বিয়ের পর থেকেই দেখছি, যতই ভালো বউ হওয়ার চেষ্টা করি না কেন শ্বাশুড়ি একটা না একটা খুঁত ঠিক খুঁজে বের করেন৷ মাঝে মাঝে ভেবে অবাক হই, একটা মানুষ এতটা খুঁতখুঁতে স্বভাবের হয় কী করে!
অথচ বিয়ের আগে ভাবতাম, আমার শ্বাশুড়ি যতই খারাপই হোক না কেন আমি তাকে এতটাই ভালোবাসবো যে তিনি আমাকে তার মেয়ে ভাবতে বাধ্য হবেন। কিন্তু বিয়ের পরে শ্বাশুড়ির আচারণ দেখে মনে হচ্ছে, তিনিও বহুত আগে থেকেই ঠিক করে রেখেছেন, তার পুত্রবধূ যতই ভালো হোক না কেন তিনি তাকে মোটেও সহ্য করবেন না।
ধৈর্যের চরম সীমা অতিক্রম করলেও নিজেকে সামলে রাখার সর্বোচ্চ প্রচেষ্টা করি। ভুল করেও এমন কোনো আচারণ করি না, যাতে সে কষ্ট পেয়ে চোখের জল ফেলেন। আর সে জল আমার কিংবা রাফসানের জীবনে অভিশাপ হয়ে নামুক। খুব চেষ্টা করি, তার কর্কশ গলার কথাগুলো অগ্রাহ্য করার। কিন্তু সবসময় সম্ভব হয়ে ওঠে না, কিছু কিছু কথা খুব পীড়া দেয়। নীরবে চোখের জল ফেলি।
বুকের মধ্যে শক্ত হয়ে বিঁধে থাকে কিছু কথা। আমি তাড়ানোর চেষ্টা করি, কিন্তু সরে না এঁটে থাকা সে ব্যথা। তবুও চেষ্টা করে চলি, আমার ভেতরকার কষ্ট যেন তার উপর প্রভাব না ফেলে। রাফসানের কাছেও কখনো অভিযোগের ডালা মেলি না। তিনি আমার শ্বাশুড়ি কিন্তু রাফসানের তো মা। সংসারে অশান্তি নামুক কখনোই কাম্য করি না। একদিন তিনি তার ভুল ঠিকই বুঝতে পারবেন, শুধু এই প্রতিক্ষায় দিন গুনি। সময়ের গতিতে চলছে সময়। সন্তানদের মা হলাম। তারা বড় হচ্ছে। শ্বাশুড়ির বয়স বাড়ার সঙ্গে শরীরের শক্তি ক্রমশ কমছে। বার্ধক্যজনিত নানা সমস্যা দেখা দিতে শুরু করলো। বৃদ্ধ বয়সে তার সমস্ত দেখাশোনার দায়িত্ব আমারই রইলো। তার এই দুঃসময়ে আমিই তার পাশে সার্বক্ষণিক থাকি।
তাকে কখনোই বিন্দু মাত্রও টের পেতে দেইনি আমার ভেতরে জমে থাকা কষ্টের বোঝাটা কত ভারী। একদিন রাতে ছলছল চোখে বললেন, ‘বউমা। আমি বড় অন্যায় করে ফেলেছি তোমার সঙ্গে। বুকের মধ্যে একটা শক্ত পাথর জমে আছে। তোমাকে কষ্ট দেওয়ার অপরাধে বিবেকের দংশনে একটা শক্ত পাথর জমে গিয়েছে বুকে। আমাকে যদি পারো ক্ষমা করে দিও। তুমি ক্ষমা করলে আমি স্বস্তিতে নিঃশ্বাস নিতে পারবো।’ কথাগুলো শুনে আমার চোখেও জলেরা ভীড় করলো। তার কান্নার সঙ্গে আমার কান্না জুড়ে দিয়ে ওখানেই জমে থাকা সব কষ্টের পতন ঘটালাম। তার কয়েক দিন পরেই শ্বাশুড়ি মারা গেলেন। নিজের মা হারানোর মতই কষ্টটা পেলাম। এখনো প্রত্যেক নামাজের মুনাজাতে তার জন্য দোয়া বরাদ্দ রাখি। তারপর পেরিয়ে গিয়েছে বহু সময়। এখন আমিও একজন শ্বাশুড়ি। সেদিন বিকেলেও প্রতিদিনকার মত বউমার সঙ্গে চা খেতে খেতে গল্প করে চলছিলাম।
বউমা গল্পের মাঝে আচমকা প্রশ্ন করে বসলো, ‘আচ্ছা মা। আপনি কী কখনোই আমার উপর বিরক্ত হন না?’
আমি চায়ের কাপে চুমুক দিয়ে হেসে বললাম, ‘কেন? বিরক্ত হই না বলে কী মন খারাপ হচ্ছে?’ বউমা সরল গলায় বললো, ‘বিয়ের আগে ভাবতাম, শ্বাশুড়িরা বোধহয় একটু খুঁতখুঁতে স্বভাবের হয়, তারা কখনোই মায়ের মত হতে পারে না। আপনজনদের থেকে এমন অনেক গল্পও শুনেছি। কিন্তু আমার বিয়ের পরে এই ধারণাটাই একেবারে পরিবর্তন হয়ে গেলো। একজন শ্বাশুড়িও তার পুত্রবধূর মা হতে পারে, আপনাকে দেখেই জানা। কিভাবে এত ভালোবাসতে পারেন আপনি?’ খেয়াল করে দেখলাম, বউমার চোখে চিকচিক করছে জল। এই জলটা কষ্টের নয়, আনন্দের। তার বয়সে আমি কষ্টের জল ঝরিয়েছি বলেই হয়তো তার চোখে কষ্টের জল দেখতে ভীষণ ভয় পাচ্ছি।
বউমার মাথায় হাত বুলাতে বুলাতে বললাম, ‘তোমাকে কষ্ট দেওয়ার অপরাধে বিবেকের দংশনে শেষ বয়সে বুকের মধ্যে শক্ত একটা পাথর জমুক, এ আমি চাই না। যতদিন বেঁচে আছি, আমি ততদিন স্বস্তির নিঃশ্বাস নিতে চাই।’
বউমা আমার মুখের দিকে ফ্যাল ফ্যাল করে তাকিয়ে রইলো। মোটা ফ্রেমের চশমাটা খুলে শাড়ির আঁচল দিয়ে নিজের চোখের কোণে জমে ওঠা জলটা মুছে নিয়ে একগাল হেসে বউমার দিকে তাকালাম।
গল্পের বিষয়:
গল্প