রান্নাঘরের থালাবাসন গুলো ধুয়ে আরশি ঘরে আসলো।থালাবাসন বলতেও তেমন কিছু নেই।ঘরে ওরা দু’জন মানুষ।আরশি আর উৎস।আজ এক মাস হয়েছে ওরা এই নতুন বাসাটায় উঠেছে।উৎসর একটু গ্রামের দিকে বদলি হওয়ায় এখানে আসা।দোতালা বাড়িটার দু’টো রুম আরশিরা নিয়েছে।আরশিকে নিয়ে বাড়িতে প্রথম ঢুকেই উৎস যে কথা বলেছিল তা হলো,”আরশি তোমার জন্য এবার দক্ষিণী জানালার ঘর নিয়েছি।জানালা দিয়ে নদী দেখা যায়।সবসময় বাতাস পাবা।বাতাসে তোমার চুলগুলো উড়বে।” শেষ লাইনটা বলে উৎস বোধহয় একটু লজ্জা পেয়েছিল।তারপর দ্রুত বললো,”আচ্ছা চলো ভিতরে যাই।সব কিছু গুছোতে হবে তো।” উৎস আরশির জন্য দক্ষিণী জানালার ঘর নিলেও আরশি এই এক মাসে জানালাটা ভুলেও খোলে নি।ঘরের সুকেসটা জানালার সামনে রেখে দিয়েছে,যাতে জানালা না খোলা যায়।উৎস কিছু বলতে চেয়েও বলে নি।মানুষটা আরশিকে তেমন কিছুই বলে না।
বছর পাঁচেক আগের কথা,আরশি ওর বান্ধবীর বোনের বিয়েতে গিয়েছিল।পরনে সেদিন নীল রঙের একটা শাড়ি ছিল তার।বান্ধবীরা সহ বসে গল্প করছিল।এমন সময় চোখ গেলো একটা ছেলের উপর।ছেলেটা একটা চেয়ারে বসে বই পড়ছে।আরশি একটু উঁকি দিয়ে দেখার চেষ্টা করলো কি বই পড়ছেন তিনি।কিন্তু তা পারলো না।বান্ধবীরা ছেলেটাকে দেখেই টিটকারি মারা শুরু করলো।একজন তো বলেই ফেললো,”আজকাল মানুষ বিয়ে বাড়িতেও পড়তে আসে।তা কি পড়ছেন?বায়োলজি?” সবাই উচ্চশব্দে হেসে উঠেছিল।কিন্তু আরশির সেদিন মনে হয়েছিল লোকটাকে ওভাবে বলা উচিত হয় নি।
উৎস দুপুরের খাবার খেতে এসেছে।ঘরে ঢুকেই আরশিকে বললো,”দেখো আরশি তোমার জন্য কি এনেছি।গরম গরম জিলিপি। একটা দোকান ভরদুপুরে জিলিপি ভাজছিল।কি জানি অর্ডার আছে ওদের।তুমি তো জিলিপি পছন্দ করো,তাই নিয়ে এলাম।একটা মুখে দিয়ে দেখো তো।স্বাদ কেমন।” “পরে খাবো।রেখে দিন।হাত মুখ ধুয়ে আসুন আমি খেতে দিচ্ছি”,একথা বলেই আরশি রান্নাঘরের দিকে পা বাড়ালো। উৎসের প্লেটে ভাত আর রুই মাছের ঝোল তুলে দিলো।উৎস বললো,”তুমি খাবে না আরশি?তুমিও নাও।একসাথে খাই।” “আমি পরে খাবো।আপনি খান”,এ কথা বলে আরশি উঠে যেতেই উৎস আবার বললো,”আরশি একটু আমার কপালে হাত দিয়ে দেখো তো জ্বর এসেছে কি না।শরীরটা কেমন জানি লাগছে।” আরশি জানে উৎসর কিছুই হয় নি।তবুও অনিচ্ছা স্বত্ত্বেও কপালে হাত দিয়ে দেখলো।তারপর বললো,”জ্বর নেই।ভাত খান এখন।”
বান্ধবীর বোনের বিয়েতে আরশির যে ছেলেটাকে বই হাতে দেখেছিল তার সাথে আরশির দ্বিতীয়বার দেখা হয়েছিল ওদের কলেজের সামনে।শুধু দ্বিতীয়বার নয় বহুদিন আরশি তাকে ওই জায়গায় দেখেছে। চশমাওয়ালা চার চোখ দিয়ে আরশিকে দেখতো।আরশি যখনি ছেলেটার দিকে তাকাতো তখন সে মাথা নিচু করে উল্টো দিকে হাটা শুরু করতো।আরশির বান্ধবীরা ব্যাপারটার খুব মজা নিলেও আরশির সবসময় মনে হতো, “ইস!ছেলেটা যদি আমাকে সামনে এসে প্রপোজ করতো।” আরশির মনের বাসনা পূরণ হয়েছিল কিছুদিন পরেই।ছেলেটা একটা সাদা গোলাপ নিয়ে আরশির সামনে এসে দাঁড়িয়েছিল।কাঁপা হাতে গোলাপটা আরশির দিকে দিতেই আরশি বললো,”মানুষ সবসময় লাল গোলাপ আনে।আপনার সব উল্টো কেন?বিয়ে বাড়িতে বই পড়েন।মেয়েদের সাদা গোলাপ দেন।” “আমি চাই আমার ভালোবাসা শুভ্রতায় ভরপুর থাকুক।”
সেদিন থেকেই আরশি আর মাঈনের প্রেম শুরু হয়।শুরু হয় একসাথে পথ চলা।যে পথ চলা দীর্ঘ তিন বছর ছিল।
কতশত স্বপ্ন বুনেছিল দু’জনে।তারপর বাসা থেকে যখন হুট করে আরশির বিয়ে ঠিক করলো, বিয়ের রাতেও আরশি শেষবারের মতো মাঈনকে ফোন করে বলেছিল,”মাঈন চলো আমরা পালিয়ে যাই।নাহলে তোমার আরশি অন্যকারো হয়ে যাবে।” “বিয়েটা করে নাও।আমার পক্ষে এখন অন্যকারো ভার নেয়া সম্ভব নয় “,একথা বলে মাঈন সেদিন তার দায়িত্ব শেষ করেছে। আরশির সেদিন মনে হয়েছে,তার ওজনটাকি বড্ড বেশি? আরশির ফোন বাজছে। পুরোনো স্মৃতি থেকে ও বাস্তবে ফিরে এলো।ফোনটা হাতে নিয়ে দেখলো শায়লা কল করেছে।শায়লা ওর পুরোনো বান্ধবী।যেদিন মাঈনের সাথে আরশির প্রথম দেখা হয় সেদিন শায়লার বোনেরই বিয়ে ছিল।আর মাঈন সম্পর্কে শায়লায় খালাতো ভাই হয়। ফোনটা দু’বার বাজার পর আরশি ফোনটা ধরলো।
“মাঈন ভাইয়ের আজ বিয়ে রে।নাফিসা নামের এক মেয়ের সাথে।ওর অফিসের কলিগ।ছয়মাসের প্রেম নাকি।ওরা নাকি আরশির আর কিছু শুনতে ইচ্ছে হলো না।শুধু একটা দীর্ঘশ্বাস বেড়িয়ে এলো।কেবল মনে হলো,একজনের জন্য আরেকজনকে কষ্ট দেয়া উচিত নয়। আজ প্রথমবারের মতো সে নিজে থেকে উৎসকে ফোন করলো।প্রথম রিং এই ফোন রিসিভ হলো। “আজ একটু তাড়াতাড়ি বাসায় আসতে পারবেন?আপনার সাথে ঘুরতে যাবো।আর সোকেসটা অন্য জায়গায় রাখতে হবে।গরম পরেছে।দক্ষিনী বাতাস দরকার।” আরশি কথা গুলো বলে দ্রুত ফোন কেটে দিল।ও জানে উৎস এখন হাওয়ার বেগে চলে আসবে।তারপর ও উৎসকে নিয়ে আবার নতুন করে সবটা সাজাবো।
গল্পের বিষয়:
গল্প