সাদার শুভ্রতায় বিলীন রঙের ছোঁয়া

সাদার শুভ্রতায় বিলীন রঙের ছোঁয়া
বাবা-মায়ের বাধ্য মেয়ে ছিলাম বলেই হয়তো কোনো ছেলের প্রেমে পড়া হলো না আমার। ছেলেদের এড়িয়ে চলতাম সব সময় আর এজন্যই স্কুলের সহপাঠীরা আমাকে নিরামিষ উপাধি দিয়েছিলো এতে অবশ্য আমার কিছু আসতো যেতো না ওরা আমাকে যতই ক্ষেপানোর চেষ্টা করতো ততই আমি নিরব থাকতাম। কখনো কখনো একটা মিষ্টি হাসি দিতাম ফলে আমাকে ক্ষেপাতে এসে ওরাই বরং বিরক্ত হতো আর ভাবতো যেটুকু সময় আমাকে ক্ষেপানোতে দিবে সেই সময়টুকু তারা নিজেদের প্রেমে দিলেই আরেকটু বেশি প্রেম করতে পারবে। স্কুল জীবনের প্রেম সবার। সবাই একটা রঙিন জগতে বাস করতো কল্পনায় নিজেদের জীবন সাঁজাতো। আমি এসব কল্পনায় বিশ্বাসী ছিলাম না বাস্তবতায় বিশ্বাসী ছিলাম তাই করো কল্পনার সঙ্গী হতে পারি নি।
আমি আমার বড় আপু বড় ভাইয়া ওদের দেখে বুঝতে চেষ্টা করতাম।আসলে এই স্কুল জীবনের ভালোবাসা খুব কমই টিকে। আবেগে ভেসে যাওয়া নৌকাটা একসময় হুট করেই স্থির হয়ে যায়,ছিটকে পড়ে সবাই একপ্রান্ত থেকে অন্যপ্রান্তে। খুব আহামরি সুন্দরী ছিলাম না আমি তবে কারো কারো চোখে মায়াবী ছিলাম আর একজনের কাছে তো আমি তার মায়াবতী’ই ছিলাম। দুনিয়ার সবাই যখন আমায় নিরু বলে ডাকতো তখন এই মানুষটা আমাকে মায়াবতী নামেই ডাকতো। এইচএসসির পর যখন হঠাৎ করে বাবা মারা গেলেন তখন মা যেনো আমাকে নিয়ে দিশেহারা হয়ে গেলেন। মায়ের মনে বড্ড ভয় ঝেঁকে বসছিলো যদি উনারও কিছু হয়ে যায় তবে আমার কি হবে? বাবা মাকে বড্ড ভালোবাসতো আর ভালোবাসার মানুষকে নাকি খুব তাড়াতাড়ি মানুষ নিজের কাছে ডেকে নেয়। মা এই ভয়টা থেকেই তড়িঘড়ি করে আমাকে বিয়ে দিয়ে দেন।
মিশকাতের সাথে আমার আগে অনেকবার দেখা হলেও কখনো কথা হয়নি। একই পাড়ায় থাকতাম আমরা। মিশকাত শহরের একটা ব্যাংকে চাকুরী করতো। ছুটিতে বাড়ি আসলে কলেজে যাওয়ার পথে দেখা হতো। তাদের বাড়ির সামনের রাস্তা দিয়েই আমাকে কলেজে যেতে হতো। মা আমার জন্য পাত্র খুঁজছেন শুনে মিশকাতের এক বন্ধুই মিশকাতকে ফোনে জানায় সব। মিশকাত খবর পেয়ে এক সন্ধ্যে বেলায় শহর থেকে সরাসরি আমাদের বাড়ীতেই চলে আসে। মিশকাত নিজেই সরাসরি আমাকে বিয়ের প্রস্তাব দেয় মায়ের কাছে। ভালো ছেলে হিসেবে এলাকায় একটা সুনাম ছিলো মিশকাতের সেই সুবাধে মা তাকে আগ থেকেই চিনতো। মা মিশকাতকে বলেন যাতে তার পরিবার প্রস্তাব নিয়ে আসে বিয়ের, ছেলের কথায় তো আর বিয়ে হতে পারে না। বিয়েটাতে শুধু একটা ছেলে আর মেয়ের সম্পর্ক তা নয় এটা দুটো পরিবারের একটা সম্পর্ক।
মায়ের সাথে মিশকাতের বলা কথাগুলো শুনে আমি এতোটাই চমকে গিয়েছিলাম যে, একটা মানুষ তার বন্ধুর কাছে একটা কথা শুনেই কিভাবে সরাসরি মেয়ের বাড়িতে নিজের বিয়ের প্রস্তাব নিয়ে নিজেই চলে আসে! এ ছেলের নিশ্চয়ই মাথায় সমস্যা আছে নয়তো এমন কাজ কেউ করে? মাকে মিশকাত চলে যাবার পরই বললাম ” আচ্ছা মা ঐ ছেলের মতো তুমিও কি পাগল হলে যে তুমি তাকে তার পরিবারকে বলতে বলছো বিয়ের প্রস্তাব নিয়ে আসতে” মা বললো “কেনো রে ছেলের প্রস্তাবেই কি বিয়ে দিয়ে দিব”? মায়ের উপর প্রচন্ড রাগ হলো আমি বললাম কি আর মা বুঝলো কি ” আরে মা বুঝো না কেন এই ছেলের নিশ্চয়ই মাথায় সমস্যা আছে নয়তো নিজের বিয়ের প্রস্তাব নিয়ে নিজেই সরাসরি চলে আসে” মা আমার একটা হাসি দিয়ে বললো “ছেলেটা ভালোই রে আর আমার মনে হয় তোকে পছন্দই করে তাই সরাসরি এখানেই চলে এসেছে”
মায়ের কথায় একটু লজ্জাই পেলাম আমি। মায়ের সামনে থেকে সরে আসলাম আর ভাবলাম “তাই কি মিশকাত ছুটিতে বাড়ি আসলে কলেজে আসা যাওয়ার সময় এভাবে ঠাঁয় দাঁড়িয়ে থাকে” নিজের উপর নিজেরই রাগ হচ্ছে আসলেই সবাই যে বলে আমি নিরামিষ আসলেই তাই নয়তো এসব ভাবনা আমার মনে আসবে না কেন? দুই পরিবারের পছন্দেই এক সপ্তাহের মাথায় আমাদের বিয়েটা হয়ে গেলো। বিয়ের রাতেই মিশকাত আমার নামটা “মায়াবতী” দিয়েছিলো। যদিও বিয়ের রাতে আমায় প্রথমবারের মতো মায়াবতী বলে ডাকদিলো স্পষ্টস্বরে কিন্তু ও নাকি যেদিন প্রথম আমায় দেখেছিলো সেই দিন থেকেই নিজের মনে মনেই আমায় ডাকতো মায়াবতী বলে। ওর কথা শুনেতো আমি লজ্জায় একদম নুয়ে পড়ছিলাম। ওর কি হাসি আমার লজ্জা দেখে ওকে দেখে মনে হয়েছিলো ও বুঝি বিশ্বজয় করে এসেছে।
বিয়ের দু’দিন পরই মিশকাত শহরে চলে যায়। মিশকাতের চলে যাবার পর আমার মাঝে একটা শূন্যতার সৃষ্টি হলো। আলাদা একটা অনুভূতি একজন স্পেশাল মানুষের জন্য। ওর হাসি কথা বলার শব্দ সব আমার কানে বাঝতো। আমাকে ছুঁয়ে দেয়া প্রতিটা স্পর্শ আমি অনুভব করতাম। এই নিরামিষ আমি বুঝলাম এটাই ভালোবাসা। আমার সব প্রেম,ভালোবাসা আমার আমিকে সঁপে দিয়েছিলাম মিশকাতকে। প্রতি বৃহস্পতিবার অফিস সেরে মিশু বাড়ি চলে আসতো। মিশকাতকে তার পরিবারের সবাই মিশু বলে ডাকতো। মিশুর এমন শহর বাড়ি দৌড়াদৌড়ি দেখে বিয়ের তিন মাসের মাথায় শ্বশুর বাড়ি থেকে আমাকে মিশুর সাথে শহরে পাঠিয়ে দেয়া হয়। সবার জন্য খারাপ লাগলেও মিশু তা ভুলিয়ে দিতো আমাকে। মা আমার বিয়ের পরই মামা বাড়ির স্থায়ী বাসিন্দা হয়ে যান। মামারা মাকে একা রাখতে রাজি ছিলেন না। তাই মাকে নিয়ে আমার আর দুশ্চিন্তা রইলো না।
ছোট একটা সংসারে অসীম ভালোবাসায় আমার বাস ছিলো। দিনে মিশুর অফিস আর আমার ভার্সিটি এতেই সময় কেটে যেতো। মিশু চায়নি বিয়ের পর আমার পড়া বন্ধ হয়ে যাক তাই শহরে এসেই আমাকে অনার্সে ভর্তি করিয়ে দেয়। দিনের ব্যস্ততা আর রাতের ভালোবাসায় আমাদের ছোট ঘরটা কানায় কানায় ভর্তি ছিলো। সময়গুলো কিভাবে কেটে যায় আমরা বুঝতেই পারি না। এক এক করে চারটি বছর কেটে যায়। এর মাঝেই আমি বুঝতে পারি ছোট একটা প্রাণের অস্তিত্ব আমার মাঝে এসে গেছে। মিশুকে রাতেই এই খুশির খবরটা দিব বলে আশায় বসে আছি। তবে আজকাল মিশুকে কেমন যেনো অন্যমনষ্ক লাগে। কিছু জিজ্ঞেস করলেও বলে না কি হয়েছে। হাসিখুশি মানুষটা হঠাৎ কেমন নিস্তেজ হয়ে গেছে। আজ এ কথটা শুনে নিশ্চয়ই মন ভালো হয়ে যাবে মিশুর।
আমি বসেছিলাম মিশুর অপেক্ষায়। আজকের সময়টা যেনো কাটতেই চাচ্ছে না। তার উপর মিশুও আজ দেরি করে বাসায় আসতেছে ঘড়ির কাঁটায় প্রায় নয়টা বাজে। মিশু যখন বাসায় আসে কিছুটা বিমর্ষ লাগে তাকে। জোর করে মুখটা হাসি হাসি করে রেখেছে দেখলেই বুঝা যায়। মিশু হাত বাড়িয়ে আমার দিকে একটা শাড়ির প্যাকেট দিলো। আমি তো মহাখুশি কারন খুশির সংবাদটা না দিতেই মিশু আমার জন্য গিফট নিয়ে আসলো। প্যাকেটটা হাতে দিয়ে নিশু আমায় বললো “ঝটপট রেডি হয়ে আসো আমরা বাইরে খেয়ে আসব” অনেকদিন হলো আমরা ঘুরতে বের হই না তাই আমিও রাজি হয়ে গেলাম ঘুরতে যাবার জন্য। রুমে এসে প্যাকেটটা খুলে দেখলাম একদম ধবধবে সাদা একটা জামদানী সাথে সাদা ব্লাউজ পেটিকোট। আর একটি শিউলি ফুলের গজরা। সাদা শাড়ীটা দেখে কেমন যেন অস্বস্তি লাগলো।
মনের মাঝে একটা ভয় ডুকে গেলো। তবুও শাড়ি পরে বের হলাম ঘুরতে। মাঝরাতে বাড়ি ফিরে আসলাম দুজনে এর মাঝে এতেটা সময় মিশু আমার হাতটা শক্ত করে ধরে রেখেছিলো অথচ একটিবার ও আমাকে ভালোভাবে তাকিয়ে দেখে নি। এতোটুকু বলেই একটা দীর্ঘশ্বাস ফেললো নিরু। আবার বলতে শুরু করলো নিরু বাসায় এসে চুপচাপ শুয়ে পড়ছিলো মিশু। রাতে আমার ঘুম ভাঙতেই দেখি ফুঁপিয়ে কাদছে মিশু, নিজের ভিতরে কি বয়ে বেড়ায় তা বলছে না আমাকে। সকালবেলা নাস্তার টেবিলে মিশুকে বললাম তার অস্তিত্ব আমার শরীরে বেড়ে উঠছে। মিশু ঠিক তখনই চিৎকার করে কেঁদে ফেললো। আমি বড্ড ভয় পেয়ে জড়িয়ে ধরি মিশুকে। বার বার জানতে চাই কি হয়ছে আমাকে কিছুই বলে না একটু শান্ত হয়ে পরে বলে এ বেবীটা পৃথিবীতে আনা যাবে না। আমি অবাক হয়ে গেলাম এমন কথাতে।
বিয়ের পর আমাদের কত প্লানিং ছিলো একটা বেবি নিয়ে অথচ আজ মিশুই এমনটা বলছে। পরিস্থিতি এমন হলো আমি খুব বাজে ভাবে কথা বলি তার সাথে। একপর্যায়ে মিশু সেন্সলেস হয়ে পড়ে। পাশের বাসার লোকদের সহায়তায় হসপিটাল নিয়ে যাই। আর তখনি জানতে পারি নির্মম সত্যটি। ব্রেইন টিউমারে ভুগছে মিশু যা এখন লাস্ট স্টেজে আছে। মিশুর বাবা -মা, আমার মা সবাই ছুটে আসেন শহরে মিশুর খবর পেয়ে। রাতদিন হসপিটালে থাকতাম মিশুর সাথে। মিশু বার বার বলতো বাচ্চাটা যাতে পৃথিবীতে না আনি। এ কথার তার যুক্তি ছিলো হয়তো আমি একা থাকে আবার নতুন করে জীবন শুরু করতে পারব একটা সন্তান থাকলে পারব না। অথচ মিশু বুঝলো না সেই আমার প্রথম ভালোবাসা আর শেষটাও সে।
মিশু আর আমার একটাই প্রর্থনা ছিলো আল্লাহর নিকট যাতে মিশু আমাদের সন্তানকে একনজর দেখে যেতে পারে।
এর মাঝে অনেকগুলো মাস কেটে গেলো। একদিন বারান্দায় বসে মিশু আমাকে সেই সাদা শাড়ী আনার গল্পটি বলছিলো। মিশু দেখতে চেয়েছিল তার মায়াবতীকে সে ছাড়া সাদা শাড়ীতে কেমন লাগে। আমি যত্ন করে তুলে রেখেছিলাম সেই শাড়িটি। আট মাসের মাথায় আমার ডেলিভারি পেইন উঠে হঠাৎ করেই। যদিন আমার পেইন উঠে ঐ দিন একদম সুস্থ দেখায় মিশুকে। সবার সাথে হসপিটাল যায় মিশু। একদিকে খুশি আর একদিকে শুন্যতা এ দুটোই দেখছিলাম আমি তার চোখে তাকিয়ে।
যখন আমাদের সন্তান পৃথিবীর আলো দেখে তখনি নার্স এসে প্রথমেই মিশুর কোলে দেয় তার সন্তানকে আমি অপারেশন রুমে বলে দিয়েছিলাম যাতে সবার আগে মিশুর কোলেই দেয় তার সন্তানকে। এই সুন্দর মুহূর্তটি আমি দেখতে পারলাম না। সাক্ষী হতে পারলাম না আমার মিশুর তৃপ্তিময় হাসি মুখটি দেখার।
ছয় দিনের মাথায় আমরা বাড়ি আসি হসপিটাল থেকে আর এই ছয়দিন মিশু এক সেকেন্ড এর জন্যও আমাদের ছেড়ে থাকেনি সবার নিষেধ থাকা স্বত্তেও মিশু হসপিটালেই থাকে আমাদের সাথে। আমিও চাইনি মিশু আমাদের ছেড়ে থাকুক। সারাবাড়ি সবার কি হৈ চৈ বাড়ি ভরতি মানুষ। মিশুও বড্ড হাসিখুশি থাকছে। আমার খুব কষ্ট হতো এসব দেখে ভাবনায় আসতো এই বুঝি একটা ভয়ংকর রকমের ঝড় উঠবে।
মিশু আমাদের ছেলের নাম রাখলো নিশান। মিশুর নিশান মিশুর স্মৃতিচিহ্ন আমাদের ছেলে। নিশানের যখন দশদিন বয়স ঐ দিন কিছুটা অসুস্থ হয়ে পড়ে মিশু। সারাটি সময় আমার পাশে বসে নিশান আর আমার হাত শক্ত করে ধরে রেখেছিলো আর বার বার বলছিলো নিশানকে মানুষের মতো মানুষ কইরো। পরদিন ভোর বেলায় মিশু আমাদের ছেড়ে চলে যায় চিরদিনের জন্য। আমার জীবনের সব রঙ নিয়ে শ্বেত সাদায় আবৃত করে দিয়ে যায় আমায়। মিশু আমাদের সন্তামটিকে দেখবে বলেই হয়তো অপিরণত বয়সেই তার জন্ম হলো। আমিই হয়তো প্রথম মেয়ে যার স্বামী জীবিত থাকতেই তার জন্য সাদা শাড়ি কিনে আনে। মিশুর আনা সাদা শাড়িটাই পরানো হলো আমাকে ঐদিন। মিশুকে হারিয়ে নিশানকে বুকে নিয়ে আমি সেদিন কাঁদতেও ভুলে গেছি। এর পর শুরু হলো আমাদের মা-ছেলের বেঁচে থাকার সংগ্রাম। কয়েক মাস পরে মিশুর অফিসেই একটা চাকরি পেয়ে যাই আমি। মা চিরদিনের জন্য আমার কাছেই থাকতে শুরু করেন মিশু মারা যাবার পর থেকে।
সময়ের সাথে সাথে আমাদের নিশান ও বড় হতে থাকে। ঠিক বাবার মতোই দেখতে হয় নিশান। মিশুর কথামতো নিশানকে মানুষের মতো মানুষ করেই বড় করে তোলে নিরু। নিরুর জীবন আজ কানায় কানায় পূর্ণ কারন আজই নিশান তার বউ আর সদ্য জন্মানো মেয়েকে নিয়ে হসপিটাল থেকে বাড়িতে এসেছে। নিশানের বউ,শ্বশুর-শ্বাশুড়ি সবাই খুবই ভালো মানুষ। আর নিশানের শ্বাশুড়ির জোরাজোরিতেই নিরু তার জীবনের গল্পটি বললো। নিরুর জীবনে আজ সব আছে শুধু নেই মিশু। আজ ছাব্বিশটি বছর নিরু মায়াবতী ডাকটি শুনে না যে ডাকটিতে মিশে ছিলো ভালোবাসার পরশ।
গল্পের বিষয়:
গল্প
DMCA.com Protection Status
loading...

Share This Post

আরও গল্প

সর্বাধিক পঠিত