শেষ লেখা

শেষ লেখা

গ্রামের এক মধ্যবিত্ত পরিবারের ছেলে আমি। ছোট থেকেই পড়াশোনা করতে আগ্রহটা আমার অন্যান্য ছেলেদের তুলনায় একটু বেশি। পড়াশোনার কারণে অনেক ছোটবেলায় গ্রামের সুন্দর প্রকৃতিকে বিদায় দিয়ে বিলাসিতাময় শহরে চলে আসি। ক্লাস সিক্সে আমি আমার গ্রাম ছেড়ে কলকাতায় চলে এসে একটা ভালো স্কুলে ভর্তি হই । তখন HS পরীক্ষা দেব, 2012 সাল, আমার বয়স কেবল 18, কলকাতায় যে স্কুলে পড়তাম তারই হোস্টেলে থাকতাম। একঘেয়েমি কাটাতে মাঝে মধ্যেই বন্ধুরা মিলে বাইরে থেকে খাবার নিয়ে আসার ব্যবস্থা করতাম। সেদিন দিন ছিল রবিবার। অন্য দিনের মতোই কিছু বন্ধুরা মিলে আমরা ঠিক করলাম যে, রাতে একটা ছোট ধরনের পার্টি করলে মন্দ হয় না। বন্ধুরা বলতে, আমার খুব কাছের দুই বন্ধু রবি আর সুরজ। সুখের দিন হোক কিংবা দুঃখের দিন সবসময়ই ওদের কাছে পেয়েছি।

সেই রবিবার আমরা তিন বন্ধু মিলে অনেক রাত পর্যন্তই হাসি ঠাট্টা করলাম। রবি অনেক মজার-মজার ঘটনা বলতে ওস্তাদ। তবে ওর ঐ ঘটনা গুলো যে কতটা সত্য তার উপর আমার আর সুরজ দুজনেরই প্রচণ্ড সন্দেহ প্রথম থেকেই থাকতো। অনেক রাত করে আমরা খাওয়াদাওয়া সারলাম। খাবার অবশ্য রেস্টুরেন্ট থেকেই নিয়ে এসেছিল সুরজ। তবু বন্ধুরা মিলে আড্ডা দিলে যা হয় আর কি, খেতে-খেতে রাত বারোটা বেজে গেল। তারপর হঠাৎ করেই যদি বলে বসল যে, সবাই মিলে ভূতের সিনেমা দেখবে। সুরজ ওর সাথে যোগদান করলো। কিন্তু আমার যে ছোট থেকেই ভুতের প্রতি প্রচণ্ড ভয়, ওদের যদি ওই কথা বলি তাহলে শুরু হয়ে যাবে দুই বন্ধুর ঠাট্টা-তামাশা। অনেকটা self-respect এর জন্যই নিজের কথাটা না বলে, ইচ্ছা না থাকা সত্ত্বেও সম্মতি দিতে হল। রবি কোথায় থাকে একটা ভূতের ভিডিও নিয়ে এসেছে। বুঝলাম বিদেশী সিনেমা।

আমাদের হোস্টেলে একটা রুমের ব্যবস্থা আছে, তবে ওই ঘরটাতে কেউ ঢুকে না। অবশ্য ঢুকবে কিভাবে, প্রথম দিন থেকেই ভালো তালা দেওয়া দেখেছি ঘরটাতে। শুনেছি, ওই ঘরেই নাকি আমাদের স্কুলের একটা ছাত্রকে পিটিয়ে মেরে ফেলা হয়েছিল, তারপর থেকে ওই ঘরটাকে তালা দিয়ে দেওয়া হয়েছে। সেই তালা এখন পর্যন্ত খোলা হয়নি, ঠিক হল সেই ঘরেই ভুতের সিনেমা দেখা হবে। ভয় পেলেও এটা ভেবেই মনটা একটু চিন্তা মুক্ত হল যে অনেক আগেকার বন্ধ ঘর ওরা খুলতে পারবে না। কিন্তু হোস্টেলে ওই ঘর ছাড়া অন্য কোথাও ডিভিডি চালানোর ব্যবস্থাও নেই। এইসব ভাবছিলাম, হঠাৎ করে রবি আর সুরজকে দেখলাম ঘরটা খুলে ফেলল। এটা দেখেই সেই অজানা ভূতের ভয় আবার জড়িয়ে ধরল আমাকে। কিন্তু চাবি ছাড়া ওরা তালা কিভাবে খুলল? ওরা মন্ত্র তন্ত্র শিখে আসলো নাকি কোথাও থেকে? এসব প্রশ্ন জিজ্ঞেস করবো ভাবছিলাম, তখনই রবি বলল সে নাকি তালা খোলার পদ্ধতি জেনে এসেছে পরিচিত একজনের কাছ থেকে।

যাইহোক তালা খুলে আমরা তিনজন ঘরে ঢুকলাম। খুবই অন্ধকার আর অপরিষ্কার ঘর, ধুল আর মাকড়সার জালে ভর্তি হয়ে আছে। অনেকের মুখে শুনেছি ঘরের ভিতরে নাকি এখনো সেই ছাত্রের নির্মম কান্নার চিৎকার শুনতে পাওয়া যায়। আমরা ঘরের লাইটটা জ্বালিয়ে ঘরটা একটু পরিষ্কার করে DVD আর টিভিটার সাথে কারেন্টে লাগিয়ে দিলাম। ভূতের সিনেমাটা চালাবো এমন সময় রবির নম্বর কে যেন একজন ফোন করল। অজানা নম্বর ভেবে কলটা রিসিভ না করে রেখে দিল রবি। আবার কল আসলো ঐ নম্বর থেকে। আবার রবি একটু ভাব নিয়ে কলটা ধরল, ওপাশ থেকে খুব সজোরে একটা বিদঘুটে আওয়াজ আসলো। আওয়াজটা এতটাই বিকট ছিল যে ফোনটা ছুড়ে ফেলে দিল রবি।

কিছুক্ষণ পর আমরা এবার সিনেমা চালু করলাম। ঠিক 10 মিনিট পর এবার সুরজের মোবাইলে ওই নম্বর থেকেই কল এল। এবার আমরা একটু ভয় পেয়ে গেলাম, বিশেষ করে আমি। সুরজ ফোন রিসিভ করল। কলটা ধরেই হঠাৎ করে ওর কি যে হল, আমাদের কিছু না বলে ঘর থেকে সোজা বেরিয়ে গেল। জিজ্ঞেস করলাম, “কোথায় যাচ্ছিস?” ও কোনও উত্তর দিল না, শুধু সজোরে হেঁটে বেরিয়ে গেল।

প্রায় এক ঘণ্টা হয়ে গেল, এখনো সুরজের কোন খবর পাচ্ছি না। আমাদের খুব দুশ্চিন্তা হতে লাগল। তখন প্রায় রাত একটা, এত রাতে কিছু না বলে কোথাও যে চলে গেল ও কিছুই বুঝতে পারছিলাম না। এক ঘণ্টার পরেও যখন ওর আসার কোন পাত্তা নেই তখন রবি বলল, “একবার বাইরে গিয়ে দেখে আসি চল।” ওর কথায় সম্মতি জানিয়ে দুজন মিলে বাইরে বেরবো এমন সময় আমার নম্বরে একটা কল এলো। পকেট থেকে বের করে দেখলাম সুরজের কল। তাড়াতাড়ি ফোনটা ধরে জিজ্ঞেস করলাম, “এত রাতে এতক্ষণ ধরে কোথায় আছিস? আমাদের তো কিছুই বলে গেলিনা?” ওপাশ থেকে একটাই উত্তর এলো, “রবিকে ফোনটা দে!”

একটু চমকে গেলাম। সুরজের গলাটা কেমন জানি একটু বিদঘুটে ধরনের লাগছিল। মনে হচ্ছে, ওর গলা থেকে সাধারণ মানুষের কণ্ঠে কেউ বের করে নিয়েছে আর তার বদলে দিয়েছে কোন যান্ত্রিক কণ্ঠ, কিন্তু সেই কণ্ঠ মানুষের মতন নয়। আমি একটু ভীত অবস্থাতেই ফোনটা রবিকে দিলাম। রবি কিছুক্ষণ কথা বলার পর আমাকে বলল, “সুরজ হোস্টেলের মেন গেইটের বাইরে আছে। কেউ বুঝি মেন গেইট টা বন্ধ করে দিয়েছে ভেতর থেকে। তাই আমাকে খুলে দেওয়ার জন্য ডাকছে।” আমার মনে একটা প্রশ্ন জাগল, “এটা কিভাবে সম্ভব? এত রাতে কে মেইন গেট বন্ধ করবে? কেউ তো নেই?” যাইহোক এসব প্রশ্ন আর রবিকে করলাম না। বললাম, “তুই তাহলে গিয়ে গেটটা খুলে দিয়ে আয়। আমি এখানেই থাকি।” রবি চলে গেল গেট খুলতে। আমি ওই ঘরটাতে একাই বসে রইলাম।

সময় ধীরে-ধীরে বয়ে চলল, কিন্তু রবিও ফিরে এল না। আমি অনেকক্ষণ একা-একা বসে রইলাম। ভয় আমার মনে বাসা বাঁধতে লাগলো। কোথায় চলে গেলে দুজন? আমি আর পারলাম না। এবার ঘর থেকে বেরোতেই হবে আমাকে। ভীত হওয়া সত্ত্বেও ভয়কে জোর করে মনের মধ্যে চাপা দিয়ে আস্তে-আস্তে ঘরের বাইরে গেলাম। বেশ অন্ধকার ,মোবাইলের লাইটটা জ্বালিয়ে এগিয়ে চললাম হোস্টেলের মেন গেইটের উদ্দেশ্যে। অবশেষে মেন গেইটের কাছে পৌঁছলাম। কিন্তু একি, এখানেও তো রবি কিংবা সুরজ কেউ নেই। সব ফাঁকা আর অন্ধকারে। এমন সময় হঠাৎ করে মোবাইলের লাইটটা অফ হয়ে গেল। মোবাইলের দিকে তাকিয়ে দেখলাম চার্জ শেষ। লাইট অফ হয়ে যাওয়াতে জায়গাটা আরো অন্ধকার হয়ে পড়ল।

পাশাপাশি ঘোর নিস্তব্ধতা যেন ছড়িয়ে পড়লো নিমিষের মধ্যেই আমার চারপাশে। আমি মনের ভয়কে এড়িয়ে অন্ধকারের মধ্যেই একটা হাল্কা ধাক্কা দিলাম গেইটটাতে। কি আশ্চর্য! ধাক্কা দিতে-না দিতেই গেটটা খুলে গেল। তাহলে সুরজ কেন রবিকে ফোনে বলল যে, গেইটে কেউ তালা দিয়ে দিয়েছে তাই ও আসতে পারছে না! আমাকে একটা অজানা ভয় যেন আবার চেপে ধরল। আমি ধীরে-ধীরে গেইটের বাইরে গেলাম। কিন্তু চারিদিকে কোন জনমানব দেখতে পাচ্ছি না, যা দেখছি তা শুধুই বিদঘুটে অন্ধকার। আমি পাকা রাস্তা ধরে একটু এগিয়ে গেলাম। কিছুদূর যাওয়ার পর দেখলাম আমাদের হোস্টেলের পাশে যে পুকুরটা আছে, ওই পুকুরের পাড়ে কিছু একটা ছায়ার অবয়ব। প্রথমে ভাবলাম হয়ত আমার মনের ভুল, কিন্তু ভালো করে খেয়াল করে দেখলাম ওই ছায়ার অবয়বটা কিছু একটা করছে।

ভয় পাওয়া সত্ত্বেও অনেকটা কৌতূহলী হয়ে এগিয়ে গেলাম পুকুরের পাড়ের দিকে, ভাবলাম হয়তো রবি আর সুরজ হতে পারে। কিন্তু আবার পরক্ষণেই মনে হল, এই সময় হোস্টেলে না ঢুকে পুকুর পাড়ে কি করছে ওরা? এসব ভাবতে-ভাবতে আমি যে অনেকটাই কাছে চলে এসেছি তা খেয়াল করিনি। জোরে আওয়াজ করলাম, “কে ওখানে? কে ওখানে? রবি নাকি রে? নাকি সুরজ?” আমার ডাকে সেই অবয়ব আমার চোখের দিকে তাকাতেই আমার সারা শরীর অবশ হয়ে গেল, বুকের রক্ত হিম হয়ে গেল, আমার মুখ দিয়ে কোন শব্দ বের করতে পারছিলাম না। মনে হচ্ছিল কেউ যেন আমার গলাটা খুব জোরে টিপে ধরে আছে। এ আমি কি দেখছি? এটা কি সত্যি বাস্তব নাকি ভয়ের কারণে আমার মনের সৃষ্ট কোন নিছক কল্পনা! আমার চোখের সামনে এক কুৎসিত জঘন্যতম আকৃতির অবয়ব, যার চোখ যেন রক্ত আর আগুনের মিশ্রণ দিয়ে প্রস্তুত। যার হাত মুখ শুধু রক্তে পরিপূর্ণ।

আমার চোখ নিজের দিকে গেল। কিন্তু একি? এ কি অবস্থা রবির? দেহটা দেখে মনে হচ্ছে কেউ যেন ওর হাত পা গুলো চিবিয়ে খেয়েছে, শুধু হাড় গুলো ছেড়ে দিয়েছে। এরকম মৃতদেহ আজ পর্যন্ত দেখিনি। রবির দেহ থেকে চোখ উপরের দিকে তুলতেই আমি লক্ষ্য করলাম, সেই অবয়বটি আর কেউ নয় আমার প্রিয় বন্ধু সুরজ। আমি চমকে গেলাম। সুরজের এই অবস্থা কি ভাবে হল? কে ই বা করল? সে আজ কিভাবে নরখাদকে পরিণত হল? এইসব ভাবতে-ভাবতেই হঠাৎ খেয়াল করলাম যে, সুরজ হিংস্র নরখাদক রূপে আমার দিকে খুব দ্রুত এগিয়ে আসছে।

গল্পের বিষয়:
গল্প
DMCA.com Protection Status
loading...

Share This Post

সর্বাধিক পঠিত