ছুটির দিন বেলকনিতে বসে পত্রিকা পড়ছি আর সিগারেট খাচ্ছি। সিগারেট শেষ হলে ওয়াশরুমে গেলাম। ওয়াশরুম থেকে বের হয়ে দেখি আমার ৪বছরের বাচ্চা ছেলে সাদমান ফেলে দেওয়া সিগারেটের অংশটা ঠিক আমার মত দুইহাতের আঙুলের মাঝে রেখে টানছে। দৃশ্যটা দেখে আমি পাথরের মত দাঁড়িয়ে রইলাম। এমন সময় আমার স্ত্রী শ্রাবণী পিছন থেকে বললো,
-ভালোই হলো , আজ থেকে বাবা ছেলে একসাথে বসে সিগারেট টানবে। অফিস থেকে ফেরার সময় তোমার জন্য এক প্যাকেট সিগারেট আনবে আর তোমার ছেলের জন্য এক প্যাকেট এইকথা বলে শ্রাবণী রাগে সাদমানকে গালে একটা থাপ্পড় মেরে আমার সামনে থেকে নিয়ে গেলো। আমি বেলকনিতে কতক্ষণ বসে চিন্তা করলাম। তারপর বাসা থেকে বের হয়ে পাশের চায়ের দোকান থেকে ১প্যাকেট সিগারেট কিনলাম সারাদিন বাহিরে থেকে সন্ধ্যায় যখন বাসায় ফিরি তখন শ্রাবণী বললো,
– সারাদিন কোথায় ছিলে? ফোনটাও বাসায় ফেলে গিয়েছিলে আমি মুচকি হেসে বললাম,
— আজ ১৩ বছরের সম্পর্ক শেষ করে দিয়ে আসলাম শ্রাবণী অবাক হয়ে বললো,
– মানে! আমি বললাম,
— ক্লাস টেন থেকে আমার সাথে সিগারেটের সম্পর্ক। বাবা কত শাসন করলো, মা কত কসম দিলো, তুমি কত বকাঝকা করলে তবুও সিগারেট ছাড়তে পারি নি। কিন্তু আজ যখন দেখলাম আমার বাচ্চা ছেলেটা আমায় দেখে সিগারেট খাওয়া শিখছে তখন আর সহ্য করতে পারলাম না। তাই আজ থেকে সিগারেট খাওয়া ছেড়ে দিলাম কয়েকদিন পর শ্রাবণীর এক বান্ধবীর বাসায় আমরা দাওয়াতে গেলাম। খাওয়া দাওয়ার পর আমরা সবাই ড্রয়িংরুমে বসে আড্ডা দিচ্ছি আর আমার ছেলে সারা বাসা ছুটাছুটি করছে। বিকাল দিকে যখন বাসায় ফিরবো তখন শ্রাবণীর বান্ধবী শ্রাবণীকে একটু আড়ালে ডেকে নিয়ে বললো,
~তোকে একটা কথা বলি কিছু মনে করিস না। তোর ছেলের পকেটে মনে হয় কিছু টাকা আছে। আমি যখন আমাদের বেডরুমে যায় তখন দেখি রিয়াদের( শ্রাবণীর বান্ধবীর স্বামী) শার্টের পকেটে তোর ছেলে যেন কি করছে। আমি বিষয়টা তখন খেয়াল করি নি। কিন্তু কিছুক্ষণ পর রিয়াদ বললো তার পকেট থেকে ৩ হাজার টাকা নাই। আসলে তোর ছেলে তো ছোট মানুষ ও তো টাকা কি বুঝে না। হয়তো খেলার চলেই পকেটে রেখেছে। শ্রাবণী যখন আমাদের বাচ্চার পকেটে হাত দিলো তখন দেখলো সত্যি সত্যি সেখানে টাকা। শ্রাবণী টাকা গুলো বের করে ওর বান্ধবীর হাতে দিলে ওর বান্ধবী বললো,
~এক হাজার টাকা রেখে দে।আমি খুশি হয়ে তোর ছেলেকে দিলাম।শ্রাবণী রাগে তখন বললো,
-দরকার নেই, আমরা এতটা অভাবে পরি নি
রিকসা দিয়ে বাসায় যখন ফিরছি তখন খেয়াল করি শ্রাবণী কেঁদে চোখের পানি নাকের পানি এক করে ফেলছে। কেন জানি আমার শ্রাবণী কান্না দেখে খুব হাসি পাচ্ছে। আমি হাসিটা অনেক কষ্টে চেপে শ্রাবণীকে বললাম,
–তুমি কাঁদছো কেন? শ্রাবণী কাঁদতে কাঁদতে বললো,
-কাঁদবো না তো কি করবো? একটা চোর জন্ম দিয়েছি আমি মুচকি হেসে বললাম,
— যার মা একটা বড় ধরনের চোর সে তো চোর হবেই শ্রাবণী চোখের জল মুছে বললো,
-মানে! আমি তখন বললাম,
— বাচ্চারা খুব অনুকরণ প্রিয় হয়। বড়রা যা করে ওরা তা দেখে সহজে শিখে ফেলে। তুমি সবসময় আমার পকেট থেকে টাকা সরাও আর সেটা আমার ছেলের সামনে। সে এটা দেখেই শিখেছে। দেখো আমাদের দেশে ৮৫% স্ত্রীরা স্বামীর পকেট থেকে চুপিচুপি টাকা সরায়। এটা স্বাভাবিক ঘটনা। কিন্তু খেয়াল রাখা উচিত এই চুরিটা যেন বাচ্চারা না দেখে। বাচ্চাদের কৌতূহলী মন। ওরা একটা কিছু দেখলে আর ভুলে না আমার কথা শুনে শ্রাবণী মুখ গোমড়া করে চুপ করে রইলো। আমি তখন ওর কানের কাছে আস্তে আস্তে বললাম,
— আমাদের ছেলের কিন্তু বুদ্ধি আছে। দেখলে কি সুন্দর করে ছোট পকেটে ৩ হাজার টাকা রাখলো। তুমি যদি ঠিক মত ট্রেনিং দাও তাহলে ও ইন্টারন্যাশনাল চোর হতে পারবে। আর কপালে লেখা থাকলে ধুম20 মুভিটার করতে পারে
আমার কথা শুনে শ্রাবণী আবার কান্না শুরু করলো আর আমি এইবার জোরে জোরে হাসতে লাগলাম চাকরিতে প্রোমোশন পেয়েছি। সে উপলক্ষে বাসায় ছোটখাটো একটা পার্টি দিলাম। পার্টিতে অফিসের কিছু কলিগ আর কয়েটা বন্ধুকে দাওয়াত দিলাম। সবাই তাদের স্ত্রী সন্তানদের নিয়ে এসেছে। সেই অনুষ্ঠানে আমার ছোট বেলার বন্ধু মামুন ওর স্ত্রী আর ৪ বছরের বাচ্চা মেয়েটাও এসেছে। আমরা বড়রা একদিকে আড্ডা দিচ্ছি আর ছোট বাচ্চারা একসাথে খেলছে।
এমন সময় একটা বাচ্চা চিৎকার করে বললো, ” আমি বেন-টেন। আমার অনেক শক্তি” এটা শুনে আমার ছেলে মামুনের মেয়ের হাত ধরে বললো, ” আমরা মটু-পাতলু” এটা শুনে মামুনের মেয়েটা বললো, “না আমরা মটু পাতলু না। আমি হলাম রাস্তার মেয়ে আর তুমি হলে জানোয়ারের বাচ্চা” ছোট বাচ্চার মুখে এমন নোংরা কথা শুনে সবাই অবাক হয়ে গেলাম। আমার ছেলে তখন বললো, “এটা কোন কার্টুন ” মামুনের মেয়েটা বললো, “এটা কোন কার্টুন না। আব্বু আম্মুকে রাস্তার মেয়ে বলে আর আম্মু আব্বুকে জানোয়ারের বাচ্চা বলে। আম্মু আমায় বলেছে মটু-পাতলুর থেকে জানোয়ের বাচ্চা আর রাস্তার মেয়ে খুব বেশি শক্তিশালী ” রাত ১০ টা বাজে। সবাই চলে গেছে। কিন্তু মামুন আর ওর স্ত্রী রিমি কিছু না খেয়ে এখনো চুপচাপ বসে আছে। আমি মামুনের কাছে গিয়ে বললাম,
— দেখ, স্বামী স্ত্রী ঝগড়া হবে এটা স্বাভাবিক ঘটনা। কিন্তু বাচ্চাদের সামনে ঝগড়া করা একদম উচিত না। ঝগড়া করলে রুমে দরজা লাগিয়ে ঝগড়া করবি যেন বাচ্চারা না শুনে। ছোট বেলায় বাচ্চাদের ব্রেইন খুব সতেজ থাকে। ওরা তখন একবার কিছু শুনলে সহজে সেটা ভুলে না। এইখানে তোর মেয়ের কোন দোষ নেই। কারণ সে তোদের মুখ থেকেই এইগুলো শুনেছে। আর নিজের স্ত্রীকে রাস্তার মেয়ে বলিস কোন কারণে? তুই কি রাস্তার মেয়েকে বিয়ে করেছিস? মামুন আমার কথা শুনে চুপ করে রইলো। আমি ওর স্ত্রীকে বললাম,
— ভাবী, আপনার মেয়ে যখন আপনার কাছে জানতে চেয়েছিলো রাস্তার মেয়ে জানোয়ারের বাচ্চা এইগুলোর মানে কি। তখন তাকে আপনি ভুল শিখিয়েছেন। বাচ্চারা যত ছোটই থাকুক না কেন ওদের কোনটা ভালো আর কোনটা মন্দ সেটা শিখাতে হয়। আর নিজের স্বামীকে জানোয়ারের বাচ্চা বলা সত্যি খুব খারাপ। ৭০% শিক্ষা একটা সন্তান তার বাবা মার থেকে পায়। আর আমাদের সন্তানদের জন্য হলেও আমাদের অভিভাবকদের উচিত নিজেদের শুধরে নেওয়া মাঝরাতে ঘুম ভেঙে গেলে আমি বেলকনিতে দাঁড়িয়ে বাহিরের দিকে তাকিয়ে আছি। হঠাৎ শ্রাবণী আমার কাঁধে হাত রেখে বললো,
– সিগারেট খেতে ইচ্ছে করছে তাই না? আমি মুচকি হেসে বললাম,
— ইচ্ছে করছে ঠিকি কিন্তু আমার সন্তানের সু-শিক্ষার জন্য হলেও আমি আর সিগারেট খাবো না
গল্পের বিষয়:
গল্প