ভবানী আর চোর

ভবানী আর চোর

এক রাজদরবারে একদিন এক অপরাধীকে হাজির করা হল। তার বিরুদ্ধে অনেক দিন থেকেই চুরির অভিযোগ, ডাকাতির অভিযোগ। কিন্তু তাকে সৈনিকরা অনেক চেষ্টা করেও আগে ধরতে পারেনি। শেষে যখন সে ধরা পরল, বিচারে রাজা তাকে প্রাণদণ্ড দিলেন।

সেই চোর চুরি করাকে একটা মজার খেলা মনে করত। সে নিজেকে চোরদের উস্তাদ ভাবত। সে মনে করত তাকে কোনদিন কেহ ধরতে পারবে না। কিন্তু সে জানত না উস্তাদের ও উস্তাদ থাকে। তাই যখন সে ধরা পরল আর তার মৃত্যুদণ্ড হল, তখন সে কঠিন বাস্তবের মুখোমুখি হল আর তার মজার খেলার সব মজা হাওয়ায় উড়ে গেল। সে প্রাণের মায়ায় হাউ-মাউ করে রাজসভাতে কাঁদতে লাগল আর প্রাণের ভিক্ষা চাইতে লাগল।

শেষে রাজা তাকে মুক্তি দিতে রাজি হলেন কিন্তু একটা শর্তে। শর্তটা ছিল, পাশের শহরে একজন জ্ঞানী, সজ্জন, সৎ লোক থাকেন। নাম ভবানী। লোকে তাকে খুব শ্রদ্ধা করে। সেই ভবানীর কাছে এই চোরকে এক বছর চাকর হয়ে, ভবানীর সাথে সাথে থাকতে হবে। তবে চোরের উপর সর্বদাই একজন গুপ্তচর নজর রাখবে। সেই চোর প্রাণ বাঁচাতে সাথে সাথেই রাজার কথায় রাজি হয়ে গেল আর মনে মনে ফন্দী আঁটল, “দুই দিন ঐ ভবানীর চাকর থেকে তারপরেই ওখান থেকে হাওয়া হয়ে যাব। হাওয়া হতে আর আমার কতক্ষণ লাগবে!”

রাজা দুজন সিপাহীর সাথে একটি চিঠি এবং সেই চোরকে ভবানীর কাছে পাঠিয়ে দিলেন। ভবানীর কাছে গিয়ে চোর দেখল, এটি একটা সাধারণ বাড়ি। এখান থেকে পালাতে তার কোন কষ্টই হবে না। আর ভবানী, সে দেখতে রোগা-পাতলা। একটা ধাক্কা সামলানোই তার পক্ষে কঠিন। চোর ভেবে পেল না রাজা কেন এই ভবানীর কাছে তাকে পাঠালেন ?

ঘরের পাশেই ভবানীর অল্প কিছু জমি-জামা ছিল। সে সকাল সন্ধ্যায় সেখানেই পরিশ্রম করে চাষ-বাস করত। প্রথম দিন চোর তার সাথেই জমিতে কাজ করতে গেল। চোর খুব অবাক হল এই দেখে যে, অল্প কিছু জায়গাতেই এত ফসল হয়েছে যা একটা বড় জমিতেও হয়না। যতই চোর ভবানীর পিছন পিছন হাটতে লাগল ততই সে জমির ফলস, সব্জী দেখে একের পর এক অবাক হতে লাগল। এত ভাল আর সুন্দর ফসল এত ছোট জায়গায় সে কখনোই দেখেনি। সে বুঝতে পারল যে কৃষিকাজ সম্পর্কে ভবানীর জ্ঞানের কোন তুলনা হয়না। সে উৎসাহে ভবানীকে এটা ওটা জিজ্ঞাস করতে লাগল। ভবানীও জবাব দিতে লাগল। কথায় কথায় চোর জানতে পারল যে বহুবার দেশের বিভিন্ন অঞ্চলে যখন নানা কারণে ফসল নষ্ট হতে বসেছিল, রাজা সেই ফলস বাঁচাতে ভবানীর পরামর্শ চেয়েছিলেন আর তাতে খুব কাজ ও হয়েছিল। এমনটা বহুবার হয়েছে।

সকালের জমির কাজ শেষ করে যখন তারা বাড়িতে ফিরল দেখল এক ধনী শেঠ হাত জোর করে দাঁড়িয়ে আছে। কাল উনার বাড়িতে দুপুরে খাবার নিমন্ত্রণ। সেই ধনী শেঠ চলে যাবার কিছু পরেই সেখানে একটা গরিব লোক এসে হাজির হল। হাত জোর করে সে বলল “মেয়ের বিয়ে ঠিক হয়েছে। কিন্তু ঘরে কোন টাকা-কড়ি নাই। এখন কি করি? ভেবে পাচ্ছি না। আপনিই শুধু আমাকে সাহায্য করতে পারেন।”

ভবানী একটু সময় ভাবল তারপর একটি চিঠি লিখে তার হাতে দিয়ে দিল। বলল “কাল সকালে এটি নিয়ে রাজ দরবারে যাবে। একশটা স্বর্ণ মুদ্রা পেয়ে যাবে। আশা করি এতেই তোমার কাজ হয়ে যাবে। তবে ধীরে ধীরে, যতদিনে হয় এর অর্ধেক তোমাকে ফিরিয়ে দিতে হবে।” সেই গরিব লোকটি সজল নয়নে হেসে উঠল, যেন সে মেঘ না চাইতেই জল পেয়ে গেল। সে খুব খুশি হয়ে ভবানীকে অনেক অনেক আশীর্বাদ দিতে লাগল। সে ভেবে পাচ্ছিল না কিভাবে ভবানীকে কৃতজ্ঞতা জানাবে।

সেই চোর দাঁড়িয়ে মনে মনে হিসাব করতে লাগল একশ স্বর্ণ মুদ্রা চুরি করে জমাতে তার ত্রিশ বছর লাগত। আর রাজা কিনা ভবানীর এক চিঠিতে একদিনেই একশ স্বর্ণ মুদ্রা দিয়ে দেবেন? তার মনের সমুদ্রে একটা নতুন বিচার-ভাবনার ঝড় উঠল।

পরদিন তারা সেই ধনী শেঠের বাড়িতে নিমন্ত্রণ খেতে গেল। এত সব ভাল ভাল রান্না, এত সব খাবার চোর কখনো চোখেই দেখেনি। সে জানতে পারল যে, একবার এই শেঠের ব্যবসাতে খুব লোকসান হয়। নিজের ব্যবসা বাঁচাতে সে ভবানীর কাছে সাহায্য চেয়েছিল। ভবানীর এক চিঠিতেই রাজা শেঠকে দশ হাজার স্বর্ণ মুদ্রা ঋণ দিয়ে দিয়েছিলেন। এই দশ হাজার স্বর্ণ মুদ্রার কথা শুনে চোর ক্যাবলার মত হা করেই তাকিয়ে রইল। সে আর হিসাব করেই পেল না এত স্বর্ণ মুদ্রা চুরি করে জমাতে তার কত বছর লাগবে। আর রাজা কিনা ভবানীর এক কথাতেই তা শেঠকে দিয়ে দিলেন?

চোরের মনে এক তুফান উঠল। “এক ভাল মানুষ যদি শুধু নিজের কাজ আর কথার গুনে এত এত কিছু করতে পারে তবে আমি কেন শুধু শুধু চুরি করে মরতে বসেছিলাম।” তার এই ভাবনার অঙ্কুর ধীরে ধীরে বৃক্ষে পরিণত হতে লাগল। সে ভবানীর কাছে থেকে মন দিয়ে কৃষি কাজ শিখতে লাগল। দেখতে দেখতে এক বছর পার হয়ে গেল, দু বছর পার হয়ে গেল। শেষে ভবানীর কথাতেই সেই চোর একদিন রাজ দরবারে হাজির হল।

রাজা চোরের মধ্যে এমন পরিবর্তটাই চেয়েছিলেন। তিনি খুশি খুশি চোরকে কিছু জমিন প্রদান করলেন চাষ-বাস করার জন্য। চোর এখন চাষ-বাস করেই মহা আনন্দে দিন কাটায়। সে তার গুরুর মত এত উস্তাদ না হলেও লোকে তাকে উস্তাদের চোখেই দেখতে লাগল।

গল্পের বিষয়:
গল্প
DMCA.com Protection Status
loading...

Share This Post

সর্বাধিক পঠিত