অনেক আগের কথা। চণ্ডীপুর নামে এক ছোট গ্রামে ভোলা নামে এক ছেলে বাস করত। ভোলার জন্মানোর কিছুদিন পরই তার মা মারা গিয়েছিল। সেই কারণে সদ্য-জন্মানো বাচ্চার লালন-পালনের জন্য ভোলার বাবা দ্বিতীয় বিয়ে করেছিল। কিন্তু সৎ-মা ভোলাকে একদমই ভালবাসত না। কোনও না-কোনও ছুতো খুঁজে ভোলাকে তার সৎ-মা প্রায় রোজেই বকত। কিন্তু তবুও সৎ-মায়ের মন পাওয়ার জন্য ভোলা নানা কিছু করত। ভোলা তার সৎ-মায়ের ভালবাসা না পেয়ে অবহেলায় বড়ো হতে লাগল।
ভোলা যতই বড়ো হয় ততই যেন তার প্রতি তার সৎ-মায়র রাগও বেড়ে যায়। একদিন কোনও একটি সামান্য কারণে ভোলাকে তার সৎ-মা খুব বকল, চেলাকাঠ দিয়ে মেরে পিঠ লাল করে দিল। ছেলের এই দুঃখ দেখে ভোলাকে তার বাবা কাছে ডেকে বললেন, “বাবা ভোলা..” বলেই বাবার চোখ থেকে জল পড়তে লাগল। কিছুক্ষণ পর ভোলা তার বাবাকে বলল, “বাবা,আমি বরং এ বাড়ি ছেড়ে চলে যাই। তাহলে সব সমস্যার সমাধান হবে আর মাও খুশি থাকবে।” ভোলার কথা শুনে তার বাবা বললেন, “কিন্তু তুই বাড়ি থেকে বেরিয়ে কোথায় যাবি? কোথায় থাকবি? আর কী বা খাবি?” ভোলা বলল, “ওসব নিয়ে তোমায় চিন্তা করতে হবে না। যার কেউ নেই, তার তো ভগবান আছেন!” ছেলের মুখে এত বড় কথা শুনে বাবার গর্ববোধ হল। কিন্তু ছেলের কথাতে বাবা সাই দেবেই বা কী করে? সব দিক বিবেচনা করে ভোলার বাবা বললেন, “তবে তুই আমাকে ভুল বুঝিস না।”
বাবার কথা শেষ হওয়ার মুহূর্তেই ভোলা কাঁদতে-কাঁদতে বাড়ি থেকে দৌড়ে চলে গেল, ছেলের ও বাপেরও চোখ দিয়ে বিবর্ণ অশ্রুধারা বইতে লাগল। আস্তে-আস্তে দুপুর গড়িয়ে, বৈকাল গড়িয়ে সন্ধ্যে এলো। ভোলা ততক্ষণে চণ্ডীপুর ছাড়িয়ে অন্য গ্রামে প্রবেশ করেছে। সারাদিন সূর্যের প্রখর তাপ ও প্রচণ্ড গরম ভোলার তৃষ্ণা ও ক্ষুধার জ্বালা আরও বাড়িয়ে তুলেছিল, তাই সে কোনও একটি কুটিরের সামনে এসে ডাক দিল, “কেউ আছ কী? কেউ আছ?” বেশ কয়েকবার ডাকাডাকি করার পর কুটিরের দরজা আস্তে-আস্তে খুলে গেল। দরজার ওপারে ছিল এক বৃদ্ধা। কুটিরের ভেতর একটা প্রদীপ টিপ-টিপ করে জ্বলছিল। বৃদ্ধা জিজ্ঞাসা করল, “কে লা বাবা তুমি? কোথা থেকে এসেছ? এখানে কেন?” ভোলা উত্তর দিল, “আমি ভোলা, বুড়ি মা। আমার বাড়ি চণ্ডীপুরে, আমাকে আমার সৎ-মা বাড়ি থেকে তাড়িয়ে দিয়েছে। আজকের রাতটা আমাকে তুমি এখানে থাকতে দেবে?”
এরূপ দুঃখের কথা শুনে বৃদ্ধার খুব কষ্ট হল। সে ভোলাকে বলল, “তা বাবা তুমি একদিন কেন, তোমার যত দিন ইচ্ছা ততদিন থাকবে।” তবে বৃদ্ধার একটি শর্ত ছিল। সেটা হল, ভোলাকে অর্থ উপার্জন করে বৃদ্ধার আর তার নিজের পেট চালাতে হবে। বৃদ্ধার শর্তে ভোলা রাজিও হল। কারণ মাথার ওপর একটা জায়গা পাওয়া গেছে। না হলে হয়ত পথে-ঘাটে ভিক্ষা করে পেট চালাতে হত। কিছুক্ষণ পর বৃদ্ধাকে ভোলা জিজ্ঞাসা করল, “বুড়িমা ভাত আছে?” বৃদ্ধা বলল, “তা আছে বৈকি, দুপুরের কিছুটা ভাত আর শাক-সেদ্ধ এখনো আছে। হাত-মুখ ধুয়ে আয়; বাইরে এক কলশি জল আছে। আমি ততক্ষণ ভাত বাড়ি।”
ভোলা হাত-মুখ ধুয়ে এসে খেতে বসল। খাওয়া-দাওয়া শেষ হওয়ার পর সে একটা জীর্ণ পাটি পেতে শুয়ে পড়ল। শোওয়া মাত্রই ভোলার চোখে ঘুম এসে গেল। পরের দিন সকালে, ভোলা ঘুম থেকে উঠে চোখে মুখে জল দিয়ে বেরিয়ে পড়ল, কাজের খোঁজে। সারাদিন বহু দোকান, বহু জায়গা ঘুরার পরেও ভোলা কোনও কাজের সন্ধান পেল না। অবশেষে নিরাশ হয়ে ভোলা সন্ধ্যায় কুটিরে ফিরতে লাগল।বৃদ্ধার কুটিরের সামনে ছিল নন্দীগ্রামের ঘন জঙ্গল, সেখানে প্রচুর গাছপালা, ফুল-ফল, পশু-পাখি। সেখান দিয়ে আসার সময় সে দেখতে পেল, ক’জন কুমারী মেয়ে মাথায় কাঠ নিয়ে কথা বলতে বলতে আসছে। সেই দেখে ভোলা ঠিক করল, সেও তাদের মত কাঠ কেটে, কাঠ বিক্রি করে অর্থ উপার্জন করবে।
তক্ষুনি সে জঙ্গলে ঢুকে কিছু শুকনো কাঠ এনে তা বিক্রি করে সেই পয়সা দিয়ে চাল-ডাল কিনল, তারপর কুটিরের দিকে চলল। কুটিরে পোঁছাতেই বৃদ্ধা উঠে দাঁড়িয়ে ভোলার হাত থেকে চাল- ডাল নিয়ে রাঁধতে চলে গেল, ভোলাও হাত-মুখ ধুয়ে কুটিরে এসে বসল। রান্না শেষ হওয়ার পর দুজনে একসাথে খেতে বসল। পরের দিন সক্কাল -সক্কাল ঘুম থেকে উঠে চোখ-মুখ ধুয়ে ভোলা জঙ্গল থেকে কাঠ কুড়িয়ে, তা বিক্রি করে সেই পয়সা দিয়ে একটা কুঠার কিনল। এরপর থেকে ওই কুঠার দিয়ে কাঠ কেটে সেই কাঠ বিক্রি করে সে পয়সা উপার্জন করতে লাগল। একদিন ভোলা কাঠ কাটতে জঙ্গলে গেছে। সেখানে হরেক রকম গাছ। কিছু সব গাছগুলোর থেকে একটি গাছ বিশেষ অন্য রকম, ভোলা সেই গাছটিকেই কাটতে লাগল। কিছুক্ষণ গাছটা কাটার পর ঘটল এক আশ্চর্য ঘটনা। গাছের নিচ থেকে এক অপূর্ব সুন্দরী পরী বেরিয়ে এলো। ভোলা একেবারে মন্ত্র মুগ্ধ হয়ে গেল। পরী সহজেই অন্যের হৃদয়ের কথা বুঝতে পাড়ত। সে বলল, “ভোলা আমাকে দেখে মন্ত্র মুগ্ধ হওয়ার কিছু নেই।” ভোলা অবাক হয়ে বলল, “আমার নাম জানলে কী করে?”
পরী বলল, “এ দুনিয়ায় পরিদের অজানা কিছুই নেই। আজ থেকে বহু বছর আগে এক যাদুকর আমার সব কিছু কেড়ে নিয়ে এই গাছে আমাকে বন্দি করে রেখেছিল। একমাত্র কোনও নিষ্পাপ-মাতৃহারা যুবক যদি এই গাছ কাটে তবেই আমি মুক্তি পেতাম। আর তুমিই হলে সেই যুবক যে আমায় মুক্তি দিলে। তোমাকে অসংখ্য ধন্যবাদ,” এই বলে পরী জাদু বলে একটি পালক সৃষ্টি করে তা ভোলার হাতে দিয়ে বলল, “নাও ভোলা, পালকটি যত্ন করে রেখে দেও, এটির সাহায্যে যেকোনো বিপদকে তুমি সরাতে পারবে কিন্তু পালকটি শুধু একবারই ব্যবহার করতে পারবে। পালকটি ব্যবহারের উপযুক্ত সময়ে নিজে থেকেই এটি সোনার পালকে পরিণত হবে। এই কথাটি কাউকে বলবে না যেন,” এই বলে পরী সেখান থেকে অদৃশ্য হয়ে গেল।
ঐ দিন ভোলা অন্য গাছ কেটে কাঠ বিক্রি করে যা পয়সা পেল তা দিয়ে বিভিন্ন সামগ্রী কিনে ও নিয়ে কুটিরে ফিরল। ক্রমে দেখতে-দেখতে বেশ ক’টা বছর ভালোভাবেই কেটে গেল। একদিন বৃদ্ধা গুরুতর অসুস্থ হয়ে পড়ল। ভোলা দুর-দুর থেকে বহু বৈদ্য – কবিরাজ আনল, কিন্তু বৃদ্ধা আর সুস্থ হল না। একদিন বৃদ্ধা হঠাৎ মারা গেল। হয়ত বৃদ্ধাকে ভোলা বাঁচাতে পারত যদি পরীর দেওয়া পালক সোনায় পরিণত হত। যাইহোক বৃদ্ধাকে শেষ পর্যন্ত পৃথিবীর মায়া ত্যাগ করে চলে যেতেই হল। বৃদ্ধার মৃত্যুতে ভোলা খুবই কষ্ট পেল। সে ভাবল, যার জন্য এখানে এতদিন ছিলাম, সে যখন আর নেই তখন এই স্মৃতি জড়ানো ঘরে আমি আর থাকবো না।
ভোলা নিজের কটা পোশাক আর সেই পালকটা নিয়ে বাড়ি থেকে বারিয়ে গেল। বহু দেশান্তর পেরিয়ে ভোলা পৌঁছল বিশাল নগরীতে। সেখানে পৌঁছানোর পরই পরীর দেওয়া পালকটি সোনায় পরিণত হল। ভোলা বুঝতে পারল, পরীর দেওয়া পালকটির ব্যবহার করার সঠিক সময় হয়ত এসেছে। একদিন ভোলা শুনল যে, রাজামশাই ঘোষণা করেছেন, রাজকন্যা কঠিন ব্যাধি যে সারাতে পারবে, তার সাথে রাজকন্যার বিবাহ হবে আর সে অর্ধেক রাজ্যও পাবে। এই সংবাদ শোনার পর ভোলা রাজপ্রাসাদের দিকে রওনা হল। রাজপ্রাসাদে পৌঁছানোর পর তাকে প্রহরীরা ভেতরে ঢোকার অনুমতি দিল না। অনেক কাকুতি-মিনতি করে ভোলা ভেতরে ঢকতে পারল। রাজামশাই ভোলাকে জিজ্ঞাসা করলেন, “তুমি কী রাজকন্যার কঠিন ব্যাধি সারাতে পারবে?” নির্ভয়ে ভোলা বলল, “নিশ্চয়ই মহারাজ। তবে আমার চিকিৎসা করার সময় সামনে কেউ যেন না থাকে।”
ভোলের কথামত এরপর রাজামশাই রাজকন্যার ঘর থেকে বেরিয়ে গেলেন ও ঘরের সমস্ত দাস-দাসী, বৈদ্য-কবিরাজদেরও ঘর খালি করতে আদেশ দিলেন। ঘর খালি হয়ে যাবের পর ভোলা ঘরের দরজা বন্ধ করে, পুঁটলি থেকে সোনার পালকটি বের করে রাজকন্যার মাথায় দিল। চোখের পলকে রাজকন্যা দিব্যি সুস্থ হয়ে গেল। দরজা খোলের পর রাজা ছুটে গিয়ে রাজকন্যাকে বুকে জড়িয়ে ধরলেন। সবার মুখে হাসি ফুটে উঠল। রাজামশাই মহানন্দে ভোলাকে বললেন, “ভোলা, আমার কন্যাকে তুমি বিবাহ করতে প্রস্তুত তো?” ভোলা উত্তর দিল, “প্রস্তুত মহারাজ।” এরপর রাজপ্রাসাদে বিয়ের সানাই বেজে উঠল।