ঘুঘুর ফাঁদ

ঘুঘুর ফাঁদ
আমার স্ত্রী স্বর্ণার মোবাইলে অন্য একটি ছেলের সাথে অন্তরঙ্গ অবস্থায় পিক দেখে তেমন অবাক হলাম না বরং ঠান্ডা মাথায় টুক করে সেটা আমার মোবাইলে নিয়ে নিলাম। কারণ আমি আগেই আঁচ করতে পেরেছিলাম যে ওর অন্য কোন ছেলের সাথে সম্পর্ক রয়েছে। আমি স্বর্ণার বিরুদ্ধে কখনো উচু গলায় কথা বলিনি আর আজও বলবোনা। কারণ আমি নিম্নবিত্ত পরিবারের সন্তান হওয়া সত্ত্বেও স্বর্ণার বাবা একজন পুলিশের কর্মকর্তা। স্বর্ণার বাবা আমাকে অনেক ভদ্র একজন ছেলে এবং কলেজের শিক্ষক হওয়ার কারণেই স্বর্ণাকে আমার নিকট বিয়ে দেন।
কিন্তু স্বর্ণার এই বিয়েতে মত ছিলনা কারণ আমি নাকি ফকিরের সমতুল্য ওর নিকট। আর আমি জানি স্বর্ণাকে পাল্টা কিছু বললে ও শ্বশুড়ের নিকট আমার সম্পর্কে উল্টাপাল্টা বলবে। ফলস্বরূপ স্বর্ণার বাবা আমাকে সান্ত্বনা দেওয়ার পরিবর্তে গালিগালাজটাই একটু বেশি দেন। স্বর্ণার মোবাইলটা জায়গা মতো রেখে শ্বশুড়কে একটা কল দিলাম জরুরী মিটিং এর কথা বলে। শ্বশুড় মশাইয়ের বাসা বেশি দূরে নয়, হেঁটে যেতে দশমিনিট সময় লাগে বৈ কি। বিকালে শ্বশুড় মশাইয়ের বাসায় উপস্থিত হয়ে একমুহূর্ত দেরী না করে মোবাইল থেকে পিকটি তার চোখের সামনে তুলে ধরলাম। স্থিরচিত্রটি দেখামাত্রই স্বর্ণার বাবার রাগে কপালের ঘাম চুইয়ে চুইয়ে পরতে শুরু করলো। তিনি আমাকে গম্ভীর গলায় বলে উঠলেন,
-রাতে স্বর্ণাকে নিয়ে এসো। এই কথা বলে চেয়ার থেকে উঠে গেলেন। আমার মনের ভিতরে কেন যেন খুব খুশি খুশি লাগছে। রাতে শ্বশুড় বাড়ির ডাইনিং টেবিলে সবাই বসে আছি। এমন সময় শ্বশুড় মশাই স্বর্ণাকে আদুরে গলায় বলে উঠলেন, -মা আমার কাছে আয়তো। স্বর্ণা কথামতো ডাইনিং টেবিল ছেড়ে শ্বশুড়ের নিকট এসে দাঁড়ালো। তৎক্ষনাৎ শ্বশুড় মশাই মোবাইলটা স্বর্ণার দিকে তাক করিয়ে বললেন,
-তোর সাথের ছেলেটা কে? ছবিটি দেখামাত্রই স্বর্ণা হতবিহ্বল হয়ে গেল। বেশকিছুক্ষন ছবিটার দিকে তাকিয়ে থেকে হঠাৎই বলে উঠলো,
-এটা নিশ্চই তোমার প্রাণপ্রিয় জামাইর কাজ তাই নাহ? বাবা তুমি কী জীবনেও বিশ্বাস করবে যে তোমার মেয়ে আরেকটি ছেলের সাথে ছবি তুলবে? স্বর্ণার বাবা এবার কিছুটা ভাবগম্ভীরতা এনে বললো,
-আমিওতো তাই ভাবছি।
-বাবা এখনকার যুগে ছবির মাথা কেঁটে অন্য মাথা লাগানো যায় যাকে বলে ইডিট। তোমার জামাইবাবু তোমার নিকট আমাকে খারাপ বানানোর জন্যই এসব করেছে। তোমাকে আগেই বলেছিলাম এসব ভদ্রবেশি ফকিরদের নিকট আমাকে তুলে দিয়োনা। এখন নিজের চোখেই দেখো।
আমি স্বর্ণার কথা শুনে হা করে ওর দিকে তাকিয়ে রইলাম। কয়লাকে কীভাবে ঘষে স্বর্ণ বানাতে হয় এই মেয়ে খুব ভালো করেই জানে দেখি। সেদিন আমার গায়ে শুধু হাত তোলাটাই বাকী রেখেছিলেন শ্বশুড় মশাই আর যা যা বলার দরকার সবই বলেছেন। আমি শুধু মেঝেতে তাকিয়ে থেকে দুফোঁটা অশ্রু বিসর্জন দিয়েছিলাম শুধু। আর স্বর্ণার মুখে এক প্রাপ্তির হাসি। আমার বলার মতো কোনো ভাষাই ছিল না। এভাবে কেটে গেল আরো দুমাস। এখন আর স্বর্ণা আড়ালে তার প্রেমিকার সাথে কথা বলেনা বরং আমার সামনেই কথা বলে। কারণ ও জানে আমি শ্বশুড় মশাইকে কিছু বললেও তিনি বিশ্বাস করবেন না। আজ রাতে যখন বাসায় ফিরি তখন স্বর্ণাকে কোথাও খুজে পেলাম না। শুধু বিছানায় একটা চিরকুট দেখতে পেলাম, “যাহ তোকে আর জালাবো না। আমি আমার প্রিয় মানুষের সাথে চলে এসেছি। চিন্তা করিস না বাবা তোকে কিছু বলবেনা আমি বাবাকে ফোন করে জানিয়ে দিয়েছি। সময়মতো ডিভোর্স লেটার পেয়ে যাবি।” চিরকুটটা পড়েই মনে এক টুকরো শান্তি অনুভব হলো। স্বর্ণা আমাকে আগে ডিভোর্স দিয়ে যায়নি কেবলমাত্র ওর বাবার কারণে। তৎক্ষনাৎ শ্বশুড় মশাইয়ের কল,
-বাবা, এ আমি কী শুনছি? স্বর্ণা এভাবে আমার মান সম্মান ধুলিস্যাৎ করে দিলো?
-আপনাকে আগেই অনেকবার বলেছি কিন্তু আপনি উল্টো আমাকে ভুল বুঝেছেন। এখন আপনার মেয়ে আপনি বুঝেন।
এই বলে আমি কলটা কেটে দিলাম। এদিকে এলাকায় জানাজানি হয়ে গেল যে পুলিশ কমিশনার এর মেয়ে স্বামী থাকতেও অন্য ছেলের সাথে পালিয়েছে। শ্বশুড় মশাই লজ্জায় একপ্রকার বাসা থেকে বের হওয়াই বন্ধ করে দিলেন। অথচ আমি রাস্তাঘাটে কলেজে বিন্দাস ঘুরে বেরাচ্ছি। অনেকেই আমার নিকট এই বিষয়ে প্রশ্ন করলে আমার একটাই উত্তর পুলিশ কমিশনারকে জিজ্ঞেস করেন। আমার এক উত্তর শুনতে শুনতে লোকেও এখন আর আমাকে কিছু প্রশ্ন করেনা। এর কিছুদিন পরেই বহুকাঙ্ক্ষিত সেই ডিভোর্স লেটারটা পেয়ে গেলাম। একমুহূর্ত দেরী না করে সই করে দিলাম। অতঃপর পকেট থেকে মোবাইলটা বের করে সাগরকে কল দিলাম,
-হ্যালো মারুফ ভাই বলেন।
-হুম ডিভোর্স লেটার পেয়ে গেছি এখন তুমি ওকে ছেড়ে দিয়ে দেশের বাহিরে চলে যাওয়ার প্রস্তুতি নাও।
-ভাই আপনার বউটাতো জোস। আর কিছুদিন রাখি।
-তাহলে কিন্তু তোমার বাবা মায়ের স্বপ্নপূরণ করতে আমেরিকা যেতে পারবেনা। -আচ্ছা ভাই বিকালেই ছেড়ে দিবো আপনি টাকাটা পাঠিয়ে দিয়েন।
-আচ্ছা একমুহূর্ত দেরী যেন না হয়।
-ঠিক আছে।
এর পরের দিনই শুনতে পেলাম স্বর্ণা শ্বশুড় বাড়িতে ফিরে এসেছে থুক্কু এখনতো আর সেটা শ্বশুড় বাড়ি নেই। স্বর্ণার মতো বিঁষফোঁড়া কে সরাতে এই বুদ্ধিটা খাঁটাতে হলো আরকি। সাগর ছেলেটি নিম্নবিত্ত পরিবারের ছেলে ওর পুরো ফ্যামিলিই অসুখে জর্জরিত। ছোটবেলা থেকেই ওর ইচ্ছা আমেরিকা গিয়ে ওর পরিবারের দুঃখ ঘোচাবে।
ছেলেটি বেশ হ্যান্ডসামও বটে। তাই স্বর্ণাকে ফাঁদে ফেলতে ওকেই ব্যবহার করলাম। সাগরেরও টাকার খুব প্রয়োজন ছিল। পরদিন স্বর্ণা ও তার বাবা আমার বাসায় হাজির হলেন। আমি তাদের দেখেও অচেনার ভান করে বললাম কী চাই? আমার কথা শুনে কিছুটা অবাক নয়নে তাকিয়ে থেকে স্বর্ণার বাবা মাথাটা নুইয়ে ফেললেন। মনে পরে গেল সেদিনের অপমানের কথা যখন আমার দোষ না থাকা সত্ত্বেও আমাকে অপমান করেছিলেন তিনি। আর আমি ঠিক এভাবেই মাথা নত করে ছিলাম। হুট করেই স্বর্ণা কোন ভুমিকা না করে আমার পা দুটো জড়িয়ে ধরলো,
-আমাকে ক্ষমা করে দাও। আমি ভুল করেছি। এখন থেকে তুমি যা বলবে আমি তাই করবো।
-ছি. ছি. পা ধরেন কেন? আমিতো ডিভোর্স লেটারে সাইন করে দিয়েছি। আর আমি কোন চরিত্রহীন মেয়েকে ঘরে তুলতে পারবোনা। আর যে বাবা মেয়েকে চরিত্রহীন করতে সাহায্য করে সেই বাবার মেয়েকেতো অবশ্যই না। আর আমি কালকেই ট্রান্সফার হয়ে গ্রামের ছেলে গ্রামেই ফিরে যাচ্ছি। এই ইট পাথরের শহরে থেকে কোন চরিত্রহীনদের সঙ্গী হতে চাইনা। আপনারা এবার আসতে পারেন। নয়তো যতটুকু সম্মান বাকি ছিলো তাও কিন্তু থাকবেনা।
এই বলেই দরজাটা খট করে লাগিয়ে দিলাম। আমি জানি কমিশনার সাহেব খুব আত্মসম্মানবোধ একজন মানুষ তাই তিনি নিজের মেয়েকে নিয়ে অপমানিত হওয়ার পর অন্যের দরজায় দাঁড়িয়ে থাকবেন না। স্বর্ণার জন্য খুব মায়া হচ্ছিল বটে কারণ মেয়েটি আমাকে হাজারো অপমান করার পরেও আমার সাথে এতোদিন ছিল যদিও কখনো কাছে যাওয়ার সুযোগ দেয়নি। কিন্তু আমার হৃদয়ে এখন আর আগের মতো নমনীয়তা নেই, হয়ে গেছে পাথরতুল্য। আর তাছাড়া সাপের উপর মায়া বাড়িয়ে পুষলে একসময় উল্টো ফঁণা তুলে নিজের মালিককেই কামড়ে দিবে। ইহাই হয়তো স্বর্ণারূপী সাপদের বৈশিষ্ট্য।
গল্পের বিষয়:
গল্প
DMCA.com Protection Status
loading...

Share This Post

আরও গল্প

সর্বাধিক পঠিত