পেশাকর

পেশাকর

ব্রহ্মপুত্র নদে নৌকা নেই, তবে নদীখাত বলে দেয় একসময় কত প্রশস্ত, কত বেগবান ছিল সে। তার তীরের কত কথা কাহিনি ইতিহাসের পাতায় ঠাই নিলেও এর রেশ আজো আছে। মনন ভাবছে আর কিছু কিছু প্রশ্ন মাথায় কিলবিল করছে। কিন্তু কাকেও কাতুকুতু দিয়ে উত্তর জানার চেষ্টা করতে পারছে না।

ব্রহ্মপুত্রের তীরবর্তী একটি অবহেলিত জেলায় এসেছে কিছুকাল, দাপ্তরিক নাম সহকারী কমিশনার (ভূমি)। এলাকার লোক তার অফিসকে জমিদারের বাগানবাড়ি হিসাবেই চিনে। এ চেনার মধ্যে কোন ভালোবাসা নেই, অত্যাচারের কাহিনি তাদের মনে দাগ কেটে আছে বহু বছর ধরে। অফিসে খতিয়ান ঘাটতে ঘাটতে একটি শব্দে চোখ আটকে যায়, পেশা লেখা আছে ‘পেশাকর’। বাংলা একাডেমির অভিধান ঘেঁটে পেলো নটী’। তা এই প্রত্যন্ত অঞ্চলে নামটি কেমন করে এলো? একটি মৌজা জুড়ে একই পেশার লোকজনের বসবাস; বেশ সমৃদ্ধ গ্রাম এটি। কৌতূহল রাখতে না পেরে প্রশ্ন ছুঁড়ে মারলো, অন্ধকারে ঢিল ছোড়ার মত, “পেশাকর কি?” বসের মুখে এই প্রশ্ন শুনে মুচকি হেসে চলে গেল অফিস সহকারী; জিহ্বাও একটু চেটে নিল, যেন প্রশ্নটি সুস্বাদু; লবণ আছে মনে হয়। “কানুনগো সাহেব, খতিয়ানে এত পেশাকর কেন?” উত্তর নেই, একটি হাসি দিয়ে চলে গেল কানুনগো সাহেব। কিছু একটা বলতে চেয়েও বললো না।

অফিসের সবচেয়ে পুরনো সার্ভেয়ার, চুল, দাড়ি, গোঁফ সবই সাদা। চাকরি জীবনের শেষ পর্যায়ে, মুখের ভাঁজে ভাঁজে অভিজ্ঞতা জমা; মানুষকে ঠকানো থেকে অফিসের কাজের নিপুণতা সবই অসাধারণ। মনন তাকেই চেপে ধরলো, “খতিয়ানে একটি পেশার উল্লেখ পাচ্ছি বারবার। তাও একটি মৌজায়, ব্রহ্মপুত্রের পাড়ে, কারণ কি?” নতজানু হয়ে মোলায়েম সুরে সার্ভেয়ার উত্তর দিল, “স্যার, এই প্রশ্নের উত্তর জানতে এই উপজেলা পরিষদের সব থেকে বড় মুরুব্বীর কাছে গেলে পাবেন।” পাশেই দোতলা ভবন। উপজেলা পরিষদ চেয়ারম্যান বসেন দোতালায়। মনন গেল তার রুমে, সালাম দিতেই চেয়ারম্যান সাহেব বললেন, “বসেন বসেন, আপনি তো সকল জমির মালিক, আমরা সবাই প্রজা।”

“হ্যাঁ, যা বলেছেন; জমি ছাড়া জমিদার।”

লোকজন ফাঁকা হলে মনন কথাটা পাড়লো, “একটি বিষয় নিয়ে আমি ভাবনায় পড়েছি?”

“জী, বলেন।”

“একটি মৌজায় প্রায় সব খতিয়ানে পেশা হিসাবে পেশাকরদের নাম দেখেছি, তাও সবাই মহিলা। আমি নতুন এসেছি এই উপজেলায়, এমন পেশার পরিচয় আর কোথাও পাইনি।”

চেয়ারম্যান সাহেব চুপচাপ। ইতোমধ্যে চা পান পর্ব শেষ, অন্যকিছু করা যাচ্ছে না। চেয়ারম্যান সাহেব ধূমপান করেন না, তাই নিঃসঙ্গতার সঙ্গীও পাচ্ছেন না। অবশেষে মুখ খুললেন, “পেশাকররা হলো এই এলাকার প্রসটিটিউট,” বাংলা প্রতিশব্দ ব্যবহার না করেই বেশ ব্ৰিতভাবে বললেন, “ব্রিটিশ আমলে এই মৌজায় পেশাকরদের জমজমাট উপস্থিতি ছিল। বৃহত্তর ময়মনসিংহে এটিই ছিল সবচেয়ে বড় পতিতালয়।” মনন দেখলো, চেয়ারম্যান সাহেবের পাকা চুলগুলো যেন ঘরের বিদ্যুৎ বাতির আলোয় চকচক করছে। কিন্তু তিনি আর কথা না বাড়িয়ে চুপ করে গেলেন। মনন ফিরে গেল তার অস্থায়ী ঠিকানায়, তথাকথিত জমিদার কুঠিতে।

মননের উৎসাহ বেড়ে গেল। ছাত্রজীবনে প্রেমে ফেল করেছে কিন্তু বিসিএস তো পাশ করেছে। এই তথ্যের গভীরে যেতে হবে। সংশ্লিষ্ট মৌজার ইউপি চেয়ারম্যান এলেন। এক মৌজা মিলেই একটি ইউনিয়ন। সহকারী কমিশনার (ভূমি)’র অফিসে তার অনেক কাজ। মননের প্রশ্নবাণে জর্জরিত হয়ে বের করে দিলেন থলের বিড়াল; উঠানে বিড়াল যেন মাছের কাঁটা খাচ্ছে আর মিউ মিউ করছে। বলে গেলেন ইউপি চেয়ারম্যান, “আমার ইউনিয়নের প্রায় সকল সম্পত্তির মালিক এই পেশাকররা।” একটু ঢোক গিলে বললেন, “সারা ময়মনসিংহের ভিতর উঠতি বা বনেদী বড়লোকদের বিনোদন কেন্দ্র ছিল এখানে। এই এলাকার মহিলারা দেহের রূপ আর সুধা বিনিময় করে পেয়েছে জমি। সেই ধারাবাহিকতার মধ্যে, ব্রিটিশ আমলে ক্যাডাস্ট্রাল সার্ভে বা সি.এস.-এর সময় এদের দখলে ছিল জমি। সি.এস. রেকর্ডে তাই কেবল এদের নাম। এরা তাদের পেশাও লুকিয়ে রাখেনি কখনো। তাই খতিয়ান জুড়ে এত পেশাকর।”

মনন বললো, “শুধু কি তাই? সুনামগঞ্জের দেরাইয়ে শুনেছি দু’টি গ্রামের লোকজন নিজেদের পেশা বলতে বলে ‘চুরি করা’ আর এখানে তো আরো অবাক কাণ্ড!”

“স্যার। এই এলাকায় যত দাতব্য চিকিৎসালয় আছে, যত স্কুল আছে, এমনকি ধর্মীয় প্রতিষ্ঠান আছে, সব তাদের দেয়া দানকৃত জমিতে গড়ে উঠেছে।”

“বলেন কি?” মননের চোখেমুখে বিস্ময়ের ঘোর, “মুরুব্বী, পুরোহিত, মুসল্লীরা আপত্তি করেননি?”

“তা করবে কেন? এই এলাকার সবচেয়ে বড় লোক ধলা মিয়া তো এদের সেবা করেই বড়লোক হয়েছে।”

উপজেলায় বিদ্যুৎ নেই, অফিস তবু খোলা। অন্ধকার কিছু কাটে মোমবাতিতে, কিন্তু গরম যে যায় না। হাতপাখা আর কত? খোলা দরজার মুখে দাঁড়িয়ে ধলা মিয়া। মনন দেখেই ডাকলো, “ধলা মিয়া, ভিতরে আসেন।”

“সালাম স্যার, আমাকে ডেকেছেন?”

“আপনি নাকি পেশাকরদের জমি ভোগ করে বড়লোক হয়েছেন?”

“কে বললো স্যার?”

“কথাটি কি সত্য?”

“জী স্যার, আমি স্বীকার করি। আমি ওদের অনেক যত্ন করেছি।”

“সেটি আবার কেমন?”

“বৃদ্ধ অবস্থায় মা’কে যেমন সেবা করেছি, পেশাকরদের আমি তেমন যত্ন করেছি। ওরা আমাকে খুশি হয়ে জমি দিয়েছে। জোর করি নাই। তবে আমি একা নই কোথায় যেন পড়েছে রাজকীয় দেহপসারিনি মেরি কেলির কথা, দিনে দোকানকর্মী, রাতে বিনোদনসংগী। কই, তারা তো কিছু পায়নি! মেরির বান্ধবী অ্যানির অবস্থা আরো ভয়াবহ, ছিনতাই হলো অবৈধ সন্তান, সার্জন নষ্ট করে দিলেন স্নায়ুতন্ত্র। আর ব্রিটিশ রাজের আমল থেকে যাদের সমাদর, তারা কি চমৎকারভাবে এই সমাজে টিকে আছে, একটু না হয় ডাকলো পেশাকর হিসাবে। কারণ হয়তো একটাই, ঐ যে ধলা মিয়া বললো,” আমি তো একা নই।”

মননের মনে পড়লো এক বড় ভাইয়ের গল্পকথা, সত্য ঘটনা। অস্ট্রেলিয়ার সিডনির কথা। পড়ালেখা উপলক্ষে তিনি তখন সেখানে। বিশ্ববিদ্যালয়ের অফিসে গিয়েছেন ভর্তির টাকা জমা দিতে। আশেপাশে সব ছাত্র-ছাত্রী তাকে ঘিরে ধরলো। এমন ঘটনা কখনো দেখেনি আগে। সবাই তো কার্ডের মাধ্যমে ফিস জমা দেয়। কিন্তু এ যে নগদ লেনদেন। যিনি টাকা নিবেন, সেই অফিসের কর্মকর্তা, যিনি একজন ভদ্রমহিলা, কিছুটা সময় থ মেরে ছিলেন। তার সাথে দ্রুতই সখ্যভাব গড়ে ওঠে, বিদেশী ছাত্রের প্রতি আগ্রহ থেকে। একদিন অনেক বৃষ্টি, বড় ভাই ফুটপাতে সেডের নিচে দাঁড়িয়ে।

ভদ্রমহিলা তাকে তার গাড়িতে উঠিয়ে নিলেন। কথা প্রসঙ্গে বললেন, “আমার মেয়েটি বড় বোকা। সেও তোমার মত ইউনিভার্সিটিতে পড়ছে, তাও আবার পিএইচডি করছে। চাকরির কোন গ্যারান্টি নাই। আর আমার ছেলেটি কত বুদ্ধিমান, সে পড়াশুনা ছেড়ে জেনিটর হয়েছে, একেবারে পায়খানার মিস্ত্রি । তার কোনদিন চাকরি খুঁজতে হবে না, যতদিন নগর সভ্যতা আছে, ততদিন তার কাজ থাকবে, ইনকাম থাকবে।” ঘটনাটা মনে হতেই মনন হাসলো একা একা; হাঁ, ধলা মিয়ার আর দোষ কি? তথাপি ধলা মিয়াকে জিজ্ঞাসা করলো মনন, “আপনি কি মনে মনে নিজেকে অপরাধী মনে করেন?” ধলা মিয়ার চটজলদি উত্তর, “আমি তো জোর করে কিছু করি নাই।” “কিন্তু আপনি তো বললেন, পেশাকরদের অনেক দেখভাল করেছেন, এত এত সম্পত্তির মালিক হয়েছেন।”

ধলা মিয়া কোন কথা বললো না, দরজার চৌকাঠের দিকে তাকিয়ে রইল। কপালে বিন্দু বিন্দু ঘাম। ঘাম মুছবার কোন আগ্রহ নেই। পেশাকরদের নিয়ে কেউ কথা বলতে চায় না। কথা বললে অনেক অপ্রিয় কথা বেরিয়ে আসবে। ধলা মিয়া কি তাই ভাবছেন? হঠাৎ করে বিদ্যুৎ এলো। মনন পিওনকে ডেকে বললো, “এতোক্ষণ কারেন্ট ছিল না, ফ্যানটা ছাড়ো তো?”
“স্যার, কাল থেকে তো ফ্যানের ক্যাপাসিটরটা নষ্ট হয়ে আছে…”

গল্পের বিষয়:
গল্প
DMCA.com Protection Status
loading...

Share This Post

সর্বাধিক পঠিত