পারুলের বাবা সরকারি চাকরি করেন। তিনি সদ্য বদলি হয়ে শহর থেকে একটু দূরে এক গ্রামে সপরিবারে এসেছেন। পারুলকে গ্রামের স্কুলে অষ্টম শ্রেণীতে ভর্তি করে দেওয়া হল। নতুন স্কুল, নতুন শিক্ষক, নতুন বান্ধবী, নতুন পরিবেশ। পারুল প্রথম দিন ক্লাসে গিয়ে চুপচাপ সবার শেষের বেঞ্চেই বসল। তার সাথে বসল আরেকটি মেয়ে, নাম লোপা। দুজনের মধ্যে প্রথম দিনেই ভাল বন্ধুত্ব গড়ে উঠল। প্রতিদিন ঐ বেঞ্চটাই হল দুজনের বসার জায়গা। পারুল বুঝতে পারল লোপা খুব ভাল মেয়ে। কম কথা বলে, সব সময় একটু উদাসীন, একটু নিজের খেয়ালেই থাকে।
যেহেতু পারুল খুব মেধাবী এবং বুদ্ধিমান ছিল তাই কয়েক দিনের মধ্যেই সে শিক্ষকদের নজরে পড়ল। ক্রমে তার নতুন অনেক বান্ধবীও জুটল। সে শেষের বেঞ্চ থেকে প্রথম বেঞ্চে চলে এল। কিন্তু সে লক্ষ্য করল তার প্রথম বান্ধবী লোপা তেমনি শেষের বেঞ্চেই আছে। কেউ তার সাথে ঠিক ভাবে কথা বলে না। শিক্ষকরা ও কিছু কিছু তাকে এড়িয়ে চলে।
পারুল অন্য বান্ধবীদের সাথে কথা বলে জানল যে লোপা পড়াশুনাতে ভাল নয়, বেশ কয়েকবার ফেল করেছে। এবার ও ফেল করেছে। তাকে স্কুল থেকে বের করে দেওয়া ও হয়েছিল। কিন্তু তার বাবা প্রধান শিক্ষকের অনেক হাত-পা ধরল, ফলে শেষ বারের মত তাকে স্কুলে থাকতে দেওয়া হয়। তাই কেউ তার সাথে মেলামেশা করতে চায় না। এ সব কথা শুনে পারুলের মনে হল কোথায় যেন একটা খটকা লাগছে। কারণ যতদিন সে লোপার সাথে বসেছিল, তার সাথে কথা বলেছিল তাতে পারুল খুব ভাল বুঝতে পেরেছিল যে লোপা বুদ্ধিমান এবং ভাল মেধাবী। তবে কেন সে বছর বছর ফেল করছে? পরদিন থেকে সে প্রথম বেঞ্চ ছেড়ে, শেষের বেঞ্চে লোপার সাথেই বসতে লাগল। সে ভাল করে লোপার উপর নজর রাখল। সে দেখল যে লোপা প্রায় সদাই জানালা দিয়ে বাইরে তাকিয়ে থাকে আর আপন মনেই মৃদু মৃদু হাসে। টিফিনের সময়ও সে স্কুলের এক কোনে এক বকুল গাছের তলে একা একা বসে থাকে আর দিগন্তের দিকে উদাস চোখে তাকিয়ে থাকে।
এক রবিবার সকালে সে সোজা লোপার বাড়িতে গিয়ে হাজির। এক গরিব কৃষকের বাড়ি। লোপা তার নিজের ছোট্ট ফুল বাগানে একা একা বসেছিল। হঠাৎ সামনে পারুলকে দেখে সে যেন বেশ চমকে উঠল। তাড়াতাড়ি সে উঠে এসে তার একমাত্র আদরের বান্ধবীকে অনেক সমাদর করে ঘরে নিয়ে গেল। বাবা , মার সাথে পরিচয় করিয়ে দিল। দুই বান্ধবী তারপর নিজেদের গল্পে মশগুল হয়ে গেল। অনেক হাসাহাসির পর পারুল তার আসল উদ্দেশ্যে পা রাখল। সে লোপাকে বলল “তোমাকে একটা প্রশ্ন করতেই আজ আমি তোমার বাড়িতে এসেছি। ঠিক ঠিক জবাব দেবে সই?”
লোপা একটু অবাক চোখে বলল “হ্যাঁ বল।”
পারুলঃ আমি অনেক দিন লক্ষ্য করেছি যে তুমি হঠাৎ হঠাৎ কি যেন মনে মনে ভাব আর নিজে নিজেই হাসো। স্কুলেও একা একা শেষ বেঞ্চে বসে জানালা দিয়ে বাইরে তাকিয়ে থাক আর মৃদু মৃদু হাসো। আবার কখনো বকুল গাছে তলে বসে দিগন্তে তাকিয়ে থাক। কেন বলত? লোপা যেন একটু লজ্জা পেয়ে গেল। সে বলল “আমি এই প্রশ্নের জবাব দিলে তুমি তো আমাকে পাগল ভাববে।” পারুল একটু ধমক দিয়ে বলল “আমি যদি তোমাকে পাগল ভাবতাম আর তোমাকে ভাল না বাসতাম তবে কি আজ আর তোমার কাছে এসেছি? তুমি মন খুলে তোমার কথা বলতে পার।” লোপা একটু ভেবে বলল “চল তবে আমরা দুই বান্ধবী আমার ছোট বাগানটাতেই গিয়ে বসি।”
দুই বান্ধবী লোপার ছোট্ট বাগানে গিয়ে বসল। লোপা বলল “ছোট বেলা থেকেই আমার মনে হত এই ফুল, পাখী, গাছ-পাতা, চাঁদ-তারা, আকাশ-মেঘ সবাই যেন আমার সাথে কথা বলতে চায়। তারা যেন আমাকে আদর করে কাছে ডাকে, আমার সাথে খেলা করতে চায়। আমার মনে হয় যেন, আমি তাদের মনের কথা বুঝি, তাদের সুখ-দুঃখ বুঝতে পারি। আমি স্কুলের জানালা দিয়ে নীল আকাশে পাখীদের উড়ে যাওয়া দেখি। মেঘের বুকে তাদের খেলা দেখি। তারা নিজেদের মধ্যে কত মজার মজার কথা বলে, কত মজার মজার গল্প বলে তা শুনি আর মনে মনে খুব হাসি।”
পারুল লোপার মুখে এমন কথা আশাই করেনি। লোপার কথা শুনে সে যেন আকাশ থেকে পড়ল। পারুল হা করে শুধু লোপার কথা শুনতে লাগল। লোপা বলতে থাকল “এই যেমন, এই গোলাপ ফুলটা এখন পাশের গোলাপ ফুলটাকে বলছে গতকাল রাতে নাকি সে বেশ ভাল একটা স্বপ্ন দেখেছে। এক খুব সুন্দর রাজকুমারী এই বাগানে এসেছিল। চাঁদের মত ছিল তার রূপ, মাথায় চাঁদের মুকুট, পায়ে চাঁদের নূপুর। সে তার রুপালী আঁচল দিয়ে গোলাপটাকে ঢেকে দিতেই গোলাপটার ঘুম ভেঙ্গে গেল। চোখ মেলতেই সে দেখল তার সামনে তেমনি এক রুপালী সুন্দর প্রজাপতি উড়ে উড়ে যাচ্ছে।” পারুল লোপার কথাগুলি যেন মন্ত্রমুগ্ধ হয়ে শুনতে লাগল। সে কখনো এমন কথা শুনেনি। সে অপলকে ভেবলার মত লোপার দিকেই তাকিয়ে রইল।
লোপা অনেক সুন্দর সুন্দর কথা, সুন্দর সুন্দর গল্প শুনাতে লাগল পারুলকে। ফুলের কথা, পাখীদের কথা, প্রজাপতিদের কথা, হাওয়ার কথা শুনতে পারুলের বেশ লাগছিল। সে ভাবতে লাগল এই কথা গুলিকে যদি গল্পের মত, কবিতার মত সাজিয়ে লেখা যায় তবে তা কতই না সুন্দর হবে। সে মুগ্ধ শ্রোতার মত লোপার কথা গুলি শুনেই যেতে লাগল। আর জীবনের প্রথম এমন একাগ্র শ্রোতা পেয়ে লোপাও মন খুলে ফুল-পাখী , আকাশ-বাদলের কথা বলতে লাগল।
হঠাৎ পারুলের মনে হল সত্যিই কি ফুল পাখীরা লোপার সাথে কথা বলে? সে লোপাকে কথাটা জিজ্ঞাস করল। লোপা হাসতে হাসতে বলল “না সই, সত্যি বলতে তারা আমার সাথে কথা বলে না। আমি জানি ওগুলি আমার কল্পনা, আমার খেয়াল। তবে আমি ওগুলি নিয়েই থাকতে খুব ভালবাসি, ওগুলিই আমার খুব ভাললাগে।”
পারুলের মনে হল লোপার মনে এক খুব বড় লেখক, এক খুব বড় কবি লুকিয়ে আছে। যেন একটা ঝড়কে মনে বেঁধে নিয়ে বসে আছে লোপা। আর সেই ঝড়ের, সেই লেখকের অমূল্য সব গল্প, কবিতা ছন্নছাড়া হয়ে চারিদিকে ছড়িয়ে ছিটিয়ে আছে। তারা দিশা খুঁজে পাচ্ছে না। সেই ঝড়কে একটি দিশা দিলে গল্প-কবিতা আর সুন্দর রচনার বন্যা বয়ে যাবে। আর সে তাই করল। সে লোপার কাছ থেকে খাতা কলম চেয়ে এক এক করে লোপার কথা গুলি গল্পের মত লিখতে লাগল। লোপাও এতে বেশ মজা পেল। সেও প্রাণ ভরে প্রাণের কথা বলে যেতে লাগল। দেখতে দেখতে সেই খাতা ভরে যেতে লাগল সুন্দর সব গল্পে, সুন্দর সব কবিতায়।
ক্লাসে পারুল এখন সব সময়ই লোপার সাথে বসে। সে প্রায়ই লোপাকে জিজ্ঞাস করে, দেখতো স্যারের বইটা কি বলছে? ব্ল্যাক-বোর্ডেটা কি বলছে? এমন করতে করতে ধীরে ধীরে লোপার মন ক্লাসের পড়াশুনার দিকে ফিরতে লাগল। মেধাবী সে বরাবরই ছিল, শুধু কোথায় যেন একটা বাধন তাকে এগিয়ে যেতে বাধা দিচ্ছিল। ক্রমে সেটা দূর হতেই তাকে আর পিছন ফিরে দেখতে হয় নি।
কিছুদিন পরে স্কুলে গল্প লেখার, কবিতা লেখার প্রতিযোগিতা শুরু হল। গল্প আর কবিতা লেখায় পারুলই প্রথম হল। তার গল্প, কবিতা এতই সুন্দর হল যে সবাই তার খুব প্রশংসা করতে লাগল। পুরস্কার বিতরণীর অনুষ্ঠানে স্কুলের মাঠে গ্রামের অনেক লোক জমা হল। শহর থেকে নামি-দামী লেখক, কবি এবং অন্য গণ্যমান্য লোককে ও নিমন্ত্রণ করে আনা হল।
পারুলকে যখন তার পুরস্কার দেওয়া হল তখন প্রধান শিক্ষক মহাশয় পারুলকে অনুরোধ করলেন কয়েকটা স্বরচিত কবিতা শুনানোর জন্য। পারুল পুরস্কার হাতে নিয়ে একে একে অনেকগুলি কবিতা শুনাল। এমন সুন্দর কবিতা শুনে উপস্থিত লেখক, কবিরা চমকে উঠলেন। এমন লেখা তারা আগে কখনো শোনেননি। সবাই বাঃ বাঃ করতে লাগল।
পারুল হাসি মুখে সবাইকে অবাক করে বলতে লাগল “আমি আপনাদের সবাইকে একটা সত্যি কথা বলতে চাই। এই লেখা গুলি আমার নয়। এই লেখা গুলি আমার সবচেয়ে প্রিয় বান্ধবী লোপার লেখা। আমার অনেক অনুরোধেও সে প্রতিযোগিতায় অংশ গ্রহণ করতে চায়নি। তাই তার রচনা গুলিকে সামনে আনার জন্য, গোপনে প্রতিযোগিতাতে এই লেখা পাঠাই। লেখা গুলির মধ্যে কোন লেখক বা কবির নাম ছিল না। কিন্তু যেহেতু লেখা গুলিকে আমিই পাঠিয়েছিলাম তাই সবাই ভাবল এগুলি আমারই লেখা। আসলে এই গুলি লোপার আর এই পুরস্কার তারই প্রাপ্য।” এই বলে সে তার বান্ধবীর সব ইতিহাস খুলে বলল।
নতুন একটা গল্পের মতই সবাই তার কথা অবাক হয়ে শুনল। লোপাকে মঞ্চে ডাকা হল। কাছে আসতেই পারুল লোপাকে আদরে, আবেগে জড়িয়ে ধরল। শেষে প্রধান শিক্ষক মহাশয় দুজনকেই পুরস্কার দিলেন। তিনি বললেন “আজ আমি নিজেকে খুব গর্বিত অনুভব করছি যে আমার স্কুলে পারুল আর লোপার মত এমন গুণী ছাত্রীরা আছে। পারুলের সততা, বুদ্ধিমত্তা এবং নিষ্ঠা একটা উদাহরণ হয়ে থাকবে আমার কাছে। জানতাম যে জীবনে মাত্র একজন বন্ধুর মত বন্ধু হলেই জীবনের রং পাল্টে যায় আর আজ এত বছর পর চোখে দেখলাম। তাদের দুজনকেই আমার অনেক অনেক আশীর্বাদ আর শুভ কামনা জানাই।” চারিদিক দর্শকদের হাততালির শব্দে মুখরিত হতে লাগল।