আজ আমি আমার প্রথম স্বামীর বাড়ীতে যাচ্ছি। ওনারাই আমাদেরকে দাওয়াত দিয়েছেন। সাথে যাচ্ছে আমার বর্তমান স্বামী আমার ছেলে আর মেয়ে। বাড়ী ভর্তি মেহমান। আমার একমাত্র ননদের বিয়ে আজ। আমরা পৌঁছানোর পরই ঘরের ভেতর ফিসফিস করে নানারকম কানাঘুষা শুরু হয়ে গেছে। সবাই আমার স্বামী আমাকে আর ছেলে মেয়েকে দেখার জন্য অস্থির হয়ে গেছে। সব মানুষের ভিড় ঠেলে আমি আমার সবচেয়ে পছন্দের মানুষটার কাছে গিয়ে পা ছুঁয়ে সালাম করলাম,আর উনি আমাকে দেখে আবেগ আপ্লুত হয়ে আমাকে বুকে জড়িয়ে ধরে রাখলেন অনেকক্ষন। আমার ও মন চাইছিল তার বুকের সাথে মিশে যাই। এত মায়াময় মানুষ আমি কখনো দেখি নাই। এরপর একে একে আমার স্বামী সন্তানদের আদর করে প্রাণভরে দোয়া করলেন। এতক্ষন আমি যেই মায়াময় মানুষটার কথা বলছিলাম তিনি আর কেউ নন আমার প্রাক্তন স্বামীর মা,আমার শাশুড়ী মা।
নিজের মা বাবার বাড়ী ছেড়ে যেদিন আমি তার ছেলের বউ হয়ে এই বাড়ীতে এসেছিলাম, সেদিন তিনি আমাকে এমন করেই বুকে টেনে নিয়েছিলেন। সে মুহূর্তে আমার মনে হয়েছিল আমার ঠিকানা বদল হয়েছে কিন্তু আমার মায়ের আঁচল, মায়ের শরীরের ঘ্রাণ আমার কাছ থেকে হারিয়ে যায় নি। আর আসিফ ছিল খুব সহজ সরল মনের মানুষ। আমাকে সে খুব ভাল ভাবে বুঝতে পারতো, তার সাথে মানিয়ে নিতে আমার কোন সমস্যাই হয়নি। বিয়ে নিয়ে মেয়েদের মনে যেমন নতুন নতুন আনন্দময় মুহূর্তের কল্পনা থাকে তেমনি শশুড়বাড়ীর লোকজন কেমন হবে, কিভাবে সবার সাথে নতুন সম্পর্কগুলো গড়ে উঠবে সেই ভীতিটাও অল্পবিস্তর কাজ করে। আমার নিজেকে ভীষণ সৌভাগ্যবতী মনে হচ্ছিল এমন মানুষদের মাঝে নিজের নতুন জীবন শুরু করতে পারবো ভেবে।
কিন্তু বিধিবাম হাসিখুশি আনন্দে ভরা সুখের উঠোনে কালো ছায়া হয়ে কিছু একটা ঘুরপাক খাচ্ছিল। বিয়ের বেশ কয়েক মাস পরের কথা, অন্য সব দিনের মতোই শশুড় শাশুড়ী,স্বামী ননদ আর আমি একসাথে বসে সকালের নাস্তা সেরেছি। তার জন্য দুপুরের খাওয়া রেডী করে হটপটে দিয়ে দিয়েছি। তাকে বিদায় জানানোর জন্য গেইট পর্যন্ত এসে হাসিমুখে বিদায় দিয়ে এসে ঘরের বাকী কাজে হাত লাগালাম। বাবা বারান্দায় বসে পেপার পড়ছিল, আমার ননদ তার ঘরে গিয়ে পরীক্ষার পড়া নিয়ে ব্যস্ত হয়ে গেল। আমি আর মা টুকটাক হাসিখুশীর ভেতর দিয়ে কাজকর্ম করে যাচ্ছিলাম। কিছু সময়ের ব্যবধানেই সেই ভয়ংকর কালো ছায়াটা আমাদের বাড়ীর উঠোনে বজ্রপাতের মতো করে ক্রিং ক্রিং করে বেজে উঠলো। আমিই দৌড়ে গিয়ে ফোনটা রিসিভ করেছিলাম। অপর প্রান্ত থেকে ভেসে আসা কথাগুলো আমার দাঁড়িয়ে থাকার শক্তিটা একমুহূর্তে কেড়ে নিয়ে আমাকে মাটিতে ফেলে দিল। এরপর অনেকক্ষন আমার আর কোন হুঁশ ছিল না।
যখন হুঁশ ফিরল তখন দেখি আমার প্রানপ্রিয় স্বামী পরপারের যাত্রার জন্য সেজেগুজে তৈরী। আমার মনে হচ্ছিল আমি চিৎকার করার শক্তি ভাষা সব হারিয়ে ফেলেছি। শুধু কানে বাজছে আসিফ সাহেব রাস্তা পার হবার সময় গাড়ী চাপায় মারা গেছেন। আমি আবারও আমার হুশ হারিয়ে ফেললাম। এরপর যতদিন আমি ওখানে ছিলাম আমি আমার শাশুড়ীর সাথে ঘুমাতাম। তিনি আমাকে একা থাকতে দিতেন না। সবসময় আগলে রাখতেন। রাতভর আমার কান্না বুকের হাহাকার আমার শাশুড়ী মাকে হয়তো ভীষণ কষ্ট দিচ্ছিল। তাই উনি আমাকে না জানিয়ে আমার বাবার বাড়ীর লোকদের সাথে যোগাযোগ করে আমার জন্য নতুন করে বিয়ে দেখতে বলেন। আমার বাবার বাড়ীর লোকরাও ভেতরে ভেতরে চারদিকে খোঁজ লাগিয়ে একসময় ভাল একপাত্রের সন্ধান পেয়ে যায়।
এক বিকেলে আমার বাবার বাড়ীর লোক আর পাত্র পক্ষের লোক এসে আমাকে দেখে যায়। আর তারা আমাকে তাদের পছন্দ হয়েছে জানিয়ে যায়। তাদের বাড়িতে আমার আত্মীয়দের যাওয়ার কথা বলে যায়। আমার তীব্র আপত্তির মুখেও উনারা বিয়ের দিন তারিখ ঠিক করে ফেলে। সবাই মিলে এটাই বুঝাতে থাকে জীবনের দীর্ঘ পথ একা পাড়ি দেওয়া সম্ভব না, সুখে দুখে একজন সঙ্গী পাশে থাকা খুব প্রয়োজন। তাই শেষ পর্যন্ত সঙ্গী হয়ে রিয়াদ এলো আমার জীবনে। যে কিনা সত্যিকার ভাবেই আমার জীবনের সুখ দুখের একজন সঙ্গী হয়ে আছে আজও। তার মতো উদার মানসিকতার মানুষ না হলে কেউ কখনো তার স্ত্রীর প্রথম স্বামীর বাড়ী সপরিবারে বেড়াতে আসতে পারে না। আর তাই রিয়াদ এখন এ পরিবারের সবার কাছে অতি প্রিয় মানুষ।
আমার ননদের কাছে তার প্রিয় ভাই আর বাবা মায়ের কাছে তাদের হারিয়ে যাওয়া ছেলে হয়েই আছে। তাই আজ রিয়াদ ভাইয়ের মতো করেই সব দায়িত্ব পালন করে বোনকে বিদায় জানালো। আর আমি যখন একান্তে নিভৃতে জীবনের হিসাব নিকাশের খাতাটা মেলে ধরি,তখন রিয়াদকে পাশে পেয়ে নিজেকে সৌভাগ্যবতী মনে করি আর যখনই মনের গহীন কোনে আসিফের কথা মনে পড়ে তখন সৌভাগ্যের হিসাবটা কেমন যেন ভীষণ রকম এলোমেলো হয়ে যায়…
গল্পের বিষয়:
গল্প