শিবনগরের রাজা খুব প্রজা বৎসল। প্রজারাও রাজাকে খুব ভালবাসে, শ্রদ্ধা করে। চারিদিকে শান্তি, উন্নতি আর প্রেমের হাওয়া উড়ে বেড়াচ্ছে। তেমনি সুখের দিনে সেই শিবগড়ের এক প্রতিভাবান দম্ভী গায়ক, গঙ্গাধর এল। সঙ্গীতে তার জ্ঞান সত্যিই অপরিসীম। রাগ-রাগিণী, ছন্দ-তাল সম্পর্কে তার ধারণা একদম পরিষ্কার। বহু সাধনার পরে এমন সুর মিলে, একমাত্র ঈশ্বরের অসীম কৃপাতেই এমন গান গাওয়া যায়। গঙ্গাধরের গান শুনলে মনে হয় সপ্ত-স্বর্গের কোন মধুর স্বর তার ভীতর থেকে ভেসে ভেসে আসছে। যে ব্যক্তিই তার গান শুনে, সে-ই মুগ্ধ হয়ে যায়। তার মিষ্ট মধুর সুর পরশপাথরের মত মানুষকে তার দিকে আকৃষ্ট করে রাখে। কার সাধ্য যে, সেই গান শেষ না করে আসর থেকে উঠে যায়? সবাই গঙ্গাধরকে খুব আদর করে, মান দেয়, সমীহ করে।
কিন্তু পরম সুন্দরের এমন ক্ষমতা ও প্রতিভায় বলীয়ান হয়ে ও গঙ্গাধর নিজেকে ঠিক রাখতে পারল না। এমনটা বহু লোকের সাথেই হয় – অর্জিত ধন, শক্তি বা ক্ষমতা সামলে রাখতে পারে না। গঙ্গাধরের মনেও খুব অহংকার চলে এল। সে এত অহংকারী আর বিবেকহীন হয়ে উঠল যে ধরাকে সরা জ্ঞান করতে লাগল। ক্ষমতা আর শক্তি কাছে এলেই বুঝি মানুষ এমন হয়ে উঠে – অহংকারী আর হিংস্র! তা সে রাবণই হোক আর আমাদের গঙ্গাধরই হোক। খুব কম মহামানব ছিলেন যারা প্রবল ক্ষমতাশালী হয়েও নিজেদের সদা সামলে রেখেছিলেন। কিন্তু আমাদের গঙ্গাধর তেমন ছিল না। সে চারিদিকে নিজের গুন গেয়ে বেড়াত, মানুষকে যা-তা গালাগাল দিত, অপমান করত। শেষে সে একদিন নিজের অহংকার আর দম্ভ প্রকাশ করতে সোজা রাজসভাতে এসে হাজির হল। রাজাকে বলল, “মহারাজ সারাদেশে একটি সঙ্গীত প্রতিযোগিতার আয়োজন করা হোক। আমিও সেই প্রতিযোগিতায় অংশগ্রহণ করব। কিন্তু শর্ত হবে যে আমার সাথে প্রতিযোগিতায় পরাজিত হবে তাকে আমি এক বছর চাকর করে রাখব। আমার সব আদেশ তাকে পালন করতে হবে। আর আমি যদি হেরে যাই তবে আমি এক বছর তার চাকর হয়ে থাকব।”
রাজা ভাবলেন, দেখাই যাক না একবার এই প্রতিযোগিতার আয়োজন করে কী হয়? সেই মত প্রতিযোগিতার আয়োজন করা হল। দেশ বিদেশ থেকে প্রচুর প্রতিযোগী এল। দাম্ভিক গঙ্গাধর খুব ভাল জানত যে, এই প্রতিযোগীদের মধ্যে এমন কেউ এখনো নেই যে তাকে সঙ্গীতে হারাতে পারে। ফলে একপ্রকারে নিশ্চিত হয়েই সে আসরে নামল – আর তেমনি হল। সে সবাইকে হারিয়ে দিল। রাজসভাতে সবার সমনে পনের জন বিদগ্ধ সঙ্গীতজ্ঞ গঙ্গাধরের দাসত্ব স্বীকার করে নিল। গঙ্গাধর তাদের পশুর মত নিজের জমির মধ্যে খাটাতে লাগল। আর এখানেই শেষ নয়, সে তাদের উপর অকথ্য অত্যাচারও করতে লাগল। দাসদের উপর এমন অত্যাচার দেখে প্রজাদের চোখে জল এল। রাজার কাছে সবাই এর নালিশ করল। সেই প্রতিযোগিতার শর্ত অনুসারে রাজা নিরুপায় ছিল। তিনি শুধু গঙ্গাধরকে অনুরোধ করলেন – কিন্তু কোন লাভ হল না। অহংকারী, দাম্ভিক, মূর্খ গঙ্গাধরের মধ্যে এক চুলও পরিবর্তন এল না।
তেমনি করে এক বছর ঘুরে গেল। গঙ্গাধরের অত্যাচার থেকে মৃত প্রায় ক্রীতদাসেরা মুক্তি পেল। কিন্তু রাজা মনে মনে ঠিক করে রাখলেন, এই নিষ্ঠুর আর অহংকারী গঙ্গাধরকে খুব কঠোর শিক্ষা দিতে হবে। কিন্তু কী ভাবে?
এ কথা চাঁদ সূর্যের মত সত্যি যে গঙ্গাধরের মত গায়ক এই রাজ্যে নাই। আশে পাশের রাজ্যেও নাই। রাজা ভাবতেন – ” তবে কীভাবে এই পাষাণ নরাধমকে শিক্ষা দেওয়া যায়?” যথা সময়ে সেই সুযোগ ও এসে গেল।
একদিন গঙ্গাধর আবার সোজা রাজদরবারে এসে হাজির। রাজসভাতে সে দীর্ঘক্ষণ নিজের গুনের খুব বড়াই করল। তারপর রাজাকে বলল – ” মহারাজ, আবার আগের মত সারাদেশে একটি সঙ্গীত প্রতিযোগিতার আয়োজন করা হোক। কিন্তু শর্ত সব আগের মতই থাকবে, যে আমার সাথে প্রতিযোগিতায় হারবে তাকে আমি এক বছর চাকর করে রাখব। আর আমি যদি হেরে যাই তবে আমি এক বছর তার চাকর হয়ে থাকব।”
গঙ্গাধরের কথা শুনে রাজা হেসে বললেন, ” বেশ তো, তাই হোক। তবে শর্তটাতে একটু পরিবর্তন হবে। এক বছর নয়, দু বছর। অর্থাৎ যে হারবে তাকে দুই বছর ক্রীতদাস হয়ে থাকতে হবে।” মহা আনন্দে গঙ্গাধর রাজী হয়ে গেল। সে জানতো তাকে হারাবার মত কেউ এই রাজ্যে এখন নাই। ফলে জয়ী তো সে হবেই। আর রাজা ভাবলেন – “গত বছরের পরাজিতদের করুন পরিণাম দেখে এই বার কোন সঙ্গীতজ্ঞই সামনে আসবে না, প্রতিযোগিতায় অংশগ্রহণ করবে না। কিন্তু যে সামনে আসবে বা অংশগ্রহণ করবে, সব কিছু জেনেশুনেই সে আসবে আর নিজের সব ক্ষমতা সাথে নিয়েই আসবে। হয়তো ওর দ্বারাই গঙ্গাধরের পরাজয় সম্ভব।” তাই রাজা মনে মনে গঙ্গাধরের পরাজয় কামনা করে দাসত্বের সময় সীমা এক বছর থেকে দুই বছর করে দিলেন।
প্রতিযোগীতায় অংশগ্রহণের জন্য নাম লিপিবদ্ধ করতে পনের দিন সময় দেওয়া হল। নির্ধারিত সময়ের আর মাত্র দুই দিন বাকী, কিন্তু একজনও নাম লেখাতে এল না। রাজা আর গঙ্গাধর খুব চিন্তায় আছে। তবে দুজনের চিন্তা আলাদা। শেষের দিন এক সুন্দর যুবক নাম লেখাতে এল। তার নাম অংশুমান। দেখেই মনেই হয়, সে কোন কালে কখনো গান গায়নি। তবে চেহারায় আর কথাবার্তা খুব শিষ্টতা, সততা আর বুদ্ধিমত্তার ছাপ। তাকে দেখে রাজা খুব খুশী হলেন, ভাবলেন – “আমার মন বলছে এ ঠিক পারবে গঙ্গাধরকে পটকনী দিতে।” অপর দিকে গঙ্গাধর মনে মনে খুব দুঃখী হল, সে ভাবল – “গত বছর তুলনায় এবার মাত্র একজন? ঠিক আছে তাইই হোক, এই ছোকরাকে দিয়েই পনের জনের কাজ করাব।”
যথা সময়ে রাজসভাতে সঙ্গীত প্রতিযোগীর আসর বসল। এক পাশে নিজের সব সাজ-সারঙ্গী নিয়ে গঙ্গাধর বসল। আর অন্য দিকে সেই নবযুবক, হরেক রকমের কিছু খেলনার ঝুনঝুনি নিয়ে গান গাইতে বসল। সেই রোমাঞ্চকর প্রতিযোগিতা দেখতে সভাসদ আর প্রজারা রাজসভায় এসে ভিড় জমালো। যথা সময়ে প্রতিযোগিতা শুরু হল। চোখ মুখ বুজে গঙ্গাধর গান ধরল। এমন তার গান যে সবাই মন্ত্র মুগ্ধ হয়ে শুনতে লাগল। গঙ্গাধরের গান কিছুদূর এগিয়েছে, ঠিক এমনি সময় সেই নবযুবক তার আসন ছেড়ে উঠল আর প্রজাদের মাঝে বসে থাকা তার স্ত্রী-র কূল থেকে তার দেড় বছরের ফুট ফুটে শিশুটিকে কুলে তুলে নিল। যেন দেব শিশু। যেমন তার গায়ের রং তেমনি তার চেহারা, তেমনি তার হাসি। তার মনমোহক হাসিতে ইন্দ্র তার স্বর্গ দান করতেও দ্বিধা করবে না – এমনই যখন অবস্থা তখন সাধারণ মানুষ কী চুপ করে থাকতে পারে?
শিশুটিকে নিজের কূলে নিয়ে সেই নবযুবক তার নিজ আসনে গিয়ে বসল। শিশুটির হাসি যেন রাজসভাকে আলোকিত করে রাখলো। সে তার বাবার কূলে বসে সেই খেলনার ঝুনঝুনই গুলি দেখে প্রাণ খুলে খিলখিলিয়ে হাসতে লাগল। তার হাসির কিলকারিতে চারিদিক ছেয়ে গেল। হাসতে হাসতে এক সময় সে জোরে জোরে আধো আধো, বেশ মিষ্টি কথা বলতে শুরু করল। তার হাসি আর আধো আধো মিষ্টি বোলে সারা রাজসভা স্নেহ, মমতা আর ভালবাসার বন্যায় দুলতে লাগল। সবাই গঙ্গাধরের গান ভুলে সেই শিশুটির আধো আধো কথা শুনতে, তার কথার দিকে একাগ্রচিত্তে, মনোযোগ করতে লাগল। একটি কথাও যেন বাদ না পড়ে। কিন্তু গঙ্গাধরের গান বিষের মত লোকদের মনোযোগকে বাধা দিতে লাগল।
ফলে সারা রাজসভা জুড়ে বেশ গোল শুরু হয়ে গেল। গঙ্গাধর চোখ বুজে গান যে শুরু করেছে, সে আর থামছেই না। শেষ কোনও এক দুষ্টের ছোড়া একটি ছেড়া পাদুকা উড়ে এসে সোজা গঙ্গাধরের মাথায় পড়তেই, সে ছেবরা খেয়ে উঠল, গান থামিয়ে চোখ খুলে তাকাল। এ কী কাণ্ড? তার এমন দিব্য গানের মাঝে সারা রাজসভা জুড়ে কী এত শোর গোল? নবযুবক কী হার মেনে পালিয়ে গেছে? না! কিছুক্ষণের মধ্যেই গঙ্গাধর আসল ঘটনা বুঝতে পারল। আর এ ও বুঝল যে ঠিক এই মুহূর্তে কেউ আর তার গান শুনতে চাইছে না। পরিস্থিতি নিজের প্রতিকুলে দেখে গঙ্গাধর চুপ-চাপ পালিয়ে যাবার পথ ধরল। কিন্তু পিছন ফিরতেই দেখল সিপাহীরা তাকে ঘিরেই দাঁড়িয়ে আছে। চুপ-চাপ রা-মাত না করে নিজের জায়গায় বসল গঙ্গাধর।
কিছুক্ষণ পর যখন সব কিছু শান্ত হল, তখন রাজা অতি উৎসাহে আর খুশীতে সভার মাঝে জানতে চাইলেন – আজকের প্রতিযোগিতায় কে জয়ী হয়েছে?
সম্পূর্ণ রাজসভা এক সাথে বলল – একটি শিশুর কাছে গঙ্গাধরের পরাজয় হয়েছে। গঙ্গাধরের গান কোন ভাবেই এই শিশুর মিষ্টি কথা, আর মধুর বোলের তুলনায় সুন্দর ছিল না।
রাজসভার এই বিচার দাম্ভিক গঙ্গাধর মানতে চাইল না। সে বলতে লাগল – হে রাজন, আমি একজন বিখ্যাত গায়ক। আমি কখনোই হারতে পারি না। আমি পরাজিত হই নি । আমিই জয়ী। প্রজারা আমাকে অপমান করছে। এ আমার অপমান। রাজ্যের অপমান – আপনার অপমান। আমার গানের স্বর্গের গান। আমার এই গানের তুলনায় ঐ শিশুর হাসি বা তার কথা অতি তুচ্ছ। আমি তার দাসত্ব স্বীকার করতে পারি না। এ অন্যায়।
রাজা ধমকের সুরে বলল – ন্যায়- অন্যায়, আর মান-অপমান আমি দেখব। এ নিয়ে তোমার ভাবতে হবে না। তুমি দুই বছরের জন্য ঐ শিশুর দাসত্ব স্বীকার করতে প্রস্তুত হও। যেহেতু তোমার প্রতিযোগী একজন নিতান্তই শিশু তাই তুমি আমার আদেশকেই শিশুটির আদেশ হিসাবে মানবে। কোন আদেশ পালনে তোমার যদি বিন্দুমাত্র দেরী বা হের-ফের হয় তবে সাথে সাথেই তোমাকে একশ বেত্রাঘাত করা হবে। এবার থেকে তুমি দু বছরের জন্য আমার দাস হলে। মনে রাখবে, তুমি যদি পালিয়ে যাবার চেষ্টা কর তবে তোমাকে অন্ধ করে গভীর বনে ছেড়ে দেওয়া হবে। আর যদি তুমি শিশুটির কিংবা তার অভিভাবকের কোনরূপ অনিষ্ট কর তবে দাসত্বের সময়সীমা দ্বিগুণ হয়ে যাবে আর সাথে প্রতিদিনের একশত বেত্রাঘাত আলাদা। আমি এ ও আদেশ দিচ্ছি, কেউ যদি গঙ্গাধরের সাথে এই দুই বছর কোনরূপ সহানুভূতি দেখায় তবে তুরন্ত তাকে মৃত্যুদণ্ড দেওয়া হবে।
ধিঙ্গি গঙ্গাধর খুব কাকুতি মিনতি করে বলতে লাগল – মহারাজ, আমি আজই এই রাজ্য ছেড়ে চলে যাব। আমাকে রাজ্য ছেড়ে চলে যাবার আদেশ দিন। কোন আবদারেই লাভ হল না। উল্টা তার কাকুতি মিনতি দেখে সভাসদেরা হা-হা করে হাসতে লাগল, ছি ছি করতে লাগল – তার উপহাস করতে লাগল। গঙ্গাধরের দাসত্বের খবর সাড়া রাজ্যে ছড়িয়ে পড়ল।