বাম হাতের অনামিকা আঙুলের দিকে একদৃষ্টিতে তাকিয়ে আছি।একটা সোনালি রঙের আংটি জ্বলজ্বল করছে।আজ বিকাল অবধিও এই আংটি আমার হাতে ছিল না।কিন্তু সন্ধ্যার কিছুটা আগেই এই আংটি পরে আমি অন্য একজনের বাগদত্তা হয়ে গেছি।যার সাথে আমার সারাজীবন কাটাতে হবে। দুপুরের পর হঠাৎ করে চাচী আমার রুমে এলো।সচরাচর তিনি আমার আশেপাশে আসেন না।যখন আসেন জরুরি কিছু বলার জন্য বা করার জন্য।তাই চাচীকে দেখেই বুঝতে পেরেছিলাম হয়তো কোন বিশেষ ব্যাপার।আজ চাচীর মুখটা হাসি হাসি।অন্যান্য সময় গম্ভীর হয়ে থাকেন।খাটের ওপর বসে আমার ধারনাকে সত্যি করে চাচী বললেন,,,
—” দেখ তনু,তোকে আর তিথিকে কখনও আলাদা করে দেখিনি।তুইও তিথির মতো আমার মেয়ে।
—” জ্বি চাচী অবশ্যই।
—” আচ্ছা শোন,এই শাড়ীটা পড়ে নে।না পারলে আমি পড়িয়ে দিচ্ছি।বিকালে কয়েকজন মেহমান আসবে তোকে দেখতে।
—” কিন্তু চাচী আমিতো আর দুটো বছর সময় চেয়েছিলাম।দুবছরে আমার অনার্স কম্পিলিট হয়ে যাবে।এখন এসব না করলেই নয়।
—” না নয়,মেয়ে মানুষের এতো পড়ে কাজ কি।বড় হয়েছিস পরের ঘরে তো যেতেই হবে।তাছাড়া তিথিটাও তো বড় হচ্ছে।বিয়ের পর যদি ছেলের বাড়ির লোক চায় তাহলে যত খুশি পড়িস।
চাচী চলে গেলেন।শেষের দিকে চাচী বেশ রেগে কথাগুলো বলেছেন।অবশ্য এটাই স্বাভাবিক।বাবা মা মরা এতিম একটা মেয়েকে কতদিন আর ঘাড়ে বসিয়ে খাওয়াবে।কম তো সহ্য করলেন না তারা।সেই জন্মের সময় মা মারা গেলেন,দু’বছর বয়সে বাবা।সেই থেকে ছোট চাচার কাছে মানুষ।আঠারোটা বছর ধরে আমায় সহ্য করছেন তারা।আমি নিজে হলেও মনে হয় করতাম না।চাচী সবসময়ই আমার ওপর বিরক্ত থাকতেন।কোনদিন হাসিমুখে কথা বলেছেন বলে মনে পড়ে না।বুঝতে পারতাম কিন্তু কিছুই করার ছিলনা।ভেবেছিলাম আর দুবছর পর অনার্স কম্পিলিট হয়ে গেলে যেকোনো একটা চাকরি জুটিয়ে নেব।কিন্তু তার আগেই চাচী পাত্র দেখে ফেললেন।চোখ মুছে শাড়িটা হাতে নিয়ে দাঁড়ালাম।মিষ্টি কালারের একটা সিল্কের শাড়ি।অপটু হাতে পড়ে নিলাম।তিথি এসে হালকা গোছগাছ করে একটু সাজিয়ে দিল।
ড্রয়িং রুমে সোফায় বসে আছি।ওনারা আমাকে দেখতে এসেছেন কিন্তু পাত্রের চোখমুখ দেখে মনে হচ্ছে ওনারা নয় বরং আমিই ওনাদের দেখতে এসেছি।মাথা নিচু করে বসে আছেন।চাচা চাচী কিছু জিজ্ঞেস করলে মুখ কাঁচুমাচু করে উত্তর দিচ্ছেন।লোকটাকে দেখে আমার সেই লেভেলের হাসি পাচ্ছে।কিন্তু পাত্রী বলে হাসতেও পারছি না।আমার দিকে একবারও তাকায়নি।আমিতো কয়েকবার তাকিয়ে ভালোকরে দেখে নিয়েছি।শ্যামলা বর্ন,মাথায় কোঁকড়ানো চুল,হালকা দাড়িও আছে,চোখে মোটা ফ্রেমের চশমা।ছেলেটাও আমার মতোই এতিম।আপনজন বলতে একজন মামা।তিনিই সাথে এসেছেন।চাচার সাথে কথা বলে বিয়ে ফাইনাল করে ওনারা চলে গেছেন।পাত্রর নাম ঈশান।ঢাকায় একটা ছোটখাটো জব করে।শুধু এটুকুই জানলাম আমার হবু বরের ব্যাপারে।চাচার ডাকে চমকে উঠলাম।তাকিয়ে দেখি চাচা দরজায় দাঁড়িয়ে আছেন,,,
—” তনু আসবো..??
—” জি চাচা আসুন।
—” যা কিছু হচ্ছে তাতে তুই খুশি তো মা..??
—” জি
—” ঈশান তোর নাম্বার নিয়ে গেছে।ফোন দিলে কথা বলিস।
—” আচ্ছা চাচা বলবো।
এই চাচা নামক মানুষটাকে কোনদিন একটুও কষ্ট দেয়ার কথা আমি ভাবতেও পারিনা।বাবা মায়ের কথা তো জানিনা কিছুই।কিন্তু যতটা স্মৃতি সামনে আসে সবটা চাচাকে ঘিরেই।মানুষটা আমার জন্য অনেক করেছেন।। প্রায় সাড়ে দশটা বাজতে চললো।বিছানা ঠিক করে শুতে আসছিলাম,তখনই ফোনটা বেজে উঠল।আননোন নাম্বার দেখে একবার রিসিভ করতে চাইছিলাম না।পরে মনে পড়লো চাচা বলেছিলেন ঈশান নাম্বার নিয়ে গেছে।উনিও হতে পারেন ভেবে রিসিভ করলাম।তিনবার হ্যালো হ্যালো করলাম।কিন্তু ওপাশ থেকে কোন সাড়াশব্দ নেই।বিরক্ত হয়ে কেটে দিব তখনই দুর্বল গলায় কে যেন হ্যালো বললো,,,
—” হ্যালো,,,,,
—” আমি ঈশান বলছি,তনুকে একটু দেয়া যাবে..??
—” আমিই তনু,আপনি এতোক্ষণ কথা বলেননি কেন..??
—” আসলে নার্ভাস লাগছিলো।কেমন আছেন আপনি..??
—” ভালো আপনি..??
—” ভালো।কাল একটু দেখা করতে পারবেন..???
—” চাচীকে জিজ্ঞেস করতে হবে।
—” আপনার চাচীর সাথে আমার কথা হয়েছে।উনি রাজি আছেন।এবার বাকিটা আপনার ওপর।
—” আচ্ছা কোথায় কখন আসবো..???
—” টিএসসিতে বিকাল চারটায়।
—” ঠিকআছে আমি চলে আসবো।
—” আচ্ছা ঘুমিয়ে পড়ুন,আল্লাহ হাফেজ।
ফোনটা কেটে গেল।কালকে ঈশানের সাথে দেখা করতে যেতে হবে।একবস্তা সমান বিরক্তি নিয়ে ঘুমাতে এলাম।।।
চারটা পাঁচ বাজে।টিএসসির মোড়ে দাঁড়িয়ে আছি।ঈশানকে কোথাও দেখতে পাচ্ছি না।দুনিয়ার মানুষ হেঁটে বেরাচ্ছে।ঈশানের টিকিও নজরে পড়ছে না।ঈশানের সাথে দেখা করতে আসছি এজন্য চাচী আমাকে দু’ঘন্টা বসিয়ে ইচ্ছেমত সাজিয়েছেন।মেকআপ ফাউন্ডেশন লিপস্টিক আরও কত কি।সাজ কম্পিলিট হওয়ার পর আয়নায় তাকিয়ে নিজেই নিজেকে চিনতে পারছিলাম না।তিথিকে কয়েকবার জিজ্ঞেস ও করেছি,এটা কি সত্যিই আমি,?পথে আসতে আসতে ভেবেছি ঈশান আমাকে দেখে জোকার ভেবে উল্টো ঘুরে দৌড় না দেয়।কিন্তু এখন মনে হচ্ছে ও আড়াল থেকে আমাকে দেখেই ভেগেছে। হঠাৎ পেছন থেকে কে যেন আমাকে নাম ধরে ডেকে উঠলো।ফিরে দেখি ঈশান দাঁড়িয়ে আছে।কালো পাঞ্জাবি পড়া।ক্যাবলাকান্তর মত মাথা নিচু করে রেখেছে। ঈশানের সাথে রেস্টুরেন্টে এসে বসলাম।কিন্তু ওনি কোন কথাই বলছেন না।আরে ব্যাটা কিছু না বললে আমাকে ডেকেছিস কেন।অধৈর্য হয়ে বসে আছি।ঈশান হয়তো আমার বিরক্তিটা বুঝতে পেরেছে।তাই মিনমিন করে বললো,,,
—” তনু,তোমার কি খেতে ভালো লাগে..??
—” অনেক কিছুই ভালো লাগে।খেতে আমার কখনও খারাপ লাগে না। আবার চুপ,এ মনে হয় বলার জন্য কিছু খুঁজে পাচ্ছেনা। অবশেষে আমিই বললাম,,,
—” আজ তাহলে আসি।সন্ধ্যা হয়ে আসছে প্রায়।
—” আমি পৌঁছে দিচ্ছি।
—” না,না আপনাকে কষ্ট করতে হবে না।আমি চলে যাব।
বাসায় আসতে আসতেই প্রচন্ড মাথা ব্যাথা শুরু হয়েছে।আর এখন কাঁপুনি দিয়ে জ্বর।জ্বরের ঘোরে আবোলতাবোল বকে চলেছি।আর তিথি আমার কথায় সায় দিয়ে চলেছে।চাচী মাথায় পানি দিয়ে দিচ্ছে।আঠারো বছরের মধ্যে মনে হয় এই প্রথম চাচীর হাতে সেবা পাচ্ছি।আমার জন্য এটাই অনেক।চোখগুলো ভরে আসছে।এটা কি জ্বরের জন্য নাকি চাচীকে নিয়ে ভেবেছি সেজন্য বুঝতে পারছি না।তবে যাই হোক আজ সব ভুলে চাচীর মুখের দিকে তাকিয়ে থাকতে ইচ্ছে করছে।মায়েরা দেখতে কেমন হয় জানিনা।কিন্তু চাচীর মধ্যে মায়ের স্নেহের ছায়া দেখতে পাচ্ছি আজ।
সকালের দিকে বেহুঁশ থাকলেও বিকেলের দিকে জ্বরটা ছেড়ে গেছে।কিন্তু প্রচন্ড দুর্বল লাগছে।দাঁড়ালেই মনে হয় পড়ে যাব।তিথির হাতে দুই লোকমা ভাত খেয়ে অষুধ খেয়ে নিয়েছি।এখন কম্বল মুড়ি দিয়ে শুয়ে আছি।ড্রয়িং রুমে কথার আওয়াজ পাচ্ছি।
তিথি এসে জানালো ঈশান এসেছে।একটু বাদেই নবাবপুত্তুর আমার রুমে এলেন।এসেছে তো এসেছে সাথে একগাদা ফলমূল নিয়ে এসেছে।দেখে মনে হচ্ছে হসপিটালে রোগী দেখতে এসেছে।ঈশানকে একপলক দেখেই চোখ বন্ধ করে নিয়েছি।একটু পরে কপালে একটা ঠান্ডা হাতের স্পর্শ পেলাম।হাতটা কপালে ছোঁয়াতেই কেঁপে উঠলাম।কিন্তু চোখমুখ খিঁচে শক্ত হয়ে বসে রইলাম।তিথি দু-একবার ডেকেছিল আমাকে।আমি সাড়া না দেওয়াতে ঈশান না করলো ডাকতে। একটু পরেই ঈশান চলে গেল।। দুটো দিন লেগে গেল পুরোপুরি সুস্থ হতে।এই দুদিনে ঈশান দুশবার চক্কর কেটেছে।আর আমি মটকা মেরে থেকেছি।চাচা চাচী ঈশানের প্রশংসায় পঞ্চমুখ।কতো কেয়ারিং একটা ছেলে।তিথি বারবার আমাকে খোঁচাচ্ছে কতো রোমান্টিক হাজবেন্ড বলে।
আজ আবার ঈশানের মুখোমুখি রেস্টুরেন্টে বসে আছি।এই কদিনে বেশ মায়া জন্মে গেছে ওর ওপর।সারাদিন নিজে থেকেই ওর ফোনের অপেক্ষা করি।কিন্তু ফোন দিলে এমন একটা ভাব নেই যেন ও ফোন দেয়াতে আমি বিরক্ত।কাল যখন দেখা করার কথা বললো তখন শুধু ঠিকআছে বলেই কেটে দিয়েছি।কিন্তু ফোন রেখে লুঙ্গীড্যান্স দিয়েছি।
আজ ঈশানকে বেশ বিমর্ষ লাগছে।চুলগুলো এলোমেলো।চোখ হালকা ফুলে আছে।দেখে মনে হচ্ছে সারারাত ঘুমায়নি।প্রতিদিনের মতোই চুপ করে আছে।শেষে আমিই বললাম,,,,
—” আপনি কি অসুস্থ..???
—” কই নাতো
—” ওহ আচ্ছা।কিন্তু আপনাকে দেখে মনে হচ্ছে আপনি অসুস্থ।শরীর ভালো না লাগলে বাসায় চলে যান।অন্য একদিন নাহয় দেখা করবো।
—” তার আর প্রোয়োজন হবে না মনে হয়।
—” মানে.??(খেয়াল করলাম ঈশান সরাসরি আমার চোখের দিকে তাকিয়ে কথা বলছে)
—” তনু আমি কাওকে জোর করে কোন সম্পর্কে বাঁধতে চাই না।
আমাদের বিয়েটা পারিবারিক ভাবে ঠিক করা হলেও আমি এই কয়েকদিনের মধ্যে তোমাকে আপন ভেবে ফেলেছি।হয়তো ভালোওবেসে ফেলেছি। কিন্তু তোমার দিক থেকে কোন পসিটিভ কিছু পাইনি আমি।এতোদিনেও তুমি নিজে থেকে একবার ফোন দাওনি।আমি ফোন দিলেও শুধু আমার কথার উত্তর দাও।নিজে থেকে কিছুই বলোনা।আমার মনে হয়েছে তুমি খুশি নও এই সম্পর্কে।তাই তুমি চাইলে আমি আমার দিক থেকে বিয়েটা ভেঙে দিতে পারি। তুমি খুব ভালো মেয়ে।হয়তো আমার চেয়ে ভালো কাওকে ডিজার্ভ করো।তাই তোমাকে আটকাতে চাই না আমি।
—” অনেক বেশি বুঝে ফেলেছেন আর বুঝতে হবে না।আপনাকে কে বললো আমি এই সম্পর্ক নিয়ে খুশি না।এটা আমি ভাঙতে চাই।আপনি জানেন সারাদিন আমি আপনার ফোনের অপেক্ষা করি।কথা বলার পুরোটা সময় ভাবি কখন দেখা করতে বলবেন।এসবের কোন মূল্য নেই তাই না। ঈশান অবাক হয়ে তাকিয়ে আছে।আমি মোটামুটি চিৎকার করেই কথাগুলো বলেছি।ও ভাবেনি আমি এভাবে রিয়েক্ট করবো।
—” কিন্তু আমার কখনও মনে হয়নি তনু,যে তুমিও আমাকে নিয়ে ভাবো।
—” তা মনে হবে কেন।আপনিতো অপেক্ষায় ছিলেন।কবে আমি বিয়ে ভেঙে দিব আর আপনি অন্য কাওকে নিয়ে ঘুরবেন। এই পর্যায়ে ঈশান হেসে দিল।আমার চোখ দিয়ে সমানে পানি পড়ছে।ঈশান দাঁড়িয়ে আমাকে চেয়ারে বসিয়ে চোখ মুছে দিল।তারপর বললো,,,
—” আমিতো ভেবেছিলাম তুমি অনেক ম্যাচিউর একটা মেয়ে,কিন্তু এখনতো দেখছি তুমি পুরাই বাচ্চা।আগে তোমাকে বড়ো করতে হবে তারপর সংসার করতে হবে।ততদিনে না আমিই বুড়ো হয়ে যাই। ঈশানের কথা বলার ধরন দেখে আমিও হেসে ফেললাম। রেস্টুরেন্ট থেকে বেরিয়ে নদীর পাড়ে এসেছি।ক্ষানিকক্ষন হাঁটাহাঁটি করে এখন ঘাসের উপর বসে আছি ঈশানের কাঁধে মাথা রেখে।দুজনের দৃষ্টি নদীর স্বচ্ছ পানিতে।চোখে ভবিষ্যৎ জীবনের হাজারো স্বপ্ন বীজ বুনে চলেছে।সবগুলো একটু একটু করে পূরন করবো আমরা।
গল্পের বিষয়:
গল্প