রাইয়ানের সঙ্গে অনুর তড়িঘড়ি করে বিয়ে হয়েছে। কিন্তু রাইয়ানের কিছুতেই এই বিয়েতে সম্মতি ছিলো না।
কিছুদিন আগে তাদের এলাকায় কলেজপড়ুয়া একটি মেয়ে ধর্ষণ হয়েছে। তার বিরুদ্ধে কতো প্রতিবাদ,কতো তোড়জোড়। রাইয়ান নিজেও ছিলো সেই ধর্ষনবিরোধী কার্যক্রমে। কিন্তু কে জানতো তার মা ওই বাসায় গিয়ে সবার সামনে সেই ধর্ষিতা মেয়ের সঙ্গেই ওর বিয়ে ঠিক করে আসবে! রাইয়ান ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের অর্থনীতি বিভাগের দ্বিতীয় বর্ষের ছাত্র। মোটামুটি দেখতে শুনতে ভালো হওয়ায় অনেক মেয়েই ভাব জমাতে চায়। ডিপার্টমেন্টেও টপার হওয়ার সুনাম আছে রাইয়ানের। কিন্তু এখন কি হবে। বিয়েতে সবাই রাইয়ান ও তার মায়ের সিদ্ধান্তের প্রশংসা করলেও আড়ালে সমাজের লোকজন এই বিষয় টা নিয়ে সমালোচনা করবেই।
বাড়িতে শুধু রাইয়ান আর ওর মা সালমা বেগম থাকেন ।রাইয়ানের বাবা রাকিব হাসান মাসছয়েক আগে মারা গেছেন। ছোটবেলা থেকেই সে শুধু এই ঢাকা শহরটাকে চিনেছে। সে এই শহরের নিষ্ঠুর,প্রেমহীনতার শহরের মাঝে ভালোবাসাও খুঁজে নিয়েছে। কিন্তু দাদাবাড়ি বা মামাবাড়ি ওদিকে কখনো যাওয়া হয়নি। তবে দাদা-দাদি বেঁচে থাকতে প্রায় মাসে মাসে আসতেন,কিছুদিন থেকে চলে যেতেন। তারাও পৃথিবী ছেড়ে চলে যাওয়ার পর এ শহরে তাদের খোঁজ আর কেউ রাখে না। রাইয়ান ওর মায়ের কাছে শুনেছে তার বাবা-মা প্রেম করে বিয়ে করেছেন। কিন্তু তার মায়ের পরিবারের লোকজন এ বিয়েটা কিছুতেই মেনে নিতে পারেনি। তাই তাদের সঙ্গে কোনো যোগাযোগ নেই।
বিয়ের রাতে রাইয়ান অনুর সঙ্গে অনেক খারাপ ব্যবহার করে। সে মেয়েটাকে কিছুতেই মেনে নিতে পারছে না। কিন্তু অনু কিছু বলে না। নিরবেই চোখের পানি ফেলে। তার মতো পোড়াকপালিকে যে রাইয়ান বিয়ে করেছে, সমাজে সম্মান দিয়েছে এইতো অনেক। নইলে এই সমাজ কোনো ধর্ষিতাকে ঠাঁই দিতো না, ভালো চোখে দেখতো না। শেষমেশ হয়তো তাকে আত্নহত্যার পথ বেছে নিতে হতো।
পরদিন সকালে অনু নিজেই সকালের নাস্তা তৈরী করে। ডাইনিং টেবিলে বসে সালমা বেগম ছেলের দিকে তাকান। কাল রাতে তার চেঁচামেচি সবটাই তিনি শুনেছেন। রাইয়ান খেতে বসে তার মায়ের দিকে তাকায় না, নিশ্চুপে নাস্তা শেষ করে। নাস্তা শেষ করার পরে সালমা বেগম তাকে তার ঘরে আসতে বলেন। ছেলেকে তিনি কিছু বলতে চান।
রাইয়ান চুপচাপ তার মায়ের ঘরে যায়। মায়ের প্রতি তার একটা তীব্র অভিমান কাজ করে। সালমা বেগম ছেলের দিকে কিছুসময় একদৃষ্টিতে তাকিয়ে থাকেন। তারপর বলেন,
-“রাইয়ান তুই বারবার জানতে চেয়েছিলি না যে কেনো তোকে আমি অনুর সঙ্গে বিয়ে দিলাম?” রাইয়ান ঝাঁঝালো গলায় বলে,
-“তার উত্তর কি আছে তোমার কাছে মা?” সালমা বেগম কোনো কথা বলেন না। আস্তে করে খাট থেকে উঠে আলমারি টা খুলেন। সেখান থেকে একটা ডায়েরি বের করেন। ডায়েরি টা রাইয়ানের হাতে দেন। রাইয়ান কিছুটা অবাক হয়। বলে,
-“মা, এই ডায়েরি টা কার?” সালমা বেগম ম্লান হাসেন। বলেন,
-“এখানে তোর সব প্রশ্নের উত্তর পাবি। আমার মনে হয় এখন তোর সবটা জানা প্রয়োজন। কিন্তু সব টা জানার পর আমাকে বা তোর বাবাকে ভুল বুঝিস না।” রাইয়ান চুপচাপ ডায়েরি টা নিয়ে ওর ঘরে যায়। ওর ভিতর ভীষণ কৌতুহল কাজ করে। কি এমন ডায়েরিতে লেখা আছে, যার জন্য ভুল বোঝাবুঝি হতে পারে!
রাইয়ান ওর পড়ার টেবিলে বসে ডায়েরি টা খোলে। সেখানে লেখা, “প্রিয় রাইয়ান, তুই আমার উপর অনেক রাগ অভিমান করে আছিস আমি জানি। তোর ইচ্ছের বিরুদ্ধে অনুকে তোমার সাথে বিয়ে দেওয়াটা হয়ত ঠিক হয়নি। কিন্তু এই সমাজে একজন ধর্ষিতা মেয়ে যে কতোটা অবহেলিত, কতোটা নিরূপায়,কতটা অসহায় তা আমি নিজের চোখে দেখেছি সেই বাইশ বছর আগে। তুই বলতে পারিস এখনকার সমাজ বদলেছে, কিন্তু আমি এই সমাজ আর সেই আগের সমাজের সঙ্গে কোনো অমিল খুঁজে পাইনা। তোকে একটা গল্প বলি। আঠারো বছরের এক দুরন্ত ডানপিটে মেয়ে। উত্তরের এক গ্রামে তার বাস। সবে কলেজে পড়ছে। প্রায় বিশ বছর আগেও মেয়েরা লেখাপড়া করছে, এটা সমাজ এবং সমাজের মানুষ ভালো চোখে দেখতো না। কিন্তু মেয়েটার বাবা ছিল ওই এলাকার সমাজপতিদের একজন। সেই সুবাদে সে বাড়ির মানুষকে সবাই সমীহ করে চলত। মেয়েটাও অনেক স্বপ্ন দেখতো, জীবনে অনেক বড় হবে। নিজের পায়ে দাঁড়াবে।
সে অনেক মন দিয়ে পড়াশোনা করত। কিন্তু ঝড় আসতে তো সময় লাগে না। পাশের গ্রামের এক ব্যক্তির সঙ্গে মেয়েটার বাবার কি একটা জমি নিয়ে বিবাদ হলো। সেই বিবাদের জের ধরে প্রতিশোধ স্বরুপ একদিন কিছু গুন্ডা মেয়েটাকে তুলে নিয়ে গিয়ে নিজেদের মতো ভোগ করলো। সে এক নির্মম অত্যাচার। সেদিন মেয়েটার চিৎকার যেনো লোকে শুনেও শুনলো না। কেউ বাঁচাতে এলো না। মেয়েটা যখন নিজের বাড়ি ফিরে এলো, সেখানে তার ঠাঁই হচ্ছিল না। নিজের বাড়ির মানুষই তাকে কলঙ্কিত বলে দিনরাত গালাগাল করতে লাগল। পড়াশোনাও বন্ধ। যে বাবা মেয়েটাকে সবসময় সাহস দিতেন, স্বপ্ন দেখাতেন সেই বাবাও কেমন হয়ে গেল। গ্রামের লোকজন একঘরে করে দিলো। মেয়েটি নিজের ঘরে বন্দি হয়ে রইল মাসের পর মাস।
তারপর হঠাৎ মেয়েটা তার মধ্যেই আরেকটা প্রানের অস্তিত্ব খুঁজে পেল। তার মা জানতে পেরে সেদিন তাকে ইচ্ছেমতো মারলেন, বললেন এ মুখ যেনো কাউকে না দেখায় সে। সে মরে গিয়ে যেন উদ্ধার করে তাদের। কিন্তু মেয়েটা শতভেবেও তার দোষ কোথায় তা খুঁজে পায় না। সেদিন গভীর রাতে মেয়েটা ঘর থেকে বের হয়ে যায়। সে এলাকার বড় রাস্তা ধরে হাঁটতে থাকে। তারপর ব্রিজের ওপর দাঁড়ায়। নিচে বর্ষায় নদী পুরো ভরা। মেয়েটা সাঁতার জানে না। কিছুক্ষন তাকিয়ে থেকে সে ঝাঁপ দিতে যাবে, এসময় পিছন থেকে একটা ছেলে তাকে ধরে ফেলে।
ছেলেটি সে এলাকায় এনজিও এর কাজে এসেছিল। অনেকদিন মেয়েটার বাবার সাথে দেখা করতে ও বাড়ি যাওয়ায় দুজন দুজনকেই চিনে। হঠাৎ বাড়ি যাবার চিঠি পাওয়ায় মন মানছিলো না। সে ভেবেছিল সে রাতেই ব্রিজে রাতের কোনো মালবাহী ট্রাক পেলে সেটা ধরেই শহরে যেতে পারবে, তাই ব্রিজে এসেছিলো। তখনই মেয়েটাকে ওখানে দেখে এবং বাঁচায়। মেয়েটাকে বাঁচিয়ে বাড়ি ফিরিয়ে দিয়ে আসতে চাইলেন তিনি। কিন্তু মেয়েটা অঝোরে কাঁদছিল,সে ফিরে যেতে চায় না। মরতে চায়। পরিস্থিতির সবটা শুনে সে রাতে নিরাপত্তার খাতিরে মেয়েটাকে নিয়ে তার বাসায় আসে। তারপর সিদ্ধান্ত নেন ভোরের বাস ধরে মেয়েটাকে নিয়েই বাড়ি ফিরবে। বাড়ি ফিরে যে চমক অপেক্ষা করছিল মেয়েটা জানত না। ছেলেটির পরিবার যখন হাজার টা প্রশ্ন করছিল, ছেলেটি সবার সামনে দাঁড়িয়ে উত্তর দেয়, এই মেয়েটিকেই সে ভালোবাসে। কিন্তু আবেগের বশে সে একটা ভুল করে বসেছে, তার ফলস্বরূপ মেয়েটির পেটে তার সন্তান। সবকিছুর জন্য ছেলেটি দায়ী। সে মেয়েটাকে যতদ্রুত সম্ভব বিয়ে করতে চায়।
পরিবারের সবাই এতে রাগ হলেও না করে না। মনঃক্ষুণ্ন হয়েই কিছুদিনের মধ্যে তারা বিয়েটা সেরে ফেলেন। ছেলেটা মেয়েটাকে নিয়ে নতুন শহরে চলে আসে। মেয়েটা খুব অবাক হয়েছিল সেদিন। মেয়েটাই চেয়েছিল তার ভিতরের সেই সন্তানটাকে পৃথিবী দেখার আগেই মেরে ফেলতে। কিন্তু ছেলেটা তা হতে দেয় না। বলে ও আমাদের সন্তান। সে আমাদের পরিচয়েই বড়ো হবে। মেয়েটার কোলজুড়ে একটা ছেলে সন্তান আসে। মেয়েটা আবার পড়াশোনা শুরু করে, সংসার সামলায়। ছেলেটা মেয়েটার সেই স্বপ্নপূরণের সঙ্গী হয়। মেয়েটার পরিবারের সাথে কোনোদিন আর যোগাযোগ হয়নি। তারা হয়তো তাকে মৃত বলেই ধরে নিয়েছে, মেয়েটাও মৃত বলেই থাকতে চায়। সে তো মরেই গিয়েছিল, তারপর নতুন এক জীবন ফিরে পেয়েছে।
সেদিনের সেই মেয়েটি ছিলাম আমি আর ছেলেটা ছিলো তোর বাবা। তুই হয়তো কখনো কোনোদিন কিছু বুঝতেই পারিসনি, পারতিও না। কারণ তার মাঝে আমাদের সুস্থ মানসিকতা আর আদর্শবাদ ছিলো। আর তোর বাবা এতোটাই ভালো মানুষ ছিলেন, সারাটা জীবন বুক দিয়ে আমাদের আগলে রেখেছেন, ভালোবেসেছেন। এখন তুই অনুর সঙ্গে কি করবি সেটা তোর ব্যাপার। অনুর সঙ্গে যদি খারাপ কিছু হয়,তাহলে ধরে নিবো আমরা যা চেয়েছিলাম তা হয়নি। আমরা তোকে মানুষ করতে পারিনি, আমাদের ব্যর্থতা।” ডায়েরিটা এখানেই শেষ। রাইয়ানের কাঁদতে ইচ্ছে হয়,কিন্তু সে কাঁদে না। তার কেমন গর্ব হয়,এমন বাবা মা সবাই পায় না। আস্তে করে ডায়েরিটা তার ওয়ারড্রবে রাখে। তারপর ঘর থেকে বের হয়। রান্নাঘরে মা আর অনু দুজন মিলে কাজ করছে আর কথা বলছে। রাইয়ান রান্নাঘরের দরজার সামনে দাঁড়ায়। অনুকে ডাকে। অনু ভয়ার্তগলায় বলে,
-“জ্বি বলুন।” রাইয়ান স্বাভাবিক গলায় বলে,
-” আমাকে এক কাপ চা দাও তো।” অনু অবাক হয়। এই মানুষ টাই তো সকালবেলা তার রান্না বলে খেতে চাইছিলো না।
-“আপনি আমার হাতে চা খাবেন?” রাইয়ান হাসে। বলে,
-“হ্যাঁ খাবো। আমি আবার মশলা চা পছন্দ করি। মা এটা খুব ভালো বানান।” তারপর মায়ের দিকে তাকিয়ে মিষ্টি হেসে বলে,
-“মা, তোমার বউমাকে মশলা চা বানানোটা শিখিয়ে দিও তো!”
সালমা বেগম মনে হয় প্রথমবারের মতো অনুর মুখে হাসি দেখলেন। মেয়েটার হাসতে হাসতেই চোখে পানি আসে। মেয়েটাকে অস্বস্তিতে না ফেলতে উনি উনার রুমে চলে আসেন। দেয়ালে টাঙানো রাকিব হাসানের ছবির সামনে দাঁড়ান। মনে মনে বলেন,
-” ওগো আমরা স্বার্থক! তুমি ঠিকই বলেছিলে, ভালো কিছুর জন্য শেষ থেকে শুরু করতে হয়।”
গল্পের বিষয়:
গল্প