চৈত্র মাসের প্রখর রোদ। তারওপর ইট পাথরের শহরে জ্যামে আটকা পড়া মানে অনাকাঙ্ক্ষিত অথিতির আগমন।গাড়িতে এসি থাকায় পারুর তেমন কষ্ট হচ্ছে না। তার বেশ ভালোই লাগছে। সে তৃপ্তি নিয়ে বাহিরের পরিবেশ দেখছে। সবাই কেমন ছুটাছুটি করছে। শহরের সাথে সাথে মানুষ গুলোও গরম হয়ে আছে। চুল দাড়ি পাকা একজন খুব শোরগোল করছেন। তার পায়ের উপর একজন পা দিয়ে পাড়া দিয়েছে। এই সূত্রে চাচা মিয়া আয়োজন নিয়ে জগড়ায় নেমে গেলেন। জগড়ায় শেষ পর্যায়ে বড় বড় শ্বাস ফেলে কী জানি বলছেন। পারু শুনতে পাচ্ছে না। সম্ভবত তার প্রেশার বেড়ে গেছে এই কথা বলছেন। এটা সম্পূর্ণ অনুমান করে বলছে। তার বাবাও জগড়ার শেষপর্যায়ে এমন করতেন। ঘন ঘন শ্বাস নিতে নিতে বলেন, ‘আমার প্রেশার বেড়ে গেছে। আমার প্রেশার বেড়ে গেছে।’
জ্যাম ছুটার নাম নিচ্ছে না। ক্রমে ক্রমে বেড়ে চলেছে। কখন ছুটে কে জানে? পারুর সন্ধানী চোখ পড়ল এক যুবকের ওপর। সে ফুটপাতে বসে আরাম করে বাদাম খাচ্ছে। এই গ্যাঞ্জাম পূর্ন পরিবেশের সাথে তার যেন কোন মিল নেই। গরমের দুপুরে আইসক্রিম চলে। সেখানে এই ছেলে বাদাম খাচ্ছে। এই চিত্র দেখে যে কারোরই অবাক হওয়ার কথা। উত্তপ্ত ফুটফাতে এমন দৃশ্য দেখলে যে কেউ পলক হীন বিস্মিত চোখে কয়েক সেকেন্ড তাকিয়ে থাকবে। তাদের মধ্যে একদল মনে মনে বলবে, ‘সমাজটা বখে গেছে। আজকাল কার অতি পন্ডিত ছেলেরা যা কিছু করতে পারে। এদের উপর ভরসা নাই।’
পারু কাউকে পর্যবেক্ষণ করা শুরু করলে প্রথমে পা থেকে শুরু করে। এটা খুব ছোট বেলার অভ্যাস। ছোট বেলায় সকাল অথবা সন্ধ্যা একবেলা সবাইকে পা ছুয়ে সালাম করতে হতো। অতিথি আসলে বাড়তি ভদ্রতা। সালামের সময় ধীরে স্থিরে এই মহা মূল্যবান পা থেকেই পর্যবেক্ষণ শুরু হত। আজ তার ব্যতিক্রম হল। নিয়ম ভঙ্গের জন্য দুটি প্রধান কারণ দাঁড় করা যেতে পারে। প্রথমত ছেলেটার বাদাম খাওয়ার দিকে প্রথমে নজর পড়েছে। সেহেতু সেখান থেকেই শুরু করা উচিত। দ্বিতীয়ত এই বিচিত্র চরিত্রের একজন কাছের মানুষ আছে। মানুষটি চিহ্নিত করতে হলে মুখ দেখতে হবে। পা থেকে শুরু করলে অনেক সময় লাগবে। এতো দৈর্য পারুর নেই। পরে ছেলেটি যদি চলে যায়! তখন?
ছেলেটির চুল অনেক লম্বা। গোফ দাড়িতে মুখ ভরে আছে। সম্ভবত চুলের সাথে মাপ রেখে এমন করা হয়েছে। চুল দাড়ি সমানই লাগছে। দাড়িতে অল্প কিছু বাদামের খোসা লেগে আছে। চোখটা পরিস্কার দেখা যাচ্ছে না। একটা কালো গর্ত মনে হচ্ছে। রোদের জন্য চোখ দেখা হলো না। নাকটা লম্বা। ফর্সা মুখ রোদে লাল হয়ে আছে। এই ছেলের রোদে পোড়ার অভিজ্ঞতা আছে। মুখে রোদে পোড়া দাগ তার জানান দিচ্ছে। গায়ে কালো পাঞ্জাবি। কালো হলেও সাদা রঙের রাজত্ব। সাদা দাগ গুলো ভেসে আছে। দেখতে বিশ্রী লাগছে। অনেক দিন না ধোয়ার ফল এটা । তবে এই বেশে তাকে মানিয়েছে। পারু এই পর্যন্ত এসে থামল। কোথাও জানি গন্ডগোল আছে। দাড়ি বাঁধা হয়ে আছে। পারু তাড়াতাড়ি করে মুখের উপর স্থির করে চোখ রাখল । যেন পৃথিবীর কোন এক প্রান্ত থেকে টেলিস্কোপ এর সাহায্যে পরিচিত নক্ষত্রের সন্ধান করছে।
ছেলেটির চেহারা ঝাপসা ঝাপসা লাগছে। পারুর চোখ ভর্তি নোনাজল নিজস্ব পথে গাল বেয়ে নামছে। জল মুছে আবার তাকালো ছেলেটার দিকে। এখন সম্পূর্ণ চেহারা চোখে ভাসছে। এই পবিত্র চেহারা দেখার জন্য পারুর চোখ যুগল অশ্রু নদীতে স্নান করল। পারুর অনিয়ন্ত্রিত মন বার বার বলছে, ‘প্রীতম। এ তো প্রীতম।’ পারু কাঠের ব্রেঞ্চের উপর বসে আছে। অপেক্ষা করছে প্রীতমের। দুপুর দু’টায় আশার কথা এখন সাড়ে চার’টা বাজে। এই সময়ে কিছুক্ষণ পর পর প্রীতমকে ফোন দিয়েছে। যদিও সে ধরবে না । কথা বলার জন্য শখ করে ফোন দিয়েছিল। কথা আর হয় না। সে ফোন দিলে ধরবে না। কারণ জিজ্ঞেস করলে বলে, ‘ফোন আসলে তোমার এই চঞ্চল চিন্তাযুক্ত মুখ চোখে ভাসে। অল্প আবেগের জন্য এই মিষ্টি প্রতিবিম্ব হারাতে মন সায় দেয় না। ‘
পারুর এই কথা গুলো যখন শুনে তখন সব ক্লান্তি অভিমান নিমিষেই শেষ হয়ে যায়। প্রীতমের পক্ষ থেকে নিশ্চিত কিছু আশা করা যায় না। সে হঠাৎ ফোন করে হঠাৎ দেখা করে। কোনদিন অল্প তো কোনদিন অনেক সময়। এ নিয়ে পারু সব সময় আতঙ্কের মাঝে থাকে। কখন ফোন দেয় কে জানে। একবারের সময় না ধরলে কয়েক সপ্তাহের জন্য নিখোঁজ হয়ে যায়। যেসব রাত জেগে ফোনের জন্য অপেক্ষা করে সেসব রাতে ফোনের দেখা নেই। হঠাৎ কোন এক আগন্তুক সময়ে ফোন আসে। ফোনটা রাতে হলে ঘুম ঘুম কণ্ঠে বলবে’ ‘হ্যালো।’ প্রতি উত্তরে আসবে শুধু একটা নিঃশ্বাসের শব্দ। তাতেই কাজ হয়ে যায়। পারুর মরা ঘুম উবে যায়। সে তখন বলে, ‘আরেকবার করো না।’ প্রীতম খালি পায়ে হেঁটে হেঁটে আসছে। গায়ে পাঞ্জাবী। হাতে কাগজের টোঙ্গা। সেখান থেকে একটা একটা করে বাদাম মুখে দিচ্ছে। তার হাঁটার মধ্যে কোন উদ্বিগ্নতা নেই। পারুর কাছে এসে বলল, ‘নাও বাদাম খাও।’ পারু মাথা নিচু করে হাতে উপর ভর দিয়ে বসে ছিল। পরিচিত কন্ঠ শুনে চোখে খুলল। প্রথমে চোখ গেল পায়ের উপর। পারু দাঁড়িয়ে বলল, ‘তোমার জুতা কই?’ প্রীতম ব্রেঞ্চে বসল। পারুর হাত ধরে তার পাশে বসিয়ে বলল, ‘রাস্তার পাশে রেখে এসেছি?’
‘কেন? জুতা রাস্তায় রাখার জায়গা?’
‘ঘাসের উপর জুতা পরে কেউ হাটে না-কি? কেমন উসখুস উসখুস করে। ঘাসের উপর হাঁটতে হয় খালি পায়ে।’
‘জুতাটা যদি কেউ নিয়ে নেয় তখন? এতক্ষণে তো নিয়েই গেছে।’
‘নিলে নিক। জুতাটা নতুন আছে । বেশ কয়দিন পরতে পারবে।’
পারুর কিছু কুৎসিত শব্দ ব্যবহার করতে ইচ্ছে করছে। বিশ্রী কিছু শব্দ। যাকে সমাজ গালি বলে সম্মোদন করে।এই মানুষটার জন্য আলাদা একটা ভাষা থাকলে ভালো হত। বাংলা বাসায় তার বর্ণনা করা তার পক্ষে সম্ভব না। প্রীতম বলল, ‘চল হাঁটি।’ পারু বিনা বাক্যে উঠে দাঁড়ালো। প্রীতম বলল, ‘জুতাটা খুলে ফেল। পারু একপ্রকার বাদ্য হয়ে জুতা খুলল। আশেপাশে ভালো করে চেয়ে দেখল তাদের এই অদ্ভুত কান্ড কেউ দেখছে কি না। পারু খালি পায়ে হাঁটছে। কিছু সময়ের ব্যাবধানে এক শুদ্ধ অনুভূতি তার ভিতর প্রবেশ করলো। অনুভূতি গুলো কতো নির্মল। নিঃসন্দেহে তার জীবনে এ যাবৎ কালের শ্রেষ্ঠ অনুভূতি।
ভোরের সময় পাঁচটা বেজে পঁয়ত্রিশ মিনিট। পারুর চোখ জোড়া লাল হয়ে আছে। সারা রাত ফোন দিবে দিবে করে দেওয়া হয়নি। এখন মোবাইল হাতে নিয়ে দেখে ভোর হয়ে গেছে। কিছুক্ষণের মধ্যেই সূর্যের আলো অন্ধকার মুক্ত করবে। বাহিরের অন্ধকার মুক্ত হলেও তার মন অনির্দিষ্টকালের জন্য অন্ধকারে ডুব দিয়েছে। প্রীতমের কাছে ফোন দিল। প্রীতম বলল, ‘সুপ্রভাত! পানির দেশের খামখেয়ালি।’ পারু কিছু বলল না। বলার জন্য কিছু কথা ঠিক করে রেখেছিল। সব এলোমেলো হয়ে গেছে। প্রীতম বলল, ‘কিছু বলছো না যে?’পারু বলল, ‘বাবা বিয়ে ঠিক করেছেন। আজকে গায়ে হলুদ।’
‘সব ঠিক হয়ে গেছে?’
‘হ্যাঁ। ‘
প্রীতমের নড়াচড়া হীন ভঙ্গিতে বসে আছে। নিজেকে সামলে নিয়ে বলল,’আমাদের শেষটা অসুন্দর।’
‘হ্যাঁ।’
‘তুমি কখনো কাঁদবে না।
‘না আমি কাঁদছি না। কাঁদার কী আছে?’
‘তোমার হাসির শব্দ শুনতে ইচ্ছে হচ্ছে। কিন্তু তুমি কাঁন্না করছো।’
ওপাশ থেকে কাঁন্নার তীব্র আওয়াজ শুনা যাচ্ছে। কাঁন্নার সাথে পাল্লা দিয়ে ব্যাথাটাও তীব্র হচ্ছে। প্রীতম বলল, ‘তুমি নিশ্চিন্ত থাক। আমার জীবনে তোমার অবস্থান ছিল আছে এবং থাকবে। আমি নিঃশেষ হলে পারু কাঁদতে কাঁদতে বলল, ‘জানি।’ ‘ বলো ভালোবাসি।’ পারু শব্দ করে কাঁদছে।সে এক বিরামহীন কাঁন্না করছে।পারুর মা দরজায় টোকা দিচ্ছেন। প্রীতম রাস্তার একপাশে দাঁড়িয়ে আছে। সে পারুর বিদায় অনুষ্ঠান দেখছে। পারু কাঁদছে। সে পারুর কাঁন্না উপর অভ্যস্ত। তবে আজকের কাঁন্না ভিন্ন। এই কাঁন্না তার উপর শুলের ন্যায় আগাত করছে। সমস্ত বুক জুড়ে কেমন একটা অস্তিরতা। তার সাথে কিছু একটা দলা পেকে আছে। অসীম কিছু যার শেষ নেই।
পারুর চোখ এদিক ওদিক দেখছে। কোথাও প্রিয়র দেখা মিলে কি না! রাস্তার পাশে প্রীতমের ছায়া দেখতে পেল। এই প্রথম তার চোখে পানি দেখছে। সাত বছরের প্রেমে চোখ মরুভূমি ছিল। চোখা চোখি হতেই প্রীতম নিজেকে সামলে নিল। তার দিকে তাকিয়ে হাসলো। পারু প্রীতমের দিকে তাকিয়ে দরজা দাক্কাচ্ছে।দরজা দিয়ে বাইরে বের হওয়ার চেষ্টা করছে। পাঁচ বছর বয়সি অরূ তার মায়ের সাদা শাড়ির আঁচল টেনে বলল, ‘মা গাড়ি চলছে। নামলে ব্যথা পাবে তো।’
গল্পের বিষয়:
গল্প