ঈশানী যখন সাড়ে চার মাসের অন্তঃসত্ত্বা, তখন আমি ওকে বিয়ে করি। কী? শুনে অবাক হচ্ছেন? আসলে আমি ঈশানীর দ্বিতীয় স্বামী। ঈশ্বানীর প্রথম স্বামী হুট করেই ট্রেন এক্সিডেন্টে মারা যান। মেয়েটা সেদিন প্রচন্ড আঘাত পেয়েছিলো। তাছাড়া তার শ্বশুরবাড়ীর লোকেরা রাতারাতি তাদের ছেলের মৃত্যুর জন্য মেয়েটাকে দায়ী করে অপয়া, অলক্ষী বলে নানা কথা শোনাতে শুরু করে ।
তাদের ধারণা, ঈশ্বানী যদি সেদিন ফেরার জন্য জোরজবরদস্তি না করতো, তবে হয়তো তারা তাদের ছেলেটাকে এভাবে হারাতো না। ঈশানীর এ অবস্থা সহ্য করতে না পেরে তার বাবা-মা মেয়েকে তাদের বাড়িতে নিয়ে আসেন। কিন্ত ঈশ্বানী ততোদিনে জানতো না তার গর্ভে আরেকটি প্রাণ বেড়ে উঠছে! বেশ কদিন ধরেই লক্ষ্য করছিলো ঈশ্বানীর মা, মেয়েটা কিছু খেতে পারছে না, হুট করেই মাথা ঘুরিয়ে পড়ে যাচ্ছে। সন্দেহবশত মেয়ের প্রেগনেন্সি টেস্ট করালেন উনি। জানা গেলো, মেয়েটা মা হতে চলেছে!
ঊনিশে বিয়ে হয় ঈশানীর। দু’বছর ছিল সেই সংসার। সে হিসেবে, মেয়েটার বয়স এখনো অনেক কম।দেখতেও কোনো অংশে কম নয়। সুতরাং দ্বিতীয়বার বিয়ে দিতে চাইলে খুব একটা সমস্যা হবে না। কিন্ত ঈশানীর বাবা-মায়ের এসব ভাবনার ব্যবচ্ছেদ ঘটে যখন তারা জানতে পারলেন, মেয়েটা অন্তঃসত্ত্বা! একদিকে মেয়ের বাকী জীবন পড়ে চইছে সে চিন্তায় বেশ বিভোর তার বাবা-মা। তাই ঈশানীকে তার মাতৃত্বের খবর না জানিয়েই দু’জনে সিদ্ধান্ত নেন সময় থাকতেই বাচ্চাটাকে মেরে ফেলতে হবে!
আমি আরফি। পেশায় একটি হাসপাতালের ডাক্তার। সেই সুবাদেই গাইনী বিশেষজ্ঞ নীলা আপুর সঙ্গে পরিচয়। ছোট ভাইয়ের মতই নীলা আপু আমাকে স্নেহ করেন। আপু আমার সিনিয়র হওয়াতে নিজের বড় বোনের মতই সম্মান করতাম তাকে। সেদিনও চেম্বারে বেশ ব্যস্ততা। হঠাৎ ২২ নাম্বার ওয়ার্ডে রোগী দেখতে যাবার পথে বাইরে থেকে লক্ষ্য করলাম, নীলার আপুর চেম্বারে হালকা মেরুন রঙ্গের শাড়ী পড়া একটা মেয়ে আনমনে বসে আছে। মেয়েটার চেহারার মায়াবী ভাব ও খুলে রাখা লম্বা চুল, দুটোই আমাকে কয়েক মুহুর্তের জন্য থমকে দিয়েছিলো। লাঞ্চ ব্রেকে নীলা আপুর সঙ্গে ক্যান্টিনে দেখা হওয়ার সাথেই নানা বিষয়ে আলাপ-আলোচনা জুড়ে দিলাম।
– জানিস আরফি? আমি না একটা ব্যাপার নিয়ে খুব চিন্তা করছি।
– কি নীলা আপু?
– আজ আমার চেম্বারে একটা মেয়ে এসেছিলো। একদম কম বয়স, দেখতে ভারী মিষ্টি। কিন্ত জানিস? মেয়েটা না ক’দিন আগেই স্বামীকে হারিয়েছে। স্বামীটাও কত হতভাগা দেখ? স্ত্রীর গর্ভে তার সন্তান এসেছে, অথচ সন্তানের মুখ দেখার আগেই উনি মারা গেলেন! নীলা আপু কিছুক্ষণ থেমে আবার বলতে শুরু করলেন,
– মেয়েটার গর্ভের সন্তানের বয়স বেশি না, চাইলেই এবরোশন করানো যাবে। তাছাড়া শ্বশুরবাড়ি ফিরে যাবারও উপায় নেই। এই মেয়েকে আবার বিয়ে দেয়ার চেষ্টা করলে, নির্ঘাত তা সম্ভব। মেয়েটার বাবা-মা এজন্যই চাচ্ছে মেয়েটার গর্ভের বাচ্চাটা নষ্ট করা হোক। এবার আমি বললাম,
– তা আপু, মেয়ের কি মত?
– আরে, ও তো জানেই না। সঙ্গে তার মা এসেছিলো। তিনিই আমায় আলাদাভাবে সব খুলে বললেন। এ ও বললেন, মেয়েকে না জানিয়ে এ কাজটা করতে হবে।
– তারপর?
– কিন্ত মেয়েটা মানসিকভাবে খুব ভেঙ্গে গেছে রে। এই অবস্থায় যদি এসব করা হয় এবং কোনোভাবে যদি টের পায় অনেক সমস্যা হবে। তাই আমি মানা করে দিয়েছি। কেন করেছি জানিস? আমিও তো একজন মা, একজন স্ত্রী। তার উপর এতো কষ্ট সে না সইতে পারবে না।
সেদিন রাতে কেন যেন আমার ঘুম হলো না। বারেবার মনে হয়েছিলো, কী মায়াবতী দেখতে মেয়েটা। এভাবে কিছুদিন গেলো। আমার ভেতরে কেন যেন কিছু করার ইচ্ছে হচ্ছিলো। আচ্ছা, মেয়েটার অনাগত শিশুর বাবা কি আমি হতে পারবো না? আমার বেড়ে ওঠা ফুপির কাছে। বলা চলে উনিই আমার সব। আমি অনাথ। মাকে হারাই জন্মের পরপরই, বাবাকেও হারিয়েছি ক্যান্সারে। বয়স যখন ষোল, তখন থেকেই ফুপি আমাকে তার সঙ্গে নিয়ে যান। সেই থেকে এই ফুপি আমার সব। কিছুদিন পর নীলা আপুর কাছে মেয়েটার কথা জিজ্ঞেস করি, উনি বললেন তার খোঁজখবর কিছুই জানেন না। আবার বেশ ভয় হলো, আচ্ছা ওই অবুঝ শিশুর কিছু হলো না তো? নীলা আপুর সঙ্গে সব কথাই শেয়ার করলাম । আপু অবাক হয়ে বললেন,
– তুমি কি পাগল হয়েছো আরফি? মাত্র ছাব্বিশ বছরের একটা ছেলে তুমি। তোমার বাকি জীবন এখনো পড়ে রয়েছে।
– আপু, ভাবিনি প্রথম দেখাতে কেউ আমাকে ওভাবে জড়িয়ে নিবে।
তাছাড়া আমি নিজেও অনাথ। আমি বুঝি, বাবা-মা ছাড়া বেঁচে থাকাটা ঠিক কতখানি কঠিন। তাই চাইছিলাম, আমি যদি কোনো নিরীহ প্রাণকে মেরে ফেলার হাত থেকে রক্ষা করি, যদি তার বাবার দায়িত্ব নেই, তাহলে কি খুব অন্যায় হবে আপু? নীলা আপু আমায় সেদিন বুঝাতে অক্ষম হলেন। শেষে না পেরে ঈশানীর মায়ের নাম্বার দিতে বাধ্য হলেন।অবশ্য নীলা আপু এর আগেই ঈশানীর মায়ের কাছ থেকে বাসার এড্রেস চেয়ে নিয়েছিলেন। বাসায় এসে ফুপিকেও বুঝিয়ে অনেক কষ্টে মানালাম, তিনিও আর কিছু বললেন না আমায়। আমার ইচ্ছেই তার কাছে প্রাধান্য।
ঈশানীদের বাড়িতে নীলা আপু ও আমার ফুপি যান বিয়ের প্রস্তাব নিয়ে। ঈশানীর বাবা-মা রাজী হলেও ঈশানী হচ্ছিলো না। নীলা আপুর কাছ থেকে এ ও জানা গেলো, ঈশানী তার মাতৃত্বের খবর জেনে গিয়েছিলো, যখন টেস্টের রিপোর্ট ভুলবশত সে হাতের কাছে পেয়ে যায় । তখন থেকেই ঈশানীর মা বারেবার চেষ্টার পরও পারেন নি মেয়েটার গর্ভে থাকা বাচ্চাটাকে নষ্ট করতে। ঈশানীর কাছে যে এটাই তার স্বামীর শেষ চিহ্ন! নীলা আপু, ফুপি এবং ঈশানীর বাবা-মা সবাই নানাভাবে বুঝিয়েও কোনো “হ্যাঁ” সূচক বাক্য শুনতে পান নি ঈশানীর মুখ থেকে। তাই বাধ্য হয়ে আমি একদিন ঈশানীর বাসায় উপস্থিত হই। ঈশানীর বাবা-মায়ের অনুমতি নিয়ে তাদের মেয়ের সঙ্গে একান্ত কথা বলার চেষ্টা করি। আমার সামনে মেয়েটা জড়সড় হয়ে বসে আছে। যেন কোনো দেবী বসে রয়েছে, দীঘল কালো চুল তার। হাতগুলো গুটিসুটি করে মাথা নিচু করে আছে।
– শুনুন, আমার পক্ষে কখনো অন্য কাউকে স্বামীর স্থানে বসানো সম্ভব নয়!
– স্বামীর অধিকার আমি চাইছিও না ঈশানী। অন্তত বন্ধুর অধিকার দিন প্লিজ।
– এ অসম্ভব!
– আচ্ছা, আপনি কী চান আপনার সন্তান বাবার আদর ছাড়াই বেড়ে উঠুক? ঈশানী কোনো জবাব ই দিলো না। আমি আবার বলতে লাগলাম,
– জানেন ঈশানী? পৃথিবীতে অনাথ, এতিম হয়ে বাঁচাটা খুব কষ্টের। আমি নিজেও অনাথ। মাকে তো জন্মের পর দেখা হয়নি। তাতে এতটুকু কষ্ট হয় না। কিন্ত যবে বাবাকে হারিয়েছি, আমার পৃথিবীটা একদম শুন্য হয়ে গিয়েছিলো। বাবাকে কাছে না পাওয়ার কষ্ট নিয়ে আমি বড় হয়েছি। ঈশানী এবার বললো,
– করুণা করতে চাইছেন?
– অবশ্যই নয়। আমি একজন অনাথ হয়ে অন্য আরেকটি শিশুর জীবন থেকে “অনাথ” হবার দুঃখ সরাতে চাই। ভেবে দেখবেন। এবং আপনাকে আমার মৃত বাবা-মায়ের দিব্বি খেয়ে বলছি, যদি বিয়ে হয় ও আমাদের, আপনি না চাইলে কখনো স্বামীর অধিকার খাটাতে চাইবো না আমি। আপনার সন্তানকে নিজের মত করে বাবার পরিচয়ে বড় করবো।
সেদিন আর কথা না বাড়িয়ে চলে আসি। এর কিছুদিন পর ঈশানীর বাড়ি থেকে ফোন করে জানানো হয়, বিয়ের জন্য ঈশানী সম্মতি দিয়েছে। খুব ঘরোয়া আয়োজনে ঈশানী ও আমার বিয়ে সম্পন্ন হলো। গর্ভকালীন সময়টায় সবসময় ঈশানীর পাশে থেকেছি। সবার আগে ঈশানীর বন্ধুর হবার চেষ্টা করেছি। মেয়েটাকে এই সময়টায় মাটিতে পা অব্ধি যেন রাখতে দেইনি। ঈশানী আমার এসব পাগলামি দেখে মাঝে মাঝেই বলতো, “এ যেন আমার নিজের সন্তান!” দিন যেতে লাগলো। হঠাৎ এক রাতে হুট করে ঈশানীর প্রসব ব্যথা শুরু হয় । তাকে হসপিটালে এডমিট করার পর নীলা আপু আমায় জানান ডেলিভারি করতে হবে। সেদিন কে দেখে আমার অস্থিরতা! যেন কেঁদে ফেলি এ অবস্থা হয়েছিলো! দীর্ঘ অপেক্ষার পর ও.টি থেকে নীলা আপু ছোট্ট একটা বাবুকে কোলে নিয়ে বের হলেন। আমার দিকে তাকিয়েই বললেন, ” অভিনন্দন আরফি! মেয়ের বাবা হয়েছিস।” ঈশানীর কোলে আমাদের মেয়েটা দেয়ার সাথে সাথেই অঝোরে কাঁদতে লাগলো। আমি তার কপালে চুমু দিয়ে বললাম, ” উহু, একদম কাঁদে না পাগলী। দেখো দেখো আমাদের মেয়ে একদম তোমার মত দেখতে হয়েছে।তাই না? “
দেখতে দেখতে আমাদের মেয়ে তনয়ার বয়স এখন চব্বিশ বছর পূর্ণ হলো। ঈশানীর সঙ্গে আমার সংসার জীবন ছিল মাত্র তের বছরের। আমি হয়তো খুব হতভাগা, সেজন্য কাউকে আঁকড়ে রাখতে পারি নি! তাই তো ঈশানীও আমায় একা রেখে চলে গেলো না ফেরার দেশে। তনয়ার জন্মের তিন বছর পর অবশ্য আমাদের একটি ছেলেরও জন্ম হয়। ঈশানী ও আমি মিলে ছেলেটার নাম রাখি, অনয়। ঈশানী চলে যাবার পর খুব যত্ন করে একা এক হাতে ছেলে-মেয়ে দুটোকে মানুষ করেছি। কত তাড়াতাড়ি মেয়েটা বড় হয়ে গেলো! আমার পছন্দের ছেলের সঙ্গেই মেয়েটার বিয়ে আজ।আস্তে আস্তে ক্রমশ মেয়ে বিদায়ের কষ্ট বাড়তে লাগলো। তনয়া বিদায় বেলায় একান্ত আমার সাথে কথা বলতে চাইছিলো। একটা ঘরে দাঁড়িয়ে আছি আমি ও তনয়া।
– বাবা? রেখে দাও না আমায় তোমার কাছে।
– না রে মা, এটা কি হয় কখনো? একদিন না একদিন তো তোকে যেতেই হতো!
মেয়েটা আমায় জড়িয়ে খুব করে কাঁদছিলো। যাবার বেলায় আমার হাতে এক টুকরো কাগজ গুজে দিয়ে বললো, “আমার চলে যাবার পর খুলে দেখো বাবা।” মেয়ে বিদায়ের যন্ত্রনা খুব তীব্র।সারা বাড়ি কেমন শুন্য শুন্য লাগছে। ইজি চেয়ারে হেলান দিতেই পাঞ্জাবীর পকেটে রাখা কাগজটার কথা মনে পড়লো। পড়তে লাগলাম,
প্রিয় বাবা,
আমি জানি তুমি আমার জন্মদাতা পিতা নও। মা মারা যাওয়ার আগেই বলেছিলো আমায় সব। বলেছিলো, তোমায় যেন কখনো কষ্ট না দেই। জানো তো বাবা? আমার একটুও কষ্ট হয়নি এটা জানার পর যে, তুমি আমার আসল বাবা নও! বরং গর্ববোধ হচ্ছিলো, তোমার মত বাবা পেয়ে। হয়তো আপন বাবাও এমনভাবে কোনো সন্তানকে গড়ে তুলতো না, যেভাবে তুমি আমাকে গড়েছো। তুমিই আমার বাবা, আমার সুপারহিরো। ভালোবাসি বাবা। অনেক অনেক অনেক বেশি।
চিন্তা করো না, প্রতিদিন তোমায় দেখতে আসবো, ভাইকে বলেছি তোমার যত্ন নিতে।আমাকে আশির্বাদ করো বাবা । ভালো থেকো, নিজের যত্ন নিও!” চোখ দুটো ছলছল করছে। ঈশানীর ছবিটা সবসময় মানিব্যাগে রাখি। মানিব্যাগটা খুলে ঈশানীর ছবির দিকে তাকিয়ে বিড়বিড় করে বলতে লাগলাম , ” আমার এতোদিনে পিতৃত্ব যেন সার্থক হয়ে গেছে আজ। আমাদের মেয়েটাক সুপাত্রের হাতে তুলে দিলাম। আজ যদি তুমি বেঁচে থাকতে ঈশানী! এভাবে চলে গেলে কেন? আমি যে খুব একা হয়ে গেলাম আজ, ঈশানী!
গল্পের বিষয়:
গল্প