পরিশেষে

পরিশেষে
বিচ্ছেদটা তুমি সত্যি চাইছো? চাকরি যে এখনো পেলে না! আমার বয়স তো থেমে নেই। বাড়ি থেকে চাপ দিচ্ছে ভীষণ। আর কটা দিন সময় দেওয়া যায় না? কটা দিন করতে করতে বছর পেরিয়ে গেলো যে! শম্ভুর মনের কথাগুলো নিখোঁজ। সে দীর্ঘশ্বাস ফেলে শর্মিষ্ঠার সাথে পা মিলিয়ে হাঁটতে লাগলো। ফাঁকা রাস্তা। মাঝে মাঝে দু একটা রিক্সা টিংটিঙে হর্ণ বাজিয়ে চলে যাচ্ছে। গাছ থেকে মড়মড় শব্দে শুকনো পাতা ঝরে পরছে। শীতের আমেজ আছে চারিদিকে। শর্মিষ্ঠার গায়ে পাতলা চাদর। কোনো উপায় কি নেই শর্মি?
আছে কি? থাকলে তুমি কেনো বলছো না? শম্ভু মাথা নাড়লো। মুখে ফ্যাকাসে হাসি। উপায় বিহীন কোনো সমাধানের দেখা যদি মিলতো! কত ভালো হতো শর্মি তাই না? উপায় আর সমাধান কি সমার্থক শব্দ নয়? শম্ভু আবারো হাসলো। হ্যাঁ বোধক অর্থে মাথা ঝাঁকালো। সেক্ষেত্রে, উপায় বিহীন সমাধান বলে কি আদৌ কিছু আছে? জানি না। শুধু মন বলছে, শেষটা আমি এমন চাই নি। প্রতিটি গল্পের শেষ সবাই নিজেদের মত করে চায়। যে গল্পের শেষটা বয়ে আনে সুখের ঢল। ঠিক বলেছো। কিন্তু শেষটা নির্ধারণ করে ভাগ্য। হুম। শর্মি? বলো। আইসক্রিম খাবে? শর্মিষ্ঠা অবাক চোখে শম্ভুর দিকে তাঁকালো। আইস্ক্রিম তার পচ্ছন্দ। অথচ সে চাইলেই খেতে পারে না। অল্পতেই ঠান্ডা লেগে যায় কিনা! কাশতে কাশতে দম যেনো গলায় আটকে যায়। শম্ভুর এসব অজানা নয়।
প্রেম করার দিনগুলোতে, দশ টাকার বাদাম টানা অথবা পাঁচ টাকার ঝালমুড়িতে শম্ভুর আপত্তি ছিলো না। কিন্তু আইস্ক্রিম খেতে চাইলে কানে তুলো দিয়ে থাকতো। যেনো শর্মিষ্ঠার আবদার শুনতেই পায় নি! সেই মানুষটা আজ বলছে আইস্ক্রিম খাবে কিনা? শর্মিষ্ঠার চোখজোড়া ভিজে উঠলো। শাড়ির আঁচলের কোণা দিয়ে যত্ন করে সে চোখ মুছলো। বলল, খাবো। চলো তাহলে এগোই। রাস্তার পাশে আইস্ক্রিম নিয়ে বসে আছে মধ্যবয়স্ক একজন লোক। হাতে ঘন্টা। হাত নেড়ে নেড়ে ঘন্টা বাজিয়ে তিনি হাঁক ছাড়ছেন। ‘আইসক্রিম খাবেন? আইস্ক্রিম!’ শম্ভু শর্মিষ্ঠাকে শুধালো, কোনটা খাবে? কুলফি। দাদা, দুটো কুলফি দিয়েন। বরফের মাঝ থেকে কুলফি বের করে দেওয়া হলো। শম্ভু পকেট থেকে ময়লা একটি দশ টাকার নোট বের করে এগিয়ে দিলো।
শর্মিষ্ঠা আইসক্রিমের গায়ে ওষ্ঠজোড়া গোল করে স্পর্শ করলো। আরামে তার চোখ বন্ধ হয়ে এসেছে। এ যেনো স্বর্গের এক টুকরো মিঠাই! শম্ভু আঁড়চোখে তাঁকিয়ে দেখছে। সব দেখছে। এত সুন্দর দৃশ্য সেকি আর দেখতে পাবে?
এই শঙ্কার মেঘ তার আগমনী বার্তার জানান আগেভাগে দেয় নি। দিলে হয়তো, প্রতিবার দেখা করার সময় শর্মিষ্ঠাকে কুলফি খেতে দিতো শম্ভু। আজ শঙ্কার মেঘ কত পুরোনো কথার বৃষ্টি ঝরিয়ে চলেছে! এই পথ তাদের গল্পের চাটাই। তাদের প্রেমের শুরুটা পাঁচ টাকার ঝালমুড়ি কিনতে গিয়েই হয়েছিলো। ওই যে! গাউছিয়ার ভীড়ে পকেট মারের কবল থেকে শম্ভুর মানিব্যাগটার শেষ রক্ষা হলো না। তা আবিষ্কার করা গেলো, ঝালমুড়ির ঠোঙ্গা হাতে নেওয়ার পরে। সে যাত্রায় শর্মিষ্ঠা বাঁচিয়ে দিয়েছিলো। তবে তার ঠোঁটের কোণে লেপ্টে থাকা মুচকি হাসি শম্ভুর প্রাণটা যে দুমড়ে মুচড়ে দিয়েছে! পরে আর কি? টাকা ফিরিয়ে দেবার নাম করে আবার দেখা। বন্ধুত্বের নাম করে আবার দেখা। বারবার দেখা! দেখতে দেখতে বন্ধুত্ব থেকে প্রেম। রইলো বাকি পরিণয়! সে যেনো আর হবার নয়।
চাকরির বাজারে চলছে ব্যাপক রেইস। শুধু একাডেমিক সার্টিফিকেটের মূল্য এখানে নেই। সাথে মামা অথবা চাচার সার্টিফিকেটও লাগছে। এই সার্টিফিকেট আবার একাডেমিক নয়। এ সার্টিফিকেট অন্য সার্টিফিকেট। এছাড়াও মোটা অংকের টাকার বান্ডেল যদি টেবিলে ফেলা হয়, তবে চাকরি আর আটকায় কে? শম্ভুর শুধুমাত্র একাডেমিক সার্টিফিকেট টাই আছে। মামা, চাচার কাজ নেই। আর টাকা? সে তো টিউশনি করে নিজের হাত খরচটা চালিয়ে নেয়! নচেৎ কবে অঞ্জন দত্তের ‘বেলাবোস’ গানটার লিরিক সে পালটে ফেলতো! চাকরিটা আমি পেয়ে গেছি শর্মি শুনছো? এখন আর কেউ আটকাতে পারবে না! সন্ধ্যে নেমে আসছে। শর্মিষ্ঠা ক্লান্ত চোখে শম্ভুর দিকে তাঁকালো। নরম গলায় বলল, ভালো থেকো? বলছো থাকতে? আমার জন্য থাকতে চেষ্টা করো? শম্ভু স্বভাবসুলভ হাসলো। আসছি। এসো।
শর্মিষ্ঠা চলে যাচ্ছে। দূরের কোন এক মসজিদ থেকে আজানের সুর ভেসে আসছে। রাস্তার পাশেই হিন্দু বাড়ি। ঘন্টা বাজাচ্ছে। ধূপ জ্বালিয়েছে। গন্ধে ম ম করছে চারিদিক। শম্ভু উল্টো পথে ঘুরে দাঁড়ালো। শর্মিষ্ঠার পায়ের নুপূরের শব্দ এখন আর শোনা যাচ্ছে না। তবুও শম্ভু মাঝ রাস্তায় দাঁড়িয়ে আছে। সন্ধ্যার এই আফিং মেশানো বাতাস গায়ে মাখতে তার ভালো লাগছে। সে বুক ভরে শ্বাস নিচ্ছে! হঠাৎ নুপূরের শব্দ পুনরায় তার কানে বেজে উঠলো। ক্ষীণ শব্দ ধীরে ধীরে গভীর হচ্ছে। শম্ভু কৌতুহলী চোখে পেছোন ফিরে তাঁকালো। দেখলো, ধূপের ধোঁয়ার মাঝ দিয়ে শর্মিষ্ঠা ফিরে আসছে। আবছা অন্ধকারেও শম্ভু বুঝতে পারলো মেয়েটির চোখ ভিজে। তার এই ফিরে আসার মাঝে ফিরে যাওয়াটুকু নেই!
গল্পের বিষয়:
গল্প
DMCA.com Protection Status
loading...

Share This Post

সর্বাধিক পঠিত