ঢেউয়ের কথা

ঢেউয়ের কথা
“আমি একজন নাবিক। সমুদ্রের ঢেউয়ের কথাগুলোও শুনতে পাই। আর এই শব্দটা ভুল শুনবো কেনো?” আমার মুখে কথাটা শুনেই হো হো করে হেসে উঠলো ফিও জোজো রোদ্রোজ্জ্যল একটা দিন। ফোক্যাসলে মুরিং ওয়্যার গ্রিজিং করছিলাম। ফোক্যাসল হলো জাহাজের একবারে সামনের অংশটা।
আমি আর ‘ওএস’। ওর নাম ফিও। বার্মিজ। জাহাজ যখন সমুদ্রের বুক চিরে ভেসে চলে তখন অনবরত বাতাসের সাঁ সাঁ শব্দ আর জাহাজের সামনে ঢেউ ভাঙার দুরুম-দারুম আওয়াজ হতেই থাকে। এর মাঝেই হঠাৎ ছলাৎ ছলাৎ একটা আওয়াজ পেলাম! আমি ফিওকে বললাম, “ডলফিন দেখবে? ডেকের উপর দিয়ে উঁকি দেও। ” ফিও প্রথম সন্দেহের চোখে তাকালো আমার দিকে। তারপর উঁকি দিলো নিচে। সত্যি ৪ টা ডলফিন সাঁতার কাটছে জাহাজের সাথে সাথে। একটু পর ওর বয়লার স্যুট ধরে টান দিলাম। “অনেক দেখা হয়েছে ডলফিন, এবার কাজে মনোযোগ দাও। চীফ অফিসার দেখলে এখানেই বেঁধে রাখবে।” ফিও আর আমি আবারো কাজ চালিয়ে গেলাম।
একটু পর ফিও বললো, “হাসান?(তাওহীদ উচ্চারণ করা ওর জন্য কষ্টকর, তাই আমাকে হাসান বলে ডাকতো) তুমি কিভাবে বুঝলে ওখানে ডলফিন আছে?” আমি একটু ভাবসাব নিয়েই বললাম, “আমি একজন নাবিক। সমুদ্রের ঢেউয়ের কথাগুলোও শুনতে পাই।আর এই শব্দটা ভুল শুনবো কেনো?” আমার মুখ থেকে কথাটা শুনেই হোহো করে হেসে উঠলো ফিও জোজো। এর কিছুদিন পর। জাহাজ সিঙ্গাপুর থেকে আন্দামান সাগরের মধ্য দিয়ে চলছে। গন্তব্য ভারত। রাঁত ১২ টা তখন। ডিউটি শেষ করেছি মাত্র। কেবিনে যাব। এমন সময় দেখি বাংলাদেশী সিনিয়র ইঞ্জিন ক্যাডেট ব্রীজে এসে হাজির। বললেন “চলো হেটে আসি জাহাজের সামনে থেকে।”
রাঁতের ঘুটঘুটে অন্ধকারে যখন চাঁদের আলোয় একটা আবছায়া ভাব নেমে আসে সমুদ্রে, তখন আমারো হাটতে ভালো লাগে খোলা ডেকে। আমিও স্বভাবতই রাজি হলাম। হাটতে হাটতে একেবারে জাহাজের সামনে গিয়ে দাঁড়ালাম। গল্প করলাম কিছুক্ষন স্যারের সাথে। স্যার অনেক খোলা মনের মানুষ। সিনিয়র হলেও মনমত গল্প করা যায়। কথায় কথায় আমরা দুজনই জোড়ে শোরে হেসে উঠলাম এমন সময় একটা শব্দ হলো। শব্দটা এরকম যে কেউ অবোধ্য কিন্ত মায়াবী কোনো একটা সুরে শিস বাজিয়ে আমার পাশ দিয়ে চলে গেলো। বেশ বড়ই ছিল শিস টা। প্রায় ৭-৮ সেকেন্ড। আমি থমকে গেলাম হঠাৎ। চারপাশে তাকালাম। যদিও অন্ধকার। তবু আবছায়া আলোতে যথেষ্ট দেখার কথা কেউ যদি ডেকে থাকতো। আমরা ছাড়া এত রাতে কেউ ডেকে আসেনি এটা আমি নিশ্চিত। কাউকে খু্ঁজেও পেলাম না। স্যারকে বললাম স্যার কিছু শুনেছেন?
: কি তাওহীদ?
:একটা শিস বা সিটি দেয়ার শব্দ?
: না!
: এইমাত্রই হলো শব্দটা! ৭-৮ সেকেন্ড ছিল!
স্যার আর কথা বাড়ালেন না। আমার কনুই টেনে হাটার জন্য তাগদা দিলেন। বললেন “ভুল শুনছো হয়ত। চলো ভেতরে যাই। ঘুম আসছে।” আমি মনে মনে বললাম “আমি একজন নাবিক। সমুদ্রের ঢেউয়ের কথাগুলোও শুনতে পাই। আর এই শব্দটা ভুল শুনবো কেনো!” দুইমাস হয়ে গেলো পারস্য উপসাগরে এসেছি। হোমপোর্ট সিংগাপুরে ফিরে যাওয়ার নাম নেই! কাতার-কুয়েত-বাহরাইন-দুবাই এই করেই দুইটা মাস গেলো! এরইমধ্যে ভয়েজ অর্ডার আসলো। কাতার থেকে গ্যাসোলিন নিয়ে পাকিস্তান যেতে হবে। পাকিস্তান এসে দেখা গেলো জাহাজ পোর্টে ঢুকতে কিছুদিন দেরি হবে। তাই তীর থেকে ৫০ মাইল দূরে নোঙর করা ছিল জাহাজ।
এখানটায় মাঝে মাঝে জলদস্যু আক্রমণ ঘটে । তাই রাঁতে প্যাট্রল ডিউটি দিতে হয়। আমার ডিউটি রাঁত ৮-১২ টা থেকে পরিবর্তন হয়ে রাঁত ১২-৪ টা হলো। রাঁতেরবেলা জাহাজের ফ্লাডলাইটের আলোতে জাহাজের চারপাশে প্রচুর মাছ এসে জড়ো হয়। নানা জাতের, নানা রঙের। প্রতিদিন একই দৃশ্য। একই দৃশ্য বলতে একটা সাদা রঙের সাপ। চামড়াটা জ্বলজ্বল করে। প্রতিদিন জাহাজের পেছনের দিকে ভেসে থাকে। টানা ৪-৫ দিন একই জায়গায় রাঁতের ডিউটির সময় দেখি ওটা। দিনে কখনোই পাই না। অনেক তাকিয়ে থাকি। হয়ত মাছ খেতে এসেছে। কিন্ত ওটা শুধুই ভেসে থাকে। একসময় তাকানো ও বাদ দিয়ে দিলাম। প্রতিদিন একই জিনিস! আগামীকাল জাহাজ পোর্টে ঢুকবে। আজই শেষদিন নোঙরের।
জাহাজ,জাহাজের ফ্লাডলাইট। তারপর যেনো অসীম অন্ধকার! মনে হয় ওই অন্ধকারটা ভেদ করে কিছু একটা হঠাৎ করেই আমার সামনে উপস্থিত হবে। তা কি আমি জানিনা! হয়ত সুন্দর হয়ত কুৎসিত বা রহস্যময়! আমি। আর পানিতে মাছের লাফ-ঝাপের আওয়াজ আর ওই বোকা সাপটা! এই বিরক্তিকর রুটিন টা শেষ হতে যাচ্ছে! এটা ভেবেই শান্তি লাগলো। আজকে যদিও একটা মাছও নেই! হঠাৎ সব মাছগুলো বেমালুম গায়েব হয়ে গেলো কি করে! আজকে অমাবস্যা মনে হলো। আকাশে চাঁদ নেই। মনে মনে ভাবলাম অমাবস্যা -পূর্ণিমার সাথে মাছের কোনো সম্পর্ক আছে নাকি আবার! থাকতেও পারে! আমরা আর কতটা জ্ঞ্যান রাখি! এত হাজার হাজার প্রাণী! কতটাই বা জানি! কিন্ত ওই সাদা সাপটা ঠিকই বোকার মত ভেসে আছে পানিতে। দেখেই গায়ে ঘিন ঘিন করে উঠলো। রাঁত ২ টার মত বাজে। আমি প্যাট্রল রাউন্ড দিতে দিতে ফোক্যাসলে গেলাম। সবকিছুই ঠিকঠাক আছে। ওয়াকিটকি তে সেকেন্ড অফিসারকে রিপোর্ট করার জন্য ডাকলাম।
: ব্রীজ,দিস ইস ডেক।
:ডেক,ব্রীজ।
: স্যার, ডেক অ্যান্ড সারোন্ডিং ইস ক্লিয়ার।
: ওকে হাসান, ডেক অ্যান্ড সারোন্ডিং ইস ক্লিয়ার। কপি।
ঘুরে পেছনে হাটা শুরু করবো এমন সময় অবোধ্য কিন্তু মায়াবী কোনো একটা সুরে কেউ শিস বাজিয়ে চলে গেলো আমার কানের পাশ দিয়ে। শিসটা বেশ বড়ই ছিল। ৭-৮ সেকেন্ড। শিরদাঁড়ার মধ্যে দিয়ে একটা শীতল অনুভূতি হলো। ঘাড়ের চুলগুলো দাঁড়িয়ে গেলো,সাথে হাতের লোমগুলো ও। যেখান দিয়ে শব্দটা চলে গেলো আমিও সেখানে চোখ লাগিয়ে রাখলাম। কিন্ত! কেউ নেই! আমার ভেতরের আমিকে জোর তাগিদে বললাম, “হয়ত ভুল শুনেছি। আমার ভেতরের আমি আমাকে জবাব দিলো, “তুমি একজন নাবিক। সমুদ্রের ঢেউয়ের কথাগুলোও শুনতে পাও। আর এই শব্দটা ভুল শুনবে কেনো!”
গল্পের বিষয়:
গল্প
DMCA.com Protection Status
loading...

Share This Post

আরও গল্প

সর্বাধিক পঠিত