তিক্ততা

তিক্ততা
— বাচ্চাটা নষ্ট করে ফেল মা। তোর এখানো মেলা জীবন পড়ে আছে। কথাটা কান পর্যন্ত আসতেই আমি মার দিকে ঘৃণা ভরা দৃষ্টিতে তাকাই। আর চেঁচিয়ে বলি,
— তুমি নিজে একজন মা হয়ে অন্য একজন মাকে কিভাবে বলছো তার বাচ্চাকে নষ্ট করে ফেলতে? এই কথা বলতে তোমার একবারও বুক কাঁপলো না? একটা কথা শুনে রাখো মা আমি কিছুতেই নিজের বাচ্চাকে নষ্ট করবো না।
মা তখন কিছু না বলে আমার মুখের পানে তাকিয়ে ছিল। কিছু বলার জন্য হয়তো ভাষা খুঁজে পাচ্ছিলেন না। এমন সময় আমার বাবা আর বড় চাচী রুমে আসে। বাবা এসেই জোর গলায় বলে উঠে,
— শুধু কষ্ট ছাড়া এই বাচ্চার কোন ভবিষ্যৎ নেই। এই বাচ্চাকে নিয়ে তুই কোথাও ঠাই পাবি না। তাই বলছি বাচ্চাটা নষ্ট করে ফেল। এতেই সকলের মঙ্গল। আমি তখন চেঁচিয়ে বলি,
— করবো না আমি বাচ্চা নষ্ট। সাথে সাথে গালে চড় বসিয়ে দেয় বড় চাচী। পান চিবুতে চিবুতে রাগি চোখে তাকিয়ে
বলেন,
— বাচ্চা নষ্ট করবো না মানে? ওরে করতেই হবই। সারাবছর কি বাচ্চা লইয়া এইখানে বোঝা হয়ে পড়ে থাকবো নি? মাইনসে কি কইবো? বাচ্চা ফালাইয়া দিয়ে নতুন কইরা জীবন শুরু করবো। সংসার করবো। তখন এমন ফালি ফালি বাচ্চা আবার এমনেই আইবো নে। ভাইজান আপনি কালকেই ডাক্তারের লগে কথা কোন। বেশি দেরি করলে পড়ে ঝামেলা হইবো। বাবা তখন বড় চাচীর কথায় সাই দিয়ে চলে যায় সাথে সাথে মাও তার পিছু নেয়। বড় চাচীও ভেংচি কেটে চলে যায়। আর আমি নীরবে চোখের মনি ফেলতে থাকি। মোবাইলে উনার ছবিটা বুকের মধ্যে জড়িয়ে বলি,
— কেন মাঝ পথে ছেড়ে গেলেন আমায়? কেন! এমনটা না হলে কি হতো না? আপনায় দোষও দিতে পারছি না কেন না সব দোষ যে আমার ভাগ্যের। এই বলে আবার ডুকরে কেঁদে উঠি। রাত ১১ টা নাগাদ কাউরো চাঁপা ডাকে আমার ঘুম ভেঙে যায়। কখন যে কান্না করতে করতে ঘুমিয়ে পড়ি তার খেয়াল ছিল না। আমি চোখ খুলে তাকাতেই দেখি আমার ছোট ভাই রিফাত দাড়িয়ে আছে। চোখে মুখে তার এক রাশ ভয়। আমি ওকে কিছু জিজ্ঞেস করতে যাব তার আগেই ও আমার হাতে একটা বোরখা ধরিয়ে দিয়ে বলে,
— আপু তুমি পালিয়া যা। এরা তোর বাচ্চাকে তোর থেকে কেড়ে নিবে রে আপু। বাবা আর বড় চাচা মিলে সব ব্যবস্থা করে ফেলেছে। কালকেই হাসপালে গিয়ে তোর বাচ্চাকে মেরে ফেলবে তারা। নিজের বাচ্চাকে বাঁচাতে চাইলে পালিয়ে যা আপু পালিয়ে যা।
তুই চিন্তা করিস না আমি সব ব্যবস্থা করে ফেলেছি। তুই এখন সোজা বাস কাউন্টারে গিয়ে সিলেটের একটা টিকেট কেটে বাসে চড়ে বসবি আর সোজা রিমি আপুর কাছে চলে যাবি। আমি রিমি আপুকে আগে থেকেই সব বলে রেখেছি। আর বাইরে আমার একটা বন্ধু দাঁড়িয়ে আছে ও ঠিক মত তোকে গাড়িতে বসিয়ে দিবে। আর এই নে কিছু টাকা। আরও দরকার হলে আমি পড়ে পাঠিয়ে দিব নে। আমি তখন শুধু ফ্যালফ্যাল করে রিফাতের দিকে তাকিয়ে থাকি। সেই ছোট রিফাত যে নাকি সবসময় আমার কাছে এইটা ওইটা বায়না করতো আজ সেই রিফাত এত বড় হয়ে গিয়েছে ভাবতেই অবাক লাগছে। নিজের বোনের খুশির কথা চিন্তা করে তাকে সুরক্ষিত রাখতে কি না করছে সে। এই কথা ভেবেই দুইচোখ ভরে আসে আমার। রিফাত আমায় তাড়া দিতেই আমি কিছু না ভেবে বোরখা আর নিকাবটা পড়েনি। রিফাত আমার হাতে নতুন একটা সিম ধরিয়ে দিয়ে বলে,
— আগেরটা ফেলে দিস আপু। পুরানো কোন সম্পর্ক আর রাখার দরকার নেই। এখন থেকে ভুলে যা যে তোর কোন বাবা-মা বা আত্মীয়স্বজন আছে। তখন আর নিজেকে আটকিয়ে রাখতে না পেরে ভাইটাকে জড়িয়ে ধরে ইচ্ছে মতে কাঁদি আমি। অতঃপর রাতের আধারে বেরিয়ে আসি বাসা থেকে। বাস চলছে আপন গতিতে। বাইরের থেকে আসা হীম শীতল বায়ুগুলো আমায় ছুঁয়ে দিচ্ছে। চোখে আমার বর্ষা নেমে আছে। যা প্রতি ক্ষনে ক্ষনে বর্ষিত হয়েই চলেছে। অতীতের স্মৃতিগুলো যে আজ বড্ড তাড়া করছে। ছোট হতে এই পর্যন্ত যত স্মৃতি সব যেন এই মূহুর্ত আমায় একদম ঝেঁকে ধরেছে।
আমি মুসকান। বাবা-মার আদরের মেয়ে। ছোট থেকেই বাবা-মার বাধক ছিলাম। তারা যেভাবে যা বলতো ঠিক সেভাবেই চলতাম। সর্বদাই পর্দা করে চলতাম। ৫ ওয়াক্ত নামাজ পড়তাম।অনার্ষের ৩য় বর্ষে উঠতেই বাবা আমার বিয়ে একজন আর্মি অফিসারের সাথে ঠিক করে ফেলে। যেহেতু আমার কোন প্রেমের সম্পর্ক ছিল না সেহেতু বাবার পছন্দের ছেলেকে বিয়ে করতে আমার কোন আপত্তি ছিল না। বিয়ের আগ পর্যন্ত আমি উনার নাম জানতাম না। বিয়ের প্রথম রাতেই আমি তার সম্পর্কে জানি। উনার নাম ছিল শফিক। দেখতে শ্যাম বর্নের ছিলেন। কিন্তু চেহারায় মায়া ভরপুর। কথা বার্তা একটু কড়া হলেও মনের দিক দিয়ে ছিলেন অতি নরম। বিয়ের প্রথম রাতেই তিনি আমাকে অবাক করে কঠোর গলায় বলে দিয়েছিলেন,
–” আপনার থেকে ছোট একটি অনুরোধ আমাকে কখনো ভালবাসতে যাবেন না। আমায় ভালবেসে আপনি কষ্ট ছাড়া কিছুই পাবেন না। ” তখন আমি শুধু ফ্যালফ্যাল করে তার দিকে তাকিয়ে ছিলাম। বুঝে উঠতে পারি নি কথাটা। কিন্তু এখন বুঝি কেন তিনি আমায় সেইদিন এই কথাটা বলেছিলেন। সেইদিন ভেবেছিলাম এ কার সাথে আমার বিয়ে হলো কে জানে। পাগল টাগল নাকি ছেলেটা। বিয়ের পরেরদিনেই শ্বাশুড়ির সাথে আমার ভাব হয়ে যায়। নিজের ছেলের থেকে বেশি আমায় ভালবাসতেন তিনি। এই নিয়ে উনার যে কত অভিযোগ। উনার বাবা ছিল না। ৫-৬ বছর হলো তার বাবা মারা গিয়েছে। এখন তার কাছে মাই তার সব।
তিনি প্রায় ১ মাসের মত আমাদের সাথে ছিলেন। আর এই ১ মাসেই যেন আমি পাগল ছেলেটাকে মনে প্রাণে ভালবেসে ফেলি আমি। উনিও যে আমায় ভালবেসে ফেলেছিলেন তা ঠিকই বুঝতে পারছিলাম। কিন্তু কেউ মুখ ফুটে বলি নি। দেখতে দেখতে সে নিজের কাজে চলে গেল। প্রথমে খারাপ লাগলেও দিন শেষে তার সাথে দুটো কথা বলতে পারলেই মনটা ভরে যেত। একসময় এইসবে অভ্যস্ত হয়ে গিয়েছিলাম। উনার হুকুমে নিজের পড়ালেখা চালিয়ে গিয়েছিলাম। শ্বাশুড়িও ছিলেন পাশে। দুইজনের উৎসাহর ফলে নিজের মাস্টার্স কমপ্লিট করা হয় আমার। তিনি ২ মাস অন্তর ১ সপ্তাহের জন্য আসতেন। সেই ১ সপ্তাহই হতো আমার কাছে ঈদের খুশির মত। তাকে নিয়ে বাকি সকলের মত ঘুরতে যাওয়া, তার কাছে নিজের সকল শখ আবদার করা কখনো হয়ে উঠেনি। কিন্তু তা নিয়ে আমার কখনো কোন আক্ষেপ ছিল না। আমি যে অল্পতেই খুশি ছিলাম। দেখতে দেখতে যে কিভাবে সাংসারিক জীবনের ৩ টি বছর কেটে যায় বুঝে উঠতেই পারি নি।
অবশেষে যখন বুঝতে পারি আমার ভিতরে অন্য এক সত্তা বেড়ে উঠেছে। তখন খুশিতে আমি আত্মহারা হয়ে যাই৷ শ্বাশুড়িমাও কথাটি শুনার সাথে সাথে আমার হাতে অসংখ্য চুমু খায়। তার চোখ সেইদিন খুশিতে চিকচিক করছিল। কিন্তু এই খুশিটা যে ক্ষণস্থায়ী ছিল। একটা ফোন কল সকল খুশিকে মৃত্যুর শোকে পরিনত করে দেয়। তিনি যেই ক্যাম্পে ছিলেন সেখানে নাকি সন্ত্রাসীরা বোমা ফালায় আর সেই বিস্ফোরণ মারা যায়। এই কথাটা শুনার সাথে সাথে শ্বাশুড়িমা ব্রেন স্টোক করে আর সেখানেই ইন্তেকাল করেন। সেইদিন শুধু আমি মূর্তির ন্যায় দাড়িয়ে ছিলাম। কাঁদতে ভুলে গিয়েছিলাম। সকল অনুভূতিগুলো যেন সেখানেই চাঁপা পড়ে যায়। বাবা-মা আমায় তাদের বাসায় নিয়ে আসে। আর যখন তারা জানতে পারেন আমি মা হতে চলেছি তখন তারা আমাকে বাচ্চা নষ্ট করে দেওয়ার জন্য চাঁপ দিতে থাকে। না করতেই শুরু হয় আরেক অমানবিক নির্যাতন। রিমির বাসায় এসেছি আজ প্রায় ১ মাস হলো। রিমি অনেক ভালো ভাবেই যত্ন নিচ্ছে। কোন কমতি রাখছে না আমার। কাউকে জানতে পর্যন্ত দেয় নি যে আমি এইখানে আছি। রিমির স্বামীও আমার দিকে বেশ খেয়াল রাখছে। আমাকে সবসময় তার ছোট বোন মত শাসন করে।
ছোট থেকেই এক সাথে বড় হয়েছি আমরা। দুইজন দুইজনের জানে বান্ধবী। ভার্সিটির ৪র্থ বর্ষ পর্যন্ত একই সাথে ছিলাম আমরা। কিন্তু ওর বিয়ে হয়ে যাওয়ায় আর স্বামী সিলেট থাকায় সে টিসি নিয়ে এইখানে চলে আসে। রিমির চেয়ে বিশ্বস্ত আর কেউ ছিল না বলে হয়তো ওর কথাই সবার আগে রিফাতের মাথায় খেলে। কিছুদিন আগেই রিফাতকে বলে আমার সব সার্টিফিকেটগুলো আনিয়ে নেই। অতঃপর ভালো একটা চাকরির খোঁজে বেরিয়ে পড়ি। কিন্তু প্রেগন্যান্ট হওয়ায় সকলেই চাকরি দিতে নারাজ। রিমি চাকরি না করার জন্য অনেকবার মানা করেছে কিন্তু আমি মানি নি। সারাজীবনতো আর একজনের ঘাড়ে চেঁপে বসে থাকা যায় না। অনেক খুঁজাখুঁজির পর গিয়ে একটা বুটিক হাউজে চাকরি পাই। হাতের কাজ ভালো ছিল বলে মাইনেও মোটামুটি পাই। এতেই মোটামুটি নিজের খাওয়ার খরচ চলে যায়। আর কিছু টাকা ডিলেভারির জন্য সঞ্চয় করতে থাকি।
এই কয়েকমাসে জীবনকে নতুন করে চিনিছি। পরিবার, স্বামী ছাড়া যে একটা নারীর জীবন তিক্ততায় ভরা। প্রথমে সহ্য করতে হয়েছে পরিবারের তিক্ততা, পরে আত্মীয়দের তিক্ততা, অতঃপর সমাজের তিক্ততা। নিচু শ্রেণির কিছু মানুষরুপি নরপশুদের তিক্ততা। জীবনটায় যে এখন তিক্ততায় ভরে উঠেছে। তাই তো এখন আল্লাহ বাদে কাউরো কাছে নিজের কষ্ট মুখ ফুটে বলি না৷ প্রতিদিন তাহাজ্জুদ নামাজের বসে কাঁদাটা যেন নিয়ম হয়ে যায়। সকল সময় নিজেকে শক্ত রাখার জন্য আল্লাহর নিকট কান্নাকাটি করি। নিজের সন্তানের সুস্থতা চাই। অনেক সময় এমনও হয় আমি কাঁদতে কাঁদতে জায়নামাজেই ঘুমিয়ে পড়ি। দেখতে দেখতে ৮ মাস হয়ে আসে। পেটটা ফুল উঠেছে। হাতে পায়ে পানিও এসে পড়েছে। চলাফেরা করতে বেশ কষ্টই হয়। তাই বাধ্য হয়ে চাকরিটা ছাড়তে হয়। সারাক্ষণ এখন বসে আল্লাহ এর নাম নিতে থাকি আর নিজের বাচ্চার সুস্থতা কামনা করি। দুই এক সময় শ্বাশুড়িমা আর উনার কথা মনে পড়লে ডুকরে কেঁদে উঠি। তাদের কমতি যে সারাক্ষণ আমায় কুঁড়ে কুঁড়ে খায়।
৮ মাস ১৪ দিনের মাথায় আমার লেভার পেইন উঠে। রিমি তখন বাজারে গিয়েছিল আর ভাইয়া অফিসে। ফাঁকা বাসায় আমি ব্যথায় কুকড়িয়ে উঠিম ব্যথায় যেন জানটা বেরিয়ে যাচ্ছিল। মনে হচ্ছিল এই মরে যাব। বার বার আল্লাহ এর নাম নিচ্ছিলাম। আল্লাহ হয়তো আমার ডাক শুনে। আমি জ্ঞান হারানোর আগেই রিমি চলে আসে আর আমার গোঙ্গানি শুনে দ্রুত আমার কাছে ছুটে আসে। আর আমায় হসপিটালে নিয়ে যাওয়ার ব্যবস্থা করে। সেইদিন আমার কোল জুড়ে আসে সায়ান। ওকে নিজের কোলে নিতেই যেন সকল কষ্ট ভুলে যাই আমি। চুমুতে ভরিয়ে দেই ওর মুখখানিতে। এতদিন পর খুশি নামক পাখিটি হয়তো আমার কাছে ধরা দিয়েছে। ছেলেটির চেহারা অবিকল তার বাবার মত। এমনকি গায়ের রঙটাও ঠিক তার মতই। ছেলেটির মুখে যতবারই তাকাই ততোবারই উনার মুখটি আমার সামনে ভেসে উঠে। সাথে সাথে চোখ দুটো ভরে আসে।
কিন্তু তখন নিজেকে শক্ত করি। এইখানে যে শেষ নয় আমায় যে আরও যুদ্ধ করতে হবে। এই সমাজে যে একা হাতে সন্তানকে বড় করে তুলা মুখের কথা নয়। প্রতিটা পদে হোচট খেতে হবে আমায়। কিন্তু সে সব পেরিয়ে যে আমায় ওকে মানুষ করতে হবে। এই তিক্ততাপূর্ণ জীবন উপেক্ষা করে আমায় এগিয়ে চলতেই হবে।
গল্পের বিষয়:
গল্প
DMCA.com Protection Status
loading...

Share This Post

আরও গল্প

সর্বাধিক পঠিত