দেনমোহর

দেনমোহর
আজ রেশমির বিয়ে।বিয়ে বাড়িতে আত্মীয় স্বজন লোকজনে পরিপূর্ণ। রেশমির বাবা আফজাল হোসেন গ্রামের মধ্যবিত্ত চাষি, ছয় বিঘা ধানের জমি আছে। রেশমি ছাড়াও আফজাল হোসেনের আরও দুইটা মেয়ে। আফজাল হোসেন এবং রেশমির মা জুলেখা বেগম বড়ো মেয়ের বিয়ে উপলক্ষে খুশি হতে পারছে না ওদের মুখে দুঃশ্চিন্তার ছাপ স্পষ্ট। বিয়ে না হওয়া পর্যন্ত শান্তি পাচ্ছে না। রেশমির বাবা মা’র দুঃশ্চিন্তা করার যথেষ্ট কারণ আছে, এর আগে রেশমির তিন জায়গার থেকে বিয়ের সম্বন্ধ এসেছিল দুই জায়গার থেকে বিয়ের দিন তারিখও ঠিক হয়েছিল শেষ পর্যন্ত বিয়ে হয়নি।
রেশমি দেখতে যথেষ্ট সুন্দরী, অনার্স ফাইনাল ইয়ারে পড়ে, বাবার অবস্থা বিশেষ ভালো না হওয়া সত্বেও প্রথমবার অনেক বড়োলোকের ছেলের সাথে বিয়ের সম্বন্ধ আসে ছেলে ব্যবসা করে। রেশমিকে ওরা খুব পছন্দ করে কিন্তু রেশমি বেঁকে বসে। বড়লোক ঘরে বিয়ে করবে না। রেশমির যুক্তি ছিলো, অতো বড়লোকদের সাথে আমি মানিয়ে চলতে পারবো না তাছাড়া সেখানে আমার বাবা মা উপযুক্ত সম্মান পাবে না, বাবা মা’কে মাথা নিচু করে থাকতে হবে কথায় কথায় আমাকে গরীবের মেয়ে গ্রামের মেয়ে বলে শ্বশুরবাড়ির আত্নীয় স্বজনদের কাছে কথা শুনতে হবে আমি সেটা কোনোদিনও সহ্য করতে পারবো না।
পরে যখন আবার বিয়ের সম্বন্ধ হলো বিয়ের দিন তারিখ এমনকি দেনমোহর পর্যন্ত ঠিক হলো রেশমি তখন কোনো ভণিতা না করে সরাসরি পাত্র পক্ষকে বলল বিয়ের আসরেই আমি দেনমোহরের টাকা হাতে পেতে চাই যদি আমি দেনমোহরের সম্পুর্ণ টাকা হাতে পাই তবেই আমি বিয়েতে রাজি নতুবা না।  রেশমির এরকম কথায় পাত্র এবং পাত্রের বাবা মা হতভম্ব, এ কেমন মেয়ে! বিয়ের আসরেই দেনমোহরের টাকা পেতে চাচ্ছে! এ তো খুব লোভী মেয়ে এ মেয়েকে কিছুতেই ঘরের বউ করা যায় না। পরপর দু’বার এভাবে বিয়ে ভেঙে যাওয়ার রেশমির বাবা মা মেয়েকে অনেক বুঝ দেয় কিন্তু রেশমি কোনো কথা শুনবে না তার একটাই কথা, যে ছেলে বিয়ের আসরে দেনমোহরের টাকা হাতে দেবে তাকেই বিয়ে করবো নাহলে সারাজীবন আইবুড়ো থাকবো।
গত সপ্তাহে মামুন ও মামুনের বাবা মা রেশমিকে দেখতে আসে। মামুন প্রাইমারি স্কুলের শিক্ষক। রেশমির বাবা মা আগেই মেয়েকে বারবার করে নিষেধ করেছে খবরদার যেনো দেনমোহরের বিষয়ে পাত্র পক্ষের সামনে কোনো কথা না বলে। পাত্র পক্ষ রেশমিকে খুব পছন্দ করে, বিয়ের দিন তারিখ দেনমোহর সব ঠিক হওয়ার পর রেশমি গলা খাঁকারি দিয়ে বলল,আমার কিছু কথা আছে। জুলেখা বেগম মেয়ের গলা শুনে চমকে উঠে বারবার ইশারা করে থামানোর চেষ্টা করছে কিন্তু রেশমি মায়ের দিকে না তাকিয়ে তার দাবি জানালো।
মামুনের বাবা মা রেশমির কথায় কিছুই মনে করলো না উল্টে মামুনের মা বলল,দেনমোহরের উপর প্রতেকটা মেয়ের অধিকার আছে এটা ওদের ন্যায্য পাওনা অবশ্যই মামুন দেনমোহরের টাকা বিয়ের আসরে পরিশোধ করবে।
রেশমি হবু শ্বাশুড়ির কথা শুনে মনে মনে খুশি হয়ে আরেকটু সাহস করে বলল, পড়াশোনা শেষে আমি তো চাকরি করবো তখন প্রতি মাসে আমার বেতনের কিছু টাকা আমার বাবার হাতে দেবো আপনাদের কোনো আপত্তি আছে? আর একটা কথা আমার বাবা যথাসাধ্য চেষ্টায় আমাদের তিন বোনকে লেখাপড়া শিখিয়ে মানুষ করার চেষ্টা করছে আমার বাবার পক্ষে কোনরকম যৌতুক উপহার সামগ্রী দেওয়া সম্ভব না। আপনারা শুধুমাত্র আমাকেই বাড়ির বউ করে নিতে পারবেন অন্য কিচ্ছু পাবেন না।
মামুনের মা স্মিত হেসে বলল, মা গো তোমার বাবা মা অনেক কষ্ট করে তোমাকে লেখাপড়া শিখিয়ে মানুষ করেছে তুমি চাকরি করলে সেই টাকার উপর আমাদের যেমন অধিকার আছে তোমার বাবা মায়েরও অধিকার আছে আমাদের দিক থেকে কোনো আপত্তি নেই আর আমাদের কোনো উপহার যৌতুকের প্রয়োজন নেই মা, আমরা শুধু একটা ভালো মনের মেয়েকে বাড়ির বউ করতে চাই যে আমাদের ভালবাসবে। মামুনের মায়ের মুখে এমন কথা শুনে রেশমি এবং রেশমির বাবা মা যারপরনাই খুশি। আজকে মামুনের সাথে রেশমির বিয়ে।বরপক্ষ চলে এসেছে। কাজি সাহেব বিয়ে পড়ানোর আগেই দেনমোহরের একলক্ষ টাকা পাত্র পক্ষ রেশমির হাতে দিলো। বিয়ে শেষে শ্বশুরবাড়ি যাওয়ার আগ মূহুর্তে রেশমি টাকাগুলো আফজাল হোসেনের হাতে দিয়ে বলল,বাবা এই টাকা দিয়ে তুমি দুইটা গরু কিনে পেলেপুষে বড়ো করবে। তোমার বয়স হচ্ছে মাঠে কাজ করতে তোমার খুব কষ্ট হয় গরুগুলো বড়ো হলে গরু বিক্রি করে তুমি মুদিখানার দোকান দেবে।
রেশমির এমন আচরণে আশেপাশের সবাই রেশমিকে বাহবা দিয়ে বলল, সব বাবা মায়ের ঘরে যেনো এমন মেয়ে হয়, আর আমি বাহবা দিলাম মামুনের বাবা মাকে, প্রতিটি বাবা মা যদি যৌতুক উপহার বিরোধী এবং সন্তানকে সুশিক্ষিত করতে পারে তাহলে সমাজ থেকে যৌতুক উপহার দেওয়ার রেওয়াজ বন্ধ হয়ে যাবে। ( রেশমিদের বাড়ি আমাদের গ্রামে) বছরখানেক আগে আমার এক কাজিন মেহনাজ আমাদের বাড়ি বেড়াতে এসেছিলো। অনার্স পড়া শেষ বিয়ের জন্য পাত্র খোঁজা চলছে। গল্পে গল্পে হঠাৎ মেহনাজ আমাকে প্রশ্ন করলো, আপু দুলাভাই তোমার দেনমোহরের টাকা পরিশোধ করেছে? ওর প্রশ্ন শুনে মনে হলো তাইতো আমি তো এখনও দেনমোহরের টাকা হাতে পায়নি! একটু ক্ষোভের সাথে বললাম,না রে এখনও অবধি দেয়নি দেওয়ার কোনো নামও করে না। আজকে বাড়ি আসলে দেনমোহরের টাকা আদায় করে ছাড়বো।
মেহনাজ হেসে বলল,আপু তোমার বিয়ে হয়েছে তিরিশ বছর আগে সেই সময়কার টাকার মান আর এখনকার টাকার মানের আকাশ পাতাল তফাৎ এখন আর ঐ টাকা আদায় করার কি দরকার ? মেহেনাজের কথা শুনে আমার বোধদয় হলো সত্যিই তো তিরিশ বছর আগে ঐ টাকায় আট ভরি সোনার গহনা হতো না হয় দেড় বিঘে ধানের জমি হতো আর এখন ঐ টাকায় আট আনা সোনাও হবে না আর জমি একশতক হবে কিনা সন্দেহ শুধু শুধু ঐ টাকা আদায় করে লাভ কি? মেহেনাজ বলল,আপু আমি ঠিক করেছি আগে দেনমোহরের টাকা হাতে পাবো তারপর কবুল বলবো। ওর কথা শুনে আমি হেসে বললাম দূর পাগলী তাই আবার হয় নাকি?
কিছুদিন পর হঠাৎ পাত্র সহ পাঁচজন এসেছে মেহেনাজকে দেখতে। পাত্রী দেখে তাদের খুব পছন্দ ঐদিনই আকদ্ করে রাখবে একমাস পর অনুষ্ঠান করে বউ উঠিয়ে নেবে। পাত্রের নাম জাহিদ ব্যাবসা করে শহরে নিজস্ব বাড়ি আছে এক বাবার এক ছেলে। সব ঠিকঠাক দেনমোহর ধার্য হলো তিন লাখ টাকা। মেহেনাজ স্পষ্ট ভাবে জানালো আগে টাকা আমার হাতে দেবেন তারপর কবুল পড়বো। পাত্র পক্ষ অবাক হয়ে বলল,একমাস পর বউ উঠিয়ে নেওয়ার সময় টাকা দেবো। মেহেনাজ তাতে রাজি না তার স্পষ্ট কথা তাহলে বিয়ে একমাস পরে হবে, বিয়ে হয়ে গেলে দেনমোহরের টাকা যদি না দেন তাহলে তো আমি ঝগড়াঝাটি অশান্তি করতে পারবো না আবার বিয়ে ভেঙেও দিতে পারবো না তাই আগে দেনমোহরের টাকা পরিশোধ করবেন তারপর আমি কবুল পড়বো।
জাহিদ আস্তে করে মেহেনাজকে বলল এতো টাকা তো আমি সাথে করে নিয়ে আসেনি। বেশ তো বাড়ি যান টাকা সাথে করে নিয়ে আসুন আজ না হলে কাল বিয়ে হবে। আমরা মেহনাজকে অনেক বুঝালাম কিন্তু ও কিছুতেই রাজি হলো না। পরেরদিন পাত্র পক্ষ তিনলক্ষ টাকা এনে মেহনাজের হাতে দিলো তারপর মেহনাজ কবুল পড়লো। মেহেনাজ টাকাগুলো ব্যাংকে রেখে দিয়েছে। ওর যুক্তি কখন কোন বিপদ আপদ আসবে তার ঠিক নেই, কার কাছে হাত পাতবো? টাকাগুলো ব্যাংকে থাক দুঃসময়ে কাজে লাগবে।
আপাতদৃষ্টিতে রেশমি, মেহনাজকে দেখে মনে হচ্ছে খুব জেদি একরোখা মেয়ে। অনেকেই ওদের এরকম ভাবে বিয়ের আসরে দেনমোহরের টাকা উসুল করাকে খারাপ চোখে দেখছে কিন্তু আমি বলবো ওর একদম ঠিক কাজ করেছে মেয়েদের অধিকার ন্যায্য পাওনা কেন স্বেচ্ছায় ছেড়ে দেবে? আমি অবাক হয়েছি মামুন এবং জাহিদকে দেখে সত্যিই এরা সুশিক্ষায় শিক্ষিত এদের বাবা মা’কে অন্তর থেকে স্যালুট জানাই। সব পিতামাতা যদি এদের মতো করে সন্তান মানুষ করে তাহলে মেয়েদের সুদিন আসতে বেশি দেরি নেই।
গল্পের বিষয়:
গল্প
DMCA.com Protection Status
loading...

Share This Post

আরও গল্প

সর্বাধিক পঠিত