“মাছের মাথাটা ওরে দাও”, বাবা মাছের মাথার সামনে থেকে নিজের প্লেট সরিয়ে নিল। মা একবার আমার দিকে তাকায়, আরেকবার বাবার প্লেটের দিকে , বাবার দিকে তাকানোর সাহস মা’র নেই)। শেষ পর্যন্ত মাছের মাথা আমার পাতেই পড়ল। আর আমি মনে-মনে ঠিক করলাম, এখন আমি মাটিতে প্লেটটা ফেলে দেব। বাবাকে বলব, “তোমার দয়া আমার লাগে না,” তারপর চলে যাব। কিন্তু এটাও জানি যে, আমার পক্ষে এরকম করার কোনও উপায়ই নেই। বাসা থেকে চলে গিয়ে যখন একবার পা ভেঙ্গেছি, এরপর থেকেই অঘোষিত নিয়মে বাবার উপর রাগ করার অধিকার চলে গেছে। আমি মাছটা শেষ করলাম, তারপরই উঠলাম, এর আগে নয়। বাবার সাথে চলতে গেলে দমে-দমে চিন্তা হয়। খোঁচা-খোঁচা দাড়ির ফাঁক থেকে কখনো আদরের কথা বের হয় নি। অবশ্য নিজেকে আদরের কাঙালও ভাবি না, মায়ের কাছ থেকে পুষিয়ে যায়।
বাবার সাথে পথে চলতেও সমস্যা, কলেজে উঠে গেছি তবু শাসনের হাল ছাড়ে না। রাস্তায় হাটতে গিয়ে যদি কোনও কারণে কারেন্টের খাম্বায় আলতো করে হাত বুলিয়ে দেই, তখনই তেজি গলায় চিল্লানো শুরু করবে, “আবর্জনা না হাতালে ভাল লাগে না, না?” বিড়ি খাই সন্দেহে প্রতিদিন বাসায় এলে লম্বা দম নিয়ে শার্টটা শুঁকতে থাকে। আর স্কুলে যাওয়ার সময়টা ছিল আমার লজ্জা সরমের পরীক্ষা। ক্লাস টেনে ওঠার পরেও স্কুল ছুটির সময় নিতে আসতো, রাস্তা পার করাতো হাত ধরে-ধরে। বিড়িখোর বন্ধুগুলি স্কুলের দেওয়ালের উপরে বসে-বসে প্রতিদিন এই সার্কাস দেখত।
শুনেছি কোনও এক বিশ্ব-বিখ্যাত নেতাকে, উনি ১১ মাসের বাচ্চা থাকতে উনার বাবা উনার পা ধরে বৃষ্টির মধ্যে ফেলে দিয়েছিলেন। সবাই যখন হায়-হায় করে উঠল, তখন বাবা গম্ভীর গলায় বলেছিল, “ওর অনেক বড় হতে হবে, এই সব রোদ-বৃষ্টির বেগ আগে থেকেই শিখে নিক।” আমার বাবাকে মাঝে-মাঝে পাগল লোক মনে হত। সাইকেলের চেইন তুলতে গিয়ে হাত কেটে ফেললেও কখনো নিজে থেকে এসে চেইন তুলে দেয় নি। আর আমার মনে নেই, বাচ্চা থাকতে আমাকে কখনো কোলে তুলেছে কিনা! এই লোকটির হয়তো সব সময়ই মনে হতো, তার কোলকে আমি টয়লেট মনে করি।
“অনিক, তোর বাবা তো কাশে, একটা কফ-সিরাপ ছিল না তোর রুমে? দিয়ে যা তো!” মা দরজার সামনে এসে বলল। মা’র শাড়ির ছেঁড়া অংশটা হাত দিয়ে গুঁটিয়ে রেখেছে।
“নেই”
“ছিল তো, দেখ।”
“শেষ করে ফেলেছি।”
মা আর কিছু না বলে চলে গেল। আর আমি সুন্দর করে সিরাপের বোতলটা বিছানার নিচে লুকিয়ে ফেললাম। এই লোককে আমার হাত দিয়ে কিছু দিব না। সেন্টিমেন্টাল মানুষজনের কাছে এটা পিতৃহত্যা জাতীয় কিছু মনে হতে পারে, আমি সেন্টিমেন্টাল না, তাই আমার কিছু যায় আসে না। টাকা কামানো শুরু করলে বাবাকে বৃদ্ধাশ্রমে রেখে মাকে নিয়ে চলে যাব ঢাকা। এই ঢং এর বাড়িটাও বেচে দিব।
ও আচ্ছা, এই বাড়িটা নিয়ে কিছু বলি। এই বাড়িটা হল আমার দাদার বানানো। দাদা আবার এটা বানাতে টাকা নিয়েছে তার বাপের কাছ থেকে। মানে বলা যায় ওটা আমার দাদার বাপের বাড়ি। আর আমার বাবা রাজার মত বাড়িটা মাগনা পেয়ে গেছে। ওই পাওয়া পর্যন্তই। আগে দেওয়ালের রং ছিল ঘন সাদা। রং না করতে-করতে শেওলা জমে কালো হয়ে গেছে। পেছনের দুটি রুম ভেঙে ভুত-পেত্নীর বাসর ঘর। বৃষ্টির দিনে ছাদটি কোনও কাজে লাগে না। আধা ঘণ্টা বৃষ্টি পড়লেই কৃত্রিম বন্যায় বাড়ি ডুবে যায়। বছরে আমার বইখাতা দুইবার কেনা লাগে শুধু এই কারণে। অথচ এই দিকে তার কোনও নজর নেই। তিনি আছেন তার মজায়। আমার মাঝে-মাঝে সন্দেহ হয়, বাবা বেতনের টাকা কোথাও কোনও ভাবে লুকিয়ে রাখে। তা না হলে, মোটামুটি সচ্ছল একটা চাকরি করার পরেও বাসায় খাবারের এত টানাটানি কেন? একদিন মাছ রাঁধলেও কে আসলে মাছটা খাবে তা নিয়ে নীরব প্রতিযোগিতা শুরু হয়ে যায়। আজব ব্যাপার!
তার নিজের তো আর সমস্যা নেই, সমস্যা সব মায়ের। দু’বছর হল বাসায় কোনও নতুন বিছানার চাঁদর নেই। ছেঁড়া চাদরটি সেলাই করা মা’র প্রতিদিনের একটি কাজ। মাঝে-মাঝে তার নিজের শাড়িতেও দু-একটা তালি দেখেও না দেখার ভান করি। এতে মা’র দুঃখ তো অবশ্যই হয়, কিন্তু বলে না কখনো। আমি তো তার চোখ দেখে ঠিকই বুঝি। আমার আবার ভাল একটা গুন আছে। মানুষের চোখ-মুখ দেখে মনের কাহিনী বুঝতে পারি। মাঝে-মাঝে নিজেকে ওলি-আউলিয়া পর্যায়েরও মনে হয়। শুধু বাবার চোখের দিকে এখনো তাকাই নি এখন পর্যন্ত, হয়তো জন্মের পর থেকে; সাহস হয় নাই।
অবশ্য তার কাহিনী বুঝতে মনের দিকে তাকানো লাগে না, তার কাজকর্ম দেখেই সব বোঝা যায়। বাড়ির সবাইকে ছেঁড়া কাপড় পরিয়ে নিজেও রং জ্বলা একটা লুঙ্গি আর মিহি করে পোকায় খাওয়া একটা ভেস্ট পরে দিব্যি ঘুরে বেড়ায়। আগে এমন ছিল না। ইদানীং গত দুই বছর ধরে কি না-কি ভীমরতি ধরেছে, বাড়ির বাইরে থাকি বলে দেখতেও পারি না ভালো মতো। অবশ্য বাড়ির বাইরে ( বাইরে বলতে একদম বাইরে না, কলেজের কাছে হোস্টেলে ) গিয়েও লাভ হয়নি। দরকারের সময় টাকা চাইলে টাকা পাঠায় না। কলেজের ছেলেরা চাঁদা তুলে বার-বি-কিউ পার্টি করে, আমি বাড়িতে টাকা চাইলে এক কথা, “বাসায় তোমার মা খাওয়ায় না? এই সব আজে-বাজে কাজে টাকা খরচ করবে না।” আর যখন পা ভেঙ্গেছিলাম, সেই সময়ের কথা মনে হলেই মেজাজ খারাপ হয়ে যায়।
হসপিটালে শুয়ে আছি, এর মধ্যেই তার গলা চড়িয়ে চিল্লানো, “টাকা গাছে ধরে? এত ওধুষের টাকা পাব কোথায়? রং করার আর জায়গা পায় না। আর ডাক্তারগুলিও মাশাল্লাহ, একদিনে টেস্ট দেয় ১০-১২ টি।” ডাক্তার তখন দরজার পাশেই দাঁড়িয়েছিল। আমি কোনও মতে মুখ ঢেকে শুয়ে ছিলাম। এসবের পর থেকে আমি ঠিক করে ফেলেছিলাম, জীবনে যাই-ই করি বাপের মত কৃপণ আর নিষ্ঠুর হব না। কখনো-কখনো একটা বিড়ি জ্বালাতে গিয়ে মনে হয়, বাবা মারা যাবার পর আকাশে দাঁড়িয়ে-দাঁড়িয়ে নিশ্চয়ই আমার কুকর্মগুলি সব দেখবে। তখন বিড়ির স্বাদটা পানসে হয়ে যায়, টানতে গেলে আশে-পাশে তাকাতে হয়। এই লোকটা ছায়ার মত আমার চিন্তাগুলিকেও আটকে রেখেছে, বড়ো যন্ত্রণা।
আবার মা’র চীৎকার, “অনিক! অনিক! দেখ তোর বাবা কেমন করছে, ওঠ! দেখ! ডাক্তার লাগবে! ডাক্তারকে ডাক!” মা জোরে-জোরে আমার গা ঝাঁকিয়ে আমার ঘুম ভাঙ্গাতে লাগল। উঠলাম, চোখ ডললাম, হাই তুলতে-তুলতে বিরক্ত মুখে বললাম, “কি?” “দেখ তোর বাবার অবস্থা ভাল না! শরীরটা ঘামছে, ডাক্তার লাগবে! হার্ট অ্যাটাক-ই হবে!”
“এত রাতে ডাক্তার কই পাবো?” আমার কাছ থেকে এই উত্তর মা আশা করেনি। “পাগলের মত কথা বলিস না! নিজের বাপ মরে যাচ্ছে আর তুই বলিস ডাক্তার কই পাব?” “মরে যাচ্ছে,” আমার মাথায় আবার ওই চিন্তাটা ঘুরপাক খেতে লাগল। এখন যদি মারা যায় তাহলে আমার আগামী সব কুকর্ম আকাশ থেকে দেখবে বাবা। আসলে জন্মানো মানেই কি মৃত্যুর গণনা শুরু না? বাবাকে দেখলে মনে হতো, পৃথিবীর ঝামেলা থেকে যত তাড়াতাড়ি বাঁচতে পারে, ততই তার সুখ। বাবাকে মাঝে-মাঝে নিঃসঙ্গতার প্রতীক মনে হতো।
আমি শেষ-মেশ উঠলাম। মা আমার হাত ধরে রীতিমত দৌড়ে নিয়ে গেল আমাকে বাবার ঘরে। বাবার ঘরে আলো কম, তার নিঃসঙ্গতার মতই বিষাদী আলো ছেয়ে আছে ঘর জুড়ে। দেখলাম, বাবার অবস্থা আসলেই খারাপ। ঘামে শরীর ডুবে গেছে, হাঁপানির মত শ্বাস-প্রশ্বাসের শব্দ আসছে। দেখিনি, তবে মায়ের কাছে শুনেছি, বাবার এরকম আগেও হয়েছে। বেশী টেনশনে নাকি এমন হয়। বাবার জীবনে যে টেনশনও হতে পারে এমনটা ভাবতে পারি না কখনো। মা কাঁদতে-কাঁদতে বলল, “কী করব বল? আমার মাথায় কিছু আসছে না।” বাবা হালকা নড়ল। হাত উঁচিয়ে মাকে ডাকল। এইটুকু করতেই ব্যথায় মুখ নীল হয়ে গেছে। মা তাড়াতাড়ি গিয়ে বাবা মুখের কাছে কান পাতলো। মা এখনো আমার হাত ধরে আছে। আমার যাওয়াও বাধ্যতা মূলক তাই মা’র পাসে হাঁটু গেড়ে বসলাম চুপচাপ।
বাবা ফিস-ফিস করে কোনোমতে যা বলল, তার যতটুকু আমি শুনলাম, তার মানে – পাশের ঘরের সিন্দুকে কিছু টাকা আছে আর বাবার হিসেবের ডাইরিটা আছে। ডায়রিতে বাবার এক ডাক্তার বন্ধু নাম্বার আর ঠিকানা আছে। আমি যে টাকা নিয়ে বেরিয়ে সেই ডাক্তারকে নিয়ে আসি। মায়ের কাছ থেকে একই কথা শুনার জন্য আর দাঁড়ালাম না, পাশের ঘরে চলে গেলাম। আমি আসলে নিজেও খেয়াল করিনি, আমার চলার গতি দ্বিগুণ হয়ে গেছে। কে জানে, কোনও সন্তানই হয়তো পিতার মৃত্যু মুখ বুজে দেখতে পারে না। যার রক্ত শরীরে নিয়ে ঘুরে বেড়াই, তার সাথে কীভাবে এমন করা যায়?
পৃথিবীটা ততক্ষণে স্তব্ধ হয়ে গেছে। জানালার বাইরে থেকে কয়েকটা ঝিঁ-ঝিঁ পোকার শব্দ আসছিল এতক্ষণ, বন্ধ হয়ে গেছে। রুমের আলোটাও করে গেল কি? পাশের ঘর থেকে মা কী যেন বিলাপ করছে। বাবার কাশির শব্দ থেমে গেছে অনেক আগেই। আমি সিন্দুকটির পাসে হেলান দিয়ে বসে আছি। কোনোদিকে তাকাই নি। বারে-বারে শুধু বাবার টানা-টানা হাতের লেখার পাতাগুলি উল্টে যাচ্ছি, আবার পড়ছি, আবার উল্টাচ্ছি।
শুনে মনে হতে পারে বাবা কোনও মর্মান্তিক স্মৃতিকথা লিখেছে ডায়রিতে। কেন বাবা সারাজীবন নিঃসঙ্গ, কেন আমায় ভালবাসে না, তার ব্যাখ্যা-বিবরণ না, কিছু না। শুধু প্রতি মাসের খরচের হিসাব লেখা বিষণ্ণ কালো কালিতে। রস-কষ হীন। কিন্তু আমার চোখ আটকে গেল সেই হিসাবের খাতাতেই। গলা শুকিয়ে গেল। জীবনে প্রথমবার হয়তো বাবার জন্য কান্না এল, বুক ফাটা চীৎকার। কিন্তু এই কান্নাটা বড়ো অদ্ভুত, বিশ্বাসঘাতকের মত; তাই কাঁদতেও পারছি না। ডায়রির হলুদ পুরানো পাতায় কয়েক ফোঁটা অশ্রু, চোখের সাথে অনেকক্ষণ যুদ্ধ করে পরে গেল।
এমনকি গত মাসের হিসাবটাও ভয়াবহ। বাড়ির মেরামতের জন্য সিমেন্টের দুটি বস্তা, মায়ের জন্য একটা নতুন শাড়ি, বাবার পড়ার টেবিলের জন্য ল্যাম্প, কিছু জামা-কাপড়, চাল-ডাল, মাছ ইত্যাদি যা-যা দরকারি বাজার, মোটামুটি সচ্ছল পরিবারের হিসাব। শেষে বড়-বড় করে লেখা ছেলের খরচ এবং সুন্দর করে আমার হিসাবের প্রত্যেকটি জিনিসের পাসে টিক দেওয়া। আমার নতুন ব্যাগ, সব স্যারের বেতন, পিকনিকের চাঁদার কথা বলে সিগারেটের জন্য যে টাকা নিয়েছি তার হিসাব, আর নতুন সাইকেলের টাকা।
বাবার জন্য আর মায়ের জন্য ছড়িয়ে-ছিটিয়ে যেসব লিখেছিল লিস্টে, সব লাল কালি দিয়ে কাটা, বাড়ি মেরামতের জিনিসগুলিও। এমনটা শুধু গত মাসেরটাই নয়, বিগত ৭ মাস ধরে হিসাবের একটা বড় অংশ জুড়ে একই জিনিস; বাড়ি মেরামতের সিমেন্ট, মায়ের শাড়ি, বাবার টেবিল ল্যাম্প আর জামা-কাপড়; আর প্রত্যেক মাসেই সবগুলি লাল কালি দিয়ে খুঁজে-খুঁজে কাটা। এটা কী বাবার দারিদ্রের ছবি? নিজের পরিবারকে সচ্ছল ও স্বাবলম্বী রাখার ইচ্ছা ষত্বেও ব্যর্থতার দলিল? কিন্তু কী আশ্চর্য, আমার হিসাবের প্রত্যেকটা জিনিস, প্রত্যেকটা লিস্টে কি যত্ন করে টিক দিয়ে রাখা। নিজের প্রয়োজনীয় লজ্জা ঢাকার কাপড়ের লিস্ট কাটা, অথচ মিথ্যা বলে আমার পিকনিকের নামে নেওয়া বিড়ি-সিগারেটের টাকায় টিক! আমার এটা-সেটা আবদারের সবগুলিতেই টিক, শুধু ‘ছেলের গিটার’ লেখাটায় লাল কালি দিয়ে বৃত্ত আঁকা।
অর্ধেক বৃত্ত বানিয়েই কাগজটা ছিঁড়ে ফেলা হয়েছে। কে জানে, হয়তো মাস শেষে দেখা গেছে ছেলের গিটার কেনার জন্য টাকা নেই, হয়তো ব্যর্থতার সব অভিমান কাগজের উপর ঢেলে কাগজটা ছিঁড়ে ফেলেছে কলমের ডগা দিয়ে। আমার পা ভাঙ্গার মাসে, এমনকি ডাল-তরকারির বেশির ভাগটাই কেটে দেওয়া। কিন্তু ছেলের খরচের সবগুলি ওধুষের পাশে টিক। আর আমি সব সময় মনে করতাম ‘বাবা কী নিষ্ঠুর!’ ছেলের পা ভেঙ্গে গেছে অথচ রুচি-মত কোনও খাবারও আনছে না বাসায়। মুখ ফুটে কখনো বলিও নি। বললে হয়তো তখন কোনও-না কোনও ভাবে ঠিক আনত, মাকে বলতো আমাকে খাইয়ে দিতে, আর গোপনে হিসাব থেকে কেটে ফেলে দিতো নিজের ভাগের কিছু।
আমি আর ডাইরিটা পড়তে পারলাম না, ডাইরিটা বন্ধ করলাম। বুকটা হু-হু করছে। বাইরে আবার ঝিঁ-ঝিঁ ডাকতে লাগল। ফ্যানটা শব্দ করে ঘুরতে লাগল। রুমের হলুদ বাল্বটা মনে হল আমাকে দেখে হাসছে, মেঝেটা আস্তে-আস্তে তলিয়ে নিয়ে যাচ্ছে আমাকে। পিতৃহত্যা করেছি কি আমি? হয়তো শরীরটাকে নয়, কিন্তু প্রতিদিন হত্যা করেছি নানান অজুহাতে মিথ্যা বলে, নতুন সাইকেলের জন্য হোস্টেল থেকে বাড়িতে আসা বন্ধ করার হুমকি দিয়ে, বাবার সাথে খেতে বসে নীরবে প্রতিদিন শত্রুতার বীজ ছড়িয়ে দিয়ে। হঠাৎ মা পাশের রুম থেকে দৌড়ে এল। মায়ের প্রতিটি কদমে মাটিটি যেন খিল-খিল করে হাসছে, কিন্তু আমার খেয়াল নেই। “কি রে, তোর কী হয়েছে? এমন বসে আছিস যে? চোখ লাল কেন?” মা আমাকে উত্তর দেওয়ার সুযোগ দিল না, “তোর বাবার বুকের ব্যথাটা হাল্কা কমেছে, আবার বাড়তে পারে, নম্বরটা পেয়েছিস? ডাক্তারের নম্বরটা?”
“কি রে, কথা বলছিস না কেন?” মা কাছে এসে আমার মুখটা টেনে সোজা করল। আমি কাঁদছি অঝোর ধারায়। মা আমার অবস্থা দেখে অবাক হয়ে গেল। পা ভাঙ্গার পরেও যে আমি কাঁদিনি, আজকে বাবার জন্য কাঁদছি? আমাকে জড়িয়ে ধরল মা। মায়ের পায়ে লুটিয়ে পড়ে কান্না থামানোর চেষ্টা করছি। “কি রে বাপ, তুই কাঁদছিস কেন? ভাল হয়ে যাবে তোর বাবা। ডাক্তার এসে ইনজেকশন দিলেই ঠিক হয়ে যাবে।” আমি উঠে দাঁড়ালাম। “কই যাস? নম্বর পেয়েছিস?” মায়ের কোনও কথা আর আমার কানে গেল না। আমি মহা ঘোরে ঝড়ের গতিতে বাবার রুমের দিকে দৌড়ে যাচ্ছি আর যখন পৌঁছলাম, মনে হল হাজার বছরের পথ পাড়ি দিয়ে এসেছি।
বাবা চুপচাপ শুয়ে ছিল বিছানায়। এখনো হাল্কা ঘামছে। আমার পায়ের শব্দ পেয়ে আমার দিকে তাকাল। আমিও তাকালাম; এই প্রথমবার, বাবার চোখের দিকে। সেখানে চোখ ছিল না, দুটি অন্ধকার গহ্বরে সীমাহীন হতাশা জড়ো হয়ে চোখের জায়গা দখল করে রেখেছে। বাবা অবাক হল আমার চেহারার মলিনতায়। কখনোই তো আমাকে নিজের সামনে এত কোমল মুখে দেখেনি। হাত দিয়ে কাছে ডাকল। আমি গেলাম, তবে খুব কাছে যাওয়ার সাহস হল না, যোগ্যতাও নেই।
তবু শেষ চেষ্টা করে যত ঘন হওয়া যায়, হলাম। হয়তো এখন আমার জিজ্ঞাস করা উচিত, শরীর কেমন আছে? হয়তো জলের গ্লাসটা এগিয়ে দেওয়া উচিত, কপালে হাত দিয়ে দেখা উচিত জ্বর এসেছে কি না? কিছুই করলাম না। শুধু বিহ্বল হয়ে তাকিয়ে রইলাম তার চোখের অতল গহ্বরে। আগে বাবার মুখে হাসি না দেখে, বাবাকে দোষ দিতাম; এখন এই গহ্বর দেখে আসল দোষী চেনা যায়। কতদিন বাবার সাথে কথা বলি না, আজ কত কথা বলার আছে, কিন্তু কিছুই বলতে পারলাম না। শুধুই তাকিয়ে রইলাম বাবার দিকে। মনে-মনে স্বস্তির নিশ্বাস ফেললাম তার স্বাভাবিক নিশ্বাসের শব্দ শুনে। চীর অপরাধীর মত শুধুই দুটি শব্দ বেরিয়ে এল গলা দিয়ে, যে শব্দগুলি কখনো কাউকে না বলার গোপন পণ করেছিলাম, ‘ক্ষমা করো’ ।