-নীলা এই নীলা তুমি এখনো রেডি হও নি?
গ্রেডারের উপর আদা টা গ্রেড করতে করতে হাতের কনুই দিয়ে চোখটা সামান্য চেপে ধরে নাকের পানিটা মুছতে মুছতে আধভোজা চোখে ন্যাকি গলায় বলল-
-কেন?
শ্বশুড় কে দেখে রান্নাঘর থেকে বের হয়ে গেল দুই ছেলের বউ। যাওয়ার সময় একজন আরেক জন কে একটু মজার ছলে ধাক্কা মারল। পালাশের চোখ এড়ায় নি। এড়ানোর কথাও না চল্লিশ বছর উচ্চ আদালতের বিচারক হয়ে বসে থাকতে থাকতে সব চোখে পড়ে কিন্তু দেখে না সে। খুব একটা রান্না ঘরে আসা না পলাশের বহু বছর। রান্না ঘর টা এখন অনেক আধুনিক। সব ক্যবিনেট। কিচেন চিমনি, ইলেক্ট্রিক চুলা, ওভেন, ব্লেন্ডার, সবে একে বারে পরিপূর্ণ । আগে প্রতি দিন প্রায় সিলিন্ডার চেক করত। শেষ হওয়ার আগে যাতে আনতে পারে কারণ নীলা বুঝতো না। শুক্রবারে কোন দিন খিচুড়ি খাওয়ার বায়না ধরলে পলাশকে দিয়ে আলু পেয়াজ কাটাতো নীলা।
আর মাসের প্রথম দিকে কখনো সখনো খাসির মাংস আনা হলে মোড়া নিয়েই পাশে বসে থাকা হতো, আর একটু ঝাল দাও। লেবু বেশি দিও না৷ একটু ঝোলা একটু ভুনা। রান্না শেষ হওয়ার আগেই চুলা থেকে স্টিলের বাটিতে তিন চার পিস দিতো। খেয়ে খেয়ে বলতো কেমন হলো আর কিছু লাগবে কিনা? নীলার হাতে জাদু ছিলো নাকি পাশে বসায় নীলার ভালোবাসায় সিক্ত হতো বুঝতে পারতাম না এত মজা লাগতো সব। নীলা হাত টা ধুয়ে বলল- কি গো, তোমাকে না বলেছে এইভাবে নীলা নীলা করো না। বউরা হাসে। বড় খোকার নাম ধরে ওর মা ডেকো সবাই তো এমন ডাকে। সিংকে ভেজানো মাছ মাংস দেখে পাশ ফিরে বলল-
– আমি তোমাকে আগে চিনি নাকি ওকে? তোমার থেকে তো ছেলে। তোমাকে তো আর কেউ নেই যে তোমার নামে ডাকবে। সবাই তো মা কাকি মাসি পিসি ঠাম্মি দিদা এইসবেই ডাকে৷ চুল থেকে প্রায় খুলে যাওয়া লাল-সবুজ চেক গামছা টা আবার একটু ঘুরিয়ে লাগিয়ে বলল-
– তা তো সময়ে সাথে মানতে হবে। তো তুমি রান্না ঘরে কি করছো?
– চারটা বাজে তুমি এখন রান্না ঘরে কি করো? আর এখন স্নান করলে কেন? আবার মাছ মাংস কেন? তোমাকে না বললাম আজ আমরা বের হবো।
-ওমা, বাসায় আজ ছোট খোকার অফিসের কলিগ নাকি আসবে৷ তাই আর কি। আর ওরা কেউ তো ফ্রি নেই আজ।
– ওরা আবার কারা? আমি আর তুমি যাচ্ছি শুধু, চলো রেডি হও।
– কি যে বল, বউরা একা সামলাতে পারবে? আর এখন কোথায় বা যাব?
-তুমি একা সব সামলাতে আর তিন বউ মিলে চার জন খাওয়াতে পারবে না? আর না পারলেও সমস্যা নেই, এখন ওরা তো সব অনলাইন অর্ডার করে। আচ্ছা তুমি পারবে না বুঝছি, আমিই বলে দিচ্ছি।
– আরে না, শোন না,
বলার আগেই বেড়িয়ে গেল পলাশ, ড্রয়িংরুমে বড় বউ বাচ্চাকে কি যেন খাওয়াচ্ছে, মেঝ খোকা ল্যাপটপ নিয়ে বসে আছ, ছোট খোকা ওর পাঁচ মাসের বাচ্চা পেটের উপর বসিয়ে সোপায় শুয়ে টিভি দেখছে৷ ওর বউ শপিং এ গিয়েছে৷
– বৌমা তুমি কি রান্নাটা সামলাতে পারবে না?
– কেন পারব না বাবা? আমিই তো করি- বলতে গিয়ে থেমে গেলো,
-ছোট খোকা তোর নাকি গেস্ট আসছে আজ? বড় বৌমা সব পারবে বলল, আর যদি না হয়, তোরা সব অনলাইন অর্ডার করিস, করে দিস। আমি তোর মা কে নিয়ে বের হচ্ছি। মেঝ ছেলে মাথা তুলে বলল- কোথায়?
– সেটা আমাদের ব্যাপার। এমন ভাবে বলল, আর কেউ প্রশ্ন করার সাহস পেলো না। অনেক টা জোর করেই রুমে নিয়ে গেল নীলাকে।
– রেডি হও।
নীলা জানে এখন কিছু বলে লাভ নেই। ও আলমারি খুলে বড় মেয়ের দেওয়া সাদার মধ্যে হালকা কাজের শাড়িটা বের করল। পলাশ আবার হুংকার দিলো,
– আমি এখনো বেঁচে আছি তো।
– কি অলুক্ষে কথা! কোন টা পড়ব তো? পলাশ দেওয়ালে লাগানো ওদের আগের একটা ছবি দেখিয়ে বলল- এইটা,
– ঘিয়ে রং এর লাল বড় পাড়ের শাড়িটা।
-এইটা? কি যে বল? এইটা তো বড় বৌ কে দিয়ে দিয়েছি আগে।
-তাহলে হলুদ টা পড়।
নীলা ভালো করে দেখল ওকে৷ আজ হয়েছে টা কি? অবশ্য এখন প্রায় এমন করে রিয়ার্ট হলো মাত্র ছয় মাস ও হয় নি। প্রায় এমন উটকো জ্বালা। ভালো অবশ্য লাগে। কিন্তু বৌ দের মুখ টিপে হাসা বড় লজ্জা দেয়৷ বড় বৌ এর থেকে শাড়িটা এনে পড়ে নীলা। পলাশ বরাবরের মতো নিচু হয়ে বসে কুচিটা ঠিক করে দেয়। প্রায় অনেক বছর পর দুইজনের একা বের হওয়া। গাড়ি থেকে নেমে অবাক হলো নীলা। পার্কে এসেছে ওরা৷ পলাশের এখনো শক্ত শরীর। কালো পাঞ্জাবি পড়ে চশমায় এখনো নীলার কেমন যেন লাগে ওকে দেখলে। নীলার চোখের অবাক হওয়া দেখে ওর হাত ধরে পার্কে ঢুকে গেল।
– এই বয়সে প্রেম করবে নাকি?
– প্রেম করার বয়সে তো করা হলো না। এখন তা পূরণ করি।
সবাই আড়চোখে তাকাচ্ছে। পলাশ নির্ভক হেঁটে যাচ্ছে। কিছুক্ষন পর নীলার ও ভালো লাগছে৷ কত বছর একা দুজনের বের হওয়া হয় না। মনেও পড়ে না। নিজেকে যেন এখন সে কলেজ থেকে পালিয়ে আসা কিশোরী মনে হচ্ছে। তা মনে হতেই মনে পড়ল এই পার্কে আগেও এসেছে ওরা। তবে এখন অনেক চেঞ্জ। চেনায় যায় না কিছু।
অনেকক্ষন হেঁটে বসল দু’জন।
– আইসক্রিম খাবে?
– দূর, ঠান্ডা লাগবে। মানুষে কি বলবে? বুড়ো বয়সে আইসক্রিম।
-আইসক্রিমের কোথায় লেখা আছে যে বুড়ো বয়সে খাওয়া যায় না? পলাশ আইসক্রিম নিলো। নীলা খাচ্ছে৷ সে কিশোরী নীলার মতো। আর পলাশ সে ডুবন্ত প্রেমিকের মতো তাকিয়ে আছে।
– তুমি আইসক্রিম খুব পছন্দ করতে। আর খেতে না কেন?
– বড় খোকার ঠান্ডার ধাঁচ ছিলো। আমি খেলে ও চাইতো। তাই আর খাওয়া হতো না৷ যখন ঠিক হলো আর কেউ বলল না খেতে।
-সবার জন্য করতে করতে আমরা নিজেদের টা করতে ভুলে যায়। এরপর রেস্টুরেন্টে গেলো ওরা৷ হঠাৎ কেক আসায় অবাক হয় নীলা। আজ ওর জম্মদিন। কারো মনে থাকে না অবশ্য। নিজের ও মনে না থাক এই চেষ্টা করে নীলা। কিন্তু মনে থাকে নীলার।
– ছেলে- মেয়ে, নাতিরা সবাই ঘরে আমরা একা একা কেক কাটবো?
– বাচ্চারা যখন একটু বড় হলো ওরা ওদের জম্মদিন বন্ধুদের সাথে পার্টি করে কাটাতো।
এরপর প্রেমিকার সাথে একা বিশেষ দিন৷ এখন বাচ্চা নিয়ে বাইরে যায়। আমরাই তো ওদের জম্ম দিয়েছি আমাদের যদি ওরা খুশি হতে পারে আমরা একটু নিজের খুশি নিজেদের মতো পারব না কেন? বাচ্চা বড় হলে যেমন আমরা ছাড় দিই। ওদের উচিত আমদের ছাড় দেওয়া। কেক কেটে পলাশ ফেসবুকে ছবিও আপলোড করল। বাসায় গেলো সাড়ে এগারো টাই। নীলার মনে কেন যেন ভয় কাজ করছে। যেন এখন মাকে জবাব দিতে হবে ওর। বাসায় ঢুকে অবস্তা থমথমে। টেবিলে তখনো আধ খাওয়া খাবার পড়ে আছে। সবাই তাকিয়ে আছে। পলাশ কেক টা ছোট বউয়ের হাতে দিলো। নীলা রান্নাঘরে দিকে যেতে চাইলে টেনে রুমে নিয়ে যায় পলাশ। যাওয়ার সময় বলল-
– কাল সকালে সবাই থেকো। জরুরি কথা আছে। পারলে বোন দের ও ফোন দিও। নীলা রুমে ঢুকে অবাক হলো, শাড়ি খুলতে খুলতে বলল,
– কি ব্যাপারে কথা বলবে? সম্পত্তি?
– না, তোমার রিটায়ার্ডমেন্ট। এই বলে ওয়াশরুমে চলে গেলো। পরের দিন সবাই আছে। নীলা পলাশের পাশে। পলাশ বলল-
– একটু চা পেলে ভালো হতো। নীলা উঠতে যাচ্ছিল। ওকে বসিয়ে দেওয়াই মেজ বউ উঠে গেল। মেয়েরাও এসেছে। বড় মেয়ে বলল-
– তোমরা নাকি কাল ঘুরতে গিয়েছো বাসায় গেস্ট ফেলে৷ আবার ফেসবুকেও ছবি দিলে। তোমাদের জামাই কি লজ্জা দিলো আমায়। ছোট মেয়ে বলল- আমি ননদে তো আমাকে ফোন দিয়ে বলল। আমি বাজি আনফলো করে রাখছি। কি একটা অবস্তা! বউরা মুখ টিপে হাসছে। পলাশ বলল-
– অভ্যাস করে নাও। না হলে আমার আইডি ব্লক দিয়ে নাও। কারণ এখন থেকে রোজ নতুন কিছু দেখবে ফেসবুকে। আমি আর তোমার মা ওর্য়াল্ড ট্যুরে যাচ্ছি কাল।
– এ?
সবার মুখে এক শব্দ। এতক্ষন চুপ ছেলে ছেলে ছেলের বউ এইবার মুখ খুলল। এখন বাচ্চাদের পরীক্ষা, অফিসের চাপ, আমার বেবি তো এখনো ছোট, সামনে আমার মায়ের অপারেশন। কত দিন লাগবে? কখন ফিরবে? পলাশ চুপ করে শুনছে। হাত তুলে সবাইকে চুপ করিয়ে দিলো।
-তোমাদের ছোট বেলায় বান্দরবান একটা টিলায় আমাদের একটা বাংলোতে বেড়াতে নিয়ে যেতাম, মনে আছে?
– হ্যাঁ।
– ফেরার পরে আমরা ওখানে থাকবো। আমি আর তোমার মা, সাথে শিউলিও যাবে। সবাই এইবার একসাথে চেঁচিয়ে উঠল।
– তোমরা যাবে যাও শিউলি কেন?
-আমি তোমার মায়ের রিটায়ার্ডমেন্টের ব্যবস্থা করছি। তাই যাবে।
এতে তোমাদের আপত্তি থাকার কথা না। আমি বলছি না তোমরা কেউ খারাপ ব্যবহার করেছো সম্মান করছো না। আমরাও কখনো তোমাদের কোন কিছু অপূরণ রাখি নি৷ কিন্তু আমরা তোমাদের জীবন তোমাদের হাতে ছেড়ে দিয়েছি। এইবার আমাদের পালা।
আমার মা পছন্দ করে খুব শখ করে নীলাকে ঘরের বউ করে এনেছিল। আমরা ছয় ভাইবোনের সংসারে মাকে আমরা অবসর দিতে পারি না। আমি তোমার মাকে আলাদা কিছু কখনো দিতে পারি নি। সবার জন্য আনতে হতো। ওর কখনো কোন অভিযোগ ছিল না। কাজের সূত্রে এইখানে এলাম। একে একে তোমরা হওয়ার পর তোমার মায়ের মা হওয়া শুরু হয়েছে বটে শেষ হয় নি। আজ অবধি চলছে সে দায়িত্ব। আমি এখন রিটায়ার্ড হয়েছি। আমি বুঝতে পারছি একটা সময়ের পর শরীর আর মনের রিটায়ার্ড হওয়া কত জরুরী। আমি রোজ হাটছি শুয়ে বসে খাচ্ছি। কিন্তু তোমার মা পারছে না। বলছি না তোমার মা একা করছে। কিন্তু তোমার মায়ের ও রিটায়ার্ড হওয়ার সময় এসেছে। আমি তারাতাড়ি উঠি তাই তোমার মা কে আগে উঠতে হয় আমার জন্য। তোমরা একে একে বাইরে যাও। বাচ্চাদের ঘরে রেখে যাও। কখনো জিজ্ঞেস ও করলে না, মা তুমি যাবে কিনা?
আসলে আমার ভুল ছিলো, এইটা আমার করা উচিত ছিলো। কারো অসুখ মা কে লাগবে। মেয়ের অসুখ মা কে লাগবে। হসপিটালে রাত কাটাতে হবে মা কে লাগবে। একটু রান্নার চাপ মা কে লাগবে৷ কিন্তু তোমার মায়ের অপারেশন এর সময় সবার অসুবিধা ছিলো। কারো বাচ্চার পরীক্ষা কারো কাজের বুয়া নেই, কারো অফিসের চাপ। তখন শুধু শিউলি ছিলো। তোমরা সবাই এখন যথেষ্ট স্বচ্ছল আর সংংসারী। যদি বলো কারো উপর কাজের চাপ পড়ে যাবে মা না থাকলে তোমরা নিজেদের সংসার নিজেরা করে নাও। এইটা খারাপ না। আমরাও হয়েছি। তখন হয়ত বুঝবে কেন তোমার মায়ের রিটায়ার্ড হওয়ার দরকার। তোমাদের দরকার হলে আমরা অবশ্যই ফিরে আসবো৷ চাইলে তোমরাও যেতে পারো। আমাদের আপত্তি নেই। কথাটা বলে উঠে গেল পলাশ।।
– আর শোন, কাল আমাদের দশটার ফ্লাইট। বড় বৌ বলল- আপনারা একা যাবেন, কিছু হয়ে গেলে সামলাতে পারবে মা?
– তোমরা হয় জানো না। জানলেও ভুলে গিয়েছ তোমাদের মা ঢাকা ভার্সিটির ইংলিস ডিপার্টমেন্ট এর ছাত্রী ছিল। একবার সুযোগ পেলে আবার ফিরে আসবে নিজের রূপে। সবাই দাঁড়িয়ে আছে। পলাশ নীলার হাত ধরে গাড়িতে তুলতে গিয়ে শাড়িটা আবার একটু খুলে গেল। পলাশ নিচু হয়ে বসে কুচি ঠিক করে দিতে সবাই এমন ভাবে তাকিয়ে আছে। যেন পাহাড় নড়তে দেখছে। অনেকদিন পর সমুদ্রের নীল পানিতে পা ডুবিয়ে বসে নীলাকে এক বুক কৌতুহল নিয়ে অজানা রঙিন ভবিষ্যৎ নিয়ে বসে থাকা এক তরুনী লাগছে। পলাশ পাশে বসে বলল-
– কি গো কেমন লাগছে রিটায়ার্ডমেন্ট?
– যেন বেঁচে উঠলাম।
গল্পের বিষয়:
গল্প