কিছু মহিলা আছে যারা মানুষের সাথে কথা বলার থেকে হাঁড়ি পাতিলের সাথে কথা বলে বেশি। যেমন আমার মা। প্রতিদিন সকালে মা ঘুম থেকে উঠার পর রান্না ঘরে যাবে।তারপর হাঁড়ি পাতিল পরিষ্কার করবে আর ঝনঝন হাঁড়ি পাতিলের আওয়াজ করবে আর ওদের সাথে কথা বলবে। আজ সকালেও মা এমনটা শুরু করেছে। হাঁড়ি পাতিলের ঝনঝন শব্দে আমার ঘুম ভেঙে গেলো। আমি বিছানা থেকে উঠে ঘুম ঘুম চোখে রান্নাঘরে গিয়ে মাকে বললাম,
— মা, কি হয়েছে তোমার? মা ভাতের পাতিলটাকে জোরে আছাড় মেরে বললো,
~মাঝে মাঝে ইচ্ছে করে এই সংসারকে লাথি মেরে বাপের বাড়ি চলে যায় সত্যি বলতে আমাদের বাসার একটাও রান্না করার পাতিল ঠিক নেই। মা প্রতিটা পাতিলকে আছাড় মেরে মেরে বেহাল অবস্থা বানিয়ে ফেলেছেন। আমি কিছুটা বিরক্ত হয়ে মাকে বললাম,
— আরে কি হয়েছে বলবে তো? মা রেগে গিয়ে বললো,
~যা সামনে থেকে, তা নাহলে হাঁড়ি পাতিল তোর মুখে ছুড়ে মারবো আমি অবস্থা খারাপ দেখে আস্তে আস্তে মার থেকে সরে আসলাম। ছোট বেলা থেকে দেখছি আমার বন্ধুরা কোন ভুল করলে ওদের মা এসে ওদের দুই একটা চড় থাপ্পড় মারে কিন্তু আমি যদি কোন ভুল করতাম তাহলে আমার মা আমার দিকে আলু পটল টমেটো ছুড়ে মারতো আর যদি কিছু না পেতো তাহলে জুতা খুলে ছুড়ে মারতো বাবার কাছে এসে দেখি বাবা বেলকনিতে বসে একমনে খবরের কাগজ পড়ছে। আমি বাবার পাশে বসতে বসতে বললাম,
— বাবা, আজ আবহাওয়া খারাপ কেন? বাবা আমার কথার কোন উত্তর না দিয়ে খবরের কাগজের দিকেই তাকিয়ে আছে আমি আবার বললাম,
— বাবা, মা সকাল সকাল রেগে আছে কেন? এইবারও বাবা কোন উত্তর দিলো না। আমি বাবার গায়ে হাত রাখতেই বাবা খবরের কাগজ থেকে চোখ সরিয়ে বললেন,
– কিছু বলবি? আমি যখন বলতে যাবো তখন বাবা ইশারায় আমায় থামতে বলবেন তারপর কানের থেকে তুলা বের করে বললেন,
– এখন বল কি বলবি? আমি অবাক হয়ে বাবার দিকে তাকিয়ে বললাম,
— তুমি কানে তুলা দিয়ে রেখেছিলে কেন? বাবা মুচকি হেসে বললো,
– আমি সকাল ৭ থেকে ১০ পর্যন্ত কিছু শুনি না কারণ এই সময় তোর মা চিৎকার চেঁচামেচি বেশি করে আমি বললাম,
— তা আজ মা কি নিয়ে রেগে গেছে? বাবা বললো,
– আর বলিস না, কথায় কথায় তোর মাকে বলেছিলাম উপরের ফ্ল্যাটের রহমান সাহেবের স্ত্রী চা খুব ভালো বানায়। এই কথা শুনেই রেগে গেছে আমি মুচকি হেসে বাবাকে বললাম,
— আচ্ছা বাবা তোমরা নাকি প্রেম করে পালিয়ে বিয়ে করেছিলে। এই রকম একটা বদরাগী মেয়ের সাথে কিভাবে প্রেম করলে? বাবা আমার কথা শুনে হাসতে হাসতে বললো,
– তাহলে তোকে আজ আমার প্রেমের কাহিনী বলি? আমার খুব আগ্রহ নিয়ে বাবাকে বললাম,
— বলো বাবা বাবা বলতে শুরু করলো,
– আমি যে কলেজে পরতাম সেই কলেজের প্রিন্সিপালের মেয়ে ছিলো তোর মা। তোর মা সবে নতুন কলেজে ভর্তি হয়েছে। আগেরকার মেয়েরা এখনকার মেয়েদের মত এত সালোয়ারকামিজ পড়তো না। একটু বড় হলেই শাড়ি পড়তো। তোর মাকে প্রথম যেদিন দেখি সেদিন তোর মা একটা সবুজ রঙের শাড়ি পড়েছিলো আর চুল লম্বা করে বেণী করা ছিলো। তোর মাকে দেখেই প্রেমে পড়ে গিয়েছিলাম।আমি তখন কলেজের নাম্বার ওয়ান ছাত্র ছিলাম। একদিন প্রিন্সিপাল স্যার আমায় ডেকে বললো, আমি যেন মাঝে মধ্যে তার মেয়েকে পড়া দেখিয়ে দেই। আমি তখন প্রতিদিনিই পড়া দেখানোর নাম করে প্রিন্সিপাল স্যারের বাসায় যেতাম তোর মাকে দেখতে। আর পড়ানোর সময় পড়ার বিষয় আলোচনা না করে রাজ্জাক ববিতার রোমান্টিক সিনেমার কাহিনী বলতাম। তোর মা এইসব কাহিনী হা করে শুনতো। একদিন তোর মাকে প্রেমের বিষয় জ্ঞান দিচ্ছিলাম আর আড়াল থেকে প্রিন্সিপাল স্যার সব শুনে ফেলে। তারপর তোর মার সামনে আমাকে কিছু উত্তম মাধ্যম দিয়ে বাসা থেকে বের করে দেয়। উত্তম মাধ্যম দেওয়ার সময় আমার নাক ফেটে গিয়ে রক্ত পড়ছিলো আর তোর মা নাকি আমার সেই রক্ত দেখে আমার প্রেমে পড়েছিলো।
এই ঘটনার পর থেকে আমি তোর মার সাথে দেখা করতে পারতাম না। তোর মার কলেজে আসাও বন্ধ। তোর মাকে একটা কাহিনী শুনিয়েছিলাম যেখানে রাজ্জাক বাঁশিতে ফুঁ দিলে ববিতা দৌড়ে বারান্দায় আসতো। তাই আমিও আমার প্রেমের টান পরীক্ষা করার জন্য ২৫ পয়সা দিয়ে একটা বাঁশি কিনে তোর মার বাসার সামনে ফুঁ দিলাম। ওমনি তোর মা দৌড়ে বেলকনিতে আসলো। তখনি বুঝলাম তোর মাও আমায় ভালোবাসে। তারপর আর কি, একদিন সময় সুযোগ বুঝে তোর মাকে নিয়ে পালিয়ে গেলাম বাবা যখন কাহিনী বলছিলো তখন মা হঠাৎ রুমে এসে বললো,
~দেখো তো চা টা কেমন হয়েছে? বাবা চায়ে চুমুক দিয়ে বললো,
– ভালো হয়েছে তবে রহমান সাহেবের স্ত্রীর চায়ের মত না বাবার কথা শুনে মা রাগে প্রথমে চায়ের কাপটা আছাড় মেরে ভাঙলো তারপর কাপড় চোপড় গুছিয়ে বললো,
~থাকো তুমি রহমান সাহেবের স্ত্রীকে নিয়ে আমি তোমার সংসার আর করবো না মা যখন বাসা থেকে বেড় হয়ে যাবে তখন আমি মার হাতটা ধরে বললাম,
— কোথায় যাচ্ছো মা? মা আমার হাতটা সরিয়ে বললো,
– তুই আর তোর বাপ দুইজনেই মিচকে শয়তান। তোর বাপের যেমন এই বুইড়া বয়সে প্রেমের বাতাস লাগছে। তেমনি তোরও এই ছোট বয়সে মনে রঙ লাগছে। তুই যে বেলকনিতে দাঁড়িয়ে পাশের বিল্ডিংয়ের মেয়েটাকে হাতে ইশারা দিস সেটা কি আমি বুঝি না? মা চলে যাচ্ছে আমি বাবাকে বললাম,
— তুমি মাকে শুধু শুধু রাগালে কেন? বাবা মুচকি হেসে বললো,
– তোর মা রাগলে অনেক সুন্দর লাগে। আমি বললাম,
— কিন্তু মা যে চলে যাচ্ছে। বাবা বললো,
– যাবে না।একটু পর ঠিকিই ফিরে আসবে। আমার ২৩ বছরের অভিজ্ঞতা। ২৩ বছর ধরে দেখছি তোর মা আমার সাথে রাগ করে কাপড় চোপড় গুছিয়ে বাসা থেকে বের যা তারপর ১৫ -২০ মিনিট পর বাসায় এসে বলে, “যাও এইবারের মত মাফ করে দিলাম” বাবার ২৩ বছরের অভিজ্ঞতাকে ভুল প্রমাণ করে মা আর ফিরে আসে নি। মা সত্যি সত্যিই নানার বাড়ি চলে গেছে। আজ ৩দিন ধরে আমি আর বাবা নানার বাড়ির সামনে অপেক্ষা করছি কিন্তু ভিতরে ঢুকতে পারছি না। নানা দারোয়ানকে সরাসরি বলে দিয়েছেন, এই বিশ্বাসঘাতক মেয়ের জামাই আর নাতী কেউ যদি গেইট দিয়ে ঢুকতে চাই তাহলে যেন হাড্ডি ভেঙে দেয়। বাবা গোমড়া মুখে আমার দিকে তাকিয়ে বললো,
– যা ভিতরে গিয়ে তোর মাকে নিয়ে আয়? আমি বাবাকে বললাম,
— তোমার বউ তুমি গিয়ে নিয়ে আসো বাবা আমার কথা শুনে রেগে গিয়ে বললো,
– তোর গর্ভধারিণী মা। তকে ১০ মাস ১০ দিন পেঠে রেখেছে। তোর একটা কর্তব্য আছে না? আমি তখন বাবাকে বললাম,
— তোমার অর্ধাঙ্গিনী। তোমার সুখে দুঃখে এত বছর তোমার পাশে ছিলো। তোমার একটা দ্বায়িত্ব আছে না? বাবা করুন স্বরে আমায় বললো,
– আমি ভিতরে গেলে তোর নানা জান ২৩ বছরের জমানো রাগটা আমার উপর ঢালবে। আমি তখন হাসি মুখে বাবাকে বললাম,
— বাবা একটা আইডিয়া আছে….
আমি বাবাকে একটা বাঁশি কিনে দিলাম। বাবা বাঁশিতে ফুঁ দিতেই মা দৌড়ে বেলকনিতে আসলো। আমি রাস্তার পাশে বসে ফোন টিপছি আর বাবা রাস্তায় দাঁড়িয়ে থেকে মার দিকে অপলক দৃষ্টিতে তাকিয়ে আছে। আমি অপেক্ষায় আছি ২৩ বছর আগে বাবা যেভাবে মাকে নিয়ে পালিয়েছিলো ২৩ বছর পরেও বাবা সেভাবে মাকে নিয়ে পালাতে পারে কি না সেটা দেখার জন্য..
গল্পের বিষয়:
গল্প