রিমুর সাথে রিলেশনের আজ ২ বছর পূর্ণ হল। অনেক প্লান রয়েছে আমাদের আজকের দিনকে ঘিরে। খুব সকালে ঘুম থেকে উঠতে হবে। আমি আবার একটু ঘুমাই বেশি। বলা যায়, রাত ১০টা বাজতে না বাজতেই ঘুম নামক বস্তুটা আমাকে জাপটে ধরে। আর ঘুম থেকে উঠতে সকাল ৯-১০ টা বাজে। তবে আজ প্লান করেছি, যত কিছুই হোক রাত ১২টার সময় রিমুকে ফোন দিয়ে চমকে দেবো।
রাতে খাওয়া-দাওয়া শেষ করে তাই বিছানায় না গিয়ে শহরের সড়কে হাটতে লাগলাম। প্রচণ্ড ঘুমে চোখ বন্ধ হয়ে আসছিলো, তাই পাশের একটা চায়ের দোকান থেকে অনবরত চা খাচ্ছিলাম। অনেক কষ্ট ও দীর্ঘ অপেক্ষার পর ঘড়ির কাটায় রাত ১২টা বাজল। আমি রিমুকে ফোন করলাম। কিন্তু রিমুর ফোন ওয়েটিং। ফোনে বারবার চেষ্টা করছিলাম রিমুকে। কিন্তু বারবার ফোন ওয়েটিং পাচ্ছি। তীব্র মানসিক বিষণ্ণতা; আর খুব খারাপ লাগছে। কিন্তু রিমুকে এতটাই ভালোবাসি যে, কোনকিছুতেই মনকে বিশ্বাস করাতে পারছি না যে, হয়তো ও অন্য কারো সাথে কথা বলছে। এভাবে কখন যে রাত ৩টা বেজে গেল বুঝতেই পারিনি। সকাল ৯টায় রিমুর সাথে দেখা করার কথা রয়েছে, তাই এভাবে রাত না জেগে ঘুমানোর চেষ্টা করলাম। যে ঘুম আমার একমাত্র সঙ্গী, সেই ঘুম আজ যেন কোথাও হারিয়ে গেল। অনেক চেষ্টা করেও ঘুমাতে পারলাম না। সকালে হতেই রিমুর ফোন এল।
– হ্যালো, ফাহিম আমার দাদু খুব অসুস্থ, একটু পরেই গ্রামে যেতে হবে। আজ তোমার সাথে দেখা করতে পারবো না। কিছু মনে করো না জানু বলেই ফোনটি কেটে দিলো। আমার কিছুই বলার সুযোগ হল না। আজকের এই বিশেষ দিনকে ঘিরে দুজনের দীর্ঘদিনের প্লান যেন সব ভেস্তে গেল এক নিমিষে। মুরব্বি মানুষ অসুস্থ, তাই ব্যাপারটা স্বাভাবিক ভাবেই নিলাম। কিন্তু গত রাতের ফোন ওয়েটিং এর ব্যাপারটা এখনো মাথায় ঘুরছে।
আমি একটা প্রাইভেট কোম্পানি জব করি। রিমুর সাথে দেখা করার জন্য অফিস থেকে ছুটি নিয়েছি। দেখা না হওয়ায় ভাবলাম, সারাদিন বাড়িতে বসে না থেকে শহরের বাইরে কোথাও যাই। শহর থেকে ১৫ কিলোমিটার দূরে আমার বন্ধু তুহিনের বাড়ি। অনেক দিন হল ওর সাথে দেখা হয়নি। তাই সিদ্ধান্ত নিলাম ওর সাথে দেখা করব। ফোন করলাম।
– হ্যালো তুহিন, কেমন আছিস? কোথায় আছিস দোস্ত?
– আমি বাসায় আছি।
– আচ্ছা। আজ আমার ছুটি, তোর সাথে দেখা করবো?
– ঠিক আছে, তুই চলে আয় আমার বাড়িতে। ভালোই হল, অনেকদিন পর দুজনের আবার দেখা হবে; আড্ডা দেব।
– ওকে আমি আসছি।
স্কুল লাইফ থেকে তুহিন আমার একমাত্র বন্ধ। বেস্ট ফ্রেন্ড বলা যায়। একসাথে থাকা, ঘুরাঘুরি আর খাওয়া-দাওয়া; মনে হয় আমরা আপন ভাই। পড়াশোনা শেষ করে আমি এখন প্রাইভেট কোম্পানিতে জব করছি আর ও দীর্ঘদিন বেকার থাকার পর সম্প্রতি সরকারি চাকরি পেয়েছে। ৪০ মিনিট পর তুহিনের বাসায় পৌঁছলাম। তারপর দু’জনে মিলে গেলাম একটা কফি শপে। তুহিন কফির অর্ডার করলো। এই ফাকে আমরা বিভিন্ন বিষয় নিয়ে কথা বলছি। কফির কাপে চুমুক দিতেই যা দেখলাম তার জন্য মোটেও প্রস্তুত ছিলাম না। একটু দুরেই একটা টেবিলে রিমু, আর ওর একটা বান্ধবী সাথে দুজন ছেলে আড্ডা দিচ্ছে।
যাকে এত ভালোবাসি, অন্ধের মতো বিশ্বাস করি, সে কিনা আমার সাথে মিথ্যা বলেছে। ভাবতেই সবকিছু কেমন অন্যরকম লাগল। নিজেকে খুব অপরাধী আর ছোট মনে হল। মনে হল, ওখানেই গিয়ে রিমুকে দু-চারটা থাপ্পড় দিই। তবে নিজেকে খুব কন্ট্রোল করলাম আর ওখান থেকে বেরিয়ে এলাম।
সারাদিন যার এসএমএস আর ফোন কলে বিরক্তি ধরে যেত, সেই রিমুর আজ কোন এসএমএস বা ফোন কল নেই। আমিও ফোন করিনি ওকে। বিষণ্ণতা আর ক্রোধ আমাকে কুঁড়ে-কুঁড়ে খাচ্ছে। কোনভাবেই নিজেকে বিশ্বাস করাতে পারছি না এই ঘটনা। রাত ৯টার দিকে রিমুর ফোন থেকে কল এলো
-তুমি সারাদিন আমার খোজ নাও নি কেন? জানো তোমাকে কতটা মিস করেছি?
ওর কথা শুনে রাগে মনে হচ্ছে মোবাইলটাকেই ছুড়ে ফেলি। তবে বইয়ে পড়েছি, ‘রেগে গেলেন তো হেরে গেলেন।’ তাই নিজেকে কন্ট্রোল করলাম।
– অনেকদিনের কাজ জমে ছিল তাই সারাদিন কাজ করেছি। এখন খুব টায়ার্ড লাগছে, ঘুমাতে হবে। আমরা কাল কথা বলি?
-আচ্ছা ঠিক আছে, গুড নাইট।
একটা মানুষ এতটা নিখুঁত অভিনয় কিভাবে করতে পারে? মিথ্যা সম্পর্ক কিভাবে কন্টিনিউ করতে পারে? সব মেয়েরাই কি এমন? আমি কি এতদিন এমন একটা নিচু মানসিকতার মানুষের সাথে কথা বলেছি, সম্পর্কে জড়িয়েছি? এসব কিছু ভাবতে-ভাবতে রাত দেড়টা বেজে গেল। সিদ্ধান্ত নিলাম, কাল রিমুর সাথে ফাইনালি কথা বলে এই মিথ্যা সম্পর্কটা শেষ করে দেব। হ্যাঁ, হয়তো কষ্ট হবে, তবে এ অবিশ্বাসের বেড়াজাল থেকে তো মুক্তি পাবো!
সকালে ঘুম থেকে উঠতেই ফোনের স্ক্রিনে রিমুর একটা এসএমএস ভেসে উঠলো।
-ফাহিম, তুমি যখন আমার এসএমএসটা পড়ছ তখন হয়তো আমি তোমার থেকে অনেক দূরে থাকবো। তুমি চাইলেও আমাকে ফেরাতে পারবে না। ফাহিম, আমি তোমাকে রিয়েলি অনেক ভালোবাসি। খুব ইচ্ছে ছিল আমরা একসাথে থাকবো, একটা ছোট ফ্যামিলি হবে আমাদের। সেখানে থাকবো তুমি আর আমি, আর আমদের একটা ছোট প্রিন্সেস। কিন্তু দেখ, ভাগ্য আজ আমাকে তোমার থেকে অনেক দূরে নিয়ে যাচ্ছে। আমি জানি, তুমিও আমাকে অনেক ভালোবাসো আর বিশ্বাস করো। আমি চলে যাওয়ার পর তুমি একদম কষ্ট পাবে না। সব সময় হাসি খুশিতে থাকবে, তাহলে আমিও ভালো থাকবো। বিদায়। এসএমএসটা পড়ার পর কিছুই বুঝতে পারছি না। এসব কি হচ্ছে? আমার কি করা উচিত? সবকিছু কেমন জানি গুলিয়ে ফেলছি। সঙ্গে-সঙ্গে রিমুকে কল করলাম, কিন্তু ফোন রিসিভ হয় না। অনেকবার চেষ্টা করে ব্যর্থ হয়ে রিমুর মাকে ফোন করলাম।
– আন্টি আমি ফাহিম বলছি, রিমুর ফ্রেন্ড। রিমু কেমন আছে? ও কোথায়?
ওদিক থেকে রিমুর মা কান্না জড়িত কণ্ঠে উত্তর দিলো- রিমু হাসপাতালে, ওর অবস্থা খুবই সিরিয়াস।
আমি বাক রুদ্ধ, কি বলবো বুঝতে পারছি না। দ্রুত হাসপাতালের দিকে ছুটলাম। হাসপাতালের আইসিইউতে প্রবেশ করতেই সাদা কাপড়ে ঢাকা রিমুর নিথর দেহ দেখতে পেলাম। এভাবে রিমুকে দেখতে হবে কোনদিন কল্পনাও করিনি, সেন্স-লেস হয়ে গেলাম। জ্ঞান ফিরলে জানতে পারলাম, রিমুর দীর্ঘদিনের কিডনির রোগ। ওর এক রিলেটিভ একটা কিডনি দিতে চেয়েছিল, রিমু গতকাল তার সাথেই দেখা করতে গিয়েছিল। আজ অপারেশন করার কথা, কিন্তু প্রকৃতি তার আগেই আমার রিমুকে নিয়ে পালিয়ে যায়। রিমুও চুপ-চাপ চলে গেল, আমাকে কিছু বলার, কিছু করার সুযোগ না দিয়ে।