৃথিবীটা অন্ধকার হয়ে গেল তার। ছেলেদের প্রতি বিশ্বাস মনের কোনে শেষ নিঃশ্বাস ত্যাগ করল।

দু’দিন পর বৃদ্ধাশ্রমের উদ্যোগে গ্রামের বাড়িতে এলো দু’জন। কামিনী আর সে ‘স্বপ্ননীড়’ তখন অন্য কারোর। কামিনীর নিচে বসে গল্প করতে লাগল দু’জনে। শেষ ইচ্ছাটা জানালো পরমা। কামিনী গাছ থেকে তখনও ফুল পড়ছে। হয়তো তাদের দেখে মনে-মনে কামিনী খুব খুশী। অবে সেও কেমন যেন শুকিয়ে গেছে। কিছুক্ষণ হাতে-হাত রেখে বসে রইল সুনীল আর পরমা, মনে করতে থাকল তাদের হারিয়ে যাওয়া দিনগুলি। একটু-একটু করে জুড়ে-জুড়ে তৈরি করা এই বাড়ি। নিজেদের সবটা দিয়ে প্রতিষ্ঠিত করা নিজের ছেলেদের, কিন্তু এ কেমন প্রতিষ্ঠিত হওয়া। শেষ পর্যন্ত এই কামিনীই একমাত্র নিজের জায়গায় অনড় থাকল। বাকি সবই ফাঁকি দিয়ে চলে গেল; বাড়ি-বয়স-সন্তান।

দুপুর গড়িয়ে বিকেল হল। পরমা মাথাটা রাখল সুনীলের কাঁধে। ভাঙা-ভাঙা গলায় বলল, “বুকটা বড় ধড়পড়-ধড়পড় করছে গো।” সুনীল পরমার মাথায় হাত বুলাতে-বুলাতে বলল, “বিষ নিজের কাজ করতে শুরু করেছে।”
পরমা আধো খোলা -আধো বন্ধ চোখে সুনীলের দিকে তাকিয়ে বলল, “আমি কিন্তু আগে যাব। তুমি কিন্তু আমার যাওয়ার পরে খেও। আমি কামিনীর তলায় তোমার অপেক্ষা করব।”

“তোমার শেষ ইচ্ছা পূরণ হবে পরমা। অপেক্ষা করো আমার। আমিও তোমার পেছনেই থাকব। অন্য কিছু কষ্ট নেই, শুধু কামিনীকে পরের হাতে ছেড়ে যেতে বড় কষ্ট হচ্ছে।” “মেয়ে কি আর চিরকাল নিজের থাকে? এতদিন আমার ঘর সাজিয়েছে, এবার অন্যের ঘর সাজাবে।” কামিনী গাছটা খুব জোড়ে-জোড়ে দুলতে লাগল। এতক্ষণে সেও হয়তো বুঝল, এবার সে সত্যিই পরের হাতে যেতে চলেছে; আর তার কিছুই করার নেই।

অস্ফুট স্বরে পরমা বলল, “আসছি।” তারপর ওর চোখদুটি চিরদিনের জন্য বন্ধ হয়ে এল। সুনীল খুব আদর করে কোলে শোয়াল পরমাকে। নিস্তব্ধ হয়ে গেল চারিদিক। ঝাপসা চোখে পাঞ্জাবির পকেট থেকে হাড়তে বিষের কৌটোটা বের করে মুখে ঢালল সুনীল। পরমার দিকে গভীর স্নেহে তাকিয়ে কিছুক্ষণের মধ্যেই পরমার পাশেই লুটিয়ে পরল সুনীল। দমকা হাওয়ায় কামিনীর ফুলগুলো তখন তাদের গায়ে অঝরে ঝরতে লাগল।

গল্পের বিষয়:
গল্প
DMCA.com Protection Status
loading...

Share This Post

আরও গল্প

সর্বাধিক পঠিত