কালো মলাটের ডায়েরি

কালো মলাটের ডায়েরি
“যাক বাবা! অবশেষে পৌঁছাতে পারলাম!” হাঁফ ছেড়ে বলল রূপন্তী। সে বড় হয়েছে ছোট একটা শহরের অনাথ আশ্রমে, আজ পড়ালেখার জন্য তাকে পা দিতে হয়েছে এই বড় শহরটাতে। লোহার গেটটা পার হয়ে কিছু আনুষ্ঠানিক কাজকর্ম শেষে ঠিক ১০টা ২৯ মিনিটে হোস্টেলের তিনতলার শেষমাথার রুমটায় পা দিল রূপন্তী। ঠিক তখনই দক্ষিণ দিক থেকে পুরো করিডর জুড়ে এক ঝড়ো বাতাস বয়ে গেল।
আচ্ছা, মানুষের চোখের রঙ কি কখনো বদলে যেতে পারে? আয়নার দিকে তাকিয়ে ভাবছিল রূপন্তী। এই হোস্টেলে সে উঠেছে গত ১৩ই অক্টোবর; আজ মাত্র চার দিন হলো। এই কদিনেই নিজের চোখের রঙে অদ্ভুত পরিবর্তন লক্ষ্য করছে সে। গাঢ় বাদামি রঙের চোখের মণি আস্তে আস্তে নীল হয়ে যাচ্ছে। আরেকটা ব্যাপারও আছে, ইদানীং সে সবকিছু ভুলে যাচ্ছে। এমনকি আশ্রমের যে ফোন নম্বরটা ছোটবেলা থেকেই তার ঠোঁটস্থ, সেই নম্বরেরও শেষ তিনটা ডিজিট মনে পড়ছে না। রূপন্তী ভীষণ অবাক হয়। এদিকে আসার পর কী এমন হলো! হঠাৎ করেই ঘরে রূপন্তীর রুমমেট মোনা এসে ঢুকল।
– “কী ব্যাপার রূপন্তী? ভার্সিটিতে গেলে না?”
– “আজ শরীরটা তেমন ভালো লাগছিল না।”
“ও” বলে মোনা আবার নিজের কাজে মন দিল। এই মেয়েটা কেমন যেন, কোনোকিছুতেই তার কৌতূহল নেই। রূপন্তীর অতটা ভালো লাগে না মোনাকে। তাই রুমমেট হয়েও খুব একটা কথা হয় না তাদের, যে যে যার যার মতো থাকে। তিনদিন পর হঠাৎ মোনা বলল,
“রূপন্তী, আমার বিয়ে ঠিক হয়ে গেছে। আমি এখান থেকে চলে যাচ্ছি।”
“রূপন্তী কে?”
“সে কী! তুমিই তো রূপন্তী। ঠাট্টা করছ তাই না?”
“আমি অর্ষা।”
“কিন্তু শুরুতেই যে তোমার নাম রূপন্তী বলেছিলে?”
“নাহ, আমি অর্ষাই।”
“ও” বলে আবার নিজের চিন্তাতে মগ্ন হয়ে গেল মোনা। সে যদি এতটা উদাসীন না হতো তাহলে হয়তো খেয়াল করত রূপন্তীর চোখ দুটো গাঢ় বাদামি থেকে বদলে গিয়ে পুরো নীল রঙ ধারণ করেছে। সে যদি আরো কৌতূহলী হয়ে অনেকটা খোঁজখবর করত তাহলে হয়তো জানতে পারত, সাত বছর আগে ১৩ই অক্টোবর রাত ১০টা ২৮ মিনিটে এই রুম থেকে অর্ষা নামের একটা অনাথ মেয়ে হঠাৎ করেই উধাও হয়ে গিয়েছিল, যার চেহারা ছিল অনেকটা রূপন্তীর মতো, শুধু চোখজোড়া ছিল আকাশের মতো নীল।
পরদিন সকালেই মোনা হোস্টেল ছেড়ে চলে গেল। ফাঁকা রুমে অর্ষা একা। এবার কাজ শুরু করে দেয়া যায়। কিছু একটা খোঁজা শুরু করল সে। টেবিলের তলায়, আলমারিতে, কোথাও বাদ রাখল না খোঁজ। রাত হতে হতেই তছনছ করে ফেলল পুরো ঘর। কিন্তু না, যা খুঁজছে তা পেল না সে। বেরিয়ে গেল ঘর থেকে। সোজা হাঁটতে শুরু করল দক্ষিণে, সুপারিন্টেনডেন্ট ম্যামের ঘরের দিকে। ঠকঠক করে দরজায় টোকা পড়ল। দরজা খুলেই ম্যাম অবাক হয়ে বললেন,
“কী হলো রূপন্তী? এত রাতে বাইরে কী করছ?”
“রূপন্তী নই, আমি অর্ষা।”
“কী বললে? রাতবিরেতে ঠাট্টা করছ?
গত ছয় বছরে এখানে কেউ নিয়ম ভাঙতে পারেনি এইটুকু বলতে বলতে অর্ষার চোখের দিকে তাকালেন ম্যাম। তাকিয়ে যেন পাথরের মতো জমে গেলেন। ওই দৃষ্টিতে কিছু একটা ছিল, অস্বাভাবিক কিছু, যে কারোই দম আটকে আসবে তাকালে। ম্যাম আর দাঁড়িয়ে থাকতে পারলেন না, ধপাস করে পড়ে গেলেন মেঝেতে। ম্যামকে ডিঙিয়ে ঘরে ঢুকেই অর্ষা আবার খোঁজ শুরু করল। কিছুক্ষণের মাঝেই ম্যামের ঘরটাও তছনছ হয়ে গেল। এবার শুধু আলমারিটা বাকি। আলমারির সব তাক, ড্রয়ার খুঁজতে খুঁজতে অবশেষে অর্ষা একটা ড্রয়ার পেল, পুরনো কাগজপত্রে ভর্তি। এবার আর বেশিক্ষণ লাগল না, সেই ড্রয়ারেই অর্ষা পেয়ে গেল তার সেই কাঙ্ক্ষিত জিনিসটি; কালো মলাটে মোড়ানো একটা ডায়েরি।
সাত বছর আগে যখন অর্ষা উধাও হয়ে গিয়েছিল তখন তার টেবিল থেকে এই ডায়েরিটা উদ্ধার করা হয়েছিল। সেসময়ের সুপারিন্টেনডেন্ট ভেবেছিলেন, এটা থেকে হয়তো অর্ষার হারিয়ে যাওয়ার কোনো কারণ খুঁজে পাওয়া যেতে পারে। ডায়েরির প্রথমদিকে খুব স্বাভাবিক কিছু দিনলিপিই ছিল, কিন্তু শেষদিকে, বিশেষ করে শেষের এক মাসের লেখাতে ছিল অনেকখানি অস্বাভাবিকতা। পুরো লেখাজুড়েই ছিল একটা আয়নার কথা। অস্বাভাবিকতার শুরুটা ছিল ১৫ সেপ্টেম্বরের নোটটা থেকে। সেদিনের লেখাটা ছিল এমন – “আজ সন্ধ্যায় রাস্তায় একটা আয়না কুড়িয়ে পেয়েছি। রাস্তার কোনকিছু কখনো আমি তুলে নিই না, কিন্তু আজ কেন যেন আয়নাটা তুলে নিলাম। ছোট ষড়ভুজ আয়নাটা ভীষণ সুন্দর। আশ্চর্যের বিষয় হলো, আয়নাটাতে কোনো প্রতিচ্ছবি দেখা যায় না।” ২৯ সেপ্টেম্বরের নোটেও যথারীতি আয়না নিয়েই লেখা ছিল- “আয়নাটা বড্ড অদ্ভুত। রাত হলেই যেন একটা অশুভ আলো ঠিকরে বেরোতে থাকে। আয়নাটার একটা কোণে কেমন সাদাটে দাগ। সম্ভবত ওখান থেকেই আলোটা বেরিয়ে পুরো আয়নাতে ছড়িয়ে পড়ে।”
যেদিন অর্ষা উধাও হয়েছিল সেদিনেরও একটা নোট পাওয়া গিয়েছিল। লেখা ছিল, “আয়নাটা আজকাল আমাকে ডাকে। কিন্তু আমি যেতে চাই না। আর অপেক্ষা নয়, আজ, এক্ষুণি আমি এই অশুভ আয়নাটাকে ভেঙে ফেল- শেষ শব্দটা হয়তো ‘ফেলব’ হতো, কিন্তু ডায়েরিতে এই শব্দটাও শেষ করে যেতে পারেনি অর্ষা। তার আগেই অশুভ কোনকিছু তাকে টেনে নিয়েছিল। সেদিন সুপারিন্টেনডেন্ট এই অশুভ আয়নাটা অর্ষার পুরো ঘরজুড়ে তন্ন তন্ন করে খুঁজেছিলেন। কিন্তু সেখানে তিনি কোনো আয়না পাননি। প্রাণভয়ে তিনিসহ আরো কয়েকজনই চাকরি ছেড়ে দিয়েছিলেন, আর সারা হোস্টেলে ছড়িয়ে দেয়া হয়েছিল যে অর্ষা কারো সাথে পালিয়ে গেছে। আগের সুপারিন্টেনডেন্ট পুরনো কাগজপত্রের সাথে একটা ড্রয়ারে অর্ষার ডায়েরিটা রেখেছিলেন, ভেবেছিলেন যাওয়ার আগে পুড়িয়ে দেবেন। কিন্তু কোনো এক আশ্চর্য কারণে সেই ড্রয়ারটা তিনি আর খুলতে পারেননি। নতুন সুপারিন্টেনডেন্টও আসার পর ড্রয়ারটা খোলার অনেক চেষ্টা করেছিলেন, সব চেষ্টা বিফলেই গিয়েছিল।
কালো মলাটের ডায়েরিটা হাতে পেয়েই অর্ষার পৈশাচিক আনন্দ হয়। এবার আর কোনো ভুল করবে না সে। বাঁ হাতের তর্জনীটাকে সেই সাদাটে চিহ্নটায় আর কিছুতেই লাগতে দেবে না। খুব সাবধানে মলাটের আড়ালে লুকানো একটা পকেট থেকে একটা ছোট্ট ষড়ভুজাকৃতি আয়না বের করল অর্ষা। না, কোনো ভুল হয়নি। শেষবারের মতো সুপারিন্টেনডেন্ট এর ঘর থেকে এক গা শিরশিরে অট্টহাসি শোনা যায়। সকালবেলা সূর্যের আলো মুখে পড়তেই রূপন্তী চোখ মেলে তাকায়। সুপারিন্টেনডেন্ট ম্যামের ঘরে নিজেকে আবিষ্কার করে সে। আর তার পাশেই দেখতে পায় একটা ভাঙা আয়না। ভাঙা আয়নার প্রতিচ্ছবিতে তার গাঢ় বাদামি চোখ দুটো বড়ই রহস্যময় লাগছে।
গল্পের বিষয়:
গল্প
DMCA.com Protection Status
loading...

Share This Post

সর্বাধিক পঠিত