রাজ্যের রাজধানী শিউলনগর। সেই নগরের পাশ দিয়ে এঁকে বেঁকে অনেক অনেক গ্রাম পেড়িয়ে মৃদুলা নদী বয়ে গেছে অনেক অনেক দূর। তেমনি এক গ্রামে এক বিমাতা মায়ের ঘরে ছিল কুসুমজবা। সৎ মা তাকে খেতে পড়তে দিত না। কুসুমজবার সোনার রূপ, ছেড়ে আর মলিন কাপড়ে ঢাকা পড়ে থাকত। তবে কুসুমজবা ছিল বুদ্ধিমান, ধীর-স্থির, হিসেবি, সাহসী, নীতিপরায়ন ও সৎ। যেমন ছিল তার গায়ের রং তেমনি ছিল তার মনের রূপ। তার মা যখন মারা যায় তখন কুসুমজবা খুব ছোট। মা সব সময় বলতেন “আমার কুসুম একদিন রাজরানী হবে। আমার কুসুম একদিন রাজরানী হবে।” মার সেই কথা কুসুম কখনো ভুলেনি।
দিন পেড়িয়ে গেল, বছর পেড়িয়ে গেল অনেক। কুসুমজবা রোজ ভোরে মৃদুলা নদীতে স্নান করতে যায়। স্নান পরে সে কলসি কাঁখে নিয়ে ফিরে আসে। একদিন সে দেখল খুব সুন্দর, কাঁসের থালার মত বড় একটি পদ্ম ফুল ভেসে ভেসে আসছে নদীর জলে। ফুলটি দেখে কুসুমজবার খুব ভাল লাগল। সে সাঁতরে নদীর মাঝে চলে গেল আর ফুলটি নিয়ে এলো। পদ্মফুলটি বেশ সুন্দর। কিন্তু কি আশ্চর্য, নদীর পারে উঠতে না উঠতেই কুসুমজবার হাতের সেই তর-তাজা ফুলটি একটি ছোট্ট সোনার পদ্ম হয়ে গেল। কুসুমজবা বেশ চমকে উঠল। সে বুঝতে পারল এটি কোন মন্ত্রপূত ফুল।
আর এত বড় একটি তাজা ফুল এমন ছোট্ট একটি সোনার ফুলে পরিণত হল, এতে ইশারা দেওয়া গেল যে এটি খুব মূল্যবান, একে যত্ন করে সামলে রাখো। কুসুমজবা সোনার পদ্মফুলটিকে আঁচলে বেঁধে বাড়ি নিয়ে গেল আর সবার অলক্ষ্যে সেটি ঘরে কোনে একটি গোপন জায়গাতে রেখে দিল। কিছুদিন পর আবার তেমনি ঘটল। তেমনি আরো একটি পদ্মফুল নদীর জলে ভেসে এলো। কুসুমজবা সেটি নিয়ে পারে উঠতেই সেটি সোনার একটি ছোট্ট পদ্ম হয়ে গেল। এই ফুলটিকেও কুসুমজবা আগের মতই লুকিয়ে রাখল। কুসুমজবা লক্ষ্য করল যে অমাবস্যা বা পূর্ণিমা’র পরে তৃতীয়ার চাঁদ যখন আকাশ উঠে সেই দিনই এই ফুলটি নদীর জলে ভেসে ভেসে আসে। এমনি ভাবে হিসাব মিলিয়ে কুসুমজবার কাছে ছয়টি ফুল জমা হল।
ওদিকে বৃদ্ধ রাজার আদেশে শিউলনগরের রাজগুরু যুবরাজের জন্য যোগ্য পাত্রী খুঁজতে প্রতি তৃতীয়াতে মন্ত্রপূত এই ফুল মৃদুলা নদীর জলে ভাসিয়ে দিতেন। ছয়টি ফুল ভাসানোর পর সপ্তম ফুলটি তিনি পরিকল্পনা মত তৃতীয়াতে না ভাসিয়ে অসময়ে পূর্ণিমার কাক-ভোরে ভাসিয়ে দিলেন আর গুপ্তচর আর সিপাহীদের মারফত ফুলটির গতিবিধি পর্যবেক্ষণ করতে লাগলেন। পদ্মফুলটি ভাসতে ভাসতে সেই ঘাটের কাছেই এলো যেই ঘাটে কুসুমজবা রোজ স্নান করে। ফুলটি সেই ঘাট ছেড়ে আর এগিয়ে গেল না। দীর্ঘক্ষণ ওখানেই ভেসে থেকে সেটি ডুবে গেল। এই খবর রাজা আর রাজগুরুর কানে যেতেই রাজপ্রাসাদে এক খুশির হাওয়া, আনন্দের হাওয়া বয়ে গেল। সবাই বুঝতে পারল যে নতুন মহারানীর নগর খুঁজে পাওয়া গেছে। পরদিন রাজা সারা রাজ্যে ঘোষণা করে দিলেন যে, মৃদুলা নদীতে দ্বিতীয়া’র ভোরে একটি মন্ত্রপূত পদ্মফুল ভাসানো হবে। যে সেই ফুলটিকে ধরতে পারবে তার সাথে যুবরাজের বিয়ে হবে। কিন্তু মনে থাকে যেন, এটি একটি মন্ত্রপূত পদ্মফুল আর এটি শুধু ভাবি মহারানীর হাতেই আগের ফুলগুলির মত রং বদলাবে। কেউ যদি দুঃসাহস করে ফুলটি হাতে নেয় আর যদি ফুলটির রং না বদলায় তবে রাজ আদেশে তুরন্ত তার মৃত্যুদণ্ড হবে।
সারাদেশের লোক পরের দিন সেই ফুলটি দেখতে, ভাবি মহারানীকে দেখতে মৃদুলার পারে পারে জমা হল, কিন্তু কেহ নিজের প্রাণের মায়া ত্যাগ করে, সাহস করে সেই ফুলটি ধরতে নদীতে নামেনি। কুসুমজবা আজ সেই নদীতেই যায়নি। সে ঘরে কোনে বসে মুচকি মুচকি হাসতে লাগল। সেই ফুলটি ভাসতে ভাসতে আজো এসে সেই কুসুমজবার ঘাটেই আটকে গেল। আর দীর্ঘক্ষণ সেখানে ভেসে শেষে ডুবে গেল। রাজগুরু মহারাজকে চিন্তিত হতে দেখে বললেন “মহারাজ আপনি কিছুই ভাববেন না। আমরা যথার্থই যোগ্য মহারানী খোঁজে পেয়েছি, যিনি সবার সামনে নিজের দম্ভ প্রকাশ করতে চান না। আর তিনি যথেষ্ট বুদ্ধিমান আর হিসেবী। তা না হলে আমার মন্ত্রপূত ফুল এমন ভাবে এখানে ভেসে থেকে শেষে ডুবে যেত না। ডুবে গিয়ে ফুলটি ইশারা করে গেল যে আগের ছয়টি ফুলই ভাবি মহারানী পেয়েছেন আর ফুলগুলি তার কাছেই আছে। সুতরাং হিসাব মত আর নিয়ম মত আগামীকাল তৃতীয়ার ফুল আবার মৃদুলার জলে ভাসবে। আর এই ফুলটিই মহারানীকে বের করে আনবে।”
পরের দিন সেই কাক-ভোরেই গোপনে গুপচরেরা ছড়িয়ে রইল কুসুমজবার ঘাটের আসে পাশে। রাজগুরু মন্ত্র পড়ে শেষ ফুলটি ভাসিয়ে দিলেন মৃদুলার জলে। এদিকে প্রতিদিনের মত ভোর বেলাতে কুসুমজবা চলল ঘাটে স্নান করতে। তৃতীয়ার সেই পদ্মফুলটিও ভেসে আসতে লাগল। কুসুমজবা সাঁতরে গেল নদীর মাঝে, সেই ফুলটিকে নিয়ে পারে উঠে এলো। কিন্তু কি আশ্চর্য আজ সেই ফুলটি আজ আর ছোট্ট সোনার ফুলে বললে গেল না। বিস্ময়ে কুসুমজবা এর কারণ ভাবতে লাগল কি আচানক তার নিজের শরীরটাই নিজের কাছে ভারি ভারি মনে হল। নিজের অঙ্গের দিকে তাকিয়ে সে অবাক হয়ে গেল। সারা অঙ্গে তার রাজরানীর গয়নায় ভরে গেছে। গলায় হীরা,মনি-মুক্তার মালা। দু-হাতে সোনার চুড়ি ছনছন করছে। কানে হীরার দুল। খোঁপায় হীরার চূড়ামণি। গায়ে রেশমের মখমলে শাড়ী। পায়ে অপরূপ রূপার নূপুর। অবাক চোখে কুসুমজবা নিজেই নিজেকে দেখতে লাগল।
ফুলটি আজ নিজে বদলায়নি, কিন্তু কুসুমজবাকেই বদলে দিয়েছে। আজ আর কুসুমজবার লুকানোর জায়গা রইল না। সাথে সাথেই কুসুমজবার ঘাটের চারিদিকে শঙ্খধ্বনি বাজতে শুরু হয়ে গেল। নদীর উভয় পারে বেজতে লাগল ঢোল-নাগারা। সৈন্য সিপাহীরা সবাই ভাবি মহারানীর জয় ধ্বনি করতে লাগল। খবর গেল রাজগুরু আর মহারাজার কাছে। সারা গ্রামের লোক দেখল দীন-দুঃখী, হতভাগী কুসুমজবাকে রাজকীয় সম্মানে দেশের যুবরাজ নিজের রথে নিয়ে রাজপ্রাসাদের দিকে ফিরে যাচ্ছেন।