মা যখন মারা গেলেন, মা হারানোর কষ্ট অনুভব করার মতো বোধশক্তিটাও তখন আমার হয়নি। আমায় আলো দেখাতে গিয়েই মা অন্ধকারে ডুবলেন। তারপর বাবা আমার মা হয়ে উঠলেও সংসার আর আমি, দু’টো জিনিসের দায়ভার সামলাতে যখন ক্লান্ত হয়ে পড়লেন তখন মায়ের দায়িত্ব নিয়ে বাড়িতে নতুন একজন এলেন। সেই ছোট্ট বেলা, অতোকিছু বুঝতাম না। বাবার বিয়ে, নতুন মা, সবকিছু মিলিয়ে বেশ আনন্দ করেছিলাম। ভালোবেসে আমি তাকে ‘নতুন মা’ বলেই ডাকতাম।
সবাই যদিও বলতো, মা বলে ডাকতে। আমার কেন যেন নতুন মা বলে ডাকতেই ভালো লাগতো। কিন্তু আমি যতই তার আপন হতে চাইতাম, ততই যেন তিনি দূরত্ব বজায় রাখতে চাইতেন। ভালোবাসার স্থলে তার প্রতি একটু আধটু করে ভয় জমতে লাগলো। একটু একটু বুঝলাম, আমার মায়ের স্থলটা অপূর্ণই রয়েছে৷ পরিবারে নতুন সদস্য হিসেবে আমার বোন এলো। আমার খুশি তো ধরে না। বাবা হেসে আমাকে জিজ্ঞাসা করলেন, ‘তৃষ্ণা, বোনের কী নাম দিবি?’ আমি চট করে বলে ফেললাম, ‘তৃপ্তি।’
বাড়ির পাশের বাকের দাদুর নাতনির নাম, তৃপ্তি। শুনেছি, ওরা বিদেশে থাকে। মাঝেমধ্যে বাকের দাদু আর দাদিমনিকে দেখতে দেশে আসে। শেষবার যখন এলো, তৃপ্তির সঙ্গে আমার খুব ভাব জমে গেলো। যখন চলে গেলো, আমার বেজায় মন খারাপ হয়েছিলো। কেঁদেছিলাম আমিও খুব। নামটা নিয়ে নতুন মা আপত্তি করলেও বাবার ধোপে তা টিকলো না। তৃপ্তির কাছে আমাকে তেমন ঘেঁষতে দেন না নতুন মা। নতুন মা যখন রান্নাঘরে কাজে ব্যস্ত থাকেন, আমি তখন চুপিচুপি তৃপ্তির কাছে গিয়ে ওকে আদর করি। একদিন নতুন মা দেখে ফেললে, খুব শাসালেন। তারপর আর তৃপ্তির আশপাশেও থাকি না। একদিন খুব মন খারাপ নিয়ে বাবাকে প্রশ্ন করলাম, ‘আচ্ছা বাবা, মা খেকো কী?’ বাবা অবাক হয়ে পাল্টা প্রশ্ন ছুঁড়লেন, ‘কে বলেছে তোকে এই কথাটা?’ আমি সরল গলায় বললাম, ‘নতুন মা বলেছে আমাকে।’
বাবা খুব রেগে গেলেন। আমাকে কিছু না বলেই নতুন মা’কে খুব বকতে লাগলেন। আমি চুপচাপ দাঁড়িয়ে রইলাম। বাবা কেন রাগলেন, নতুন মাকে কেন বকছেন, কিছুই বুঝতে না পেরে ফ্যাল ফ্যাল করে তাকিয়ে নতুন মা আর বাবার কথা কাটাকাটি দেখছিলাম। তারপর নতুন মা আমার উপর আরো চড়াও হয়ে গেলেন। পাশের বাড়ির দাদিমনি বলতেন, ‘এখন তুই হইলি তোর নতুন মায়ের দুই চক্ষুর বিষ।’ দুই চক্ষুর বিষ কথাটা পুরোপুরি না বুঝলেও এতটুকু বুঝতাম, কথাটার অর্থ নিশ্চয়ই খারাপ ঠিক ‘মা খেকো’ কথাটার মতোই। তৃপ্তির সঙ্গে আমার আর ভাব জমানোর সুযোগ হয়ে ওঠেনি৷ আমার জগতে আমি একাই পড়ে রইলাম। বড় হওয়ার পরে বুঝতে পারলাম, বাবাও ভেতরে ভেতরে আমারই মতো একা৷ পড়াশোনায় তৃপ্তির তেমন মনোযোগ ছিলো না। বাবা চাইতেন, আমাদের দু’বোনেরই যেন নিজস্ব একটা পরিচয় তৈরি হয়। কিন্তু নতুন মা চাইতেন, তৃপ্তি বড় বাড়ির বউ হোক৷ আমায় নিয়ে তিনি কখনো ভাবতেন না৷ অপচয় করার মতো এতো সময় তার ছিলো না।
বাড়িতে ভালো সম্বন্ধ এলেই নতুন মা খুব উৎসাহী হয়ে উঠতেন। তৃপ্তির জন্য ভালো পাত্র খুঁজতে তার ব্যস্ততা বাবাকে খুব বিরক্ত করতো। বাবা একদিন রেগে বললেন, ‘ভেবেছো একবার, বড় মেয়ে রেখে ছোট মেয়ের বিয়ে দিলে লোকে কী বলবে আমায়?’ নতুন মা কড়া স্বরে বললেন, ‘তোমার মেয়েকে তুমি বিদ্বান বানাও, আমার কোনো আপত্তি নাই। কিন্তু আমার মেয়ের বিষয়ে আমাকেই ভাবতে দাও।’ ছোটবেলা থেকেই দেখেছি, নতুন মায়ের বিপরীতে বাবা কিছু করতে গেলে সংসারে তুমুল অশান্তির সৃষ্টি করেন নতুন মা। তাই নতুন মায়ের বিরুদ্ধে গিয়ে সংসারে নতুন করে অশান্তি ডেকে আনতে চাননি বলেই তার কথা মেনে নিতে বাধ্য হন বাবা।
বাবা নতুন মাকে সবসময় বোঝাতেন, ‘বড়লোক নয়, বড় মনের লোক খোঁজো। তবেই শান্তির দেখা মিলবে।’
নতুন মা বিদ্রূপ করে বলতেন, ‘বড় মন ধুয়ে পানি খাবো নাকি!’ তারপর লোকের কথা অগ্রাহ্য করেই বাবা আমার আগে আমার ছোট বোন তৃপ্তির বিয়ে দিলেন। সম্বন্ধটা নতুন মায়ের পছন্দ, ছেলের পরিবার বিশাল বড়লোক। নতুন মায়ের চোখে মুখে উপচে পড়া খুশি। আমার পড়াশোনা নিয়ে নতুন মা সবসময় কটাক্ষ করতেন। ব্যঙ্গ করে বলতেন, ‘আমিও দেখব, এতো লেখাপড়া করে কোন বিদ্বানটা হও! বয়স বেড়ে বুড়ি হয়ে শেষে তো বাবার কাঁধেই চেপে বসতে হবে।’ আমি চুপ করে শুনতাম। তার কথার প্রত্যুত্তরে কখনোই কিছু উচ্চারণ করতাম না। বাবা বলতেন, ‘ধৈর্য ধর। ধৈর্যের ফল স্বয়ং আল্লাহ দেন।’ ধৈর্য ধরেই কেটে গেলো বেশ কয়েকটা বছর। পড়াশোনা শেষ হলো, নিজের একটা পরিচয় তৈরি হলো, সামনের দিনগুলো যেন সোনালী আলোর মতো চকচক করছে।
তৃপ্তি এখন এ বাড়িতেই থাকে। ডিভোর্স হয়েছে কয়েক মাস আগে। শ্বশুর বাড়ির লোকের থেকে উঠতে বসতে কথা শোনা, স্বামীর পরোকিয়ায় জড়িয়ে যাওয়ার খবর জানা, তারপর দিন রাত্রির ঝগড়াঝাটি লেগে থাকা শেষে ডিভোর্স।
নতুন মা আর পুরাতন হননি৷ তিনি আমার কাছে এখনো নতুন, ঠিক প্রথম দিনের মতো। নতুন কিছুর প্রতি যেমন মায়া জন্মায় না, আপন হয়ে ওঠে না। নতুন মাও তেমন আর আপন হয়ে ওঠেনি, মায়াও জন্মায়নি। বাবার বয়সটাও বেড়েছে, চাকুরি থেকে অবসরে চলে গিয়েছেন। সংসারের হালটা এবার আমার ধরার সুযোগ হয়েছে। সামনের মাসে আমার বিয়ে। সম্বন্ধটা বাবার পছন্দের। ছেলে আমার মতই একজন ম্যাজিস্ট্রেট। সবথেকে বড় কথা হলো, মানুষটা নাকি বড় মনের একজন। এতো বছর বাদে একটা কথা ঠিক টের পাচ্ছি – ‘সময়! অপেক্ষা করলে মিলিয়ে দেয় – সব হিসেব কানায় কানায়।’
গল্পের বিষয়:
গল্প