আকস্মাৎ জনসম্মুখে আমার স্ত্রীর চড় খেয়ে আমি হতবম্ভ হয়ে দাঁড়িয়ে আছি। চারপাশের মানুষ আমার আর আমার স্ত্রীর দিকে অবাক নয়নে তাকিয়ে রয়েছে। কেউ বুঝতে পারছে না ঘটনা কী? আমার অফিসের কলিগ আয়েশা আমার স্ত্রীর ভয়ঙ্কর রূপ দেখে আমার থেকে দুরত্ব কিছুটা বাড়িয়ে নিলো।
-আমি সন্দেহ করি নাহ? তো আজকে এই মেয়ের সাথে তোর কী? আর এই মেয়ে তোমার লজ্জা করে নাহ একটি বিবাহিত ছেলের সাথে প্রেম করতে? আমি আর সহ্য করতে পারলাম না। আমিও ঠাস করে একটি চড় বসিয়ে দিলাম মালিহার গালে। একটি মেয়ে যে এতোটা সন্দেহপ্রবণ হতে পারে তা মালিহাকে না দেখলে কেউ বিশ্বাসই করতে পারবে না। মালিহা আমার পাল্টা চড় খেয়ে আগুনের মতো ফুলকি উড়িয়ে হনহন করে চলে গেল। এদিকে রাস্তায় দাঁড়িয়ে থাকা উৎসুক জনতা চারিপাশে গোল হয়ে দাঁড়িয়ে আমাদের সার্কাস দেখছে। আমি আয়েশাকে উদ্দেশ্য করে বললাম,
-চলুন, এখানে দাঁড়িয়ে থেকে আর কাজ নেই। মানসম্মান যা গেছেতো গেছেই। আয়েশা আমার কথামতো চলে গেল।
ঘটনার শুরুটা বিয়ের পর থেকেই বাবা মায়ের পছন্দেই মালিহাকে বিয়ে করি। কিন্তু বিয়ের পর বুঝতে পারি মেয়েটি খুব সন্দেহপ্রবণ। আমার মোবাইলে কোন কল আসলেই প্রথমে মালিহা রিসিভ করবে তারপর যদি পুরুষ কন্ঠ হয় তবে আমাকে দিবে আর যদি মেয়ে কন্ঠ হয় তবে মেয়েটির সাথে নিজে কথা বলে পরিচয় নিশ্চিত হয়ে আমাকে দিবে। প্রথম দিকে বিষয়গুলো আমি আমলে না নিলেও আস্তে আস্তে সন্দেহের মাত্রা তীব্রতর হতে থাকে। আর আজকে যখন অফিসের কলিগ আয়েশাকে নিয়ে বাড়ির দিকে ফিরছিলাম তখনই এই ঘটনা। আয়েশা আর আমার বাসা একই পথে। আমি একটা জিনিস বুঝতে পারছি না যে একটি মেয়ে কতটা সন্দেহপ্রবণ হলে ঘর থেকে বের হয়ে স্বামীকে নজরদারী করতে পারে? বাড়িতে ফিরতেই আমি অবাক! কারণ সমস্ত ঘরে জিনিসপত্র ছড়িয়ে ছিটিয়ে রয়েছে এবং কাঁচের জিনিসগুলো ভাঙ্গা অবস্থায় মেঝেতে পরে রয়েছে। আমি যথেষ্ট সাবধানতা অবলম্বন করে বেডরুমে এগিয়ে দেখি সেখানেও একই অবস্থা, আলমারি পুরো খালি। আমি তৎক্ষনাৎ মালিহাকে কল দিলাম কিন্তু বার বার ব্যস্ত দেখাচ্ছে। তাই আমি শ্বশুরকে কল দিতেই তিনি আমাকে বললেন,
-ছিহ. জামাই তুমি এতোটা খারাপ আমি ভাবতে পারিনি। আমার মেয়ের কোন ভুল থাকলে আমাকে বলতে তাহলেতো আমি ওকে শাসন করে শুধরে দিতাম কিন্তু তুমি আরেকটা মেয়ের সাথে? ছি ছি ছি!
-বাবা বিশ্বাস করুন বিষয়টি তেমন কিছুনা।
-না আমি তোমার কথা কিছুতেই বিশ্বাস করবোনা।
এই বলেই তিনি কলটি কেটে দিলেন। আমি কিছুই ভাবতে পারছি না, মালিহা বিষয়টি ভালোভাবে না জেনেই এরকম করতে পারলো? আমি মালিহাকে অসংখ্যবার বুঝিয়েও বাড়িতে ফেরাতে পারিনি। এর কিছুদিন পরই পার্সেলে আমার নিকট একটি খাম আসে। খাম থেকে কাগজটি খুলতেই আমি হতবিহ্বল হয়ে গেলাম। সামান্য এই কারণে ডিভোর্স? এবার কেন জানি আমার মনটাও রুক্ষ হয়ে গেল। আমি আর একমুহূর্ত দেরী না করে ডিভোর্স লেটারে সই করে দিলাম।
যেই মেয়ে স্বামীকে সামান্য সন্দেহের বশে ডিভোর্স দিতে পারে তার সাথে আর যাই হোক সংসার করা যায়না। মালিহার সাথে বিচ্ছেদের পর একপ্রকার মেয়েদের প্রতি ঘৃণা ও আস্থাহীনতা দুটোই জন্ম নিয়েছিলো আমার মধ্যে। কিন্তু বাবা মায়ের জোরাজুরিতে গ্রামের এক সহজ সরল মেয়ে বর্ণাকে পুনরায় বিয়ে করি। সত্যি বলতে মেয়েটি মালিহার সম্পূর্ণ উল্টো। কখনোই আমাকে আগবাড়িয়ে এমন কিছুই প্রশ্ন করেনি যাতে সন্দেহের অবকাশ থাকে। আমি খুব করে আফসোস করি, যদি প্রথমবার মালিহার স্থলে বর্ণাকে পেতাম তবে আমার নামের সাথে বিচ্ছেদ নামক কলঙ্কটা তৈরি হতোনা হয়তো। দুইবছর পর বর্ণাকে নিয়ে একটি শপিংমলে এসেছিলাম কিছু কেনাকাটার জন্য। হঠাৎই একটি দোকানের দিকে তাকাতেই আমি থমকে গেলাম। হ্যাঁ ঠিকই ভাবছেন সে আর কেউ নয় বরং আমারই প্রাক্তন স্ত্রী মালিহা। মালিহাও কিছুক্ষণ অবাক নয়নে তাকিয়ে রইল আমার দিকে। বর্ণাকে বললাম,
-তুমি কাপড় পছন্দ করতে থাকো।
আমার কথামতো বর্ণা শপিংমলের অন্য দিকটাতে চলে গেল। সামনে তাকাতেই দেখি মালিহা আমার সামনে এসে দাঁড়িয়েছে,
-কে তোমার স্ত্রী?
-হ্যাঁ।
-খুব সুখেই আছো তবে?
-হুম কেন নয়? সে অন্যের মতো এতো সন্দেহ করেনা। কথাটা শুনে কিছুক্ষণ চুপ থেকে মালিহা বললো,
-আমি আসলেই ভুল ছিলাম।
-এই ভুলটা যদি আগে বুঝতে পারতে তবে হয়তো এই পরিস্থিতিতে থাকতে হতোনা। যাই হোক তোমার হাসবেন্ডের কী অবস্থা? মালিহা একটি দীর্ঘশ্বাস ছেড়ে বললো,
-বাবা বিয়ে দিয়েছিলেন এক ব্যবসায়ীর সাথে কিন্তু সে প্রতিদিন রাতে মদ খেয়ে বাড়িতে ফিরতো মেয়েদের সাথে নিয়ে। আমি কিছু বললেই খুব মারধোর করতো। বাবাকে এসব বললেও বাবা বিশ্বাস করতেন না। কারণ তিনি তখন ভেবেই নিয়েছিলেন আমি তোমার ব্যপারে না জেনে যেরকমটা বলেছিলাম ওর ব্যপারেও হয়তো তেমনই করছি। তাই তার সাথেও আর সম্পর্ক বেশিদূর এগোয়নি। বাবাও আর বাড়িতে জায়গা দেননি তাই এই শপিংমলের একজন কর্মচারী হিসেবেই আছি এখন। জানো, আজ খুব করে বুঝতে পারছি যে, দাত থাকতে দাতের মর্যাদা দেইনি বলেই আজ আমার এই অবস্থা। আমি ওর কথাগুলো শুনে খানিকটা চুপ করে রইলাম। তখনি বর্ণা আমাকে ডাক দিলো। আমি ওর ডাক শুনে মালিহাকে বললাম,
-আমার স্ত্রীর মনে হয় কাপড় পছন্দ হয়েছে। আজ তবে আসি।
এই বলেই বিপরীত দিকে ঘুরে আমি হাঁটা ধরলাম। আমি খুব করেই আঁচ করতে পারছি যে মালিহা আমার পথের দিকে চেয়ে দুফোটা অশ্রুজল বিসর্জন দিচ্ছে। এটাই হয়তো কাম্য ছিল। প্রকৃতি কখন কীভাবে যে ভাগ্যের পরিবর্তন করে দেয় তা কখনো বলা যায়না। সন্দেহের বাতিটা যদি একটুখানি নেভাতে পারেন তবে আপনার মতো সুখি কেউ হতে পারবেনা এটা আমার নয় বড় বড় মনীষীদের নীতি। HIV যেমন শরীরের রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা কমিয়ে দিয়ে মৃত্যুর দরজায় আপনাকে দাঁড় করাবে তেমনি সন্দেহ একটি সংসারে বিশ্বাস ও আস্থা কমিয়ে আপনাকে বিচ্ছেদের দরজায় দাঁড় করাবে। এটাই চিরন্তন সত্য। যার প্রমাণ অধিকাংশ বিচ্ছেদের অন্তরালে লুকিয়ে।
গল্পের বিষয়:
গল্প