ইরাবতী

ইরাবতী
গভীর রাত। চারপাশে সুনসান নীরবতা। একটি দোতলা বাড়ি। নীচ তলায় টিপ টিপ করে আলো জ্বলছে। ইসমাইল হোসেন মেয়েকে কোলে নিয়ে বসে আছেন। জানালা দিয়ে একটা ঠান্ডা বাতাস ঢুকছে ঘরের মধ্যে। বাতাসের পরশে মোমবাতিটা নিভু নিভু প্রায়। কয়েকদিন ধরে বিদ্যুৎ নেই। একটু ঝড় হলেই কমপক্ষে তিনদিনে এর দেখা পাওয়া যায় না। নীলুফা বেগম দুধ গরম করছেন মেয়ের জন্য। ইসমাইল হোসেন ও নীলুফা বেগমের একমাত্র মেয়ে ইরাবতী। ডাক নাম ইরা। এ বছর স্কুলে যাওয়া শুরু করেছে।
বয়স পাঁচ কি ছয় হবে। বেশ আদুরে মেয়ে। রাত দুপুরে সজাগ হয়ে দুধ খাওয়ার বায়না ধরেছে। ইরাবতীর মুখ থেকে বায়না উচ্চারণ করতে দেরি হলেও তা পূরণ করতে দেরি হয় না। ইসমাইল হোসেনের সাফ কথা, “সারা পৃথিবী একদিকে আর আমার মেয়ে একদিকে ।” শুধু ইসমাইল হোসেন না, পৃথিবীর সকল বাবার কাছেই তার সন্তান বিশেষ কিছু। আর মায়ের কাছে সন্তান কেমন ? এ প্রশ্নের উত্তর সকলেরই জানা । একজন মা সন্তানের জন্য নিজেকে তিলে তিলে বিলিয়ে দেন প্রতিনিয়ত। দুদিন পরে ইরাবতীর জন্মদিন। কিছুদিন আগে ইরাবতী খুব অসুখে পড়েছিল। ইসমাইল হোসেন মেয়ের সুস্থতার জন্য একটা খাসী মানত করেছিলেন। কিন্তু মানতের খাসীটা এখনো কোথাও দেয়া হয়নি। এবার সুযোগ এসেছে। জন্মদিনে এলাকার গরীব দুঃখীকে খাসীটা খাওয়াতে চান ইসমাইল হোসেন। এ ব্যাপারে স্ত্রীকে জিজ্ঞেস করলেন,
– ইরার জন্মদিনে মানতের খাসীটা খাওয়ালে কেমন হয়? নীলুফা বেগম বললেন,
– মানতের খাসী জন্মদিনে খাওয়ালে মেয়ের অকল্যাণ হবে। স্ত্রীর মতামত ইসমাইল হোসেনের পছন্দ হল না। শুরু হল তর্ক। ইসমাইল ভ্রু কুঁচকে বললেন, ” কিসের অকল্যাণ? যা বুঝ না, তা নিয়ে কথা বলতে এসো না। “
স্বামীর কথা একদম পরোয়া করে না নীলুফা বেগম। মেয়ের জন্মদিনে খাসী খাওয়াবে , তবে সেটা মানতেরটা নয়, এটাই তাঁর শেষ কথা। ইসমাইল হোসেন বড় জেদি মানুষ। মুখে যা বলেন , কাজেও তাই প্রমান করেন। কালকে মানতের খাসীই রান্না হবে, এটাই তাঁর শেষ কথা। তর্ক চলতে থাকে। কখনো নীচু স্বরে কখনো উচ্চ স্বরে। ফজরের আযান হয়েছে। তর্কটা এবার ঝগড়ায় পরিণত হল। ইরাবতী ঘুমোচ্ছে। ইসমাইল হোসেনের মেজাজটা টন টন করছে। একে তো সারা রাত জাগনা , তার উপরে খাসী কান্ড! সকালে অফিসে যেতে হবে। কী করবেন বুঝতে পারছেন না। ইচ্ছে করছে জোরে একটা চিৎকার করতে। চিৎকারে দারুন উপকার পান অনেকে। অনেক মানুষ আছে যাদের রাগ যখন সহ্যের সীমা অতিক্রম করে তখন তারা চিৎকার করেন। এতে রাগ প্রশমিত হয়। কিন্তু এই মুহূর্তে ইসমাইল হোসেনের চিৎকার দিতে ভাল লাগছে না।
ইসমাইল হোসেন অফিসের জন্য প্রস্তুতি নিচ্ছেন। ইরাবতী মাত্রই ঘুম থেকে উঠেছে। নীলুফা বেগমের ব্যস্ততার আর শেষ নেই। মেয়েকে স্কুলের জন্য রেডি করতে হবে। সকালের নাস্তা এখনো তৈরি হয়নি। মেজাজ যেন আগুনের ফুলকি। গতরাতের ঝগড়ায় তিনি জিততে পারেননি। ঝগড়ায় না জিতলে এর তেজ তিন চারদিন পর্যন্ত থাকে। পান থেকে চুন খসলেই আবার ঝগড়া বেধে যেতে পারে। তাই মনে মনে প্রস্তুতিও নিয়ে রেখেছেন। ইসমাইল হোসেনের শরীরটা ভাল লাগছে না। রাত জাগার কারনে হয়তো এমনটা হয়েছে। আজকে অফিসে যাবেন না ভাবছেন। নীলুফা বেগম স্বামীর অবস্থা বুঝতে পেরেছে। বাঙালী নারীদের এটা চিরায়ত বৈশিষ্ট্য । এরা স্বামীর মুখ দেখে অন্তরের খবর বলে দিতে পারে। নীলুফা বেগম বললেন,
– শরীর কি বেশি খারাপ লাগছে?
– হুম। এক কাপ গরম চা দাও তো !
নীলুফা বেগম নাস্তা রেখে চা বানাতে লাগলেন। ইরাবতী দাত ব্রাশ করছে। ইসমাইল হোসেন বললেন, “মামনি, আজকে আমি অফিসে যাব না। তোমাকেও স্কুলে যেতে হবে না।” স্কুলে যেতে হবে না – কথাটি ইরার কাছে যেন ইদের মত মনে হল। “কী মজা, কী মজা – আজ স্কুলে যাব না” – বলে এক লাফ দিয়ে বাবার কোলে উঠলো ইরা। বাবার কোল একটা মেয়ের জন্য পৃথিবীতে সবচেয়ে নিরাপদ আশ্রয়। এ আশ্রয়টুকু যতদিন টিকে থাকে, একটা মেয়ের জীবন ততদিন সুন্দর ও সাবলীল থাকে। গভীর রাতের ঝগড়া ঝাটি এখন শান্তিতে রুপ নিয়েছে। সংসার অনেকটা সমুদ্রের মত। কখনো এর সমান্তরাল প্রবাহ, কখনো এর উত্তাল প্রবাহ। সংসারে টিকে থাকতে হলে সবাইকেই সেক্রিফাইজ করতে হয়। তবে যে কোন একজনকে একটু বেশি নিবেদিত হতে হয়। বাড়ির সামনে ছোট্ট একটি উঠোন। উঠোনের চারপাশে নানা রকম ফলের গাছ, ফুলের গাছ। পুরো উঠোন জুড়ে খেলায় মেতেছে ইরাবতী। বারান্দায় বসে মেয়ের এই উচ্ছ্বলতা দেখছে ইসমাইল হোসেন। নীলুফা বেগম রান্না করছেন।
দুপুর গড়িয়ে বিকেল হল। আবার শুরু হল ঝগড়া। এবারের ইস্যুটা ভিন্ন। ইসমাইল হোসেনের একটা লাল পাঞ্জাবী আছে। একজন কলিগ গিফট দিয়েছিল। সমস্যা মূলত পাঞ্জাবী নিয়ে নয়, যিনি গিফট দিয়েছেন তাকে নিয়ে। কলিগের নাম ঝুমুর আক্তার। নীলুফা বেগম উচ্চ স্বরে বললেন, “এই পাঞ্জাবী তুমি পরতে পারবা না। আমি আগুন দিয়ে পুড়ে ফেলবো। ” ইসমাইল হোসেনও কম যান না। তিনি বললেন, “তোমার খালাতো ভাই যে শাড়ি দিয়েছিল তাতে কোনো সমস্যা নেই? তাঁর সাথে তোমার প্রেম ছিল এতেও কোন সমস্যা নেই।” এভাবে খুঁচে খুঁচে সবাই সবার দোষ ত্রুটি বের করতে লাগলো। কারো গোপন কথাই আর গোপন থাকলো না। ঝগড়ার সময়ে বিরোধী পক্ষকে কাবু করার অন্যতম হাতিয়ার হল দুর্বল জায়গায় আঘাত করা। যা ইসমাইল হোসেন ও নীলুফা বেগম ঠিকঠাক মত করছেন।
স্বামী-স্ত্রীর তর্ক বিতর্কের গতি আরো বাড়তে লাগলো। কেউ কাউকে ছেড়ে কথা বলছে না। নিজের সর্ব শক্তি ঢেলে দিচ্ছেন। প্রচন্ড রাগ নিয়ে নীলুফা বললেন, “জীবনে সবচেয়ে বড় ভুল হল তোমার মত একটা কাপুরুষকে বিয়ে করা।” কথাটি শুনে ইসমাইল হোসেন যেন বারুদের মত জ্বলে উঠলেন। কাপুরুষ উপাধি যে কোন পুরুষের জন্য খুবই অসহ্যকর। এরা এই উপাধি থেকে পরিত্রানের জন্য যে কোন কিছু করতে পারেন। ইসমাইল হোসেনও কিছু একটা করার চেষ্টা করলেন। বউকে একটা থাপ্পড় দেয়ার জন্য এগিয়ে গেলেন। আবার কী যেন মনে করে দিলেন না। এতে নীলুফা বেগম যেন আরো জ্বলে উঠলেন। ব্যাগ গুছিয়ে বাবার বাড়ি রওনা দিলেন। ইসমাইল হোসেন আটকালেন না। ব্যাগ নিয়ে উঠোনের সামনে দাঁড়ালেন নীলুফা। মেয়েকে কোলে নিয়ে বললেন, “নানু বাড়ি চল”। ইসমাইল হোসেন চিৎকার দিয়ে বললেন, “আমার মেয়ের গায়ে হাত দিবা না। যেতে হলে একা যাও। ” ইরাবতীর ছোট্ট মুখখানা মলিন হয়ে গেল। মা বাবা যে ঝগড়া করেছে তা ও বুঝতে পেরেছে। মায়ের কোল থেকে নেমেই আব্বু আব্বু বলে কয়েকটা ডাক দিলো ইরাবতী।
নীলুফা বেগম প্রচন্ড রাগ নিয়ে চলে গেলেন। ইসমাইল হোসেন মেয়েকে কোলে নিলেন। মানুষের মাঝে যখন পশুত্ব জেগে ওঠে তখন তারা পৃথিবীর সকল সম্পর্ক ছিন্ন করতে পারে। পৃথিবীতে একই মানুষের মধ্যে হাজারটা রুপ। ইসমাইল হোসেন মেয়ের কাছে একরকম। স্ত্রীর সাথে অন্যরকম। স্ত্রীর কাছে একটা ভন্ড কাপুরুষ, মেয়ের কাছে মহামানব । নীলুফা বেগম নিজের সন্তানকে রেখে কীভাবে বাড়ি ছাড়লেন? মেয়ের জন্য একটুও মন কাঁদলো না? হয়তো আবেগের বশবতী হয়ে এমনটা করেছেন। বিকেল গড়িয়ে রাত হল। ইরাবতী মায়ের জন্য কাঁদছে। ইসমাইল হোসেনের কাছে শুধু বাবার ভালবাসা আছে। মায়ের ভালবাসা নেই। কিন্তু ইরাবতীর দুটোই দরকার। মেয়ের কান্না থামাতে আপ্রাণ চেষ্টা চালাচ্ছেন ইসমাইল।
পরেরদিন সকালে নীলুফা বেগম ফিরে এলেন। ঘরে ঢুকেই মেয়েকে জড়িয়ে ধরলেন। ইরাবতী মাকে দেখে কেঁদে ফেললো। দূরে দাঁড়িয়ে সবকিছু দেখছে ইসমাইল। নীলুফা বেগম মেয়েকে ছেড়ে একটা রাত কাটিয়েছে। চোখে মুখে একধরনের কষ্টের ছাপ স্পষ্ট। মেয়েকে না দেখে থাকতে পারেননি তাই চলে এসেছেন। স্বামীর সাথে একটা কথাও বললেন না । ইরাবতীর এবারের জন্মদিনটা সাদামাটাভাবে কাটলো। মেয়ের জন্মদিন সাদামাটাভাবে কাটলেও স্বামী স্ত্রীর সম্পর্কটা সাদামাটা থাকলো না। দিন দিন ঝগড়া ঝাটি বাড়তে লাগলো। সামান্য বিষয় নিয়ে প্রতিদিন তুলকালাম কান্ড ঘটে। ইরাবতীর চোখের সামনে হাতাহাতিও হয়েছে বেশ কয়েকবার। মা বাবার এরকম পরিস্থিতি দেখে খুব ভয় পায় ইরাবতী। ভয়ে কান্নাও করে প্রায়ই। সেদিকে মা বাবার কোন খেয়াল নেই।
যতই দিন যাচ্ছে সম্পর্কের তিক্ততা ততই বাড়ছে। এর শেষ কোথায় কে জানে? ইসমাইল ও নীলুফার সম্পর্কটা মূলত ঝুলে আছে। পৃথিবীতে ঝুলে থাকা সম্পর্কগুলো সবচেয়ে ভয়ংকর। যেকোন সময় মারাত্নক বিপদ ঘটে যেতে পারে। যে বিপদের দ্বারা সম্পর্কের প্বার্শ চরিত্রগুলোও ক্ষতিগ্রস্ত হতে পারে। একদিন সকালে নীলুফার মা ও বড় ভাই এলেন। শাশুড়ির প্রতি বিন্দুমাত্র সন্মান দেখালেন না ইসমাইল। বড় ভাই বাবুল মিয়া সরাসরি কথা বলতে পছন্দ করেন। ইসমাইলকে উদ্দেশ্য করে বললেন, “আমরা নীলুফাকে নিতে এসেছি।” ইসমাইল কিছু বলছে না। ইরাবতী নানীর কোলে বসে আছে। সবাই অনেক জোরে কথা বলছে। খুব ভয় লাগছে ইরাবতীর। নীলুফার মা বললেন, “এই দোযখের মধ্যে আমার মেয়েকে রাখবো না।”
একজন মা যখন মেয়ের পক্ষে এভাবে কথা বলবে তখন ধরে নিতে হবে যে, মেয়ের সংসারের এই পরিনতির জন্য মা অনেকাংশে দায়ী। ইসমাইল অন্যদিকে তাকিয়ে বললেন, “আপনাদের মেয়েকে নিয়ে দয়া করে আমাকে বাঁচান।” ইসমাইলের কথা শুনে বাবুল মিয়া খুব ক্ষেপে গেলেন। চেয়ার থেকে চট করে দাঁড়িয়ে গেলেন। এত বড় অপমান। এই অমানুষটার কাছে নিজের বোনকে আর নিরাপদ মনে করছেন না বাবুল মিয়া। নীলুফার ব্যাগ গোছানো ছিল আগে থেকেই। ইরাবতী কার সাথে থাকবে এটা নিয়ে সমস্যা দেখা দিল। ইসমাইল হোসেনের সাফ কথা, “আপনাদের মেয়েকে নিয়ে যান অথবা কেটে ফেলেন এতে আমার কোন মাথা ব্যাথা নেই, কিন্তু আমার মেয়ে আমার কাছেই থাকবে।”
নীলুফা বেগম বললেন, “মেয়ে তোমার একার না। ” নীলুফা বেগম ঠিকই বলেছেন। সন্তান কখনো একজনের হয় না। সন্তান যেমন দুজনের ভালবাসাও তেমনি দুজনের। অধিকারও দুজনের। দায়িত্বও দুজনের। তবে এখন দায়িত্বের চেয়ে, জয় – পরাজয়টাই মুখ্য হয়ে দাঁড়িয়েছে। সন্তানকে ভালবাসার টানে কাছে টানছে না। কাছে টানছে নিজের খামখেয়ালিপনাকে টিকিয়ে রাখার জন্য। ইরাবতী বাবার গলা ধরে বসে আছে। ও বাবাকে ছেড়ে কোথাও যাবেনা। একপর্যায় ইরাবতীকে জোর করে নিয়ে গেলেন নীলুফা বেগম। বাচ্চা মেয়েটা চিৎকার দিয়ে কাঁদছে। “আমি আব্বুর কাছে থাকবো।” হিংস্র মানুষগুলোর কাছে এই চিৎকারের কোন মূল্য নেই। কিছুদিন পর।
ঝুলে থাকা সম্পর্কের অবসান চান দুজন। সাত বছর আগে পারিবারিকভাবে বিয়ে করেছিলেন। তাদের একটা সুন্দর সংসার হতে পারতো। নিজেদের টানে না হলেও, অন্তত ফুটফুটে মেয়েটার টানে সংসারটাকে টিকিয়ে রাখতে পারতেন। কীসের নেশায় সাজানো সংসারকে তছনছ করে দিচ্ছে কে জানে? আদালতের মাধ্যমে দুই পক্ষের বিচ্ছেদ হল। ডিভোর্স হল স্বামী স্ত্রীর। বিচারক বারবার বলেছেন,”আপনারা বাচ্চাটার কথা একটু ভেবে দেখুন। ওর ভবিষ্যৎ কোন দিকে যেতে পারে একটু ভেবে সিদ্ধান্ত নিন।” কিন্তু ইসমাইল ও নীলুফা নিজেদের সিদ্ধান্তে অটল রইলেন। ইরাবতী মলিন মুখে একবার বাবার দিকে একবার মায়ের দিকে তাকায়। ওর জীবনে কী ঘটতে চলেছে তা হয়তো বুঝতে পারেনা। তবে মা বাবা দুজনই যে ওকে একটু একটু করে অবহেলা করছে তা বুঝতে পেরেছে। কিছুদিন আগেও নিজেরা আলাদা হতে চাইলেও ইরাবতীকে চাইতো দুজনেই। কিন্তু এখন কেউই চায় না। নিজের সন্তানকে এখন বোঝা মনে হচ্ছে।
সমস্যা সমাধানের জন্য আদালতের দারস্থ হতে হয়েছে। বিচারকের সিদ্ধান্তটা এমন, ” বাচ্চার বয়স দশ বছর না হওয়া পর্যন্ত মায়ের কাছে থাকবে। এ সময়ে বাচ্চার যাবতীয় খরচ বাবা বহন করবে।” কিন্তু দশ বছর বয়সের পরে কী হবে এ সম্পর্কে আদালত কিছু বলেননি। আদালত কক্ষ থেকে সবাই বেড়িয়ে গেলেন। বিদায়বেলা বাবার কাছ থেকে একটু আদর পেতে পারতো ইরাবতী। কিন্তু ইসমাইল হোসেন সম্পর্ক ভাঙার যে খেলায় মেতেছেন সেখানে আদর ভালবাসার কোন ঠাঁই নেই। নীলুফা বেগম ভাইয়ের সংসারে অতিরিক্ত লোক হিসেবে প্রবেশ করলেন। কাবিননামার কিছু টাকা হাতে আছে। যা দিয়ে মাসছয়েক চলা যাবে। এরপর পুরোপুরি ভাইয়ের উপর নির্ভর করতে হবে। দিনে দিনে ইরাবতী কেমন যেন হয়ে যাচ্ছে। সারাদিন ঘরের এক কোণে চুপচাপ বসে থাকে। মামাতো ভাই বোনদের সাথে প্রায়ই এটা সেটা নিয়ে খুঁনসুটি হয়।
মাসখানেক পর একদিন সন্ধ্যায় ইসমাইল হোসেন মেয়েকে দেখতে আসলেন। বাড়ির ভিতরে ঢুকেননি। রাস্তায় দাঁড়িয়ে খবর পাঠালেন। খবর শুনে এক দৌড়ে রাস্তায় আসলো ইরাবতী। এক লাফে বাবার কোলে উঠলো। বাবাকে জড়িয়ে ধরে ফুঁপিয়ে ফুঁপিয়ে কাঁদছে মেয়েটা। ইসমাইল হোসেনের চোখেও পানি। দৃশ্যটি বড়ই মর্মান্তিক। দূর থেকে দেখছে নীলুফা বেগম। কাছে যাওয়ার সাহস ও ইচ্ছা কোনটাই তাঁর নেই। বাবার গলা ধরে ইরাবতী বললো,”আমার কথা তোমার মনে পড়ে না?” এই প্রশ্নের কোন উত্তর জানা নেই ইসমাইলের। বাবার সাথে যেতে চায় ইরাবতী। কিন্তু বাবা নিলেন না। কাঁদতে কাঁদতে মায়ের হাত ধরে মামা বাড়িতে ঢুকলো ইরাবতী।
বাবুল মিয়া নীলুফার বিয়ে দিতে চান। নীলুফা এ বিষয়ে কিছু বলছে না। ভাইয়ের সংসারে বোঝা হয়ে থাকাটা বড়ই কষ্টের । এ কষ্টের সামনে ইসমাইলের দেয়া কষ্ট কিছুই না। তাই ইচ্ছে না থাকা সত্যেও দ্বিতীয় বিয়ের জন্য রাজি হলেন নীলুফা বেগম। আজ ইরাবতীর মায়ের বিয়ে। বাড়িতে তেমন কোন উৎসব নেই। দু তিনজন লোক এসে নীলুফাকে নিয়ে যাবে। ইরাবতী কোথায় থাকবে? মামা বাড়ি নাকি মায়ের শ্বশুড় বাড়ি? এ বিষয়ে এখনো সিদ্ধান্ত হয়নি। বাবুল মিয়ার স্ত্রী আপ্রাণ চেষ্টা চালাচ্ছেন যাতে পাত্র পক্ষের বাড়িতে ইরাবতীকে গছিয়ে দেয়া যায়। কিন্তু বাবুল মিয়া এমনটা চাচ্ছেন না। এ নিয়ে স্ত্রীর সাথে তাঁর কয়েকবার কথা কাটাকাটিও হয়েছে।
ইরাবতীকে রেখে মা চলে গেলেন। বিদায় বেলায় মা ও মেয়ের কান্না দেখে বাড়ির প্রতিটি লোকের চোখে পানি ছল ছল করেছে। বাবুল মিয়ার স্ত্রীও বেশ কয়েকবার আঁচল দিয়ে চোখ মুছেছেন। ইরাবতীর চোখে যে পানি তার মূল্য কে দিবে? এই ছোট্টমনে যে ক্ষতের সৃষ্টি হয়েছে তা কী দিয়ে পূরণ হবে? হয়তো কোনদিন পূরণ হবে না। বছরখানেক পর একদিন সকালে, ইসমাইল হোসেন ইরাবতীকে দেখতে এলেন। ইরাবতী এখন আর সহজে কাঁদে না। একটা মানুষের জন্য চোখের পানি নির্দিষ্ট পরিমানে বরাদ্দ থাকে। ইরাবতীর ছোট্ট জীবনে হয়তো সবটুকু পানি খরচ হয়েছে। বাবা কোলে নিতে চাইলে খুব একটা আগ্রহ দেখায় না ইরাবতী। শুধু মলিন মুখে তাকিয়ে থাকে উঠোনের দিকে। বাবা ইরাবতীকে নিতে এসেছে। নতুন জামা পরে রওনা হল।
দুপুরের মধ্যে বাড়িতে পৌঁছল বাবা ও মেয়ে। বাড়ির উঠোনে গাছগুলো আগের মতই আছে। গোলাপ গাছে ফুল ধরেছে। গাছগুলো মা লাগিয়েছিলেন। জানালার পাশে যে বিছানায় ইরাবতী ঘুমাতো সেখানে একটা ফুটফুটে শিশু ঘুমিয়ে আছে। শিশুটিকে দেখিয়ে বাবা বললেন , “এটা তোমার বোন।” দেয়ালে যেখানে ইরার ছবি টাঙানো ছিল, সে জায়গাটা এখন খালি। রান্নাঘরে এক মহিলা দাঁড়িয়ে আছেন। তাকে দেখিয়ে বাবা বললেন, “ইনি তোমার মা।” ইরাকে দেখে মহিলা একটু হাসলেন। কিন্তু হাসিটা মোটেও ওর মায়ের মত না। ইরার মনে আছে এই রান্নাঘরে বসে মা কীভাবে রান্না করতেন। পিছন থেকে এসে ইরাবতী মাকে জড়িয়ে ধরতো। মা হাসিমুখে কোলে নিতেন।খেলনাগুলো একটাও নেই আগের মত। সবকিছু দেখে মায়ের কথা খুব মনে পরছে।
বুক ফেটে কান্না আসছে ইরাবতীর। যে বাড়ির প্রতিটি জায়গায় ইরাবতীর পদচারণা ছিল , সেখানে ইরাবতীর কোন চিহ্ন এখন আর নেই। এখানে আর এক মুহূর্তও থাকতে ইচ্ছে করছে না। বাবার কাছে বললো,” আব্বু আমি নানুর কাছে যাব।” ইসমাইল হোসেন মেয়ের মনের অবস্থা হয়তো বুঝতে পেরেছেন। সন্ধ্যারদিকে ইরাবতীকে নানুর কাছে রেখে গেলেন ইসমাইল।
ইরাবতী প্রতিদিন স্কুলে যায়। মামীর সাথে সংসারে কাজ করে। এতকিছু সামলে মামাতো ভাই বোনদের সাথে খেলার সময়টুকু পায় না। যখন অনেক বেশি কষ্ট হয় তখন পুকুর পাড়ে আম গাছটির নিচে বসে থাকে একা একা। সবার অগোচরে চোখের জল ফেলে। ছোট্ট মনে জমে আছে অনেক কথা । কিন্তু এ কথা শোনার মানুষ নেই।
ইরাবতী স্বপ্ন দেখে, একদিন মা বাবার মাঝখানে শুয়ে রুপকথার গল্প শুনবে। এই স্বপ্ন কি পূরণ হবে? হয়তো হবে, হয়তো হবে না।
গল্পের বিষয়:
গল্প
DMCA.com Protection Status
loading...

Share This Post

আরও গল্প

সর্বাধিক পঠিত