হরিপুর গ্রাম থেকে এক ক্রোশ দূরে রঘু ডাকাতের জঙ্গল। ঘোর ঘন সেই জঙ্গলে রঘু ডাকাত তার সঙ্গী সাথীদের নিয়ে লুকিয়ে থাকে আর রাতের বেলায় গ্রামের পর গ্রামে লুটপাট চালায়। ধনী-গরীব, ধনবান-নির্ধন, ছোট-বড় কেহ তার অত্যাচার থেকে রেহায় পায়নি। রঘু ডাকাতের হাত থেকে তাদের বাঁচাবার জন্য প্রজারা রাজার কাছে করুন প্রার্থনা করতে লাগল। রাজা সৈন্য পাঠাল কিন্তু নির্দয়, নিষ্ঠুর রঘু ডাকাত সেনাদের উপর গুপ্ত আঘাতে আঘাতে রক্তের বন্যা বইয়ে দিল। রাজার সৈন্য গভীর জঙ্গলে খুব ভাবে পরাজিত হয়ে ফিরে গেল। রঘুকে তারা থামাতে পারল না।
মানুষ অসহায় হতে পারে কিন্তু সময় অসহায় নয়। সময় ঠিক সময়েই রঘুর হিসাব নিলো। সেই কাহানীটি ছিল এই রকম। এক রাখাল সেই বনে গরু চড়াত। সে সেখানে এক নদীর ধারে, এক বটের ছায়ায় আপন মনে বাঁশি বাজাত। গভীর বনে তার বাঁশির মধুর সুর অনেক দূর দূর পর্যন্ত ছড়িয়ে পড়ত, কিন্তু সেখানে সেই বাঁশি সুর শুনার মত কেউ ছিল না। রাখাল রোজ সেই বটের তলে আপন মনে বাঁশি বাজিয়ে যেত।
একদিন সেই রাখাল যখন আপন মনে বাঁশি বাজাচ্ছে তখন সে হঠাৎ নদীর জলে বিকট বিকট শব্দ শুনতে পেল। সে চোখ খুলে যা দেখল তা অবাক করার মত। সে দেখল সেই নদীর জলে বিশাল বড় এক মাছ বেশ আলোড়ন সৃষ্টি করেছে। এত বড় মাছ রাখাল কখনো দেখেনি। সে ঘাবড়ে দুই পা পিছিয়ে গেল। সে দূর থেকে সেই মাছটাকে বেশ ভাল করে লক্ষ করতে লাগল। সে অবাক হয়ে দেখল সেই মাছটার মাথায় একটা সোনালী মুকুট আঁকা। তার মুখে একটি সোনার টুকরা। মাছটি সেই সোনার টুকরাটি রাখালের দিকে ছুঁড়ে দেয়। কিন্তু সোনার টুকরাটি এত দূর উড়ে আসতে না পারে আবার জলে পড়ে যায়। মাছটি টুকরাটা লুফে নেয়, আবার ছুঁড়ে দেয় সেই রাখালের দিকে। রাখালের মনে হল মাছটি যেন রাখালের সাথে খেলা করতে চাইছে, যেন বন্ধুত্ব করতে চাইছে। রাখাল ভয়ে কাছে গেল না। দূর থেকেই সে মাছটির খেলা দেখতে লাগল।
পরদিন আবার সেই একই কাণ্ড। রাখাল যখন বাঁশি বাজাতে লাগল মাছটি আবার এলো আর সোনার টুকরাটি নিয়ে খেলা করতে লাগল। আজ রাখালের আর তেমন ভয় লাগল না। সে আপন মনে বাঁশি বাজাতে লাগল আর মাছটাও জলে নিজের মত খেলা করতে লাগল।
রোজ রাখাল যখন বাঁশি বাজায় মাছটাও তখন আসে আর সোনার টুকরাটা নিয়ে খেলা করে। ধীরে ধীরে তাদের দুজনের মধ্যে ভাল এবং গভীর বন্ধুত্ব হয়ে উঠল। একজন অপরজনকে না দেখলে অস্থির হয়ে উঠে। তেমনি এক দিনে রাখাল সাহস করে মাছটির কাছে গেল, তার পিঠে হাত রেখে আদর করল। মাছটির ও খুব ভাল লাগল। জল আর স্থলের প্রাণীর মধ্যে এক মহা মিলন হল। মাছটি তার মুখের সোনার টুকরাটি রাখালের উপর ছুঁড়ে দিয়েই উধাও। রাখাল সেদিন আর তাকে দেখতে পায়নি। রাখাল বুঝল যে মাছটি এই সোনার টুকরাটি তাকেই দিয়ে গেছে। সে তার বন্ধুর স্মৃতি হিসেবে সেই সোনার টুকরোটি কোমরের গামছাতে বেঁধে ঘরে নিয়ে গেল আর যত্ন করে রেখে দিল।
পরদিনই সেই গ্রামে ডাকাত পড়ল। রঘু সেই গ্রামের অনেক ঘর জ্বালিয়ে দিল। গ্রামবাসীদের উপর অনেক অত্যাচার করল। অনেক ধন সম্পদ লুট করে সে রাখালের ঘরে ডুকে সেই সোনার টুকরাটি পেল। এক গরীব রাখালের ঘরে এমন সোনার টুকরা পেয়ে রঘু খুব অবাক হল। সে রাখালকে সেই সোনার টুকরাটির কথা জিজ্ঞাস করতে লাগল। রাখালের উপর সে অনেক অত্যাচার করতে লাগল। শেষে রাখাল অসহায় হয়ে নিজের প্রাণ বাঁচাতে রঘুকে সব কথা সত্যি বলে দিল। প্রথমে রঘু তা বিশ্বাস করতে পারেনি। কিন্তু রাখাল বারে বারে একই কথা বলতে লাগল। শেষে রাখালের কথার প্রমাণ পাওয়ার জন্য রঘু তার দল বল নিয়ে তক্ষুনি, রাতের বেলায় বনে সেই নদীর পারে বটের তলায় গেল। রাখালকে সে বাধ্য করল বাঁশি বাজাতে। রাখাল তার বাঁশি বাজাতে লাগল।
ধীরে ধীরে নদীর জলের উপর অসংখ্য জোনাকি জ্বলে উঠল। রাখাল এই জোনাকির আলোকে চিনতে পারেনি। কিন্তু রঘুর বুঝতে বাকী রইল না যে এগুলি সব মনি-মুক্তার আলো। এত গুলি রত্নের লোভে সে তক্ষুনি তলবার হাতে, সঙ্গী সাথীদের নদীর জলে ঝাঁপিয়ে পড়ার আদেশ দিল আর নিজেও ঝাঁপিয়ে পড়ল সেই নদীর জলে। কিন্তু সে বুঝতে পারেনি মনি-মুক্তা মাথায় নিয়ে কালসাপেরা ভেসে আছে। যা হবার তাই হল। কালসাপের ছোবলে ছোবলে সঙ্গী সাথী সহ রঘুর লীলা সাঙ্গ হল।