‘রুশা, কাল থেকে আমি তোর সঙ্গে এ রুমে ঘুমাবো। আর রাতুল তোর বাবার সঙ্গে ওর রুমে থাকবে।’ খানিকটা অবাক হয়ে প্রশ্ন করলাম, ‘আর তোমাদের রুম?’
মা নরম গলায় বললো, ‘ওই রুমটা সাবলেট হিসেবে ভাড়া দিয়ে দিব। এটাচড বাথরুম আছে, বের হওয়ার জন্য সিঁড়ির দিকে আলাদা দরজাও আছে। শুধু রান্না করার জন্য আমাদের রান্নাঘরটাতে একটু ছাড় দিতে হবে। ওটাতে সমস্যা নেই, ও ঠিক মানিয়ে নিবো।’ মন খারাপ নিয়ে বললাম, ‘মা, আমাদের বাসার ব্যালকনিটাও তো ওই রুমেরই সঙ্গে!’ ‘তাতে কী হয়েছে! রুমের মধ্যে যখন একঘেয়ে লাগবে, তখন ছাদে যাবি।’ ‘বাবা কী এই সিদ্ধান্তে একমত?’ ‘হ্যাঁ, বাড়িওয়ালার সঙ্গে কথা বলে নিয়েছে তোর বাবা। বিকেলেই টু-লেট লাগিয়ে দিবে। রুমটা তো খুবই সুন্দর। দেখবি তাড়াতাড়িই ভাড়া হয়ে গিয়েছে।’ আমি চুপ করে ভাবতে লাগলাম, সময় মানুষকে কীভাবে বদলে দেয়! মা পাশে বসে সান্ত্বনার স্বরে বললো, ‘আমরাও-বা এত বড় বাসা দিয়ে কী করবো বল! তাছাড়া নতুন ভাড়াটিয়া এলে কিছু টাকাও বাঁচলো আর গল্প করার মত মানুষও পাওয়া গেলো।’ আমি মায়ের দিকে তাকিয়ে ঠোঁট দু’টো প্রসারিত করে মাথা ঝুঁকলাম।
আমি জানি, সমস্যাটা আসলে বড় বাসা কিংবা গল্প করার মানুষের অভাবের নয়। সমস্যা হলো, টাকার। এই মুহুর্তে ব্যয়ের তালিকায় টাকার পরিমাণ যত কম রাখা যায় আর আয়ের তালিকায় যত টাকা যোগ করা যায়, ততই মঙ্গল।
রাতের মধ্যে বড় রুমটা খালি করে জিনিসপত্র সব আমার আর রাতুলের রুমে আনা হলো৷ সপ্তাহ খানেক হলো রাতুলের টিউটর বিদায় হয়েছেন৷ ওকে পড়ানোর দায়িত্ব এখন আমার। টিউটরের সঙ্গে কাজের বুয়াকেও বাদ দেওয়া হয়েছে। আমি মাকে কাজে সাহায্য করার যথাসাধ্য চেষ্টা করলেও মায়ের উপর বেশ চাপ পড়ে যায়, বুঝতে পারি।
সংসারে অভাব ঢুকে পড়ার পর থেকে হিসেব জিনিসটার সঙ্গে দিনদিন বেশ পরিচিত হয়ে উঠছি। যখন তখন চা খাওয়ার অভ্যেসটাকে বিদেয় দিয়েছি৷ সকাল আর সন্ধ্যা ছাড়া বাসায় এখন আর চা করা হয় না। খাবারের তালিকায় কম দামের শাক সবজির স্থান বেশি। মাছের ক্ষেত্রে সস্তা দামের মাছটাই স্থান পায়। রাতুল এখন তার প্রিয় মাছ ইলিশের বদলে তেলাপিয়াকেই প্রিয় করে ফেলেছে।
বাবা এখন বয়লার মুরগি খাওয়া শিখলেও গোশতটা খুব কমই খাওয়া হয় বাসায়। রাতে খাওয়া শেষে অবশিষ্ট থাকা ভাতগুলো মা এখন আর ফেলে দেয় না৷ ওগুলো কিছু চালের সঙ্গে দিয়ে রান্না করে সকালে খাওয়া হয়। ‘মা, একটা কথা বলার ছিলো।’ ভাতের হাঁড়িটা উপুড় করে মা বললো, ‘হ্যাঁ। বলে ফেল।’ ‘বলছিলাম, পাশের বাসার রুম্পা আর টুম্পার জন্য আন্টি টিউটর খুঁজছেন। তো ওদেরকে যদি আমি পড়াই তাতে কী অসুবিধা হবে?’ মা চুপ করে খানিকক্ষণ তাকিয়ে থাকার পরে বললো, ‘তোর বাবা কখনো চাইতেন না, তার সন্তানেরা এতটুকু কষ্ট করুক কোথাও। আর এখন!’ দীর্ঘশ্বাস ছাড়লো মা। আমি সরল গলায় বললাম, ‘কাউকে পড়ালে জ্ঞান বাড়ে মা, কমে না। আমি মনে করি, প্রত্যেকের ছাত্রজীবনে শিক্ষক হওয়ার অভিজ্ঞতা থাকা উচিত৷ সে হোক যত ধনবান। এই অভিজ্ঞতা অবশ্যই অনেক আনন্দের।’
মা সায় দিলে আমি রুম্পা আর টুম্পাকে পড়ানো শুরু করি। বাবার চাকুরিটা চলে যাওয়ার পর থেকে সংসারে বিপর্যয় নেমে আসে। আপনজনেরাও আস্তে আস্তে দূরত্ব বজায় রেখে চলতে শুরু করে। আমাদের বাসায় একসময় যাদের খুব বেশি যাতায়াত ছিলো তাদের এখন ডেকেও পাওয়া যায় না। মা বলে, টাকা ফুরালে আত্মীয় স্বজনদের টানও ফুরায়। বাবা বলে, ওরা সব দুধের মাছি ছিলো। বাসায় নতুন ভাড়াটিয়া উঠেছে। রান্নাঘরের অর্ধেকটা মা এখন তাকে ছেড়ে দিয়েছে। অল্প স্থানে মায়ের কাজকর্ম সারতে বেশ কষ্ট হয়ে পড়লেও মা হাসিমুখে সব সামলে নেয়। বিদ্যুৎ খরচের বেলায়ও এখন মা হিসেব করা শুরু করেছে। খুব বেশি দরকার না পড়লে ফ্যান চালায় না, লাইট জ্বালায় না, সিরিয়াল দেখে অবসর যাপন করা মা এখন খুব বেশি একঘেয়ে হয়ে না পড়লে টিভি দেখে না।
রাতুল সেদিন হেসে বলে, ‘আপা, ভাগ্যিস ফ্যানের গতি কম আর বেশি হোক একই বিদ্যুৎ খরচ হয়। না হলে মা ফ্যানের গতি সবসময় কমের দিকেই রাখতো।’ কথার মাঝে মা চলে এলে আমি রাতুলকে ধমকের সুরে বললাম, ‘শুধু ফাজলামি। যা পড়তে বস গিয়ে।’ রাতুল আবার হেসে মায়ের দিকে তাকিয়ে বললো, ‘মা, বিটিভিতে যদি মনোযোগ আকর্ষণের মত অনুষ্ঠান দেখাতো, তবে নিশ্চয়ই তুমি এতদিনে ডিশের লাইনটা কেটে দিতে বলতে। তাই না?’ মা কথার উত্তর না দিয়ে রাগত্ব ভঙ্গিতে চলে গেলো। আমি রাতুলের দিকে তাকিয়ে বললাম, ‘খুব বেশি ইয়ার্কি হয়ে যাচ্ছে রাতুল।’ মায়ের জমানো কিছু টাকা ছিলো। বাবার চাকুরি হারানোর পর থেকে মা’ই সংসারটাকে সামলাচ্ছে। বাবা সারাদিন এখানে ওখানে ছোটাছুটি করলেও একটা চাকুরির দেখা নেই।
চোখের সামনে সব পরিবর্তন যেন স্বপ্নের মত লাগে। বাজার থেকে বেছে বড় মাছটা কেনা, দামী জামা কাপড়টা পরিধানের জন্য পছন্দ করা, উচ্চারণের সঙ্গে সঙ্গে পছন্দের সব খাবার মুখের সামনে হাজির হওয়া, ক’দিন পর পরই পরিবারের সবাই মিলে ঘুরতে বের হওয়া, এ সবকিছু এখন অতীত। আর বর্তামানটা অতীতের ঠিক বিপরীত।
যেসব আত্মীয়-স্বজনেরা আমাকে আর রাতুলকে মাথায় তুলে রাখতো, এখন তাদের সঙ্গে পথের মাঝে ভুল করে দেখা হয়ে গেলে দৃশ্যটা এমন হয়, যেন তারা আমাদের চিনতেই পারেনি। রাতুল সেদিন মুখ কালো করে বললো, ‘আপা। বাবার সম্পদ ছিলো যতদিন, আত্মীয়দের কাছে আমাদের আদরযত্নও ছিলো ততদিন।’
দামী খাবার, দামী পোশাক, নিশ্চিন্তের জীবনযাপন ছেড়ে এখন সস্তা খাবার, কম দামী পরিধানযোগ্য পোশাক, অভাবের জীবনযাপনে অভ্যস্ত হয়ে উঠেছি। যেখানে সেখানে গাড়িতে চলাচল করা আমরা এখন দু’পা হেঁটে দু’পয়সা জমিয়ে রাখতে চেষ্টারত। খুব ভালো প্রস্তাব পাওয়া সত্বেও আমার পড়ার ক্ষতি হবে ভেবে বাবা কখনো ছাত্র-ছাত্রী পড়ানোর অনুমতি দেয়নি৷ অথচ আজ আমার ছাত্রছাত্রীর সংখ্যা অনেক। যে রাতুলটা মাছ গোশত ছাড়া ভাত খেতেই বসতো না, সেই রাতুল আজ দিনের পর দিন শুধু সবজি দিয়ে খেয়ে চলছে তবুও অভিযোগ করছে না। শৌখিন মা এখন দিনরাত খেটে চলছে সংসারে৷ শীততাপ নিয়ন্ত্রিত রুমে অফিস করা বাবা এখন রোদে পুড়ে একটার পর একটা চাকুরির ইন্টারভিউ দিয়ে চলছে।
সবকিছুর বদল ঘটেছে। সংগ্রামের এই জীবনটাই এখন অভ্যাসে পরিণত হয়ে চলছে। মা প্রায়ই সান্ত্বনা দিয়ে বলে, ‘দেখিস একদিন সব ঠিক হয়ে যাবে। শীঘ্রই এই দুর্দিন কেটে যাবে। আবার সুদিন ফিরে আসবে৷ সৃষ্টিকর্তা নিশ্চয়ই ধৈর্যশীল ব্যক্তিদেরকে সুখবর দিয়ে থাকেন।’ আমিও মনেপ্রাণে বিশ্বাস করি এই কথা, নিশ্চয়ই দুঃখের পরে সুখের আগমন ঘটান উপরওয়ালা। সব দিন একরকম যায় না। খারাপ সময় জীবনে আসে, আসবেই। আশেপাশের মানুষদের ভেতর থেকে আপন পরের তফাৎ বুঝিয়ে দেওয়ার জন্য হলেও সবার জীবনে খারাপ সময় আসে। আর খারাপ সময় যতটা বাড়তে থাকে, ভালো সময়ের দূরত্ব ততটাই কমতে থাকে। সুদিনে সুজন চেনা যায় না, দুধের মাছি চিনতে হলে দুঃখের দিন দরকার।
গল্পের বিষয়:
গল্প